নাফিস, আকায়েদের পর আশিক: নানা প্রশ্ন প্রবাসী জনমনে by ইব্রাহীম চৌধুরী ও সোহেল মাহমুদ
নিউইয়র্ক
সিটির জনবহুল ও বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট টাইমস স্কয়ারে সন্ত্রাসী হামলা
চালানোর পরিকল্পনা করার অভিযোগে গত ৭ জুন বৃহস্পতিবার বিকেলে কুইন্সের অধিবাসী
এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর নাম আশিকুল আলম (২২)। তিনি কুইন্সের
বাসিন্দা এবং গ্রিনকার্ড আছে তাঁর।
আশিকুল আলম ওরফে আশিককে গত ৮ জুন শুক্রবার ব্রুকলিনের ফেডারেল আদালতে হাজির করা হয়। ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত আশিকের গতিবিধির ওপর প্রায় বছর খানেক ধরেই নজরদারি চলছিল। একজন আন্ডারকভার এজেন্ট তাঁর সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে।
প্রবাসী বহুল জ্যাকসন হাইটস এলাকায় আশিকুলের বসবাস ছিল। কর্মজীবী বাবা–মা বলছেন, ‘আমার ছেলে যদি অন্যায় করে তাঁর বিচার হোক। যদি তাঁকে বিভ্রান্ত করার জন্য, ফাঁদে ফেলা হয়, তারও তদন্ত হোক।’
আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছে। দুষ্কর্মের সঙ্গে স্বদেশের নাম উচ্চারণে বিব্রত প্রবাসীরা। সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাংলাদেশি ইমাম কাজী কায়্যূম বলেছেন, নাফিস-আকায়েদের মতো এবারে আশিকুলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মান পদদলিত হলো। এদিকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ড্রামের নেত্রী কাজী ফৌজিয়া বলেছেন, ‘কয়েক শ মানুষ আমেরিকার জেলে আছে এমন সাজানো কেসে, তারা সবাই বাংলাদেশি নয়। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি যুবকদের কেন টার্গেট করছে সেটা চিন্তার বিষয়।’
ঘটনা এক
২০০৪ সালে আগস্টে নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনিতে সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনার অভিযোগে আটক করা হয় সেখানকার সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত মসজিদে আস-সালামের ইমাম ইয়াসিন আরেফ (৩৪) ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেনকে (৪৬)। কাঁধে রেখে ছোড়া যায় এমন মিসাইল কিনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন তারা। দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইর। সেই অভিযোগে ২০০৬ সালে ১৫ বছর করে সাজা হয় দুজনের। মোহাম্মদ হোসেন কিছুদিন জামিনে থাকলেও আরেফ আটক হওয়ার পর থেকে কারাগারে থেকেছেন। গত ৯ জুন রোববার রাতে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তার জন্মস্থান ইরাকে।
ইয়াসিন আরেফ কুর্দি শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। মার্কিন নাগরিক নন। মোহাম্মদ হোসেন বাংলাদেশি। আলবেনিতে পিজার দোকান ছিল তাঁর। অভিবাসন সূত্রে মার্কিন নাগরিক। এ দুজনের আটকের ঘটনা সেসময় বেশ আলোচিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এফবিআই দাবি করে, ইরাকে একটি বোমা হামলার ঘটনায় আটক এক ব্যক্তির কাছে পাওয়া একটি নোট বইয়ে ইয়াসিন আরেফের নাম লেখা ছিল। সেটির সূত্র ধরে দীর্ঘদিন তথ্যদাতা (ইনফরম্যান্ট) লাগিয়ে আটক করা হয়েছে দুজনকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি ছিল, এটি একটি সাজানো ঘটনা, যাতে এ দুজনকে শিকার বানানো হয়েছে।
ঘটনা দুই
২৮ বছরের ম্যাথিউ সানিৎসা যোগ দিতে চায় তালিবানে-তথ্যদাতার এমন তথ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এফবিআইর এজেন্টরা। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে এলাকা থেকে আটক করা হয় তাকে। সানিৎসার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ওকল্যান্ডে একটি ব্যাংক ভবন গাড়িবোমায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
সানিৎসার পেছনে দীর্ঘদিন লেগে ছিলেন একজন তথ্যদাতা। এফবিআইর নিয়োগ করা। একই সময়ে, সানিৎসার পরিবার তার মানসিক চিকিৎসার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ খুঁজছিলেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে, হাঁপানিসহ নানা রোগে ভুগতে থাকা সানিৎসার মানসিক সমস্যাও বেড়ে চলেছিল। এর মধ্যে, তার সঙ্গে তথ্যদাতা পরিচয় করিয়ে দেয় একজন এফবিআই এজেন্টকে, যিনি তাকে নকল বোমাসহ একটি গাড়ি সরবরাহ করেন।
২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের সাজা হয় সানিৎসার। আদালতে তার আইনজীবীরা এ ঘটনাকে ‘পাতানো খেলা’ বলে মন্তব্য করে তার মানসিক সমস্যার কথা তুলে ধরলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
একই ঘটনা এখানেও
তথ্যদাতাকে ব্যবহার করে, ফাঁদ পেতে আটকের ঘটনা সবশেষটি ঘটেছে বাংলাদেশের তরুণ আশিকুল আলমকে ঘিরে। নিউইয়র্কের পর্যটকবহুল টাইম স্কয়ারে পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মারার, রকেট ছুড়ে নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা অভিযোগে গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার এফবিআই আর নিউইয়র্ক পুলিশের বিশেষ দল ‘জয়েন্ট টেররিজম টাস্ক ফোর্স’ আটক করে তাঁকে।
দীর্ঘ প্রায় এক বছর একজন তথ্যদাতা লেগে ছিল আশিকুলে পেছনে। নানা পরিকল্পনা করে দুজনে বৃহস্পতিবার ব্রুকলিনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে যায়। আটক আশিকুলের বিরুদ্ধে আদালতে সন্ত্রাসবাদের নয়, আনা হয়েছে হামলা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অস্ত্র কেনা এবং সেগুলোর সিরিয়াল নম্বর মুছে ফেলার অভিযোগ। আদালত তাঁকে স্থায়ীভাবে আটক রাখার আদেশ দেয়।
বাংলাদেশি যুবক কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের কথা মনে আছে? ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর, ১ হাজার পাউন্ডের নকল বিস্ফোরকভর্তি ট্রাকসহ যাকে ম্যানহাটনের নিউইয়র্ক রিজার্ভ ব্যাংকের ভবন থেকে আটক করেছিল এফবিআই? সেটিও তথ্যদাতানির্ভর ঘটনা। এমন ঘটনা অসংখ্য। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন ইলেভেন) নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার পর এফবিআইর ক্ষমতা আর কর্মপরিধি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে ফাঁদ পেতে মানুষকে ধরার ঘটনা।
কাঠগড়ায় এফবিআই
এফবিআই প্রকাশিত তথ্য ও বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আশিকুল আলমকে নিয়ে নাইন ইলেভেনের পর থেকে মোট ৮৯২ জনকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য আটক করে এফবিআই, কিংবা এ সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। এদের ৩২১ জন আবার স্টিং অপারেশনের ফসল। এদের কারো বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে বস্তুগত সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ, কারো বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ, কেউ অভিবাসন আইন ভেঙেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। তথ্যানুসন্ধানী সংবাদ প্রতিষ্ঠান ‘দা ইন্টারসেপ্ট’–এর সবশেষ তথ্য, এফবিআইর হাতে আটক এসব ব্যক্তির মধ্যে ৪৭৯ জনই এখন মুক্ত। নিঃশর্ত মুক্তি মিলেছে তাদের। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণে নেই। কোনো নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতাও নেই। এর অর্থ, সরকার তাদের আর দেশের প্রতি হুমকি মনে করে না। অথচ দীর্ঘ সময় আর প্রচুর নগদ অর্থ ব্যয়ে এদের আটক করা হয়েছিল। তাদের গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছিল ভয়ংকর সন্ত্রাসী বলে।
৩১ মে, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড টেরর’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে ‘দা ইন্টারসেপ্ট’ উল্লেখ করে, এফবিআই সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে আসামি করেছে এমন বেশির ভাগেরই কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেকের সন্ত্রাস করার মতো সক্ষমতা নেই। অথচ, এদের ধরতে এফবিআই কিংবা সংস্থার তথ্যদাতারা নিজেরা নিজেদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের লোক বলে পরিচয় দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল।
দা ইন্টারসেপ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল, আটক এমন ৩৪ জনকে এফবিআই ছেড়ে দিয়ে সংস্থার সহায়তাকারী (কোঅপারেটর) বানিয়েছে। বিপরীতে, স্টিং অপারেশনে ধরা পড়া বেশির ভাগ ব্যক্তি বছরের পর বছর কারাগারে আটক রয়েছেন। কারণ, বাণিজ্য করার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
স্টিং অপারেশন এবং ইনফরম্যান্ট বিতর্ক
দীর্ঘদিন তথ্যদাতা লাগিয়ে, কিংবা এজেন্ট নিজে ফাঁদ পেতে কাউকে আটকের পদ্ধতি হচ্ছে স্টিং অপারেশন। কেউ একজন কোনো অপরাধ করতে চায়, তাকে ধরতে অভিনয়ের মাধ্যমে ফাঁদ পাতা হচ্ছে এ অপারেশনের বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন কিংবা তাদের নিয়োগ করা তথ্যদাতা কখনো অপরাধীর, কখনো অপরাধীর সহযোগীর, আবার কখনো ভুক্তভোগীর অভিনয় করে আস্থাভাজন হন তথাকথিত অপরাধীর। এরপর, তার সঙ্গে কথোপকথন, তার নানা কর্মকাণ্ডের অডিও, ভিডিও দলিল তৈরি করেন। প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর সময় আর অর্থ ব্যয় করে এসবের ফল কি? অধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, নাইন ইলেভেনের পর এফবিআই নানা কায়দায় এ সংস্থাকে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দেয়নি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এই দুই সংবেদনশীল বিষয়কে ভালোই কাজ লাগিয়েছে এফবিআই।
নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা নন-প্রফিট মার্কিন সংগঠন ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন’ মনে করে, ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন ইলেভেন) সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর থেকে, এফবিআই বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। ‘ফ্লোরিডা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং’–এর নির্বাহী পরিচালক ট্রেভর এরনসন এফবিআইর কর্মকাণ্ড-নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছেন। তাঁর মতে আল কায়েদার চেয়ে বেশি, আল শাবাব কিংবা ইসলামিক স্টেটের চেয়ে, এমনকি এরা সবাই মিলে যা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর চেয়ে অনেক বেশি যে ‘সন্ত্রাস-নকশা’ করার দায় এফবিআইর। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে পর্যালোচনা করে, আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এফবিআই সন্ত্রাসী ধরার চেয়ে তৈরিতে বেশ ভালো।’ এ ধরনের অভিযান, যেগুলো সাধারণ একজন তথ্যদাতা দিয়ে পরিচালিত হয়, মানসিক অসুস্থ এবং আর্থিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসবাদী (আমরা এখন এভাবে বলি) হওয়ার উপায়, সুযোগ এবং কখনো কখনো ধারণার জোগান দেয়।
এফবিআই ফ্যাক্টশিট ও অন্যান্য তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে যায়, যখন যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আলোচনার শীর্ষে থেকেছে, এফবিআই এজেন্টরা সে সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লেষ আছে এমন ব্যক্তিদের আটক করেছেন বেশি। ২০১৪ সাল থেকে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পর এ সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঝোঁকের দায়ে ১৭১ জনকে আটক করা হয়। বিন লাদেনের আল কায়েদা সংশ্লেষে ধরা হয় ১৬৩ জনকে।
দেশি কিংবা বিদেশি সন্ত্রাসবাদী কাজ থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ কাউন্টার টেররিজম খাতে ব্যয় করে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থ থেকে এফবিআইর তথ্যদাতার পেছনেও ব্যয় হয় বিরাট অঙ্ক। একজন তথ্যদাতা প্রতিটি কেসে গড়ে এক লাখ ডলার সম্মানী পান। পরিসংখ্যান বলছে, টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত সন্ত্রাসী হামলা ঘটনা ১০টিও নয়। অথচ, একই সময়ে এফবিআই স্টিং অপারেশন চালিয়েছে ৩২১টি, যার ২৭৯টি তথ্যদাতার সাহায্য নিয়ে।
কারা পা দিচ্ছে এই ফাঁদে
পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, অসুস্থ, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, স্নায়বিক চাপে থাকা, নির্জনতা পছন্দ করা, খরুচে তরুণেরাই স্টিং অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এফবিআইর এমন কর্মকাণ্ড অনুসরণ ও বিশ্লেষণ করেন এমন একজন অধিকার কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এফবিআই বিজ্ঞাননির্ভর কৌশলে লক্ষ্যবস্তুকে শিকারে পরিণত করেন। এর ফলে, শুরুতে চরম আপত্তি থাকলেও একসময় ধীরে ধীরে তিনি এফবিআইর জালে নিজেকে সঁপে দেন। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে মনে হয়েছে, এফবিআই তথ্যদাতা বা এজেন্ট তার সুবিধাজনক কথোপকথন রেকর্ড করেন। শিকারের সঙ্গে আলোচনা তথ্যদাতার পক্ষে গেলে সেগুলোর ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। আদালতে উপস্থাপন করা হয়।’
অভিবাসী অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ড্রাম’ এর অরগানাইজিং ডিরেক্টর কাজী ফৌজিয়ার মতে, ‘এ ধরনের কথা বলা, বাংলাদেশিদের নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে সে ঘটনার দায় কমিউনিটির নয় বলে প্রচারেরও একটা সংস্কৃতি দেখা যায় আমাদের মধ্যে, যা আত্মঘাতী। একটা ঘটনাকে ঘটনা হিসেবে দেখে সেটি নিয়ে অতিপ্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আইনকে তার গতিতে চলতে দেওয়া ভালো।’ তিনি, কমিউনিটিতে বিভেদের রাজনীতি বন্ধেরও অনুরোধ জানান।
তথ্যদাতা বনাম এজেন্ট
তথ্যদাতা নিয়োগ দেন একজন এজেন্ট। এতে এফবিআই কর্তৃপক্ষের কোনো হাত নেই। একটি সমন্বিত অ্যাপস ‘ডেলটা’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় এজেন্টদের কর্মকাণ্ড। এই এজেন্ট আর তথ্যদাতার মধ্যে বিরোধের নানা কাহিনি আলোচিত হয়ে আছে। তথ্যদাতা নিয়োগের জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও আছে। নাজি মনসুরের ঘটনা ২০১৪ সালের। কেনিয়া বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মনসুর সুদানে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। দীর্ঘদিন তাঁকে পরিবার আর সন্তানদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি পরে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন, এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। তাঁকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলারও হুমকি দেন একজন এজেন্ট।
এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার কারণে প্রভাব বিস্তারের ঘটনাও কম নয়। ২০১৮ সালে অক্টোবরে আপস্টেট নিউইয়র্ক হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় নাম আসে এফবিআই তথ্যদাতা শাহেদ হোসেনের। তিনি দুর্ঘটনা কবলিত লিমোর মালিক। আইন রক্ষার জন্য এফবিআইকে সহায়তাকারী এই পাকিস্তানি আলবেনিতে ইরাকি ইমাম ইয়াসির আরেফ ও বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলমকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শাহেদ নিজে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর লিমো কোম্পানিটির বৈধতা ছিল না। লিমোর লাইসেন্স ছিল না। এরপরও, শুধু এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার কারণে তিনি সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একসময় তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হয়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে বিচারের মুখোমুখি হন তাঁর ছেলে।
এফবিআই এবং বাংলাদেশি জনসমাজ
বিভিন্ন সময়ে এফবিআইয়ের অপারেশনে আটক হয়েছে অন্তত ৬ বাংলাদেশি। এদের মধ্যে আলোচিত কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস (২০১২), মোহাম্মদ হোসেন (২০১৪), এবং সাম্প্রতিক হওয়ার কারণে আশিকুল আলম। এ ঘটনাগুলোর কারণে এফবিআই নিয়ে বাংলাদেশি জনসমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তবে অনেকে মনে করেন, জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা এফবিআইর লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কথা নয়। রাশিয়া, চীন, ইয়েমেন, সোমালিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকদের প্রতি এফবিআই জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক নজর পড়লেও বাংলাদেশিরা সেদিক থেকে নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অধিকার সংগঠন দাবি করে আসছে, মুসলমানদের প্রতি এফবিআইর আগ্রাসী ও নিবর্তনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বাংলাদেশি সমাজের প্রবীণ নেতা ছালামত উল্লাহর মতে, এফবিআই ফাঁদে ফেলার কাজটা খুব ভালোভাবে করে। সেকারণে আমাদের সবার সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে, তরুণদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। তাঁরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’ সন্তানের সঙ্গে বা মায়ের, তরুণ-যুবাদের সঙ্গে আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক আরও নিবিড় করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এফবিআই’র নিয়ন্ত্রণ জরুরি!
তদন্ত সংস্থা হিসেবে এফবিআইর দক্ষতা ও পেশাদারি নিয়ে খুব কম প্রশ্ন উঠেছে। বিধিবদ্ধ একটি সংস্থা হওয়ার পরও এফবিআই নানা গোপন নিয়মে কাজ করে। নাইন ইলেভেনের পর ১৫ শত তথ্যদাতার সঙ্গে রাতারাতি যোগ হয়ে যায় আরও সাড়ে ১৩ হাজার। এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। কাজের ক্ষেত্র বেড়ে সন্ত্রাসবাদ যোগ হয় বিস্তৃত পরিসরে। ২০০৮ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল মিউকেসির অফিস এ সংস্থার জন্য যে ইনভেস্টিগেশন গাইডলাইন তৈরি করে দেয়, যেটিতে আসলে শতভাগ না মেনে নিজেদের কর্মকাণ্ড-গোপনীয়তা আর রহস্যময়তায় ঢেকে রাখে এফবিআই। অনেক কিছুতে জবাবদিহির ক্ষেত্র খুব সীমিত হওয়ার কারণে, সন্ত্রাস নির্মূলের নামে জনসমাজ, জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক-এমন অনেকের ওপর নজরদারি শুরু করে এফবিআই। এ কাজ এত বেশি লাগামহীন হয়ে পড়ে যে, একসময় এফবিআইর ফাইলের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছায় ছয়শ কোটিতে। জনপ্রতি দিনে গড়ে ২০টি করে ফাইল ভাগে পড়বে।
সংবাদমাধ্যম ‘দা ইনটারসেপ্ট’ এর মতে, বিধি থাকলেও সেগুলো না মেনে এফবিআই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে নজর দিচ্ছে। অ্যান্টি-প্রোফাইলিং বিধিমালা থাকার পরও কাউকে লক্ষ্যবস্তু করতে তার ধর্ম ও বর্ণকে গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির ঘটনাও বাড়িয়েছে তারা। দা ইনটারসেপ্ট বলছে, এসবের প্রমাণ হিসেবে অসংখ্য দলিল দস্তাবেজ আছে তাদের হাতে।
আশিকুল আলম ওরফে আশিককে গত ৮ জুন শুক্রবার ব্রুকলিনের ফেডারেল আদালতে হাজির করা হয়। ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত আশিকের গতিবিধির ওপর প্রায় বছর খানেক ধরেই নজরদারি চলছিল। একজন আন্ডারকভার এজেন্ট তাঁর সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে।
প্রবাসী বহুল জ্যাকসন হাইটস এলাকায় আশিকুলের বসবাস ছিল। কর্মজীবী বাবা–মা বলছেন, ‘আমার ছেলে যদি অন্যায় করে তাঁর বিচার হোক। যদি তাঁকে বিভ্রান্ত করার জন্য, ফাঁদে ফেলা হয়, তারও তদন্ত হোক।’
আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছে। দুষ্কর্মের সঙ্গে স্বদেশের নাম উচ্চারণে বিব্রত প্রবাসীরা। সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাংলাদেশি ইমাম কাজী কায়্যূম বলেছেন, নাফিস-আকায়েদের মতো এবারে আশিকুলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মান পদদলিত হলো। এদিকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ড্রামের নেত্রী কাজী ফৌজিয়া বলেছেন, ‘কয়েক শ মানুষ আমেরিকার জেলে আছে এমন সাজানো কেসে, তারা সবাই বাংলাদেশি নয়। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি যুবকদের কেন টার্গেট করছে সেটা চিন্তার বিষয়।’
ঘটনা এক
২০০৪ সালে আগস্টে নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনিতে সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনার অভিযোগে আটক করা হয় সেখানকার সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত মসজিদে আস-সালামের ইমাম ইয়াসিন আরেফ (৩৪) ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেনকে (৪৬)। কাঁধে রেখে ছোড়া যায় এমন মিসাইল কিনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন তারা। দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইর। সেই অভিযোগে ২০০৬ সালে ১৫ বছর করে সাজা হয় দুজনের। মোহাম্মদ হোসেন কিছুদিন জামিনে থাকলেও আরেফ আটক হওয়ার পর থেকে কারাগারে থেকেছেন। গত ৯ জুন রোববার রাতে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তার জন্মস্থান ইরাকে।
ইয়াসিন আরেফ কুর্দি শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। মার্কিন নাগরিক নন। মোহাম্মদ হোসেন বাংলাদেশি। আলবেনিতে পিজার দোকান ছিল তাঁর। অভিবাসন সূত্রে মার্কিন নাগরিক। এ দুজনের আটকের ঘটনা সেসময় বেশ আলোচিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এফবিআই দাবি করে, ইরাকে একটি বোমা হামলার ঘটনায় আটক এক ব্যক্তির কাছে পাওয়া একটি নোট বইয়ে ইয়াসিন আরেফের নাম লেখা ছিল। সেটির সূত্র ধরে দীর্ঘদিন তথ্যদাতা (ইনফরম্যান্ট) লাগিয়ে আটক করা হয়েছে দুজনকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি ছিল, এটি একটি সাজানো ঘটনা, যাতে এ দুজনকে শিকার বানানো হয়েছে।
ঘটনা দুই
২৮ বছরের ম্যাথিউ সানিৎসা যোগ দিতে চায় তালিবানে-তথ্যদাতার এমন তথ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এফবিআইর এজেন্টরা। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে এলাকা থেকে আটক করা হয় তাকে। সানিৎসার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ওকল্যান্ডে একটি ব্যাংক ভবন গাড়িবোমায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
সানিৎসার পেছনে দীর্ঘদিন লেগে ছিলেন একজন তথ্যদাতা। এফবিআইর নিয়োগ করা। একই সময়ে, সানিৎসার পরিবার তার মানসিক চিকিৎসার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ খুঁজছিলেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে, হাঁপানিসহ নানা রোগে ভুগতে থাকা সানিৎসার মানসিক সমস্যাও বেড়ে চলেছিল। এর মধ্যে, তার সঙ্গে তথ্যদাতা পরিচয় করিয়ে দেয় একজন এফবিআই এজেন্টকে, যিনি তাকে নকল বোমাসহ একটি গাড়ি সরবরাহ করেন।
২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের সাজা হয় সানিৎসার। আদালতে তার আইনজীবীরা এ ঘটনাকে ‘পাতানো খেলা’ বলে মন্তব্য করে তার মানসিক সমস্যার কথা তুলে ধরলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
একই ঘটনা এখানেও
তথ্যদাতাকে ব্যবহার করে, ফাঁদ পেতে আটকের ঘটনা সবশেষটি ঘটেছে বাংলাদেশের তরুণ আশিকুল আলমকে ঘিরে। নিউইয়র্কের পর্যটকবহুল টাইম স্কয়ারে পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মারার, রকেট ছুড়ে নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা অভিযোগে গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার এফবিআই আর নিউইয়র্ক পুলিশের বিশেষ দল ‘জয়েন্ট টেররিজম টাস্ক ফোর্স’ আটক করে তাঁকে।
দীর্ঘ প্রায় এক বছর একজন তথ্যদাতা লেগে ছিল আশিকুলে পেছনে। নানা পরিকল্পনা করে দুজনে বৃহস্পতিবার ব্রুকলিনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে যায়। আটক আশিকুলের বিরুদ্ধে আদালতে সন্ত্রাসবাদের নয়, আনা হয়েছে হামলা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অস্ত্র কেনা এবং সেগুলোর সিরিয়াল নম্বর মুছে ফেলার অভিযোগ। আদালত তাঁকে স্থায়ীভাবে আটক রাখার আদেশ দেয়।
বাংলাদেশি যুবক কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের কথা মনে আছে? ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর, ১ হাজার পাউন্ডের নকল বিস্ফোরকভর্তি ট্রাকসহ যাকে ম্যানহাটনের নিউইয়র্ক রিজার্ভ ব্যাংকের ভবন থেকে আটক করেছিল এফবিআই? সেটিও তথ্যদাতানির্ভর ঘটনা। এমন ঘটনা অসংখ্য। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন ইলেভেন) নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার পর এফবিআইর ক্ষমতা আর কর্মপরিধি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে ফাঁদ পেতে মানুষকে ধরার ঘটনা।
কাঠগড়ায় এফবিআই
এফবিআই প্রকাশিত তথ্য ও বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আশিকুল আলমকে নিয়ে নাইন ইলেভেনের পর থেকে মোট ৮৯২ জনকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য আটক করে এফবিআই, কিংবা এ সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। এদের ৩২১ জন আবার স্টিং অপারেশনের ফসল। এদের কারো বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে বস্তুগত সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ, কারো বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ, কেউ অভিবাসন আইন ভেঙেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। তথ্যানুসন্ধানী সংবাদ প্রতিষ্ঠান ‘দা ইন্টারসেপ্ট’–এর সবশেষ তথ্য, এফবিআইর হাতে আটক এসব ব্যক্তির মধ্যে ৪৭৯ জনই এখন মুক্ত। নিঃশর্ত মুক্তি মিলেছে তাদের। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণে নেই। কোনো নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতাও নেই। এর অর্থ, সরকার তাদের আর দেশের প্রতি হুমকি মনে করে না। অথচ দীর্ঘ সময় আর প্রচুর নগদ অর্থ ব্যয়ে এদের আটক করা হয়েছিল। তাদের গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছিল ভয়ংকর সন্ত্রাসী বলে।
৩১ মে, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড টেরর’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে ‘দা ইন্টারসেপ্ট’ উল্লেখ করে, এফবিআই সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে আসামি করেছে এমন বেশির ভাগেরই কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেকের সন্ত্রাস করার মতো সক্ষমতা নেই। অথচ, এদের ধরতে এফবিআই কিংবা সংস্থার তথ্যদাতারা নিজেরা নিজেদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের লোক বলে পরিচয় দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল।
দা ইন্টারসেপ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল, আটক এমন ৩৪ জনকে এফবিআই ছেড়ে দিয়ে সংস্থার সহায়তাকারী (কোঅপারেটর) বানিয়েছে। বিপরীতে, স্টিং অপারেশনে ধরা পড়া বেশির ভাগ ব্যক্তি বছরের পর বছর কারাগারে আটক রয়েছেন। কারণ, বাণিজ্য করার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
স্টিং অপারেশন এবং ইনফরম্যান্ট বিতর্ক
দীর্ঘদিন তথ্যদাতা লাগিয়ে, কিংবা এজেন্ট নিজে ফাঁদ পেতে কাউকে আটকের পদ্ধতি হচ্ছে স্টিং অপারেশন। কেউ একজন কোনো অপরাধ করতে চায়, তাকে ধরতে অভিনয়ের মাধ্যমে ফাঁদ পাতা হচ্ছে এ অপারেশনের বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন কিংবা তাদের নিয়োগ করা তথ্যদাতা কখনো অপরাধীর, কখনো অপরাধীর সহযোগীর, আবার কখনো ভুক্তভোগীর অভিনয় করে আস্থাভাজন হন তথাকথিত অপরাধীর। এরপর, তার সঙ্গে কথোপকথন, তার নানা কর্মকাণ্ডের অডিও, ভিডিও দলিল তৈরি করেন। প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর সময় আর অর্থ ব্যয় করে এসবের ফল কি? অধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, নাইন ইলেভেনের পর এফবিআই নানা কায়দায় এ সংস্থাকে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দেয়নি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এই দুই সংবেদনশীল বিষয়কে ভালোই কাজ লাগিয়েছে এফবিআই।
নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা নন-প্রফিট মার্কিন সংগঠন ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন’ মনে করে, ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন ইলেভেন) সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর থেকে, এফবিআই বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। ‘ফ্লোরিডা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং’–এর নির্বাহী পরিচালক ট্রেভর এরনসন এফবিআইর কর্মকাণ্ড-নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছেন। তাঁর মতে আল কায়েদার চেয়ে বেশি, আল শাবাব কিংবা ইসলামিক স্টেটের চেয়ে, এমনকি এরা সবাই মিলে যা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর চেয়ে অনেক বেশি যে ‘সন্ত্রাস-নকশা’ করার দায় এফবিআইর। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে পর্যালোচনা করে, আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এফবিআই সন্ত্রাসী ধরার চেয়ে তৈরিতে বেশ ভালো।’ এ ধরনের অভিযান, যেগুলো সাধারণ একজন তথ্যদাতা দিয়ে পরিচালিত হয়, মানসিক অসুস্থ এবং আর্থিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসবাদী (আমরা এখন এভাবে বলি) হওয়ার উপায়, সুযোগ এবং কখনো কখনো ধারণার জোগান দেয়।
এফবিআই ফ্যাক্টশিট ও অন্যান্য তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে যায়, যখন যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আলোচনার শীর্ষে থেকেছে, এফবিআই এজেন্টরা সে সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লেষ আছে এমন ব্যক্তিদের আটক করেছেন বেশি। ২০১৪ সাল থেকে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পর এ সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঝোঁকের দায়ে ১৭১ জনকে আটক করা হয়। বিন লাদেনের আল কায়েদা সংশ্লেষে ধরা হয় ১৬৩ জনকে।
দেশি কিংবা বিদেশি সন্ত্রাসবাদী কাজ থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ কাউন্টার টেররিজম খাতে ব্যয় করে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থ থেকে এফবিআইর তথ্যদাতার পেছনেও ব্যয় হয় বিরাট অঙ্ক। একজন তথ্যদাতা প্রতিটি কেসে গড়ে এক লাখ ডলার সম্মানী পান। পরিসংখ্যান বলছে, টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত সন্ত্রাসী হামলা ঘটনা ১০টিও নয়। অথচ, একই সময়ে এফবিআই স্টিং অপারেশন চালিয়েছে ৩২১টি, যার ২৭৯টি তথ্যদাতার সাহায্য নিয়ে।
কারা পা দিচ্ছে এই ফাঁদে
পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, অসুস্থ, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, স্নায়বিক চাপে থাকা, নির্জনতা পছন্দ করা, খরুচে তরুণেরাই স্টিং অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এফবিআইর এমন কর্মকাণ্ড অনুসরণ ও বিশ্লেষণ করেন এমন একজন অধিকার কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এফবিআই বিজ্ঞাননির্ভর কৌশলে লক্ষ্যবস্তুকে শিকারে পরিণত করেন। এর ফলে, শুরুতে চরম আপত্তি থাকলেও একসময় ধীরে ধীরে তিনি এফবিআইর জালে নিজেকে সঁপে দেন। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে মনে হয়েছে, এফবিআই তথ্যদাতা বা এজেন্ট তার সুবিধাজনক কথোপকথন রেকর্ড করেন। শিকারের সঙ্গে আলোচনা তথ্যদাতার পক্ষে গেলে সেগুলোর ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। আদালতে উপস্থাপন করা হয়।’
অভিবাসী অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ড্রাম’ এর অরগানাইজিং ডিরেক্টর কাজী ফৌজিয়ার মতে, ‘এ ধরনের কথা বলা, বাংলাদেশিদের নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে সে ঘটনার দায় কমিউনিটির নয় বলে প্রচারেরও একটা সংস্কৃতি দেখা যায় আমাদের মধ্যে, যা আত্মঘাতী। একটা ঘটনাকে ঘটনা হিসেবে দেখে সেটি নিয়ে অতিপ্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আইনকে তার গতিতে চলতে দেওয়া ভালো।’ তিনি, কমিউনিটিতে বিভেদের রাজনীতি বন্ধেরও অনুরোধ জানান।
তথ্যদাতা বনাম এজেন্ট
তথ্যদাতা নিয়োগ দেন একজন এজেন্ট। এতে এফবিআই কর্তৃপক্ষের কোনো হাত নেই। একটি সমন্বিত অ্যাপস ‘ডেলটা’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় এজেন্টদের কর্মকাণ্ড। এই এজেন্ট আর তথ্যদাতার মধ্যে বিরোধের নানা কাহিনি আলোচিত হয়ে আছে। তথ্যদাতা নিয়োগের জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও আছে। নাজি মনসুরের ঘটনা ২০১৪ সালের। কেনিয়া বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মনসুর সুদানে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। দীর্ঘদিন তাঁকে পরিবার আর সন্তানদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি পরে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন, এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। তাঁকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলারও হুমকি দেন একজন এজেন্ট।
এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার কারণে প্রভাব বিস্তারের ঘটনাও কম নয়। ২০১৮ সালে অক্টোবরে আপস্টেট নিউইয়র্ক হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় নাম আসে এফবিআই তথ্যদাতা শাহেদ হোসেনের। তিনি দুর্ঘটনা কবলিত লিমোর মালিক। আইন রক্ষার জন্য এফবিআইকে সহায়তাকারী এই পাকিস্তানি আলবেনিতে ইরাকি ইমাম ইয়াসির আরেফ ও বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলমকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শাহেদ নিজে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর লিমো কোম্পানিটির বৈধতা ছিল না। লিমোর লাইসেন্স ছিল না। এরপরও, শুধু এফবিআইর তথ্যদাতা হওয়ার কারণে তিনি সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একসময় তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হয়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে বিচারের মুখোমুখি হন তাঁর ছেলে।
এফবিআই এবং বাংলাদেশি জনসমাজ
বিভিন্ন সময়ে এফবিআইয়ের অপারেশনে আটক হয়েছে অন্তত ৬ বাংলাদেশি। এদের মধ্যে আলোচিত কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস (২০১২), মোহাম্মদ হোসেন (২০১৪), এবং সাম্প্রতিক হওয়ার কারণে আশিকুল আলম। এ ঘটনাগুলোর কারণে এফবিআই নিয়ে বাংলাদেশি জনসমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তবে অনেকে মনে করেন, জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা এফবিআইর লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কথা নয়। রাশিয়া, চীন, ইয়েমেন, সোমালিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকদের প্রতি এফবিআই জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক নজর পড়লেও বাংলাদেশিরা সেদিক থেকে নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অধিকার সংগঠন দাবি করে আসছে, মুসলমানদের প্রতি এফবিআইর আগ্রাসী ও নিবর্তনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বাংলাদেশি সমাজের প্রবীণ নেতা ছালামত উল্লাহর মতে, এফবিআই ফাঁদে ফেলার কাজটা খুব ভালোভাবে করে। সেকারণে আমাদের সবার সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে, তরুণদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। তাঁরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’ সন্তানের সঙ্গে বা মায়ের, তরুণ-যুবাদের সঙ্গে আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক আরও নিবিড় করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এফবিআই’র নিয়ন্ত্রণ জরুরি!
তদন্ত সংস্থা হিসেবে এফবিআইর দক্ষতা ও পেশাদারি নিয়ে খুব কম প্রশ্ন উঠেছে। বিধিবদ্ধ একটি সংস্থা হওয়ার পরও এফবিআই নানা গোপন নিয়মে কাজ করে। নাইন ইলেভেনের পর ১৫ শত তথ্যদাতার সঙ্গে রাতারাতি যোগ হয়ে যায় আরও সাড়ে ১৩ হাজার। এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। কাজের ক্ষেত্র বেড়ে সন্ত্রাসবাদ যোগ হয় বিস্তৃত পরিসরে। ২০০৮ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল মিউকেসির অফিস এ সংস্থার জন্য যে ইনভেস্টিগেশন গাইডলাইন তৈরি করে দেয়, যেটিতে আসলে শতভাগ না মেনে নিজেদের কর্মকাণ্ড-গোপনীয়তা আর রহস্যময়তায় ঢেকে রাখে এফবিআই। অনেক কিছুতে জবাবদিহির ক্ষেত্র খুব সীমিত হওয়ার কারণে, সন্ত্রাস নির্মূলের নামে জনসমাজ, জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক-এমন অনেকের ওপর নজরদারি শুরু করে এফবিআই। এ কাজ এত বেশি লাগামহীন হয়ে পড়ে যে, একসময় এফবিআইর ফাইলের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছায় ছয়শ কোটিতে। জনপ্রতি দিনে গড়ে ২০টি করে ফাইল ভাগে পড়বে।
সংবাদমাধ্যম ‘দা ইনটারসেপ্ট’ এর মতে, বিধি থাকলেও সেগুলো না মেনে এফবিআই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে নজর দিচ্ছে। অ্যান্টি-প্রোফাইলিং বিধিমালা থাকার পরও কাউকে লক্ষ্যবস্তু করতে তার ধর্ম ও বর্ণকে গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির ঘটনাও বাড়িয়েছে তারা। দা ইনটারসেপ্ট বলছে, এসবের প্রমাণ হিসেবে অসংখ্য দলিল দস্তাবেজ আছে তাদের হাতে।
No comments