‘তুইতোকারিকে’ কেন্দ্র করে চার খুন by মারুফ কিবরিয়া
তুচ্ছ
ঘটনা। ছোট-বড় দ্বন্দ্ব, প্রেম সংক্রান্ত বিরোধ কিংবা মাদক। ঘটনাগুলোকে
কেন্দ্র করে দেশজুড়ে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
প্রাণ যাচ্ছে একের পর এক কিশোরের। শুধু ‘তুই’ করে বলাতেই গত ৩ বছরে
রাজধানীতে খুন হয়েছে চারজন। এছাড়া প্রেম সংক্রান্ত বিরোধ, মাদক ও আধিপত্য
বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৫ বছরে ৯৯টি খুনের সঙ্গে তিনশ’র বেশি কিশোর
জড়িত। ২০১৭ সালের ১৮ই জানুয়ারি রাজধানীর তেজকুনী পাড়ায় খুন হয় কিশোর আবদুল
আজিজ। একই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর দক্ষিণখানের কেসি হাসপাতালের সামনে খুন হয়
কিশোর মেহেদী হাসান।
চলতি বছরের ২১শে মার্চ উত্তরখানে টেকপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র কামরুল হাসান হৃদয়। সর্বশেষ রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ছুরিকাঘাতে খুন হয় কলেজছাত্র শাওন। এই সবক’টি খুনের নেপথ্যে ‘তুই’ করে বলা। এসব খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমনটাই স্বীকার করেছে তারা। তবে এইসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হলেও সব আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তারা এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ খুন হওয়া গেণ্ডারিয়ার কিশোর শাওনের খুনের ঘটনায় ৭ জন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে গেণ্ডারিয়া থানা পুলিশ।
এ বিষয়ে গেণ্ডারিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) এমএ জলিল মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় আমরা মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এর মধ্যে ৩ জন এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। মূলত ছোট-বড় আর এলাকায় দাপট দেখানোকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত কেউই স্কুল-কলেজের ছাত্র নয়। তারা সবাই টোকাই। উত্তরখানের কিশোর হৃদয় হত্যার ৪ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে উত্তরখান থানার পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, হৃদয় খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা আদালতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। একবছর আগে ফেসবুকে ‘ঈগল’ নামে একটি গ্রুপ খুলে তারা। কে কাকে বড় ভাই বলে ডাকবে, কে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে এসব আলোচনা হতো ওই গ্রুপে। সামান্য কিছু হলেই একজন আরেকজনকে হুমকিধমকি দিতো। একদিন গ্রুপে কথা বলার সময় সামান্য বিষয় নিয়ে রনি নামের একজনের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় হৃদয়ের। আর এর জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড।
রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোরদের এসব অপরাধের তৎপরতা আশঙ্কা জনক হারে বেড়ে গেছে।
দেশজুড়ে অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রতিনিয়ত নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষত খুন, মারামারি, ধর্ষন এবং মাদকের মতো বড় অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। গত ৭ই জুলাই গাজীপুরের শুভ আহমেদ নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারই প্রতিপক্ষ একদল কিশোর। বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড বলে জানিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। শুভ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। ওই দিন গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব-থানাধীন বিসিক ফকির মার্কেট পাগার মদিনাপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব-শত্রুতার জেরে স্থানীয় পাগার ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র শুভ আহমেদকে বুকে, পিঠে ও মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করা হয়। নিহত শুভ আহমেদ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ঘটনার পর দিন নিহতের বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ব্যবসায়ীপুত্র কিশোর আদনান কবির। তার আগে ২০১৫ সালের মে মাসে উত্তরায় রিয়াজুর হাসান অনিক নামে এক কিশোর খুন হয় এই গ্যাংয়ের হাতে। মার্চ মাসেই রাজধানীর হাজারীবাগের টালি অফিস এলাকায় ১৫ বছরের কিশোর ইয়াসিন আরাফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল কিশোর। আর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য খুঁজতে গিয়ে পুলিশের নজরে আসে কিশোর গ্যাংভিত্তিক চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। এ ছাড়াও ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যার পর আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং- সেভেন স্টার, থ্রি স্টার, গ্যাং স্টার, বিগবস, ডিসকো বয়েজ উত্তরা, পাওয়ার বয়েজ উত্তরা, দাদা বয়েজ, আরটি, এক্স, ০৭, ০৯, নাইনএমএম বয়েজ উত্তরা ও নাইন স্টারসহ বেশকিছু গ্রুপ। বর্তমানেও উত্তরা, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বাড্ডা, বারিধারা, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, ওয়ারী, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও মিরপুরসহ রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় মহল্লা বা এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। রাজধানীর বাইরেও জেলা শহরে, উপজেলা পর্যায়েও এমন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফেসবুক পেজ, মেসেঞ্জার, ইমো ও ভাইবারসহ নানা অ্যাপ ব্যবহার করে তাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় রয়েছে ২০-২৫টি কিশোর গ্যাং। এসব কিশোর প্রায়ই হিংস্র্রতায় মেতে উঠছে। রক্ত ঝরাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে অন্তত ছয়টি গ্যাং। দিনভর বখাটেপনা করে বেড়ানো এবং আড্ডা দেয়াই এদের কাজ। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয় থাকে এরা। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, ফয়’স লেক, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশী, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসেরপাড়া, ফরিদেরপাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর ও বন্দর কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সরব উপস্থিতি। মাদক, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই কিশোররা। এলাকায় সবসময় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপরতা চালায়। এর জের ধরেই জামালখান এলাকায় হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফারকে।
কুমিল্লায় ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোরদের বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপ। এমনই একটি গ্রুপের নাম ‘ঈগল’। যাদের হামলায় প্রাণ যায় কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুল থেকে সদ্য এসএসসি পাস করা আজনাইন আদিল (১৭)। নগরজুড়ে আলোচনায় এখনও ‘ঈগল’-‘র্যাগ’সহ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর নাম। চলতি বছরেই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং শহরের এসবি প্লাজার তিনটি দোকান থেকে অন্তত ৭শ’ আধুনিক ছোরা ও চাপাতি উদ্ধার করে।
এদিকে ঢাকার শিশু আদালত সূত্র বলছে, এই আদালতে ২০১৮ সালের ৩১শে নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ছিল ১ হাজার ৩৮১টি মামলা। এর মধ্যে খুনের মামলা ৮৬টি। এসব খুন হয়েছে গত ১৫ বছরে। দেড় শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ। এ বছর ১৯শে জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং শিশু আদালতের বিচারিক নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সব মিলিয়ে ঢাকায় ৯৯ খুনের মামলায় তিনশ’র বেশি কিশোর জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে গত দেড় বছরেই ঘটেছে ১৩টি খুন। এতে জড়িত অন্তত ১২০ কিশোর। এদের নাম উল্লেখ করে খুনের মামলাও হয়েছে। তার মধ্যে ২৭ জনকে আদালতের মাধ্যমে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
কিশোরদের এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, কিশোর অপরাধের বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। কেননা এ সময় বয়সের কারণে বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু কিশোর নিজেদের অজান্তেই অপরাধে জড়িয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। কিছু কিশোর হয়তো অনেক সময় বিপথে চলে যায়। তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পুলিশ সব সময় তৎপর। যাতে কিশোররা অপরাধের সংস্পর্শে আসতে না পারে এজন্য আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়ায়ও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব, পারিবারিক অসচেতনতা, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও আকাশ-সংস্কৃতিসহ নানা কারণে সমাজে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে কিশোরদের মধ্যেও। এ ছাড়া পারিবারিক বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে যাওয়া ও ভিডিও গেমসহ নানা কারণে আস্তে আস্তে কিশোররা হিংস্র হয়ে উঠছে। ভিডিও গেমসের প্রভাবে কিশোররা মানসিকভাবে নিজেদের রোবটিক হিরো ভাবছে। সেই ভাবনা থেকে অনেক সময় সমবয়সী ও সমমনা কিশোররা মিলে গড়ে তুলছে একেকটি গ্রুপ বা গ্যাং। তৌহিদুল হক আরো বলেন, এসব অপরাধ থেকে কিশোরদের দূরে রাখতে সাংস্কৃতিকচর্চা ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানোর পাশাপাশি অভিভাবক তথা পরিবার ও সমাজকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানদের খোঁজখবর রাখতে হবে। সন্তানরা কখন কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে- এসব বিষয়ে মনিটরিং করা জরুরি। পাশাপাশি অভিভাবকদের সন্তানদের জন্য বেশি বেশি সময় দিতে হবে।
চলতি বছরের ২১শে মার্চ উত্তরখানে টেকপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র কামরুল হাসান হৃদয়। সর্বশেষ রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ছুরিকাঘাতে খুন হয় কলেজছাত্র শাওন। এই সবক’টি খুনের নেপথ্যে ‘তুই’ করে বলা। এসব খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমনটাই স্বীকার করেছে তারা। তবে এইসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হলেও সব আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তারা এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ খুন হওয়া গেণ্ডারিয়ার কিশোর শাওনের খুনের ঘটনায় ৭ জন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে গেণ্ডারিয়া থানা পুলিশ।
এ বিষয়ে গেণ্ডারিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) এমএ জলিল মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় আমরা মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এর মধ্যে ৩ জন এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। মূলত ছোট-বড় আর এলাকায় দাপট দেখানোকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত কেউই স্কুল-কলেজের ছাত্র নয়। তারা সবাই টোকাই। উত্তরখানের কিশোর হৃদয় হত্যার ৪ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে উত্তরখান থানার পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, হৃদয় খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা আদালতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। একবছর আগে ফেসবুকে ‘ঈগল’ নামে একটি গ্রুপ খুলে তারা। কে কাকে বড় ভাই বলে ডাকবে, কে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে এসব আলোচনা হতো ওই গ্রুপে। সামান্য কিছু হলেই একজন আরেকজনকে হুমকিধমকি দিতো। একদিন গ্রুপে কথা বলার সময় সামান্য বিষয় নিয়ে রনি নামের একজনের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় হৃদয়ের। আর এর জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড।
রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোরদের এসব অপরাধের তৎপরতা আশঙ্কা জনক হারে বেড়ে গেছে।
দেশজুড়ে অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রতিনিয়ত নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষত খুন, মারামারি, ধর্ষন এবং মাদকের মতো বড় অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। গত ৭ই জুলাই গাজীপুরের শুভ আহমেদ নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারই প্রতিপক্ষ একদল কিশোর। বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড বলে জানিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। শুভ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। ওই দিন গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব-থানাধীন বিসিক ফকির মার্কেট পাগার মদিনাপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব-শত্রুতার জেরে স্থানীয় পাগার ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র শুভ আহমেদকে বুকে, পিঠে ও মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করা হয়। নিহত শুভ আহমেদ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ঘটনার পর দিন নিহতের বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ব্যবসায়ীপুত্র কিশোর আদনান কবির। তার আগে ২০১৫ সালের মে মাসে উত্তরায় রিয়াজুর হাসান অনিক নামে এক কিশোর খুন হয় এই গ্যাংয়ের হাতে। মার্চ মাসেই রাজধানীর হাজারীবাগের টালি অফিস এলাকায় ১৫ বছরের কিশোর ইয়াসিন আরাফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল কিশোর। আর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য খুঁজতে গিয়ে পুলিশের নজরে আসে কিশোর গ্যাংভিত্তিক চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। এ ছাড়াও ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যার পর আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং- সেভেন স্টার, থ্রি স্টার, গ্যাং স্টার, বিগবস, ডিসকো বয়েজ উত্তরা, পাওয়ার বয়েজ উত্তরা, দাদা বয়েজ, আরটি, এক্স, ০৭, ০৯, নাইনএমএম বয়েজ উত্তরা ও নাইন স্টারসহ বেশকিছু গ্রুপ। বর্তমানেও উত্তরা, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বাড্ডা, বারিধারা, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, ওয়ারী, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও মিরপুরসহ রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় মহল্লা বা এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। রাজধানীর বাইরেও জেলা শহরে, উপজেলা পর্যায়েও এমন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফেসবুক পেজ, মেসেঞ্জার, ইমো ও ভাইবারসহ নানা অ্যাপ ব্যবহার করে তাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় রয়েছে ২০-২৫টি কিশোর গ্যাং। এসব কিশোর প্রায়ই হিংস্র্রতায় মেতে উঠছে। রক্ত ঝরাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে অন্তত ছয়টি গ্যাং। দিনভর বখাটেপনা করে বেড়ানো এবং আড্ডা দেয়াই এদের কাজ। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয় থাকে এরা। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, ফয়’স লেক, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশী, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসেরপাড়া, ফরিদেরপাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর ও বন্দর কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সরব উপস্থিতি। মাদক, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই কিশোররা। এলাকায় সবসময় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপরতা চালায়। এর জের ধরেই জামালখান এলাকায় হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফারকে।
কুমিল্লায় ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোরদের বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপ। এমনই একটি গ্রুপের নাম ‘ঈগল’। যাদের হামলায় প্রাণ যায় কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুল থেকে সদ্য এসএসসি পাস করা আজনাইন আদিল (১৭)। নগরজুড়ে আলোচনায় এখনও ‘ঈগল’-‘র্যাগ’সহ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর নাম। চলতি বছরেই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং শহরের এসবি প্লাজার তিনটি দোকান থেকে অন্তত ৭শ’ আধুনিক ছোরা ও চাপাতি উদ্ধার করে।
এদিকে ঢাকার শিশু আদালত সূত্র বলছে, এই আদালতে ২০১৮ সালের ৩১শে নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ছিল ১ হাজার ৩৮১টি মামলা। এর মধ্যে খুনের মামলা ৮৬টি। এসব খুন হয়েছে গত ১৫ বছরে। দেড় শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ। এ বছর ১৯শে জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং শিশু আদালতের বিচারিক নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সব মিলিয়ে ঢাকায় ৯৯ খুনের মামলায় তিনশ’র বেশি কিশোর জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে গত দেড় বছরেই ঘটেছে ১৩টি খুন। এতে জড়িত অন্তত ১২০ কিশোর। এদের নাম উল্লেখ করে খুনের মামলাও হয়েছে। তার মধ্যে ২৭ জনকে আদালতের মাধ্যমে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
কিশোরদের এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, কিশোর অপরাধের বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। কেননা এ সময় বয়সের কারণে বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু কিশোর নিজেদের অজান্তেই অপরাধে জড়িয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। কিছু কিশোর হয়তো অনেক সময় বিপথে চলে যায়। তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পুলিশ সব সময় তৎপর। যাতে কিশোররা অপরাধের সংস্পর্শে আসতে না পারে এজন্য আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়ায়ও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব, পারিবারিক অসচেতনতা, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও আকাশ-সংস্কৃতিসহ নানা কারণে সমাজে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে কিশোরদের মধ্যেও। এ ছাড়া পারিবারিক বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে যাওয়া ও ভিডিও গেমসহ নানা কারণে আস্তে আস্তে কিশোররা হিংস্র হয়ে উঠছে। ভিডিও গেমসের প্রভাবে কিশোররা মানসিকভাবে নিজেদের রোবটিক হিরো ভাবছে। সেই ভাবনা থেকে অনেক সময় সমবয়সী ও সমমনা কিশোররা মিলে গড়ে তুলছে একেকটি গ্রুপ বা গ্যাং। তৌহিদুল হক আরো বলেন, এসব অপরাধ থেকে কিশোরদের দূরে রাখতে সাংস্কৃতিকচর্চা ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানোর পাশাপাশি অভিভাবক তথা পরিবার ও সমাজকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানদের খোঁজখবর রাখতে হবে। সন্তানরা কখন কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে- এসব বিষয়ে মনিটরিং করা জরুরি। পাশাপাশি অভিভাবকদের সন্তানদের জন্য বেশি বেশি সময় দিতে হবে।
No comments