চারদিক-ঘোড়দৌড় হারিয়ে যায়নি

না, ঘোড়দৌড় হারিয়ে যায়নি। এখনো তা টিকে আছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গায় যদি ১৮ ডিসেম্বর আপনি আসতেন, তাহলে দেখতে পেতেন ঘোড়াদের তেলেসমাতি কারবার। এদিন বিকেলে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরের উপস্থিতিতে এই প্রতিযোগিতা হয়েছিল। শালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ধুলাঝাড়ি এলাকায় বিশাল খেতের মধ্যে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতার আয়োজক ‘হঠাৎ কমিটি’ নামের একটি সংগঠন।


প্রতিযোগিতার দিন সকাল থেকেই ছিল সাজ সাজ রব। আশপাশের বাড়িগুলো দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনে ছিল ভরপুর। এ ছাড়া জেলার বাইরে থেকেও অসংখ্য দর্শক খেলা দেখতে এসেছে। কারা আসেনি? পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এদিন আসতে থাকে। একপর্যায়ে এলাকাটি বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। উদ্যোক্তারা আগেই বাঁশ দিয়ে মাঠ ঘিরে দিয়েছিলেন। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা জায়গা করা হয়। অনেক নারী কোলের শিশুকে নিয়ে এসেছিলেন ঘোড়দৌড় দেখতে। লাল, নীল ও সবুজ পতাকা দিয়ে সাজানো হয় মাঠ। বাইরে নানা রকমের দোকান বসে। সাইকেলের গ্যারেজ করা হয় কয়েকটি। বিপুলসংখ্যক মানুষের নিরাপত্তা দিতে দেবীগঞ্জ থানার পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবীদের হিমশিম খেতে হয়।
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি থেকে গৃহবধূ মর্জিনা খাতুন এসেছিলেন ধুলাঝাড়ির এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে। প্রতিবছরের মতো এবারও তিনি ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। বোদা উপজেলার সাকোয়া থেকে দুই নাতিকে নিয়ে বৃদ্ধা সোরোবালা (৭০) এসেছেন খেলা দেখতে। এবারই প্রথম তিনি নাতিদের অনুরোধে রিকশাভ্যানে খেলা দেখতে আসেন। শালডাঙ্গার শিকারপুর গ্রামের রুবেল জানান, বিজয় দিবস উপলক্ষে ধুলাঝাড়ি মাঠে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেন ঈদের উৎসব পালন করে এলাকার মানুষ। শালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের মাঠের পাশে চা-বিস্কুটের দোকানমালিক রফিকুল ইসলাম জানালেন, প্রতিবছর ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার দিন বেচাবিক্রি বেশি হয়। এই এক দিনে ১০ হাজার টাকার চা-বিস্কুট বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিকেল সাড়ে তিনটায় খেলা শুরু হয়। এর আগে ব্যান্ড পার্টির তালে তালে মাঠের চারদিকে পুরস্কারগুলো দর্শকদের দেখানো হয়। অংশগ্রহণকারীদের লটারির মাধ্যমে তিন গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রথমে ৭ রাউন্ড দৌড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের নিয়ে ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনাল রাউন্ডে ১০ রাউন্ড দৌড় অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় দর্শকেরা করতালি দিয়ে প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেয়।
মাঠে নাতি-নাতনি নিয়ে প্রতিযোগিতা দেখতে নীলফামারীর ডোমার থেকে এসেছেন আরজিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘অনেক আগে আমরা এমন প্রতিযোগিতা দেখেছি। এখন এসব প্রতিযোগিতা আর হয় না। আত্মীয়দের কাছে শুনে নাতি-নাতনিদের নিয়ে এসেছি। খুব ভালো লেগেছে।’
মধ্য শিকারপুর গ্রামের আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘ঘোড়দৌড় খেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিসহ অনেক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে খেলা দেখে খুব আনন্দ পেয়েছি।’
সাইকেলে করে ২০ কিলোমিটার দূর বাগদহ থেকে প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছিলেন বৃদ্ধ আবদুল জব্বার। তিনি বললেন, ঘোড়দৌড় ভালোই লাগল।
একটু দূরেই দেখি, কোলে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাড়েয়া কাঁঠালতলী থেকে আসা আমেনা বেগম। তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার কথা শুনে আর বাড়িতে থাকতে পারলাম না।’
‘হঠাৎ কমিটি’র উপদেষ্টা লুলু চৌধুরী জানান, ‘২০০৫ সালে তাঁর বড় ভাই মনিরুজ্জামান চৌধুরীর উদ্যোগে এলাকার যুবকদের নিয়ে ‘হঠাৎ কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির উপদেষ্টা করা হয় রোকনুজ্জামান চৌধুরী এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয় শালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাসানাত জামান চৌধুরীকে। প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি জানান, পুরোনো দিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। পুরস্কার স্থানীয় বিত্তবান মানুষের অনুদানে প্রদান করা হয়।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। দিন দিন অংশগ্রহণকারী ও দর্শকের সংখ্যাও বাড়ছে।
পঞ্চগড়-২ আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘোড়দৌড় বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতীক। বাঙালিদের ঐতিহ্যের প্রতি কতটুকু অনুরাগ, আজ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি তা-ই প্রমাণ করে। আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চাই। সত্যিই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার এই বিরল প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। এ প্রতিযোগিতা আমাদের ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং সবার সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে এ উদ্যোগ ধরে রাখতে হবে।’
প্রতিযোগিতায় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী জেলার মোট ১৭টি ঘোড়া অংশ নেয়। বোদা উপজেলার আয়নাল হক প্রথম পুরস্কার হিসেবে একটি ২১ ইঞ্চি টেলিভিশন, ডোমার উপজেলার আবদুল্লাহেল কাফি দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশন এবং দুজনকে যৌথভাবে তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে একটি করে ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন দেওয়া হয়।
পুরস্কার প্রদান করেন পঞ্চগড়-২ আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম। হঠাৎ কমিটির সভাপতি কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল হক, দেবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল সরকার প্রমুখ।
শহীদুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.