‘তাল চারার দরকার নাই, আমরার আর্জেন্ট দরকার ঠাডার খুঁটি’ by হিমাদ্রি শেখর ভদ্র
‘আমরা হুনছি সরকার ঠাডা ফিরাইবার লাইগা হাওরে তাল গাছের চারা লাগাইতো।
তাল গাছ আমরার পইর দাদা লাগাইয়া খাইতো পারছে না। এই তাল তাইলে আমরা ক্যামনে
খাইয়াম। তাল চারার দরকার নাই, আমরার আর্জেন্ট দরকার ঠাডার খুঁটির ( বজ্র
নিরোধদণ্ড ), আমরা হেইডা চাই। মানুষ ঠাডা পইড়া মরতাছে এই তাল গাছ কোন দিন
বড় অইবো আর কুনদিন আমরা বাঁচবাম? ঠাডায় মরা আর সহ্য হয় না।’ বজ্রপাত রোধে
তাল গাছের চারা লাগানোর বিষয়ে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন বিশ্বম্ভরপুর
উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের গড়েরগাঁও গ্রামের রুবেল মিয়া।
বজ্রপাত
রোধে তাল গাছ লাগানোর সরকারি উদ্যোগের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না
সুনামগঞ্জের কৃষকরা। তাদের ভাষ্য, তাল গাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। এর মধ্যে
অনেকে মারা যাবেন। এজন্য তারা গাছের পরিবর্তে বজ্র নিরোধক দণ্ড লাগানোর
দাবি জানিয়েছেন।
বাগবের গ্রামের তৌফিক উল্লাহ বলেন, ‘বর্ষায় হাওরে ফানি
(পানি) আর ফানি। এই ফানির তলে কি ছোডছোড তালের চারা বাঁচবো। আমরা অখন
ক্ষেত ধান কাডি (কেটে) পুরা বাইশা আইলে জাল দড়ি লইয়া হাওরে মাছ ধরতে
যাইয়াম। ধান কাটলে ঠাডা পড়ে, মাছ ধরলেও ঠাডা পড়ে। আমরা যে কিমুন (কেমন)
একটা মুছিব্বতে পরছি আল্লা ছাড়া আর কেউ কইতে পারে না। হাওরে তালের চারা বড়
অইতে অইতে মানুষ মইরা সাফ হইয়া যাইবো। আমরার সরহারের (সরকার) কাছে ইডাওই
আবেদন ঠাডা ফিরাইতে হাওরে ঠাডা খুঁটি লাগানো হোক।’
সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের ওসমান আলী বলেন, ‘একটা
তালের চারা বড় গাছ হইতে কমপক্ষে ২০-৩০ বছর সময় লাগে। এই সময় কি মাইনসের
উপরে ঠাডা পরতো না? ইডা কি বাঁচনের না মরণের প্রকল্প অইলো হিডাইতো বুঝলাম
না।’
বাঘবের গ্রামের হযরত আলী বলেন, ‘সরকারে কইতাছে হাওরে
তাল গাছের চারা লাগাইতো। একটা তাল গাছের চারা লাগাইলে তিরিশ বছর পরে বুলে
বড়ো হয়। বাপে লাগাই থুইলে পুতে (ছেলে) খাইতো পারে না, নাইতে (নাতি) খায়।
অনে এই তালগাছ লাগাইয়া আমরা বাছাম ক্যামনে? কুন বালা বড়ো অইবো আর কুনবালা ঠাডা ফিরাইবো ইডার লাইগা কী আমরা বার চাইয়া বইয়া থাকলে অইবো। এর লাইগা আমরার ঠাডার খুঁটি জরুরি দরকার।’
তিনি
আরও বলেন, ‘আমরা গুরিব (গবির) মানুষ। আমরা আর ঠাডা পইরা মরতে চাই না।
গেরামের (গ্রাম) মানুষ জঙ্গল বরাবর চলাফেরা করে কুনদিন তালগাছ বড়ো অইবো আর
কুনদিন আমরা বাছাম।’
রাধানগর গ্রামের এমদাদ উল্লাহ বলেন, ‘বড়ো লোকরা ঠাডা পইরা মরে না গবির মরে। ধান কাটতে, মাছ ধরতে, আঙিনায় ধান শুকাইতে ঠাডা পইরা মানুষ মরে। আমরা গরিবরা ও মানুষ আমরারও বাঁচনের অধিকার আছে।’
একই গ্রামের রহমত আলী বলেন, ‘ইডা কেমন বিষয় যে, তালের চারা বড়ো হইলে হাওরের ঠাডা ফিরাইবো। গরিব মাইনসের জান লইয়া সরকার কী শুরু করছে?’
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ মার্চ থেকে ৯ মে পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ২০ জন লোক মারা গেছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে বজ্রাঘাতে ২১ জন ধান কাটার শ্রমিক, একজন ছাত্রী, তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
হাওরে ধান কাটার শ্রমিকরা জানান, একটি
তালগাছ বড়ো হতে অনেক সময় লাগে। এছাড়া বছরের ৬-৮ মাস হাওরে পানিতে ভরপুর
থাকে। তাই হাওরের সর্বত্র তালগাছ লাগানো সম্ভব নয়। তাদের দাবি, হাওরে বজ্র
নিরোধক দণ্ড লাগানোর।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হাওরে
বজ্রাঘাতে আকস্মিক মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য হাওরে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসাতে
সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে স্থায়ীভাবে বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণের
জন্য বিগত এক বছরে তালগাছ রোপণ কর্মসূচির আওতায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৪২
হাজার ৫০০টি তাল গাছ রোপণ করা হয়েছে। তালগাছগুলো বড় হলে বজ্রাঘাতে মৃত্যু
প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তা সময় সাপেক্ষ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন, হাওরে
বজ্রপাত রোধে সাড়ে ৪২ হাজার তাল গাছ লাগানো হয়েছে। দ্রুত সমস্যার মোকাবিলা
করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বজ্রনিরোধ দণ্ড স্থাপনের জন্য চিঠি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হাওর এলাকার কৃষকদের বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষিবিভাগ
সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের মাঠ দিবসের
কর্মসূচিতে বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
No comments