প্রথম-লঘু অপরাধে শাস্তি নয়, ‘শিক্ষানবিশ আইন’ চূড়ান্ত by এস এম আববাস
জীবনে
প্রথম ও লঘু অপরাধের জন্য কাউকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে
১৯৬০ সালের ‘প্রবেশন অর্ডিন্যান্স’কে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই লক্ষ্যে ‘শিক্ষানবিশ আইন’ (Probation Act-2018)-এর খসড়া চূড়ান্ত করা
হয়েছে। এর ফলে জীবনে সংঘটিত প্রথম কিংবা লঘু অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি
সংশোধনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাবেন। সমাজকল্যাণ
মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ১৯৬০ সালের ‘প্রবেশন অর্ডিন্যান্স’ যুগোপযোগী করে নতুন খসড়া আইন চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। নতুন করে এই আইনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিক্ষানবিশ আইন’। আইনটি চূড়ান্ত হলে অপরাধীদের সংশোধন কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সমাজ সেবা অধিদফতরের উপপরিচালক (চিকিৎসা ও প্রবেশন) লাইমা ইয়াসমিন বলেন, ‘১৯৬০ সালের প্রবেশন অর্ডিন্যান্স যুগোপযোগী করে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। খসড়াটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোও হয়েছে। জীবনে প্রথম ও লঘু অপরাধে কাউকে জেল না দিয়ে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতেই আইনটি করা হচ্ছে। যেন অপরাধীরা সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে আসতে পারে।’
প্রবেশন বা শিক্ষানবিশ
লঘু ও প্রথম অপরাধী এবং অপরাধের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য পরিচালিত কার্যক্রম হচ্ছে প্রবেশন। ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০’ অনুযায়ী কারাদণ্ড পাওয়া নারীদের ‘বিশেষ সুবিধা আইন-২০০৬’ ও ‘শিশু আইন-২০১৩’ অনুসারে সমাজসেবা অধিদফতর প্রবেশন ও আফটার কেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এসব আইন ছাড়াও নতুন খসড়ায় ২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সুরক্ষা আইন’ অনুযায়ী শিক্ষানবিশ কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষানবিশ হিসেবে সুযোগ পাবেন যারা
যেসব অপরাধীর আগে কোনও আদালতে কোনও দণ্ড হয়নি, তারা নির্ধারিত শর্তে মুক্তি পাবেন। অপরাধীর বয়স, চরিত্র, প্রাক-পরিচয়, অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধ সংঘটনে সংশ্লিষ্টতা বিবেচনা করে যেকোনও বয়সের নারী-পুরুষকে শিক্ষানবিশ হিসেবে মুক্তি দিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট আদালত।
অনূর্ধ্ব দুই বছরের সাজা পাওয়া কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স, চরিত্র, প্রাক-পরিচয় অথবা শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষানবিশ আদেশ দিতে পারবেন আদালত। অপরাধীর শারীরিক-মানসিক অবস্থা, অপরাধের প্রকৃতি ও অপরাধ লাঘবে তার সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আদালত শিক্ষানবিশ আদেশ দেবেন বিচারক।
দণ্ডাদেশের পর দণ্ডিত ব্যক্তির আবেদন জানানোর পর নির্ধারিত আদালত এসব বিবেচনায় শিক্ষানবিশ হিসেবে আদেশ দেবেন।
যেসব আদালত শিক্ষানবিশ আদেশ দেবেন
সাজা পাওয়া কোনও আসামিকে শিক্ষানবিশ আদেশ পেতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালতে আবেদন জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, দায়রা জজ আদালত অথবা মহানগর দায়রা জজ আদালত, অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত অথবা অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত অথবা মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম অথবা অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম, সিনিয়র বিচারিক হাকিম অথবা মহানগর বিচারিক আদালত ও বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিচারিত হাকিম এই আদেশ দেবেন।
যেসব অপরাধে কোনও ব্যক্তি শিক্ষানবিশ আদেশের অযোগ্য হবেন
কোনও ব্যক্তির দণ্ডবিধির ২১৬-এ, ৩২৮, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪০২, ৪৫৫ অথবা ৪৫৮ ধারার অপরাধে শাস্তি হলে অথবা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা হলে অপরাধী শিক্ষানবিশ আদেশের অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
উল্লিখিত ধারার অপরাধগুলো হলো, দস্যু বা ডাকাতকে আশ্রয় দেওয়া; হত্যার উদ্দেশ্যে বিষপ্রয়োগ; কাউকে হত্যা বা গুরুতর আঘাতের ভয় দেখিয়ে কোনও কিছু আদায় করা; কোনও কিছু আদায় করার উদ্দেশ্যে কাউকে খুন বা গুরুতর আঘাতের ভয় দেখানো; মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করার মতো অপরাধের ভয় দেখিয়ে কোনও কিছু আদায় করা; কোনও কিছু আদায়ের উদ্দেশ্যে কাউকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত করার ভয় দেখানো, দস্যুতার উদ্যোগ নেওয়া; হত্যা বা গুরুতর আঘাতের উদ্দেশ্যসহ দস্যুতা বা ডাকাতি করা; মারাত্মক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দস্যুতা বা ডাকাতির উদ্যোগ নেওয়া; ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়া; চোরের দলভুক্ত হওয়া; ডাকাতির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া; আঘাত-আক্রমণ বা অবৈধ আটকের প্রস্তুতি নেওয়ার পর গোপনে অনধিকার গৃহপ্রবেশ; কিংবা আঘাত-আক্রমণ বা অবৈধ আটকের প্রস্তুতি নেওয়ার পর রাতের বেলা গোপনে অনধিকার কারও ঘরে গৃহপ্রবেশের মতো অপরাধ।
এসব অপরাধ ছাড়া অন্য যেকোনও অপরাধে সাজা হলে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশের জন্য আবেদন করা যাবে। তবে মৃত্যদণ্ড ছাড়া যেকোনও নারী অথবা প্রতিবন্ধী যদি কোনও অপরাধে সাজা হয়, তাহলে সাজা থেকে মুক্তি পেতে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশের জন্য নির্ধারিত আদলতে আবেদন করা যাবে।
যেসব শর্তে মুক্তি দেওয়া হবে
আদালতের দেওয়া নির্ধারিত সময়ে আর কোনও অপরাধ না করা, শান্তি বজায় রাখা, ভালো আচরণ করা, নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির হওয়া ও শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকার শর্তে অঙ্গীকার করে মুচলেকা (অথবা জামিনদারসহ অথবা জরিমানা ছাড়া) দেওয়ার শর্তে আদালত ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশ দিতে পারবেন। তবে অপরাধীর স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে তার অথবা তার কোনও জামিনদারের বসবাসের নির্দিষ্ট স্থান অথবা নিয়মিত জীবিকা থাকে এবং মুচলেকার সময় ওই স্থানে বসবাস করার অথবা জীবিকা নির্বাহ করার সম্ভাবনা থাকে এবং স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে মুচলেকার মেয়াদকালে বসবাস করার অথবা জীবিকা অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশ দেবেন আদালত। অর্থাৎ এসব বিষয়ে আদালত সন্তুষ্ট হলে সংশোধনের মাধ্যমে মুক্তি পাবেন অপরাধী। এসব শর্ত পূরণ না হলেও আদালত অপরাধীকে শিক্ষানবিশ হিসেবে তার অবস্থানের জন্য কোনও শিক্ষানবিশ আবাসস্থলে পাঠানোর আদেশ দিতে পারবেন। অপরাধীকে অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য মামলার বিশেষ পরিস্থিতির আলোকে আদালত যেমন মনে করবেন, তেমন শর্ত মুচলেকায় যুক্ত করতে পারবেন।
শিক্ষানবিশ মঞ্জুরের আবেদন
আইনজীবী অথবা আইনগত প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে কোনও মামলা ও দণ্ড সম্পর্কে জেনে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে অপরাধীকে শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি অথবা শিক্ষানবিশ মঞ্জুরের জন্য বিচারিক আদলতে আবেদন করতে পারবেন। বিচারিক আদালত অপরাধীকে দেওয়া আদেশ বিবেচনা করে শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি অথবা শিক্ষানবিশ মঞ্জুর করতে পারবেন। আদালত উপযুক্ত মনে করলে অপরাধীকে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা আহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ এবং মামলার ব্যয় নির্বাহ করার আদেশ দিতে পারবেন।
মুচলেকার শর্ত পূরণের ব্যবস্থা হলে অপরাধী অথবা জামিনদারের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারবেন আদালত। শর্ত ভঙ্গ করলে আদালত অপরাধীকে মূল অপরাধের জন্য দণ্ডিত করতে পারবেন।
শিক্ষানবিশ কার্যালয়
শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য শিক্ষানবিশ অধিশাখা এবং ক্ষেত্রমতে প্রতি বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মহানগর এলাকার জনবলসহ শিক্ষানবিশ কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে সরকার। জেলা ও মহানগর এলাকায় শিক্ষানবিশ কার্যালয় আদালত ভবনে হতে হবে।
শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা
প্রত্যেক জেলা উপজেলা এবং মহানগর এলাকায় এক বা একাধিক শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা নিয়োগ, যোগ্যতা ও চাকরির শর্ত নির্ধারিত থাকবে। শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত জেলা ও উপজেলায় কর্মরত সমাজ সেবা অফিসার শিক্ষানবিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।
শিক্ষানবিশ পর্ষদ
সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষানবিশ পর্ষদ থাকবে। শিক্ষানবিশ পর্যদে জাতীয় সংসদের স্পিকারের মনোনীত দুই জন সংসদ সদস্য (একজন সরকারদলীয় ও একজন বিরোধীদলীয়) থাকবেন। মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) অথবা তার মনোনীত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক সমমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সদস্য থাকবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ, আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মনোনীত যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা সদস্য থাকবেন। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক, স্থানীয় সরকার বিভাগ মনোনীত একজন প্রতিনিধি, বার কাউন্সিল মনোনীত একজন প্রতিনিধি, কারা মহাপরিদর্শক, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক, সরকার মনোনীত বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। সমাজ সেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক থাকবেন সদস্য সচিব।
জাতীয় শিক্ষানবিশ পর্যদ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেবে। শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পরিবীক্ষণ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে। বিভাগীয় শিক্ষানবিশ পর্ষদের কার্যক্রম সমন্বয়, অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবে। বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও শহর শিক্ষানবিশ পর্ষদ থাকবে।
শিক্ষানবিশ আবাসস্থল
সরকার শিক্ষানবিশের আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষানবিশ আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করবে। বেসরকারিভাবে শিক্ষানবিশ আবাস্থল শর্তসাপেক্ষে সরকারের অনুমতি নিয়ে করা যাবে।
সূত্র জানায়, ১৯৬০ সালের ‘প্রবেশন অর্ডিন্যান্স’ যুগোপযোগী করে নতুন খসড়া আইন চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। নতুন করে এই আইনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিক্ষানবিশ আইন’। আইনটি চূড়ান্ত হলে অপরাধীদের সংশোধন কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সমাজ সেবা অধিদফতরের উপপরিচালক (চিকিৎসা ও প্রবেশন) লাইমা ইয়াসমিন বলেন, ‘১৯৬০ সালের প্রবেশন অর্ডিন্যান্স যুগোপযোগী করে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। খসড়াটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোও হয়েছে। জীবনে প্রথম ও লঘু অপরাধে কাউকে জেল না দিয়ে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতেই আইনটি করা হচ্ছে। যেন অপরাধীরা সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে আসতে পারে।’
প্রবেশন বা শিক্ষানবিশ
লঘু ও প্রথম অপরাধী এবং অপরাধের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য পরিচালিত কার্যক্রম হচ্ছে প্রবেশন। ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০’ অনুযায়ী কারাদণ্ড পাওয়া নারীদের ‘বিশেষ সুবিধা আইন-২০০৬’ ও ‘শিশু আইন-২০১৩’ অনুসারে সমাজসেবা অধিদফতর প্রবেশন ও আফটার কেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এসব আইন ছাড়াও নতুন খসড়ায় ২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সুরক্ষা আইন’ অনুযায়ী শিক্ষানবিশ কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষানবিশ হিসেবে সুযোগ পাবেন যারা
যেসব অপরাধীর আগে কোনও আদালতে কোনও দণ্ড হয়নি, তারা নির্ধারিত শর্তে মুক্তি পাবেন। অপরাধীর বয়স, চরিত্র, প্রাক-পরিচয়, অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধ সংঘটনে সংশ্লিষ্টতা বিবেচনা করে যেকোনও বয়সের নারী-পুরুষকে শিক্ষানবিশ হিসেবে মুক্তি দিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট আদালত।
অনূর্ধ্ব দুই বছরের সাজা পাওয়া কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স, চরিত্র, প্রাক-পরিচয় অথবা শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষানবিশ আদেশ দিতে পারবেন আদালত। অপরাধীর শারীরিক-মানসিক অবস্থা, অপরাধের প্রকৃতি ও অপরাধ লাঘবে তার সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আদালত শিক্ষানবিশ আদেশ দেবেন বিচারক।
দণ্ডাদেশের পর দণ্ডিত ব্যক্তির আবেদন জানানোর পর নির্ধারিত আদালত এসব বিবেচনায় শিক্ষানবিশ হিসেবে আদেশ দেবেন।
যেসব আদালত শিক্ষানবিশ আদেশ দেবেন
সাজা পাওয়া কোনও আসামিকে শিক্ষানবিশ আদেশ পেতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালতে আবেদন জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, দায়রা জজ আদালত অথবা মহানগর দায়রা জজ আদালত, অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত অথবা অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত অথবা মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম অথবা অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম, সিনিয়র বিচারিক হাকিম অথবা মহানগর বিচারিক আদালত ও বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিচারিত হাকিম এই আদেশ দেবেন।
যেসব অপরাধে কোনও ব্যক্তি শিক্ষানবিশ আদেশের অযোগ্য হবেন
কোনও ব্যক্তির দণ্ডবিধির ২১৬-এ, ৩২৮, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪০২, ৪৫৫ অথবা ৪৫৮ ধারার অপরাধে শাস্তি হলে অথবা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা হলে অপরাধী শিক্ষানবিশ আদেশের অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
উল্লিখিত ধারার অপরাধগুলো হলো, দস্যু বা ডাকাতকে আশ্রয় দেওয়া; হত্যার উদ্দেশ্যে বিষপ্রয়োগ; কাউকে হত্যা বা গুরুতর আঘাতের ভয় দেখিয়ে কোনও কিছু আদায় করা; কোনও কিছু আদায় করার উদ্দেশ্যে কাউকে খুন বা গুরুতর আঘাতের ভয় দেখানো; মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করার মতো অপরাধের ভয় দেখিয়ে কোনও কিছু আদায় করা; কোনও কিছু আদায়ের উদ্দেশ্যে কাউকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত করার ভয় দেখানো, দস্যুতার উদ্যোগ নেওয়া; হত্যা বা গুরুতর আঘাতের উদ্দেশ্যসহ দস্যুতা বা ডাকাতি করা; মারাত্মক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দস্যুতা বা ডাকাতির উদ্যোগ নেওয়া; ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়া; চোরের দলভুক্ত হওয়া; ডাকাতির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া; আঘাত-আক্রমণ বা অবৈধ আটকের প্রস্তুতি নেওয়ার পর গোপনে অনধিকার গৃহপ্রবেশ; কিংবা আঘাত-আক্রমণ বা অবৈধ আটকের প্রস্তুতি নেওয়ার পর রাতের বেলা গোপনে অনধিকার কারও ঘরে গৃহপ্রবেশের মতো অপরাধ।
এসব অপরাধ ছাড়া অন্য যেকোনও অপরাধে সাজা হলে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশের জন্য আবেদন করা যাবে। তবে মৃত্যদণ্ড ছাড়া যেকোনও নারী অথবা প্রতিবন্ধী যদি কোনও অপরাধে সাজা হয়, তাহলে সাজা থেকে মুক্তি পেতে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশের জন্য নির্ধারিত আদলতে আবেদন করা যাবে।
যেসব শর্তে মুক্তি দেওয়া হবে
আদালতের দেওয়া নির্ধারিত সময়ে আর কোনও অপরাধ না করা, শান্তি বজায় রাখা, ভালো আচরণ করা, নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির হওয়া ও শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকার শর্তে অঙ্গীকার করে মুচলেকা (অথবা জামিনদারসহ অথবা জরিমানা ছাড়া) দেওয়ার শর্তে আদালত ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশ দিতে পারবেন। তবে অপরাধীর স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে তার অথবা তার কোনও জামিনদারের বসবাসের নির্দিষ্ট স্থান অথবা নিয়মিত জীবিকা থাকে এবং মুচলেকার সময় ওই স্থানে বসবাস করার অথবা জীবিকা নির্বাহ করার সম্ভাবনা থাকে এবং স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে মুচলেকার মেয়াদকালে বসবাস করার অথবা জীবিকা অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ‘শিক্ষানবিশ’ আদেশ দেবেন আদালত। অর্থাৎ এসব বিষয়ে আদালত সন্তুষ্ট হলে সংশোধনের মাধ্যমে মুক্তি পাবেন অপরাধী। এসব শর্ত পূরণ না হলেও আদালত অপরাধীকে শিক্ষানবিশ হিসেবে তার অবস্থানের জন্য কোনও শিক্ষানবিশ আবাসস্থলে পাঠানোর আদেশ দিতে পারবেন। অপরাধীকে অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য মামলার বিশেষ পরিস্থিতির আলোকে আদালত যেমন মনে করবেন, তেমন শর্ত মুচলেকায় যুক্ত করতে পারবেন।
শিক্ষানবিশ মঞ্জুরের আবেদন
আইনজীবী অথবা আইনগত প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে কোনও মামলা ও দণ্ড সম্পর্কে জেনে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে অপরাধীকে শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি অথবা শিক্ষানবিশ মঞ্জুরের জন্য বিচারিক আদলতে আবেদন করতে পারবেন। বিচারিক আদালত অপরাধীকে দেওয়া আদেশ বিবেচনা করে শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি অথবা শিক্ষানবিশ মঞ্জুর করতে পারবেন। আদালত উপযুক্ত মনে করলে অপরাধীকে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা আহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ এবং মামলার ব্যয় নির্বাহ করার আদেশ দিতে পারবেন।
মুচলেকার শর্ত পূরণের ব্যবস্থা হলে অপরাধী অথবা জামিনদারের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারবেন আদালত। শর্ত ভঙ্গ করলে আদালত অপরাধীকে মূল অপরাধের জন্য দণ্ডিত করতে পারবেন।
শিক্ষানবিশ কার্যালয়
শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য শিক্ষানবিশ অধিশাখা এবং ক্ষেত্রমতে প্রতি বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মহানগর এলাকার জনবলসহ শিক্ষানবিশ কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে সরকার। জেলা ও মহানগর এলাকায় শিক্ষানবিশ কার্যালয় আদালত ভবনে হতে হবে।
শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা
প্রত্যেক জেলা উপজেলা এবং মহানগর এলাকায় এক বা একাধিক শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা নিয়োগ, যোগ্যতা ও চাকরির শর্ত নির্ধারিত থাকবে। শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত জেলা ও উপজেলায় কর্মরত সমাজ সেবা অফিসার শিক্ষানবিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।
শিক্ষানবিশ পর্ষদ
সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষানবিশ পর্ষদ থাকবে। শিক্ষানবিশ পর্যদে জাতীয় সংসদের স্পিকারের মনোনীত দুই জন সংসদ সদস্য (একজন সরকারদলীয় ও একজন বিরোধীদলীয়) থাকবেন। মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) অথবা তার মনোনীত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক সমমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সদস্য থাকবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ, আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মনোনীত যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা সদস্য থাকবেন। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক, স্থানীয় সরকার বিভাগ মনোনীত একজন প্রতিনিধি, বার কাউন্সিল মনোনীত একজন প্রতিনিধি, কারা মহাপরিদর্শক, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক, সরকার মনোনীত বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। সমাজ সেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক থাকবেন সদস্য সচিব।
জাতীয় শিক্ষানবিশ পর্যদ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেবে। শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পরিবীক্ষণ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে। বিভাগীয় শিক্ষানবিশ পর্ষদের কার্যক্রম সমন্বয়, অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবে। বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও শহর শিক্ষানবিশ পর্ষদ থাকবে।
শিক্ষানবিশ আবাসস্থল
সরকার শিক্ষানবিশের আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষানবিশ আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করবে। বেসরকারিভাবে শিক্ষানবিশ আবাস্থল শর্তসাপেক্ষে সরকারের অনুমতি নিয়ে করা যাবে।
No comments