চট্টগ্রামের পাঁচ জয়ীতার গল্প
নারীর সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক। নারী শুধু মা
নন- কন্যা, বোন, সহধর্মিণীও। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তো বলেই গেছেন, কোনো
কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী/প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে
বিজয়লক্ষ্মী নারী। নজরুলের এই সাম্যের বাণী আজ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে। নারীর
অভিধানে অবহেলা, অসহায়ত্ব এই শব্দগুলো এখন আর নেই। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে
শিখেছে ওরাও। মহাকাশে ছুটে চলা বিমান আজ তাদের দখলে। জয় করেছে এভারেস্টও।
তেমনি জীবনযুদ্ধে জয় করেছেন চট্টগ্রামের পাঁচ জয়ীতা।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর আমিরাবাদ গ্রামের বাবুল কর্মকারের স্ত্রী দুলালী কর্মকার। নিজের ও অন্যের পরিবারের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সামাজিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে তিনি হয়েছেন জয়ীতা। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু-নির্যাতন প্রতিরোধে সকলকে সচেতন করছেন তিনি। ব্র্যাক মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচিতে আইন সেবিকা হিসেবে চাকরি করে এলাকার পারিবারিক আইন সম্পর্কে সচেতন করে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছেন তিনি।
দুলালী কর্মকার বলেন, লোহাগাড়া উপজেলার ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির উদ্যোগে দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে ‘পল্লী সমাজ’ নামে সংগঠন তৈরি করেছি। উক্ত সংগঠনে তিনি ২০১২ সাল থেকে সভা প্রধান-এর দায়িত্ব পালন করছি। উক্ত সংগঠনে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিবার ও সমাজ উন্নয়নে কাজ করছি।
রীনা আক্তার একজন আত্মপ্রত্যয়ী ও অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী। সফলতার নানা ধাপ অতিক্রম করে তিনিও হয়েছেন জয়ীতা।
রীনা আক্তার বলেন, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মো. শামসুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। বিয়ের পর সুখেই সংসার করছিলাম। কিন্তু ২০০৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর দুই পা অকেজো হয়ে যায়। এতে সংসারে অন্ধকার নেমে আসে।
তিনি বলেন, এরপর দৃঢ় মনোবলে সংসারের হাল ধরি। স্বামী ছিল পাশে। নিজেকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলার মানসিকতায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর-এর আওতাধীন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দর্জি প্রশিক্ষণ নেই। ২০১১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও ২০১৮ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাধীন আইজিএ প্রকল্পের অধীনে আবারো দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দর্জির প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি আমি।
তিনি জানান, সমাজের দুস্থ ও অবহেলিত মেয়েদের নিজ বাড়িতে সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এই প্রশিক্ষণ থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে সংসার চলে। দুই কন্যা সন্তান ও দুই পুত্র সন্তানের জননী আমি। কন্যা সন্তানকেও নিজের আয় দিয়ে ভালোভাবে পাত্রস্থ করেছি।
হাজেরা বেগম। ১৯৮৭ সালে এহসানুল আলমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের পর হাজেরা বেগমের ঘর আলো করে জন্ম নেয় তার প্রথম সন্তান আনিকা আলম। এরপর জন্ম নেয় সাদিয়া আলম ও হাসিবুল হাসান ডিও।
বহু কষ্টে তাদের মানুষ করছেন তিনি। বর্তমানে তার প্রথম মেয়ে আনিকা আলম সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। দ্বিতীয় কন্যা সাদিয়া আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্মান করেছেন। আর ছোট সন্তান হাসিবুল হাসান ডিও বুয়েটে সিভিল বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। ডিও নিজে ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়ে নিচ্ছে।
হাজেরা বেগম বলেন, সৌদি প্রবাসী স্বামী এহসানুল হক এক সময় তার সংসারের বাসা ভাড়া দিতেই গড়িমসি করছিল। পুরো সংসারের দায়িত্ব নেয়াটাই ছিল তখন অচিন্তনীয়। এতে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন এককভাবে। দৃঢ়প্রত্যয়ী সফল জননী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।
লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সুখছড়ি গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম রত্না চক্রবর্তীর। বাবা যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মা চবলা বালা চক্রবর্তী খুব আদরেই তাকে বড় করেন। এরই মাঝে রত্না চক্রবর্তীর জীবনে নেমে আসে ভয়াল অন্ধকার।
১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল সুখছড়ি গ্রামটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জনৈক স্থানীয় ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া, রাজাবাড়ী ও কলাউজানে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় পাড়ার হিন্দু পরিবারের লোকজন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ১৮ বছরের রত্না চক্রবর্তীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় দোহাজারী ক্যাম্পে। প্রায় এক মাস রত্না চক্রবর্তীর ওপর চলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর পাশবিক নির্যাতন। এক পর্র্যায়ে তাকে মৃত ভেবে ক্যাম্পের বাইরে ফেলে দেয়।
রত্না চক্রবর্তী বলেন, ওই সময় দোহাজারী সেতুর পাশে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায় বাদল চক্রবর্তী। আত্মীয়স্বজনরা সব জেনে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু দেশ ছেড়ে যায়নি। শেষে বাদল চক্রবর্তীকে পরিবারের অমতেই বিয়ে করি। উদার মানসিকতার বাদল চক্রবর্তীর সঙ্গে খুব সুখেই সংসার কাটছিলো।
কিন্তু এই সুখের জীবনে আবারো নেমে আসে অন্ধকার। স্বামী বাদল চক্রবর্তী হঠাৎ করেই স্ট্রোক করেন। আর তাতে আটকে যায় দু’মাসের বাসা ভাড়া। স্বামীর চিকিৎসা খরচ, বাসা ভাড়া যখন আর বহন করা যাচ্ছিল না তখন ২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর আফমি প্লাজার বিপণি বিতানে ঝাড়ুদারের কাজ নেই। বর্তমানে নগরীর দেওয়ান বাজারের ডিসি রোডের ভরাপুকুরপাড় এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা বাসাভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে থাকি। ৬৬ বছর বয়সেও সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়কে পাথরচাপা দিয়ে রাখছি।
জন্মের মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতৃহারা হন চন্দনা মজুমদার। পাঁচ বছর বয়সে কাকার আশ্রয়ে পিতৃমাতৃ স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। চট্টগ্রামের রাউজানস্থ গহিরা কুণ্ডেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুণ্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার আশায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
চন্দনা মজুমদার জানান, ১৯৮৬ সালের ১২ই মার্চ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা চৌধুরী বাড়িনিবাসী, বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর স্বপন কান্তি চৌধুরীর সঙ্গে বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হই। শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ সমন্বয়ে আমি বাড়িতে একজন পরিপূর্ণ গৃহিণী। সাংসারিক জীবনে স্বামীর ব্যক্তিগত আয় ও পৈতৃক প্রাপ্ত ফসল ছিল জীবনের একমাত্র অবলম্বন। অন্যদিকে, সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সমধিকার আমার পক্ষে ছিল না। তখন থেকে নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করি। ১৯৯০ সালের ১০ই জুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করি। সংসারের অজস্র প্রতিকূল অবস্থায় আমার চাকরি জীবন শুরু হয়।
চন্দনা মজুমদার বলেন, আমার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গত ২০১৮ সালের ২৭শে জানুয়ারি ভারতের ব্যাঙ্গালুরে বাইপাস সার্জারি হয়। ফলে দুর্গাদেবীর দশ হাতের মতো আমাকে পরিবারের, সমাজের দশদিক সামলিয়ে চাকরি জীবন ঠিকভাবেই চালাতে হচ্ছে।
বর্তমানে প্রথম ছেলে শান্তনু রাজ চৌধুরী বি.এম.এ-তে মেজর পদে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত আছেন। একমাত্র কন্যা পূজা চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তার স্বামী চট্টগ্রাম নিটল টাটা অফিসে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত। শুভ রাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিজিএমইএ-মার্চেন্ডাইজিং বিএসসি অনার্স কোর্সে অধ্যয়নরত।
এরই মধ্যে বিগত ১১ই নভেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে প্রধান শিক্ষক (মাইজবিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) পদে পদোন্নতি পেয়ে আমি নিজেকে আরো ধন্য মনে করছি। বর্তমানে একজন স্বনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা মহিলা কর্মবীর বলে আমাকে মনে করি।
তেমনি জীবনযুদ্ধে জয় করেছেন চট্টগ্রামের পাঁচ জয়ীতা।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর আমিরাবাদ গ্রামের বাবুল কর্মকারের স্ত্রী দুলালী কর্মকার। নিজের ও অন্যের পরিবারের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সামাজিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে তিনি হয়েছেন জয়ীতা। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু-নির্যাতন প্রতিরোধে সকলকে সচেতন করছেন তিনি। ব্র্যাক মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচিতে আইন সেবিকা হিসেবে চাকরি করে এলাকার পারিবারিক আইন সম্পর্কে সচেতন করে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছেন তিনি।
দুলালী কর্মকার বলেন, লোহাগাড়া উপজেলার ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির উদ্যোগে দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে ‘পল্লী সমাজ’ নামে সংগঠন তৈরি করেছি। উক্ত সংগঠনে তিনি ২০১২ সাল থেকে সভা প্রধান-এর দায়িত্ব পালন করছি। উক্ত সংগঠনে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিবার ও সমাজ উন্নয়নে কাজ করছি।
রীনা আক্তার একজন আত্মপ্রত্যয়ী ও অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী। সফলতার নানা ধাপ অতিক্রম করে তিনিও হয়েছেন জয়ীতা।
রীনা আক্তার বলেন, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মো. শামসুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। বিয়ের পর সুখেই সংসার করছিলাম। কিন্তু ২০০৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর দুই পা অকেজো হয়ে যায়। এতে সংসারে অন্ধকার নেমে আসে।
তিনি বলেন, এরপর দৃঢ় মনোবলে সংসারের হাল ধরি। স্বামী ছিল পাশে। নিজেকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলার মানসিকতায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর-এর আওতাধীন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দর্জি প্রশিক্ষণ নেই। ২০১১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও ২০১৮ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাধীন আইজিএ প্রকল্পের অধীনে আবারো দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দর্জির প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি আমি।
তিনি জানান, সমাজের দুস্থ ও অবহেলিত মেয়েদের নিজ বাড়িতে সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এই প্রশিক্ষণ থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে সংসার চলে। দুই কন্যা সন্তান ও দুই পুত্র সন্তানের জননী আমি। কন্যা সন্তানকেও নিজের আয় দিয়ে ভালোভাবে পাত্রস্থ করেছি।
হাজেরা বেগম। ১৯৮৭ সালে এহসানুল আলমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের পর হাজেরা বেগমের ঘর আলো করে জন্ম নেয় তার প্রথম সন্তান আনিকা আলম। এরপর জন্ম নেয় সাদিয়া আলম ও হাসিবুল হাসান ডিও।
বহু কষ্টে তাদের মানুষ করছেন তিনি। বর্তমানে তার প্রথম মেয়ে আনিকা আলম সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। দ্বিতীয় কন্যা সাদিয়া আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্মান করেছেন। আর ছোট সন্তান হাসিবুল হাসান ডিও বুয়েটে সিভিল বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। ডিও নিজে ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়ে নিচ্ছে।
হাজেরা বেগম বলেন, সৌদি প্রবাসী স্বামী এহসানুল হক এক সময় তার সংসারের বাসা ভাড়া দিতেই গড়িমসি করছিল। পুরো সংসারের দায়িত্ব নেয়াটাই ছিল তখন অচিন্তনীয়। এতে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন এককভাবে। দৃঢ়প্রত্যয়ী সফল জননী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।
লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সুখছড়ি গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম রত্না চক্রবর্তীর। বাবা যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মা চবলা বালা চক্রবর্তী খুব আদরেই তাকে বড় করেন। এরই মাঝে রত্না চক্রবর্তীর জীবনে নেমে আসে ভয়াল অন্ধকার।
১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল সুখছড়ি গ্রামটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জনৈক স্থানীয় ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া, রাজাবাড়ী ও কলাউজানে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় পাড়ার হিন্দু পরিবারের লোকজন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ১৮ বছরের রত্না চক্রবর্তীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় দোহাজারী ক্যাম্পে। প্রায় এক মাস রত্না চক্রবর্তীর ওপর চলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর পাশবিক নির্যাতন। এক পর্র্যায়ে তাকে মৃত ভেবে ক্যাম্পের বাইরে ফেলে দেয়।
রত্না চক্রবর্তী বলেন, ওই সময় দোহাজারী সেতুর পাশে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায় বাদল চক্রবর্তী। আত্মীয়স্বজনরা সব জেনে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু দেশ ছেড়ে যায়নি। শেষে বাদল চক্রবর্তীকে পরিবারের অমতেই বিয়ে করি। উদার মানসিকতার বাদল চক্রবর্তীর সঙ্গে খুব সুখেই সংসার কাটছিলো।
কিন্তু এই সুখের জীবনে আবারো নেমে আসে অন্ধকার। স্বামী বাদল চক্রবর্তী হঠাৎ করেই স্ট্রোক করেন। আর তাতে আটকে যায় দু’মাসের বাসা ভাড়া। স্বামীর চিকিৎসা খরচ, বাসা ভাড়া যখন আর বহন করা যাচ্ছিল না তখন ২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর আফমি প্লাজার বিপণি বিতানে ঝাড়ুদারের কাজ নেই। বর্তমানে নগরীর দেওয়ান বাজারের ডিসি রোডের ভরাপুকুরপাড় এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা বাসাভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে থাকি। ৬৬ বছর বয়সেও সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়কে পাথরচাপা দিয়ে রাখছি।
জন্মের মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতৃহারা হন চন্দনা মজুমদার। পাঁচ বছর বয়সে কাকার আশ্রয়ে পিতৃমাতৃ স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। চট্টগ্রামের রাউজানস্থ গহিরা কুণ্ডেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুণ্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার আশায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
চন্দনা মজুমদার জানান, ১৯৮৬ সালের ১২ই মার্চ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা চৌধুরী বাড়িনিবাসী, বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর স্বপন কান্তি চৌধুরীর সঙ্গে বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হই। শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ সমন্বয়ে আমি বাড়িতে একজন পরিপূর্ণ গৃহিণী। সাংসারিক জীবনে স্বামীর ব্যক্তিগত আয় ও পৈতৃক প্রাপ্ত ফসল ছিল জীবনের একমাত্র অবলম্বন। অন্যদিকে, সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সমধিকার আমার পক্ষে ছিল না। তখন থেকে নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করি। ১৯৯০ সালের ১০ই জুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করি। সংসারের অজস্র প্রতিকূল অবস্থায় আমার চাকরি জীবন শুরু হয়।
চন্দনা মজুমদার বলেন, আমার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গত ২০১৮ সালের ২৭শে জানুয়ারি ভারতের ব্যাঙ্গালুরে বাইপাস সার্জারি হয়। ফলে দুর্গাদেবীর দশ হাতের মতো আমাকে পরিবারের, সমাজের দশদিক সামলিয়ে চাকরি জীবন ঠিকভাবেই চালাতে হচ্ছে।
বর্তমানে প্রথম ছেলে শান্তনু রাজ চৌধুরী বি.এম.এ-তে মেজর পদে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত আছেন। একমাত্র কন্যা পূজা চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তার স্বামী চট্টগ্রাম নিটল টাটা অফিসে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত। শুভ রাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিজিএমইএ-মার্চেন্ডাইজিং বিএসসি অনার্স কোর্সে অধ্যয়নরত।
এরই মধ্যে বিগত ১১ই নভেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে প্রধান শিক্ষক (মাইজবিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) পদে পদোন্নতি পেয়ে আমি নিজেকে আরো ধন্য মনে করছি। বর্তমানে একজন স্বনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা মহিলা কর্মবীর বলে আমাকে মনে করি।
No comments