তেল-গ্যাস ইজারা ও দেশের স্বার্থ by প্রকৌশলী এস এম ফজলে আলী
দেড় যুগ আগেও বলা হতো, বাংলাদেশ তেল-গ্যাসের ওপর ভাসছে। এত গ্যাস ব্যবহারের তেমন সুযোগ নেই। তাই তা রফতানি না করলে উৎপাদনকারীদের মারাত্মক ক্ষতি হবে। বিদেশি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহী হবে না। এ ওকালতি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি করেছে বিগত এক যুগ যাবত। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। আর তাদের সবার পরামর্শ ছিল ভারতে গ্যাস রফতানির জন্য।
কিন্তু প্রস্তাবে সায় দেয়নি আগের কোনো সরকার। ঘটনাচক্রে যদি বাংলাদেশ তাতে রাজি হতো, তা হলে আজকে দেশের কী অবস্থা হতো কল্পনা করা যায় না। গ্যাসের অভাবে সার উৎপাদন সীমিত হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শতকরা ৪০ ভাগ কমে গেছে। শিল্প কলকারখানা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। লোডশেডিংয়ে জনগণ অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় তেল-গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি ভেবেচিন্তে করতে হবে। শোনা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে শতকরা ৮০ ভাগ গ্যাস রফতানির সুযোগ রেখে চুক্তি হতে যাচ্ছে। যা হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সমুদ্র এলাকায় কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাবে, তা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আগে দেশের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করে এবং অন্তত ৫০ বছরের মজুত হাতে রেখে তারপর অন্য কথা। এ কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই। তাই মধ্যপথে কোনো অতিউৎসাহী আমলা এ নিয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করলে ধরেই নিতে হবে তিনি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহীর গ্যাস সংক্রান্ত বিষয়ে কার্যক্রম জাতি সন্দেহের চোখে দেখছে। তার এ সন্দেহজনক কাজের জন্য তাকে উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া উচিত। সাধারণত উপদেষ্টা হন তারা, যারা ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। জনাব তৌহিদ একজন বিতর্কিত আমলা। তার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য চুক্তিতে বিদেশে গ্যাস রফতানির কোনো সুযোগ রাখা যাবে না। তাদের সব গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করতে হবে। পেট্রোবাংলা যদি মনে করে গ্যাস উদ্বৃত্ত হচ্ছে, তখন তারাই তা বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করবে। পত্রিকায় প্রকাশ, ৮০ শতাংশ গ্যাস রফতানির সুযোগ রেখে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার। আর পেট্রোবাংলাকে শর্তসাপেক্ষে মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস দেয়া হবে। সমুদ্রবক্ষে পাইপলাইন না করতে পারলে পেট্রোবাংলা সে ২০ শতাংশও পাবে না। বিদেশি কোম্পানি তাও রফতানি করতে পারবে। কী বিচিত্র যুক্তির মহড়া! পেট্রোবাংলা নিজ দেশে পরবাসী! এসব চিন্তা-চেতনা যাদের মাথা থেকে আসে দেশের প্রতি তাদের আনুগত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন জাগে। আরো মজার ব্যাপার, সরকারকে এড়িয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুযোগও রাখা হয়েছে মডেল পিএসসিতে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চুক্তি করতে হলে আমাদের সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনটা কী? আহরিত তেল-গ্যাস তো দেশের কোনো কাজেই আসবে না! চুক্তিতে যে সব ক্লজ রাখা হয়েছে, তা দেশের চরম স্বার্থবিরোধী। দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা এর কড়া সমালোচনা করেছেন। আশা করি, শেষ মুহূর্তে হলেও সরকারের সঠিক বিবেকের উদয় হবে। তারা দেশের স্বার্থ রক্ষা করুক-এটাই জনগণের দাবি। এ সম্পদের মালিক জনগণ। তাই তাদের লাভক্ষতি ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। তৃতীয় বিডিং রাউন্ডের জন্য যে মডেল প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) প্রণয়ন করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ দেশের স্বার্থের পরিপন্হী। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়া গেলে তার শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত এলএনজি আকারে রফতানির সুযোগ রাখা হয়েছে। মডেল পিএসসির ১৫.৫.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গ্যাস পরিবহন ও ব্যবহারের অবকাঠামো নির্মাণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে পেট্রোবাংলা। তাই যে কোনো উৎপাদিত গ্যাসের লভাংশের ওপর তার অধিকার বলবৎ থাকবে। তবে তা মোট বাজারজাতযোগ্য গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি নয়। কোনো এলএনজি রফতানি চুক্তি সম্পাদনের আগে পেট্রোবাংলার অধিকারে মাসে কী পরিমাণ গ্যাস সংরক্ষিত থাকবে, তা পেট্রোবাংলাকে জানাতে হবে। এই মাসিক গ্যাসের পরিমাপটি চুক্তি কার্যকর সময়কালীন ফিক্সড বা নির্ধারিত থাকবে। এসএনজি রফতানির উদ্দেশ্যে গ্যাস ডেলিভারি দেয়া শুরু হওয়ার এগারো বছরের মাথায় পেট্রোবাংলা অনুরোধ করলে ২০ শতাংশের স্থলে ৩০ শতাংশ গ্যাস তার অধিকারে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।' তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুযোগ রেখে মডেল পিএসসির ১৫.৬(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কন্ট্রাক্টর ইচ্ছা করলে তার শেয়ারের গ্যাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রোবাংলা ছাড়া তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে। তবে প্রথম একবার এই বিষয়ে অস্বীকৃতির অধিকার থাকবে পেট্রোবাংলার।' উল্লিখিত ধারা দুটি পুরোপুরি দেশের স্বার্থবিরোধী। এ ধরনের ধারা জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলা কিভাবে সংযুক্ত করল, তা অবাক কান্ড। যাদের মধ্যে ন্যূনতম জাতীয়তাবোধ আছে তারা কিছুতেই এ ধারা চুক্তিতে যুক্ত করতে পারে না। দেশে বর্তমানেই গ্যাস সংকট প্রকট। ভবিষ্যতে এ সমস্যা মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্যাস সংকট নিরসনে প্রতিবেশি মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছিল। সেই দেশ এই মুহূর্তে কিভাবে গ্যাস রফতানির চিন্তা করতে পারে? ধারা দুটির প্রতিটি বাক্যে কন্ট্রাক্টরদের হুকুমে বাংলাদেশ সরকারকে চলতে হবে। আমার দেশের সম্পদে আমাদের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয়, জ্বালানি সম্পর্কে যার ক-খ জ্ঞান নেই, সেই উপদেষ্টার নির্দেশ মতো এ ধরনের দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করতে যাচ্ছে। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয় তা হলে বাংলাদেশকে আফ্রিকার নাইজিরিয়ার মতো বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে। সে দেশ থেকে আমেরিকান কোম্পানিগুলো তেল-গ্যাস এমনভাবে লুট করেছে, আজ তাদের দেশ তেল-গ্যাস শূন্য। বিদেশি কোম্পানিগুলো স্থানীয় তৃতীয় পক্ষের কাছে যে এলএনজি গ্যাস বিক্রি করবে, তারা তা অভ্যন্তরীণ বাজারে নাও বিক্রি করতে পারে। বিদেশি কোম্পানির যোগসাজশে তারা তা বিদেশি তৃতীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। ফলে পোয়াবারো হবে ভারতের। তারাই এ সুযোগটি গ্রহণ করবে সবার আগে। ভারত সরাসরি গ্যাস পাবে না, তা তারা জানে। এই তৃতীয় পার্টির মাধ্যমে তা পেতে পারে। তাই চুক্তির শর্তগুলো দেশের স্বার্থে নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত। সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাসের ৮০ শতাংশ রফতানির কথা তৃতীয় বিডিংয়ে উল্লেখ থাকার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সে প্রস্তাব অনুমোদন না করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাসের ৮০ শতাংশ যদি রফতানি করার সুযোগ দেয়া হয় তা হলে সমুদ্রের গ্যাস দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না। এ কারণে তৃতীয় বিডিং রাউন্ডে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো বাতিল করে নতুনভাবে চুক্তির শর্তগুলো দেশের স্বার্থে ঢেলে সাজাতে হবে; যাতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং সে মোতাবেক নতুন বিডিং রাউন্ড করা দরকার। তাতে আপাতত গ্যাস রফতানির কোনো সুযোগই রাখা যাবে না। ভবিষ্যতে যদি প্রচুর গ্যাস পাওয়া যায় এবং তা দেশের ৫০ বছরের চাহিদা পূরণের পরও উদ্বৃত্ত থাকে তখন রফতানির কথা চিন্তা করা যাবে। এর আগে মূল ভূখন্ডে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যে সব চুক্তি করা হয়েছিল, তা ছিল দেশের স্বার্থবিরোধী। তাতে বিদেশি কোম্পানি অক্সিডেন্টাল ও নাইকোকে বলতে গেলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে দেয়া হয়েছে। তাতে দেশের স্বার্থরক্ষা করা হয়নি। তারা মাগুরছড়া-টেংরাটিলায় গ্যাসফিল্ডে আগুন লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ গ্যাস নষ্ট করলেও তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো ক্লজ চুক্তিতে না থাকায় তাদেরকে এক টাকাও জরিমানা দিতে হয়নি। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে তেমন কোনো দায়িত্বই দেয়া হয়নি। অথচ তুলনামূলক বাপেক্সের সফলতা ছিল অনেক বেশি। ওই দুই কোম্পানির সঙ্গে বাপেক্সকে নামকা ওয়াস্তে রাখা হয়েছিল। তখনকার জ্বালানি মন্ত্রণালয় দেশের স্বার্থ দেখলে বাপেক্সকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে ৫০ : ৫০ অনুপাতে শেয়ারে কাজ করতে দিত। এতে করে দেশের স্বার্থ রক্ষা হতো। আর ওই ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা গ্যাসফিল্ডে হতো না। সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তা উত্তোলনে বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানিকেই নিয়োগ দিতে হবে। কারণ আমাদের বাপেক্সকে এখনো সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের মতো কর্মক্ষম করা হয়নি। তবে তাদের অভিজ্ঞতার জন্য তাদেরকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। চুক্তিতে সে রকম ক্লজ থাকতে হবে। সার্বিকভাবে দেশের গ্যাস দেশের কাজেই লাগাতে হবে। সব ব্লকের গ্যাস উত্তোলন এক সময়ে করা যাবে না। দেশের চাহিদা মোতাবেক তা করতে হবে। অন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো একসঙ্গে অধিক গ্যাস উত্তোলন করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে তা রফতানির জন্য। এ সুযোগ বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া যাবে না। আর একান্তই যদি রফতানি করতে হয় তা করবে বাংলাদেশ সরকার। আমাদের গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে শিল্পের প্রসার দ্রুত হতে পারে যদি গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দেয়া যায়। দেশি-বিদেশি বহু কোম্পানি আমাদের দেশে শিল্প-কারখানা গড়তে আগ্রহী। তবে তারা অবকাঠমো ও গ্যাস-বিদ্যুতের ধারাবাহিক সরবরাহের নিশ্চয়তা চায়। বিশ্বের বহু দেশের চেয়ে আমাদের শ্রমবাজার খুবই সস্তা। তাই বিদেশিদের আগ্রহ বেশি এখানে শিল্প গড়ার। সরকার যদি দ্রুত গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারে তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই সরকারকে পরামর্শ দেবেন। গ্যাস ক্ষেত্রেও আমাদের বহু অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ বিদেশি নামিদামি কোম্পানিতে কাজ করেন। তাদের নিয়ে এ ধরনের প্যানেল করা যায়। কোনো আমলার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে কোনো আমলা উপদেষ্টার প্রয়োজন নেই। আমাদের গ্যাস উত্তোলন অতীব জরুরি। তবে তা হতে হবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই।
No comments