বাহাদুর শাহ জাফরের করুণ পরিণতি by কাজী জহিরুল ইসলাম
কিত না হ্যায় বদ-নসিব, 'জাফর' দাফন কি লিয়ে দো গাজ জামিন ভি না মিলি কু-এ-ইয়ার মেঁয়। দিল্লির সর্বশেষ সম্রাট আবু জাফর সিরাজুদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর এভাবেই নিজের জীবনের করুণ পরিণতির কথা লিখে যান। ছেলেবেলায় মুঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি মধ্য এশিয়ার তুর্ক-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত সম্রাট বাবর এবং তার উত্তরসূরিদের নাম মনে রাখতে একটি বাক্য মুখস্থ করতাম, 'বাবার হইল একবার জ্বর, সারিল, ঔষধে।'
এই বাক্যের ৬টি শব্ধের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের ৬ জন ধারাবাহিক সম্রাটের নাম আছে। তারা হলেন-বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়নি। ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত এবং হত্যা করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার শুরু করলেও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদীপ তখনও জ্বলছিল। আওরঙ্গজেবের ষষ্ঠ উত্তরসূরি ভারতবর্ষের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তার পূর্বসূরিরা হলেন-বাহাদুর শাহ'র পিতা আকবর শাহ যিনি মির্জা আকবর নামে পরিচিত ছিলেন, শাহ আলম-২ যিনি আলী গওহর নামে পরিচিত, আলমগীর-২ যিনি আজিজ উদ্দীন আলমগীর নামে পরিচিত, জাহান্দর শাহ, মুয়াজ্জেম বাহাদুর শাহ যিনি শাহ আলম নামে পরিচিত এবং সম্রাট আওরঙ্গজেব। ২৪ অক্টোবর ১৭৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাহাদুর শাহ জাফর। সম্রাট আকবর শাহ'র হিন্দু সত্রী লাল বাইয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতার মৃত্যুর পর ১৮৩৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৬৩ বছর বয়সে তিনি দিল্লির মসনদে বসেন। বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন এক ধরনের কারাবন্দি রাজা। দিল্লির লাল কেল্লার বাইরে তাকে কখনোই যেতে দেয়া হতো না। তার রাজদরবার ছিল মূলত কাব্যচর্চা কেন্দ্র, ওখান থেকেই তৈরি হয় মির্জা গালিব, ইব্রাহিম জাউক, মমিন খান মমিন এবং দাঘের মতো বিখ্যাত উর্দু কবিরা। ইব্রাহিম জাউক ছিলেন বাহাদুর শাহ'র গুরু, তার কাছেই তিনি কাব্যচর্চার তালিম নিতেন। বাহাদুর শাহ জাফর তার সারা জীবন কাব্যচর্চায়ই ব্যয় করেন। যতটা সম্রাট, তার চেয়ে মোটেও কম খ্যাত নন তিনি উর্দু কবি হিসেবে। ভারতবর্ষের অনেক বিজ্ঞজনই মনে করেন, বাহাদুর শাহ জাফর দিল্লির মসনদ হারিয়েছেন বলেই আমরা কবি বাহাদুর শাহ জাফরকে পেয়েছি। এই প্রাপ্তি হারানোর গ্লানিকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তার রচিত গজলগুলো উপমহাদেশে খুবই সমাদৃত এবং জনপ্রিয়। আবিদা পারভিন, ভুপেন্দর সিং, আহমেদ হুসাইন, মুহাম্মদ হুসাইনের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা তার রচিত গজলগুলো গেয়েছেন। বাহাদুর শাহ'র পিতামহ আলী গওহর ওরফে সম্রাট শাহ আলাম-২ এবং তার পিতা মির্জা আকবর ওরফে সম্রাট আকবর শাহও কবি ছিলেন। প্রেম এবং রহস্যময়তা বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তার রচিত কবিতা, গান, গজলে আধ্যাত্মিক রহস্যের ঘোর দেখতে পাই। ইংরেজ বেনিয়াদের অত্যাচারে ভারতবর্ষ তথা মুঘল সাম্রাজ্য জর্জরিত ছিল। অত্যাচার আর অপমানের গ্লানি তার শৈশব-কৈশোরকে বিষাদময় করে তোলে। তারই ছায়া পড়ে তার সাহিত্যকর্মে। সাহিত্যের প্রতি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সশ্রদ্ধ পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ওই সময়ে মির্জা গালিবের মতো বিশ্বনন্দিত উর্দু কবি তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের পেনশনভোগী ক্ষমতাহীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কবিমন এ পরাধীনতা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি; কিন্তু দোর্দন্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাজের দাপটের সামনে কখনোই মুঘল সম্রাটের আপন মহিমায় সদর্পে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশবিরোধী সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয় যুদ্ধ। ১৮৫৭ সালের ইংরেজবিরোধী যুদ্ধে বিপ্লবী সৈনিকরা বাহাদুর শাহ জাফরকেই অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে তাদের সেনাধ্যক্ষের আসনে বসান। বিপ্লবীরা ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাহাদুর শাহকে অখন্ড স্বাধীন ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেন; কিন্তু অল্প ক'দিনের মাথায়ই সুসংগঠিত ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের দুর্গ গুঁড়িয়ে দিয়ে চিরতরে মুঘল সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বাহাদুর শাহ জাফর তার তিন পুত্র এবং নাতিসহ কারাবন্দি হন। ব্রিটিশ রাজ তার বিচারের আয়োজন করে। হায়রে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ভারতবর্ষের সম্রাটের বিচার করছে ভিনদেশি বেনিয়া, ভারতেরই মাটিতে। ক্যাপ্টেন হডসন তার তিন পুত্র ও নাতিকে হত্যা করে তাদের খন্ডিত মস্তক ক্ষমতাচ্যুত সম্রাটকে উপহার দেয়। এমনি নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের পর বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি তার তৃতীয়া সত্রী বেগম জিনাত মহল এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বার্মায় নির্বাসনে যান। এরই মধ্য দিয়ে মধ্য-এশিয়া থেকে আগত তিমুরিয়ান পিতৃকুল এবং চেঙ্গিস খান তথা মঙ্গোলিয়ান মাতৃকুলে জন্মগ্রহণকারী মুসলিম বীর জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বিন উমর শেখ বাবর যে সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৩০ এপ্রিল ১৫২৬ সালে, ৩৩১ বছর পর ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সালে তার পতন হয়। কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষের আন্দোলন থেমে থাকেনি। পরবর্তী দশ বছরে ব্রিটিশ বেনিয়া প্রায় এক কোটি ভারতবাসীকে হত্যা করে। এত অধিক মানুষ হত্যা এর আগে আর পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেনি। মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পরবর্তী ৫ বছর বার্মার রেঙ্গুনে নির্বাসিত জীবনযাপন করে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আমার বার্মিজ সহকর্মী এ্যা মিন্ত-এর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মার মানুষ ধর্মীয় নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করে এবং তার সমাধিতে নিয়মিত শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। তার উত্তরসূরিরা বার্মার সাধারণ নাগরিকের মতোই জীবনযাপন করছেন। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরসূরিদের আরেক অংশ বর্তমানে কলকাতায় বসবাস করেন। লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments