ঠিক কী কী বদলে যাচ্ছে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে by রঞ্জন বসু
ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ৫ আগস্ট সোমবার রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত এক বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের
বিশেষ স্বীকৃতি বা মর্যাদা বাতিল করার পর বেশ কয়েক ঘণ্টা অতিক্রান্ত
হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের যে ৩৭০ ধারা কাশ্মিরকে এই বিশেষ স্বীকৃতি দিতো, তা
অবলুপ্ত হওয়ার পর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সেখানে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে
চলেছে তা নিয়ে এখনও চলছে বিস্তর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধরে ধরে এই প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভারত সরকারের ওই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য।
>>>প্রশাসনিক পরিবর্তন
জম্মু ও কাশ্মির এতদিন ছিল ভারতের এমন একটি অঙ্গরাজ্য, যার কার্যত
নিজস্ব সংবিধান ছিল। প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র ছাড়া ওই রাজ্যের কোনও
বিষয়ে ভারত সরকার নাক গলাতে পারতো না। পার্লামেন্ট কাশ্মির নিয়ে কোনও নীতি
নিলেও সেটা ছাড়পত্র পেতে কাশ্মির বিধানসভা অনুমোদন দিলে, তবেই।
’৪৭-এ দেশভাগের পর যে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনে’ সই করে কাশ্মিরের
তদানীন্তন হিন্দু রাজা হরি সিং তার রাজ্যর ভারতভুক্তিতে সায় দিয়েছিলেন, তার
অংশ হিসেবেই ভারত এই সব শর্তে রাজি হয়েছিল–আর কাশ্মিরের সেই বিশেষ
রক্ষাকবচেরই নাম ছিল ৩৭০ ধারা।
এদিনের পর সেই ভারতীয় সংবিধানের সেই ধারাটাই ইতিহাসে পরিণত হলো।
সরকারের নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুসারে জম্মু ও কাশ্মির এখন হবে একটি
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (ইউনিয়ন টেরিটরি), যেখানে কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে
প্রশাসকের ভূমিকায় থাকবেন একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর।
অন্যদিকে, রাজ্যটি থেকে শিয়া মুসলিম ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখ অঞ্চলকে
আলাদা করে গড়া হবে আর একটি ইউনিয়ন টেরিটরি, সেখানে আবার কোনও বিধানসভাও
থাকবে না।
ফলে জম্মু ও কাশ্মিরের অবস্থা হবে অনেকটা দিল্লির মতো (যেখানে আম আদমি
পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল ক্ষমতায় আছেন), যেখানে রাজ্যের একটা নিজস্ব
বিধানসভা থাকলেও সেটা আসলে থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই।
>>>ভারতীয়দের কাশ্মিরে জমি-বাড়ি কেনার ক্ষমতা
বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির একটা পোস্টার ছিল ‘আপকা সাহি ভোট কাশ্মিরমে আপকো প্লট দিলা সাকতা হ্যায়’।
হিন্দি ভাষার ওই নির্বাচনি স্লোগানের অর্থটা হলো, আপনি যদি ঠিকমতো ভোট
দিয়ে (বিজেপিকে) জেতান, তাহলে আপনার কাশ্মিরে জমি কেনার স্বপ্নও সফল হবে।
ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মিরে বাকি ভারতের অধিবাসীরা এতদিন জমি বা সম্পত্তি কিছুই কিনতে পারতেন না।
কাশ্মিরে সব ধরনের সরকারি চাকরি বা ট্রেড লাইসেন্সও বরাদ্দ ছিল
শুধুমাত্র রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্যই। আর কাদের স্থায়ী বাসিন্দা বলা
হবে, সেই কঠোর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষমতাও ছিল রাজ্য বিধানসভার হাতেই।
আর কাশ্মিরিদের কপালে এই সব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা জুটেছিল সেই ৩৭০ ধারার সুবাদেই।
সেই ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন ভারতের অন্য অংশের নাগরিকরাও
কাশ্মিরে গিয়ে জমি-বাড়ি কিনতে পারবেন। চাইলে টাটা বা বিড়লা শিল্পগোষ্ঠী জমি
কিনে সেখানে কারখানাও গড়তে পারবে।
কাশ্মির পুলিশে বা রাজ্যের বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরির জন্য আবেদন করতে
পারবেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের বাসিন্দারাও। ফলে এক ধাক্কায়
কাশ্মির নেমে আসবে দেশের বাদবাকি অংশের সঙ্গে এক কাতারে।
>>>কাশ্মির কি আর মুসলিম-প্রধান থাকবে না?
বিজেপির এদিনের সিদ্ধান্তকে অনেকেই কিন্তু দেখছেন ভারতের একমাত্র
মুসলিম-গরিষ্ঠ রাজ্যটির ডেমোগ্রাফিক বা জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলানোর একটি
চেষ্টা হিসেবে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপরিচিত কাশ্মিরি অ্যাক্টিভিস্ট, ব্যারিস্টার
আবদুল মজিদ ট্রাম্বো বাংলা ট্রিবিউনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী ব্রাসেলস
থেকে বলছিলেন, ‘বিজেপি আসলে চাইছে এখন দলে দলে হিন্দুদের কাশ্মির ভ্যালিতে
ঢুকিয়ে মুসলিমদের সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে।’
তিনি আরও জানাচ্ছেন, বিজেপি যখন থেকে আবার কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা তথা
আর্টিকল ৩৫এ বিলোপ করার কথা বলতে শুরু করেছে তখন থেকেই তারা ঠিক এই
আশঙ্কাটাই করে আসছেন।
‘অথচ কাশ্মির হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ডিসপিউটেড ল্যান্ড বা
বিতর্কিত ভূখণ্ড। সেখানে আপনি এভাবে একতরফাভাবে বাইরে থেকে লোকজন ঢুকিয়ে
ডেমোগ্রাফি পাল্টে দিতে পারেন না’, বলছিলেন ব্যারিস্টার ট্রাম্বো।
কাশ্মিরি অ্যাক্টিভিস্টরা অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তাদের রাজ্যের বিশেষ
রক্ষাকবচ চলে যাওয়ার পর এখন সুপরিকল্পিতভাবে বাকি ভারত থেকে অমুসলিমদের
সেখানে সরিয়ে আনা হবে।
কাশ্মিরি হিন্দু পণ্ডিতদের যেমন আলাদা কলোনি গড়া হবে, তেমনি এক্স
সার্ভিসমেন বা সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের জন্যও জমির বিশেষ ব্যবস্থা হবে।
কলকারখানার শ্রমিকদেরও নিয়ে আসা হবে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে।
এর মাধ্যমেই কাশ্মির ভ্যালির প্রায় সত্তর লাখ মুসলিমকে নিজভূমেই ধীরে
ধীরে সংখ্যালঘু করে ফেলাটাই বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি গেমপ্ল্যান বলে তারা
আশঙ্কা করছেন।
শেষ পর্যন্ত কাশ্মিরে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে, তা অনেকটাই
এখনও অনুমানের বিষয়–কিন্তু ভারত-শাসিত এই ভূখণ্ডটির আগামী দিনগুলো যে গত
সত্তর বছরের মতো একই খাতে বইবে না তা এখন পরিষ্কার।
No comments