ভুল বা সত্য যাই হোক, মোদির রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে ট্রাম্পের কাশ্মির বোমা by সিদ্ধার্থ বরদারাজন
একসময়ের
বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার রোমান্স। ওই সম্পর্কে
শীতলতা দেখা দেওয়ার পর এখন নিশ্চিতভাবেই সিদ্ধান্তসূচক স্থানে পৌঁছে গেছে।
কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে বিরোধ মেটাতে মোদি মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছিলেন বলে ট্রাম্পের দাবিটি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির প্লেবুকের পেছন থেকে ছুরিকাঘাতের মতো বিষয় বিবেচিত হচ্ছে। ট্রাম্প সত্য বলেছেন কিনা তা কোনো ব্যাপার নয়। ওই কথা বলে তিনি স্রেফ একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ফেলেছেন। আর সেটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে করা যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পরিক্রমায় করায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, যা সামাল দেয়া কঠিন কাজ।
ভারতের আনুষ্ঠানিক অস্বীকৃতি এসেছে দ্রুততার সাথে এবং এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। ওই বক্তব্যের ফলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশে রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে মোদি ও তার উপদেষ্টাদের ক্রোধ দ্রুত প্রশমিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাদেরকে এখন অবশ্যই ইরান ও ভেনেজুয়েলা, এশিয়ানীতিতে ট্রাম্পকে এমনভাবে বিশ্বাস করা, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ইচ্ছার আলোকে কাজ করার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
ট্রাম্প কখনো তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা গোপন করেননি। তবে তা কোনো না কোনোভাবে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করার মধ্যেই ছিল বিস্ময়।
মোদির অধীনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাবে তা জানার আগে গত কয়েক ঘণ্টায় কী ঘটেছে, তা জেনে নেয়া যাক।
ওয়াশিংটনে আসলে চলতি মাসের প্রথম দিকে জাপানের ওসাকায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সাথে নিজের শেষ বৈঠক সম্পর্কে অবাক করা দাবি করেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, দুই সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী মোদরি সাথে বৈঠকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আর সত্যিই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি মধ্যস্ততাকারী হতে আগ্রহী কিনা? আমি বলেছিলাম, কোথায়? তিনি বললেন, কাশ্মিরে। কারণ ঘটনাটা অনেক অনেক বছর ধরে চলছে। এটা এত দীর্ঘ দিন ধরে চলছে যে আমি অবাক হয়ে গেছি।
ইমরান খান সাথে সাথে লুফে নিয়ে বললেন, মধ্যস্ততা করে এই ইস্যুটির সমাধান করেন। তখন ট্রাম্প বলেন, আমি মোদির সাথে কথা বলব, দেখি আমরা কী করতে পারি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের কোনো অনুরোধ করেননি। এই অস্বীকারের ফলে আমাদের সামনে চারটি সম্ভাবনা থেকে যায়: প্রথমত, ট্রাম্প পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প সামান্য ইঙ্গিত থেকে বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলে ধরেছেন। তৃতীয়ত, ওসাকায় ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। চতুর্থত, ভারতীয় পক্ষ সত্য বলছেন না।
এসব বিকল্পের মধ্যে আমি চতুর্থটি বাতিল করে দিতে প্রস্তুত। কারণ ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের কাছে বড় শক্তির মধ্যস্ততা কামনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মোদি ও তার উপদেষ্টারা তাদের দীর্ঘ দিনের অবস্থান ত্যাগ করা ও কাশ্মিরে ট্রাম্পকে সম্পৃক্ত করে ভালো কিছু পাবেন বলে বিশ্বাস করবেন, এমনটা কল্পনা করা কঠিন।
তবে আরো তিনটি বিকল্প থেকে যায়। ভুল বোঝাবুঝিই সবচেয়ে ভদ্রোচিত বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু তাতে বিশ্ব ফোরামগুলোতে মোদির তৎপরতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।
অবশ্য এ নিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস ওয়েলস একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে কাশ্মির উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মতো একটি দ্বিপক্ষীয় ইস্যু, ভারত ও পাকিস্তানের এই ইস্যুতে একত্রিত হয়ে বসে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করবে, তা চায় ওয়াশিংটন এবং এতে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।
এতে মনে হচ্ছে, মার্কিন ও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের বক্তব্যের রেশ টানতে নারাজ। তবে পরিস্থিতি ততটা সহজ নয়। পুরো ঘটনাটি ভারতীয় পক্ষের একটি মৌলিক সমস্যা তুলে ধরেছে। আর তা হলো, সারা বিশ্ব যখন শুরুতেই বুঝে ফেলেছিল যে ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার নয়, তখন মোদি ওয়াশিংটনকে আরো কঠোরভাবে আলিঙ্গন করার দিকে নিয়ে গেছেন ভারতকে। আর এ জন্য কতটা মূল্য দিতে হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই।
মোদি যে বিশ্বনেতার প্রশংসায় এত বেশি উদার, সেই তিনিই যদি কাশ্মির প্রশ্নে ভারতীয় অবস্থান নিয়ে উদাসিন থাকেন, তখন মোদির বিচারবোধ নিয়ে কী ধারণা পাওয়া যেতে পারে?
মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ানোর ঝুঁকি গ্রহণ করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। ২০১৬ সালে লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট সই করেন। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ভারতের ব্যবহৃত হওয়াটা নিশ্চিত করা হয়। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনায় মোদি ও তার উপদেষ্টারা মনে করেছিলেন যে মার্কিনিদের সঙ্গী হলে ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
কিন্তু গত আড়াই বছর ধরে ইরান, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ইত্যাদি ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসন যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠতম মিত্ররা ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্নই হয়েছে। তবে মোদি ও জাপানের শিনজো অ্যাবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব নেতা হিসেবে ট্রাম্প প্রশ্নে জুয়া খেলতে রাজি। এমনকি তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমন সক্রিয়ভাবে কামনা করছেন অ্যাবে। আর ভারত নিরাপদ দূরত্বে বসে তা দেখছে কেবল।
ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যে পশ্চিম এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মোদি কমিউনিকেশন্স কম্পাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিও এমসিএএসএ) সই করার মাধ্যমে পেন্টাগনের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
মোদি ও তার উপদেষ্টারা মৌলিক যে ভুল হিসাব করছেন তা হলো এই যে – বাস্তব চিত্র নেতিবাচক হলেও ব্যক্তিগত রসায়ন কোনো না কোনোভাবে ভারতের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। কিন্তু আরো খারাপ বিষয় হলো লক্ষ্য নির্ধারণেও ভুল করা।
প্রথম মেয়াদে ওই সময়ের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠক আয়োজনের বিপর্যয়কর ব্যবস্থা করেছিলেন এই আশায় যে এর ফলে পরমাণু সরবরাহ গ্রপের সদস্য হতে ভারতকে সহায়তা করবে চীন। ওই সময়ে এনএসজির সদস্যপদ ভারতের জন্য তেমন লাভজনক না হলেও ঘরোয়া রাজনীতিতে তা হতে পারত বড় ধরনের সাফল্য। এর ফলাফল কী হয়েছিল? ভারত চেয়েছিল সে ঘোষিত হবে পরমাণু জগতের দায়িত্বশীল দেশ আর পাকিস্তান পরিচিত হবে দায়িত্বহীন রাষ্ট্র। কিন্তু বেইজিং এনএসজির সদস্যপদের জন্য ইসলামাবাদ ও নয়া দিল্লির মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। দুই দেশকেই সে একসাথে সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে।
তাড়াহুড়া করে মাসুদ আজহারকে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী তালিকায় ফেলাও ছিল প্রথম মেয়াদে মোদির কূটনীতিক সাফল্যের একটি বহুল প্রচারিত বিষয়। বাস্তবে এই অর্থহীন অর্জনের বিনিময়ে ট্রাম্প মধ্যস্ততা করার দায়িত্ব পেয়ে যান। ট্রাম্প এই দায়িত্বের প্রথম কাজটি করেছিলেন পাকিস্তানে অবতরণ করা ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে।
মোদি সরকার দ্বিতীয় ভুলটি করেছিল ইরানের ওপর চাপ দেয়া, রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা বাড়ানো ও চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক স্নায়ুযুদ্ধের মতো ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কৌশলে সামিল হয়ে। দুই বছর আগে ভিন্ন সুরে কথা বললেও ট্রাম্প এখন বুঝতে পেরেছেন যে ইরান ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্কে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটেই ইমরান খানের হোয়াইট হাউস সফর হচ্ছে। আর এর মধ্যেই মধ্যস্ততা করার কথাটি বললেন ট্রাম্প।
বর্তমান বিরোধের অবসান ঘটলে মোদি ও তার উপদেষ্টাদের প্রয়োজন হবে নতুন করে পরিকল্পনা প্রণয়নের। ওয়াশিংটনের ঝুড়িতে এত ডিম রাখা এবং মস্কো, বেইজিং ও তেহরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাকে অবহেলা করাটা ছিল মৌলিক ভুল। সর্বোপরি পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ়, যৌক্তিক নীতির অনুপস্থিতির ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়। মোদির সৌভাগ্য, তিনি তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সুযোগ পেয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে বিরোধ মেটাতে মোদি মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছিলেন বলে ট্রাম্পের দাবিটি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির প্লেবুকের পেছন থেকে ছুরিকাঘাতের মতো বিষয় বিবেচিত হচ্ছে। ট্রাম্প সত্য বলেছেন কিনা তা কোনো ব্যাপার নয়। ওই কথা বলে তিনি স্রেফ একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ফেলেছেন। আর সেটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে করা যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পরিক্রমায় করায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, যা সামাল দেয়া কঠিন কাজ।
ভারতের আনুষ্ঠানিক অস্বীকৃতি এসেছে দ্রুততার সাথে এবং এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। ওই বক্তব্যের ফলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশে রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে মোদি ও তার উপদেষ্টাদের ক্রোধ দ্রুত প্রশমিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাদেরকে এখন অবশ্যই ইরান ও ভেনেজুয়েলা, এশিয়ানীতিতে ট্রাম্পকে এমনভাবে বিশ্বাস করা, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ইচ্ছার আলোকে কাজ করার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
ট্রাম্প কখনো তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা গোপন করেননি। তবে তা কোনো না কোনোভাবে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করার মধ্যেই ছিল বিস্ময়।
মোদির অধীনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাবে তা জানার আগে গত কয়েক ঘণ্টায় কী ঘটেছে, তা জেনে নেয়া যাক।
ওয়াশিংটনে আসলে চলতি মাসের প্রথম দিকে জাপানের ওসাকায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সাথে নিজের শেষ বৈঠক সম্পর্কে অবাক করা দাবি করেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, দুই সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী মোদরি সাথে বৈঠকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আর সত্যিই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি মধ্যস্ততাকারী হতে আগ্রহী কিনা? আমি বলেছিলাম, কোথায়? তিনি বললেন, কাশ্মিরে। কারণ ঘটনাটা অনেক অনেক বছর ধরে চলছে। এটা এত দীর্ঘ দিন ধরে চলছে যে আমি অবাক হয়ে গেছি।
ইমরান খান সাথে সাথে লুফে নিয়ে বললেন, মধ্যস্ততা করে এই ইস্যুটির সমাধান করেন। তখন ট্রাম্প বলেন, আমি মোদির সাথে কথা বলব, দেখি আমরা কী করতে পারি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের কোনো অনুরোধ করেননি। এই অস্বীকারের ফলে আমাদের সামনে চারটি সম্ভাবনা থেকে যায়: প্রথমত, ট্রাম্প পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প সামান্য ইঙ্গিত থেকে বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলে ধরেছেন। তৃতীয়ত, ওসাকায় ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। চতুর্থত, ভারতীয় পক্ষ সত্য বলছেন না।
এসব বিকল্পের মধ্যে আমি চতুর্থটি বাতিল করে দিতে প্রস্তুত। কারণ ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের কাছে বড় শক্তির মধ্যস্ততা কামনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মোদি ও তার উপদেষ্টারা তাদের দীর্ঘ দিনের অবস্থান ত্যাগ করা ও কাশ্মিরে ট্রাম্পকে সম্পৃক্ত করে ভালো কিছু পাবেন বলে বিশ্বাস করবেন, এমনটা কল্পনা করা কঠিন।
তবে আরো তিনটি বিকল্প থেকে যায়। ভুল বোঝাবুঝিই সবচেয়ে ভদ্রোচিত বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু তাতে বিশ্ব ফোরামগুলোতে মোদির তৎপরতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।
অবশ্য এ নিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস ওয়েলস একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে কাশ্মির উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মতো একটি দ্বিপক্ষীয় ইস্যু, ভারত ও পাকিস্তানের এই ইস্যুতে একত্রিত হয়ে বসে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করবে, তা চায় ওয়াশিংটন এবং এতে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।
এতে মনে হচ্ছে, মার্কিন ও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের বক্তব্যের রেশ টানতে নারাজ। তবে পরিস্থিতি ততটা সহজ নয়। পুরো ঘটনাটি ভারতীয় পক্ষের একটি মৌলিক সমস্যা তুলে ধরেছে। আর তা হলো, সারা বিশ্ব যখন শুরুতেই বুঝে ফেলেছিল যে ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার নয়, তখন মোদি ওয়াশিংটনকে আরো কঠোরভাবে আলিঙ্গন করার দিকে নিয়ে গেছেন ভারতকে। আর এ জন্য কতটা মূল্য দিতে হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই।
মোদি যে বিশ্বনেতার প্রশংসায় এত বেশি উদার, সেই তিনিই যদি কাশ্মির প্রশ্নে ভারতীয় অবস্থান নিয়ে উদাসিন থাকেন, তখন মোদির বিচারবোধ নিয়ে কী ধারণা পাওয়া যেতে পারে?
মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ানোর ঝুঁকি গ্রহণ করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। ২০১৬ সালে লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট সই করেন। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ভারতের ব্যবহৃত হওয়াটা নিশ্চিত করা হয়। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনায় মোদি ও তার উপদেষ্টারা মনে করেছিলেন যে মার্কিনিদের সঙ্গী হলে ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
কিন্তু গত আড়াই বছর ধরে ইরান, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ইত্যাদি ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসন যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠতম মিত্ররা ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্নই হয়েছে। তবে মোদি ও জাপানের শিনজো অ্যাবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব নেতা হিসেবে ট্রাম্প প্রশ্নে জুয়া খেলতে রাজি। এমনকি তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমন সক্রিয়ভাবে কামনা করছেন অ্যাবে। আর ভারত নিরাপদ দূরত্বে বসে তা দেখছে কেবল।
ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যে পশ্চিম এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মোদি কমিউনিকেশন্স কম্পাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিও এমসিএএসএ) সই করার মাধ্যমে পেন্টাগনের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
মোদি ও তার উপদেষ্টারা মৌলিক যে ভুল হিসাব করছেন তা হলো এই যে – বাস্তব চিত্র নেতিবাচক হলেও ব্যক্তিগত রসায়ন কোনো না কোনোভাবে ভারতের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। কিন্তু আরো খারাপ বিষয় হলো লক্ষ্য নির্ধারণেও ভুল করা।
প্রথম মেয়াদে ওই সময়ের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠক আয়োজনের বিপর্যয়কর ব্যবস্থা করেছিলেন এই আশায় যে এর ফলে পরমাণু সরবরাহ গ্রপের সদস্য হতে ভারতকে সহায়তা করবে চীন। ওই সময়ে এনএসজির সদস্যপদ ভারতের জন্য তেমন লাভজনক না হলেও ঘরোয়া রাজনীতিতে তা হতে পারত বড় ধরনের সাফল্য। এর ফলাফল কী হয়েছিল? ভারত চেয়েছিল সে ঘোষিত হবে পরমাণু জগতের দায়িত্বশীল দেশ আর পাকিস্তান পরিচিত হবে দায়িত্বহীন রাষ্ট্র। কিন্তু বেইজিং এনএসজির সদস্যপদের জন্য ইসলামাবাদ ও নয়া দিল্লির মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। দুই দেশকেই সে একসাথে সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে।
তাড়াহুড়া করে মাসুদ আজহারকে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী তালিকায় ফেলাও ছিল প্রথম মেয়াদে মোদির কূটনীতিক সাফল্যের একটি বহুল প্রচারিত বিষয়। বাস্তবে এই অর্থহীন অর্জনের বিনিময়ে ট্রাম্প মধ্যস্ততা করার দায়িত্ব পেয়ে যান। ট্রাম্প এই দায়িত্বের প্রথম কাজটি করেছিলেন পাকিস্তানে অবতরণ করা ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে।
মোদি সরকার দ্বিতীয় ভুলটি করেছিল ইরানের ওপর চাপ দেয়া, রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা বাড়ানো ও চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক স্নায়ুযুদ্ধের মতো ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কৌশলে সামিল হয়ে। দুই বছর আগে ভিন্ন সুরে কথা বললেও ট্রাম্প এখন বুঝতে পেরেছেন যে ইরান ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্কে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটেই ইমরান খানের হোয়াইট হাউস সফর হচ্ছে। আর এর মধ্যেই মধ্যস্ততা করার কথাটি বললেন ট্রাম্প।
বর্তমান বিরোধের অবসান ঘটলে মোদি ও তার উপদেষ্টাদের প্রয়োজন হবে নতুন করে পরিকল্পনা প্রণয়নের। ওয়াশিংটনের ঝুড়িতে এত ডিম রাখা এবং মস্কো, বেইজিং ও তেহরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাকে অবহেলা করাটা ছিল মৌলিক ভুল। সর্বোপরি পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ়, যৌক্তিক নীতির অনুপস্থিতির ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়। মোদির সৌভাগ্য, তিনি তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সুযোগ পেয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
No comments