দারিদ্র্যতা বাধা হতে পারেনি ওদের
অদম্য সবুজ
মধুপুর (টাঙ্গাইল): বাবা ভ্যান চালক। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে অদম্য মেধাবী আশরাফুল ইসলাম সবুজ। দরিদ্রতাকে পেরিয়ে পীড়িত পরিবারে সকলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে সে। জিপিএ-৫ পাওয়ায় সবুজের বাবা-মার খুশি আর ধরে না। পিইসি পরীক্ষায় ধনবাড়ী পুষ্প প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে জিপিএ-৫, ধনবাড়ী কলেজিয়েট মডেল স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং একই স্কুল থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সবুজ জানায়, আমার বাবা মো. আবদুর রশিদ পেশায় ভ্যান চালক। সবুজের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় কয়ড়া পূর্বপাড়া গ্রামে। মা সুফিয়া বেগম। অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করেন। আর ছোট ভাই সজীব রায়হান ধনবাড়ী কলেজিয়েট মডেল স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেও লেখাপড়ায় খুব ভালো। তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করতে চায় সে। জীবনে আমি কখনো প্রয়োজনীয় সব কিছু পাইনি। স্কুলে শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে বই-খাতা নিয়ে লেখাপড়া করতাম। অনেক সময় বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। আমি এইচএসসিতে ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ কলেজে আমার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। মা সুফিয়া বেগম জানান, কষ্টের সংসারে আমি সবুজকে পড়ালেখার ব্যাপারে উৎসাহ দেই। ও যে পর্যন্ত পড়ালেখা করতে চায় আমি শত কষ্টেও পড়ালেখা করাবো। সবুজের বাবা আবদুর রশিদ জানান, আমার সম্পত্তি বলতে ৭ শতক জমি। আর ২টা ছেলে সবুজ ও সজীব। আমি ছেলে ২টাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছি। স্থানীয় এনজিও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার, সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস থেকে ৫০ হাজার টাকা ও আশা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। এনজিওর কিস্তি, সংসারের খরচ ও ছেলেদের পড়ালেখা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
স্বপ্ন পূরণের পথে হেলেনা-রায়হান
মতিউল আলম, ময়মনসিংহ থেকে: জন্মগতভাবে দুই পা অচল। তবু দমে যায়নি হেলেনা খাতুনের স্বপ্ন। বুকভরা দম নিয়ে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে নেমে পড়ে মাঠে। কখনো হামাগুড়ি দিয়ে আবার কখনো মায়ের সহযোগিতায় হুইল চেয়ারে নিয়মিত স্কুলের ক্লাস করেছেন। তার সুফলও পেয়েছে সে। গফরগঁাঁও উপজেলার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হেলেনা খাতুন জিপিএ-৪.৮৯ পেয়েছে।
হেলেনার বাড়ি গফরাগাঁও উপজেলার ঘাগড়া গ্রামে। আর দশটা শিশুর মতো সে হাঁটতে পারে না। হেলেনার মনে কষ্টের পাহাড়। সে সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারেনি। দৌড়াতে পারে না। খেলতে পারে না। তার অন্য সব সহপাঠীরা যখন স্কুল মাঠে খেলা করে, সে তখন চেয়ে চেয়ে দেখে। তার চোখের কোণে তখন বিন্দু বিন্দু নোনাপানি এসে জমা হয়। তবু সে দমেনি।
হেলেনা জানায়, ছোট বেলা থেকেই তার পা দুটি অচল। বড় হওয়ার পরও শক্তি ফিরে আসেনি পায়ে। স্কুলের যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকেই। শারীরিক অক্ষমতার জন্য পরিবার-স্বজন ও প্রতিবেশীরা তার পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও হেলেনার কখনো মনে হয়নি সে পারবে না। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে স্কুল। শুরুর দিকে মা ফজিলা খাতুন কোলে করে নিয়ে যেতেন। একটু বড় হওয়ার পর হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেয় পরিবার। হুইল চেয়ারে করে একা একা স্কুলে যাওয়ার বায়না করলেও মা কখনো একা ছাড়েনি। হুইল চেয়ারের হাতলে সব সময় থাকতো মায়ের হাত। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হলেও দ্রুততার সঙ্গেই সব কাজ করতে পারে সে। অনেকেই তাকিয়ে দেখে অদম্য হেলেনার মনের জোর। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ হেলেনার। নিজের জীবনের স্বপ্ন কি জানতে চাইলে অনেক মুখেটিপে হেসে হেসে বলে, ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষা নিতে চাই। আর হেলেনার মা ফজিলা খাতুনের স্বপ্ন তার মেয়ে একদিন ডাক্তার হবে। আবার মায়ের শঙ্কাও হয়। প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছেন হেলেনার বাবা। ছয় ভাই-বোনের সংসারে হেলেনার স্বপ্নপূরণের পথে কোনো বাধা তাই এই শঙ্কা মায়ের মনে। হেলেনার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, জেএসসি সে জিপিএ ৪. ৮৫ পেয়েছিল। এসএসসিতে ৪.৮৯ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস হেলেনা একদিন শিক্ষক ও তার মায়ের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হবে।
অপরদিকে জীবনে চরম দারিদ্র্যতা, আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি রায়হানের। পড়াশোনায় প্রচণ্ড ঝোক আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ঠেলে এবার এসএসসির ফলাফলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। জন্ম থেকে বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে না থাকা এ শিক্ষার্থী এবার আঠারদানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২.৮৯ পেয়েছে। তার বন্ধুরা যখন ফলাফলের জন্য বিদ্যালয়ে অপেক্ষা করছিল তখনো সে রিকশা চালাচ্ছিল। সে জানায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ জোগাতে সে সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়েছে। সে কারণে খুব একটা ভালো ফলাফল করতে পারেনি। প্রতিবন্ধী রায়হান আঠারদানা গ্রামের বেলাল উদ্দিনের ছেলে।
শঙ্কায় নাসিম ও ফারজানা
শ্যামনগর (সাতক্ষীরা): ট্রাক ড্রাইভার পিতার দুই সন্তানের বড় নাসিম আলী এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ পাঁচ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি-তে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেলেও লেখাপড়ার জন্য টাকা উপার্জনের পিছে সময় দিতে গিয়ে এক বিষয়ের ব্যর্থতায় তার গোল্ডেন জিপিএ হাতছাড়া হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার কাঁঠালবাড়িয়া এজে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা মেধাবী নাসিম আলী জানায় পিতার একার উপার্জনে সংসারের খরচ জোগানোর পর তার লেখাপড়ার টাকা হতো না। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে সে দিনমজুরের কাজ করে গত দুই বছর ধরে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে এসেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিনা সম্মানীতে তাকে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগে সে এমন ফলাফল অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তবে বই আর কলম পেন্সিল কেনার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে শ্রমিকের কাজে সময় নষ্টের কারণে আশানুরূপ ফল অর্জনে সক্ষম হয়নি বলে দাবি মেধাবী এ শিক্ষার্থীর। ভবিষ্যতে ইংরেজি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা নাসিম আলী জানায়, ঢাকার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ায় এখন তার প্রাথমিক লক্ষ্য। তবে আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ভালো কলেজে ভর্তি কিংবা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণ নিয়ে ইতিমধ্যে সংশয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন, দরিদ্র পরিবারের এ মেধাবী ছাত্রের মা মোছা. নাসিমা বেগম ও পিতা আবু সিদ্দিক। তবে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে আরেক মেধাবী ফারজানা ইয়াসমিনের ক্ষেত্রে। ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো কোনো সহায়-সম্পদ না থাকা বয়াতী (গায়ক) পিতা ফারুক হোসেনের সঙ্গে নিজেও বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে যায় সে। পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ জোগাতে ফারুক হোসেনের একার উপার্জন যথেষ্ট নয় বলে দাবি তার। একান্ত বাধ্য হয়ে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে ফারজানা নিজে তার পেশায় সহায়তা করেন বলে দাবি ফারুকের। ফারজানা ইয়াসমিন জানায় এবছর সে ভুরুলিয়া সিরাজপুর কলেজিয়েট বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ পাঁচ অর্জন করেছেন। বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়ার খরচ বেশি বিধায় বাধ্য হয়ে পিতার পেশায় নিজেকে জড়ানোর কথা জানায় সে। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় ফারজানা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে আগ্রহী উল্লেখ করে জানায় গানের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণ করতে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল কোন কলেজে ভর্তির সুযোগ চায় সে।
বাজিমাত কমল চন্দ্র রায়ের
পঞ্চগড়: কমল চন্দ্র রায় নামের এক এতিম প্রতিবন্ধী এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। হাতের তালু দিয়ে লেখেই সে এ সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করেছে। হাতের লেখা দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার দুই হাতে কোনো আঙুল নেই। কম্পিউটারে টাইপের মতো পরিপাটি তার হাতের লেখা। অদম্য মেধাবী কমল শিশু শ্রেণি থেকেই ক্লাসে ছিল প্রথম। পিএসসিতে জিপিএ-৫ সহ বৃত্তি ও জেএসসিতেও জিপিএ-৪ দশমিক ৯৫ অর্জন করে। এসএসসি’র ফলাফলে তার উচ্চ শিক্ষার ইচ্চাশক্তি আরো বেড়ে গেছে। এখন তার স্বপ্ন একটাই। একদিন ডাক্তার হয়ে তার মতো অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণে বাধা আর্থিক সমস্যা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কমলসহ তার মা এবং স্কুল শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষিরা। জন্ম থেকেই দুই হাতে কোনো আঙ্গুল ছিল না কমল চন্দ্র রায়ের। মাত্র দুই বছর বয়সে বজ্রপাতে মারা যান তার কৃষি শ্রমিক বাবা স্বরনার্থী রায়। সেই থেকে বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিবন্ধী কমলকে নিয়ে মা লিলি রায়ের সংসার। অন্যের বাড়িতে কাজ করে মা লিলি রায় তিন সন্তানকে দেখভাল করতেন। দিনমজুর বড় ভাই সম্প্রতি বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। প্রতিবন্ধী কমলসহ তার আরেক বড় ভাইকে নিয়ে মা লিলি রায় এখনো জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সহায় সম্বল বলতে ৫ শতক ভিটেমাটি মাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি কমল মাঝে মধ্যে তার ওই বড় ভাইয়ের সঙ্গে অন্যের জমিতে চুক্তিভিত্তিক কৃষি শ্রমিক হয়ে কাজ করতো। কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও সে থেমে যায়নি। লেখাপড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিই তাকে আরো অদম্য মেধাবী করে তুলেছে। কমল চন্দ্রের বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সাহাপাড়া গ্রামে। সে স্থানীয় গোবিন্দ আইডিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নিয়মিত স্কুলে যেত। এ জন্য শিক্ষকরাও তাকে বেশ স্নেহ করতেন। স্কুল ক্লাসের বাইরেও তারা নিজেদের মতো করে তাকে সহযোগিতা করতেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নন এমপিওভুক্ত এই স্কুল থেকে এবার ২৬ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে ৭ জন জিপিএ-৫ সহ ২৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কমল চন্দ্র রায় কথা বলার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলে।
মেধাবী আহম্মেদ আলীর গল্প
হাফিজ উদ্দিন, সাভার থেকে: আহম্মেদ আলী (২২) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি বিবিএ-র ছাত্র। থাকেন সাভার কলেজ ভবনের সিঁড়ির নিচে। সেখানে থেকেই চলে তার পড়ালেখা। আলী ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরিবারের হাল ধরতে চান। সাভার কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্টাফ এবং সহপাঠীদের সহায়তায় চলছে তার দারিদ্র্য জয়ের সংগ্রাম। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। প্রতিবন্ধী হলেও সে পড়ালেখা শিখেই দারিদ্র্যকে হার মানাতে চান। সাাভার থানা রোডে চলার পথে আলাপচারিতায় আহম্মেদ আলী জানান, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর বদরগঞ্জের দলপাড়ায়। বাবা আবু হাসেম কৃষক। মা আছিয়া বেগম গৃহিণী। এক ভাই এক বোনের সংসারে বড় আম্মদ আলী। ছোটবোন হাসিনা আক্তার (১৬) এ বছর গ্রামের একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আলী বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে এবং আগ্রহ ছিল পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। দারিদ্র্যতা তাকে ঘিরে ধরলেও পরিবারের উৎসাহ এবং নিজের আগ্রহে গ্রামের স্কুল থেকে ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৩.৩৮ এবং ২০১৬ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৩ পান তিনি। এরপর তার শহরের কলেজে পড়ালেখার আগ্রহ জাগে। সেই সুবাদে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি ভর্তি হন সাভার কলেজে বিবিএ। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফরা মিলে তার চলাচলের জন্য একটি পুরানো মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। এরপর সেই মোটরসাইকেলের পেছনে বাড়তি দুটি চাকা লাগিয়ে বিশেষভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তারা। মোটরসাইকেলের জ্বালানির খরচ দেন তার সহপাঠীরা। আহম্মেদ আলী বলেন, সাভার কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সকল স্টাফ তাকে আপন করে নিয়েছেন প্রথম দিন থেকেই। তাদের সাহায্যে বিনা পয়সায় করছেন পড়ালেখা। কলেজের সিঁড়ির নিচে স্টাফদের সঙ্গে তার থাকার সুযোগ হয়েছে। সেখানেই তিনি পড়ালেখা করেন। আলী নিজে পড়ালেখার পাশাপাপশি ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রকে প্রাইভেট পড়ান। মাসে পান এক হাজার টাকা। আলী জানান, সাভার কলেজের অদূরে প্রেস ক্লাবের বিপরীতে একটি মেসে তিনি রিকশাচালকদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে থাকেন। তিনবেলা মেসে খেলে তাকে কমপক্ষে ২১০০ টাকা গুনতে হয়। সে জন্য কোনো সকালে মুড়ি খেয়ে তার দিন চলে আবার টাকার অভাবে কোনো দিন দুপুরে তিনি অভুক্ত থাকেন। তবুও তিনি হার মানতে চান না। দারিদ্র্যতাকে জয়ের স্বপ্নে তিনি সবার দোয়া চান। গত ৫ই মে সাভারের একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা দেয়াও হয়েছে। আলী বলেন, তিনি বিবিএ শেষ করে এমবিএ পড়তে চান।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ভালো একটা চাকরির স্বপ্ন দেখেন। দারিদ্র্যতাকে হার মানিয়ে পরিবারের হাল ধরার স্বপ্নে বিভোর আহম্মেদ আলী সামনে এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। তিনি বলেন, তাদের অভাব ও কষ্টের সংসার। এরমধ্যেও কোনো মাসে অনেক কষ্ট করে গ্রামের বাড়ি থেকে ৫০০-৭০০ টাকা পাঠায় তার বাবা কোনো কোনো মাসে আবার টাকা দিতেও পারে না। তবে অভাব ও কষ্টের মধ্যেও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চান। কারো কাছে হাত পেতে নয় বরং যদি কেউ স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তবেই তিনি সাড়া দেন বলে জানান। আলী বলেন, ঈদের সময় মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যান তিনি। এছাড়া যাওয়ার সুযোগ হয় না।
মধুপুর (টাঙ্গাইল): বাবা ভ্যান চালক। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে অদম্য মেধাবী আশরাফুল ইসলাম সবুজ। দরিদ্রতাকে পেরিয়ে পীড়িত পরিবারে সকলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে সে। জিপিএ-৫ পাওয়ায় সবুজের বাবা-মার খুশি আর ধরে না। পিইসি পরীক্ষায় ধনবাড়ী পুষ্প প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে জিপিএ-৫, ধনবাড়ী কলেজিয়েট মডেল স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং একই স্কুল থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সবুজ জানায়, আমার বাবা মো. আবদুর রশিদ পেশায় ভ্যান চালক। সবুজের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় কয়ড়া পূর্বপাড়া গ্রামে। মা সুফিয়া বেগম। অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করেন। আর ছোট ভাই সজীব রায়হান ধনবাড়ী কলেজিয়েট মডেল স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেও লেখাপড়ায় খুব ভালো। তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করতে চায় সে। জীবনে আমি কখনো প্রয়োজনীয় সব কিছু পাইনি। স্কুলে শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে বই-খাতা নিয়ে লেখাপড়া করতাম। অনেক সময় বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। আমি এইচএসসিতে ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ কলেজে আমার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। মা সুফিয়া বেগম জানান, কষ্টের সংসারে আমি সবুজকে পড়ালেখার ব্যাপারে উৎসাহ দেই। ও যে পর্যন্ত পড়ালেখা করতে চায় আমি শত কষ্টেও পড়ালেখা করাবো। সবুজের বাবা আবদুর রশিদ জানান, আমার সম্পত্তি বলতে ৭ শতক জমি। আর ২টা ছেলে সবুজ ও সজীব। আমি ছেলে ২টাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছি। স্থানীয় এনজিও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার, সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস থেকে ৫০ হাজার টাকা ও আশা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। এনজিওর কিস্তি, সংসারের খরচ ও ছেলেদের পড়ালেখা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
স্বপ্ন পূরণের পথে হেলেনা-রায়হান
মতিউল আলম, ময়মনসিংহ থেকে: জন্মগতভাবে দুই পা অচল। তবু দমে যায়নি হেলেনা খাতুনের স্বপ্ন। বুকভরা দম নিয়ে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে নেমে পড়ে মাঠে। কখনো হামাগুড়ি দিয়ে আবার কখনো মায়ের সহযোগিতায় হুইল চেয়ারে নিয়মিত স্কুলের ক্লাস করেছেন। তার সুফলও পেয়েছে সে। গফরগঁাঁও উপজেলার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হেলেনা খাতুন জিপিএ-৪.৮৯ পেয়েছে।
হেলেনার বাড়ি গফরাগাঁও উপজেলার ঘাগড়া গ্রামে। আর দশটা শিশুর মতো সে হাঁটতে পারে না। হেলেনার মনে কষ্টের পাহাড়। সে সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারেনি। দৌড়াতে পারে না। খেলতে পারে না। তার অন্য সব সহপাঠীরা যখন স্কুল মাঠে খেলা করে, সে তখন চেয়ে চেয়ে দেখে। তার চোখের কোণে তখন বিন্দু বিন্দু নোনাপানি এসে জমা হয়। তবু সে দমেনি।
হেলেনা জানায়, ছোট বেলা থেকেই তার পা দুটি অচল। বড় হওয়ার পরও শক্তি ফিরে আসেনি পায়ে। স্কুলের যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকেই। শারীরিক অক্ষমতার জন্য পরিবার-স্বজন ও প্রতিবেশীরা তার পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও হেলেনার কখনো মনে হয়নি সে পারবে না। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে স্কুল। শুরুর দিকে মা ফজিলা খাতুন কোলে করে নিয়ে যেতেন। একটু বড় হওয়ার পর হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেয় পরিবার। হুইল চেয়ারে করে একা একা স্কুলে যাওয়ার বায়না করলেও মা কখনো একা ছাড়েনি। হুইল চেয়ারের হাতলে সব সময় থাকতো মায়ের হাত। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হলেও দ্রুততার সঙ্গেই সব কাজ করতে পারে সে। অনেকেই তাকিয়ে দেখে অদম্য হেলেনার মনের জোর। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ হেলেনার। নিজের জীবনের স্বপ্ন কি জানতে চাইলে অনেক মুখেটিপে হেসে হেসে বলে, ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষা নিতে চাই। আর হেলেনার মা ফজিলা খাতুনের স্বপ্ন তার মেয়ে একদিন ডাক্তার হবে। আবার মায়ের শঙ্কাও হয়। প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছেন হেলেনার বাবা। ছয় ভাই-বোনের সংসারে হেলেনার স্বপ্নপূরণের পথে কোনো বাধা তাই এই শঙ্কা মায়ের মনে। হেলেনার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, জেএসসি সে জিপিএ ৪. ৮৫ পেয়েছিল। এসএসসিতে ৪.৮৯ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস হেলেনা একদিন শিক্ষক ও তার মায়ের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হবে।
অপরদিকে জীবনে চরম দারিদ্র্যতা, আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি রায়হানের। পড়াশোনায় প্রচণ্ড ঝোক আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ঠেলে এবার এসএসসির ফলাফলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। জন্ম থেকে বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে না থাকা এ শিক্ষার্থী এবার আঠারদানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২.৮৯ পেয়েছে। তার বন্ধুরা যখন ফলাফলের জন্য বিদ্যালয়ে অপেক্ষা করছিল তখনো সে রিকশা চালাচ্ছিল। সে জানায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ জোগাতে সে সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়েছে। সে কারণে খুব একটা ভালো ফলাফল করতে পারেনি। প্রতিবন্ধী রায়হান আঠারদানা গ্রামের বেলাল উদ্দিনের ছেলে।
শঙ্কায় নাসিম ও ফারজানা
শ্যামনগর (সাতক্ষীরা): ট্রাক ড্রাইভার পিতার দুই সন্তানের বড় নাসিম আলী এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ পাঁচ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি-তে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেলেও লেখাপড়ার জন্য টাকা উপার্জনের পিছে সময় দিতে গিয়ে এক বিষয়ের ব্যর্থতায় তার গোল্ডেন জিপিএ হাতছাড়া হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার কাঁঠালবাড়িয়া এজে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা মেধাবী নাসিম আলী জানায় পিতার একার উপার্জনে সংসারের খরচ জোগানোর পর তার লেখাপড়ার টাকা হতো না। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে সে দিনমজুরের কাজ করে গত দুই বছর ধরে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে এসেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিনা সম্মানীতে তাকে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগে সে এমন ফলাফল অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তবে বই আর কলম পেন্সিল কেনার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে শ্রমিকের কাজে সময় নষ্টের কারণে আশানুরূপ ফল অর্জনে সক্ষম হয়নি বলে দাবি মেধাবী এ শিক্ষার্থীর। ভবিষ্যতে ইংরেজি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা নাসিম আলী জানায়, ঢাকার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ায় এখন তার প্রাথমিক লক্ষ্য। তবে আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ভালো কলেজে ভর্তি কিংবা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণ নিয়ে ইতিমধ্যে সংশয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন, দরিদ্র পরিবারের এ মেধাবী ছাত্রের মা মোছা. নাসিমা বেগম ও পিতা আবু সিদ্দিক। তবে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে আরেক মেধাবী ফারজানা ইয়াসমিনের ক্ষেত্রে। ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো কোনো সহায়-সম্পদ না থাকা বয়াতী (গায়ক) পিতা ফারুক হোসেনের সঙ্গে নিজেও বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে যায় সে। পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ জোগাতে ফারুক হোসেনের একার উপার্জন যথেষ্ট নয় বলে দাবি তার। একান্ত বাধ্য হয়ে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে ফারজানা নিজে তার পেশায় সহায়তা করেন বলে দাবি ফারুকের। ফারজানা ইয়াসমিন জানায় এবছর সে ভুরুলিয়া সিরাজপুর কলেজিয়েট বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ হতে জিপিএ পাঁচ অর্জন করেছেন। বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়ার খরচ বেশি বিধায় বাধ্য হয়ে পিতার পেশায় নিজেকে জড়ানোর কথা জানায় সে। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় ফারজানা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে আগ্রহী উল্লেখ করে জানায় গানের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণ করতে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল কোন কলেজে ভর্তির সুযোগ চায় সে।
বাজিমাত কমল চন্দ্র রায়ের
পঞ্চগড়: কমল চন্দ্র রায় নামের এক এতিম প্রতিবন্ধী এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। হাতের তালু দিয়ে লেখেই সে এ সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করেছে। হাতের লেখা দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার দুই হাতে কোনো আঙুল নেই। কম্পিউটারে টাইপের মতো পরিপাটি তার হাতের লেখা। অদম্য মেধাবী কমল শিশু শ্রেণি থেকেই ক্লাসে ছিল প্রথম। পিএসসিতে জিপিএ-৫ সহ বৃত্তি ও জেএসসিতেও জিপিএ-৪ দশমিক ৯৫ অর্জন করে। এসএসসি’র ফলাফলে তার উচ্চ শিক্ষার ইচ্চাশক্তি আরো বেড়ে গেছে। এখন তার স্বপ্ন একটাই। একদিন ডাক্তার হয়ে তার মতো অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণে বাধা আর্থিক সমস্যা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কমলসহ তার মা এবং স্কুল শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষিরা। জন্ম থেকেই দুই হাতে কোনো আঙ্গুল ছিল না কমল চন্দ্র রায়ের। মাত্র দুই বছর বয়সে বজ্রপাতে মারা যান তার কৃষি শ্রমিক বাবা স্বরনার্থী রায়। সেই থেকে বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিবন্ধী কমলকে নিয়ে মা লিলি রায়ের সংসার। অন্যের বাড়িতে কাজ করে মা লিলি রায় তিন সন্তানকে দেখভাল করতেন। দিনমজুর বড় ভাই সম্প্রতি বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। প্রতিবন্ধী কমলসহ তার আরেক বড় ভাইকে নিয়ে মা লিলি রায় এখনো জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সহায় সম্বল বলতে ৫ শতক ভিটেমাটি মাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি কমল মাঝে মধ্যে তার ওই বড় ভাইয়ের সঙ্গে অন্যের জমিতে চুক্তিভিত্তিক কৃষি শ্রমিক হয়ে কাজ করতো। কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও সে থেমে যায়নি। লেখাপড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিই তাকে আরো অদম্য মেধাবী করে তুলেছে। কমল চন্দ্রের বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সাহাপাড়া গ্রামে। সে স্থানীয় গোবিন্দ আইডিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নিয়মিত স্কুলে যেত। এ জন্য শিক্ষকরাও তাকে বেশ স্নেহ করতেন। স্কুল ক্লাসের বাইরেও তারা নিজেদের মতো করে তাকে সহযোগিতা করতেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নন এমপিওভুক্ত এই স্কুল থেকে এবার ২৬ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে ৭ জন জিপিএ-৫ সহ ২৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কমল চন্দ্র রায় কথা বলার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলে।
মেধাবী আহম্মেদ আলীর গল্প
হাফিজ উদ্দিন, সাভার থেকে: আহম্মেদ আলী (২২) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি বিবিএ-র ছাত্র। থাকেন সাভার কলেজ ভবনের সিঁড়ির নিচে। সেখানে থেকেই চলে তার পড়ালেখা। আলী ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরিবারের হাল ধরতে চান। সাভার কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্টাফ এবং সহপাঠীদের সহায়তায় চলছে তার দারিদ্র্য জয়ের সংগ্রাম। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। প্রতিবন্ধী হলেও সে পড়ালেখা শিখেই দারিদ্র্যকে হার মানাতে চান। সাাভার থানা রোডে চলার পথে আলাপচারিতায় আহম্মেদ আলী জানান, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর বদরগঞ্জের দলপাড়ায়। বাবা আবু হাসেম কৃষক। মা আছিয়া বেগম গৃহিণী। এক ভাই এক বোনের সংসারে বড় আম্মদ আলী। ছোটবোন হাসিনা আক্তার (১৬) এ বছর গ্রামের একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আলী বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে এবং আগ্রহ ছিল পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। দারিদ্র্যতা তাকে ঘিরে ধরলেও পরিবারের উৎসাহ এবং নিজের আগ্রহে গ্রামের স্কুল থেকে ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৩.৩৮ এবং ২০১৬ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৩ পান তিনি। এরপর তার শহরের কলেজে পড়ালেখার আগ্রহ জাগে। সেই সুবাদে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি ভর্তি হন সাভার কলেজে বিবিএ। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফরা মিলে তার চলাচলের জন্য একটি পুরানো মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। এরপর সেই মোটরসাইকেলের পেছনে বাড়তি দুটি চাকা লাগিয়ে বিশেষভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তারা। মোটরসাইকেলের জ্বালানির খরচ দেন তার সহপাঠীরা। আহম্মেদ আলী বলেন, সাভার কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সকল স্টাফ তাকে আপন করে নিয়েছেন প্রথম দিন থেকেই। তাদের সাহায্যে বিনা পয়সায় করছেন পড়ালেখা। কলেজের সিঁড়ির নিচে স্টাফদের সঙ্গে তার থাকার সুযোগ হয়েছে। সেখানেই তিনি পড়ালেখা করেন। আলী নিজে পড়ালেখার পাশাপাপশি ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রকে প্রাইভেট পড়ান। মাসে পান এক হাজার টাকা। আলী জানান, সাভার কলেজের অদূরে প্রেস ক্লাবের বিপরীতে একটি মেসে তিনি রিকশাচালকদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে থাকেন। তিনবেলা মেসে খেলে তাকে কমপক্ষে ২১০০ টাকা গুনতে হয়। সে জন্য কোনো সকালে মুড়ি খেয়ে তার দিন চলে আবার টাকার অভাবে কোনো দিন দুপুরে তিনি অভুক্ত থাকেন। তবুও তিনি হার মানতে চান না। দারিদ্র্যতাকে জয়ের স্বপ্নে তিনি সবার দোয়া চান। গত ৫ই মে সাভারের একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা দেয়াও হয়েছে। আলী বলেন, তিনি বিবিএ শেষ করে এমবিএ পড়তে চান।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ভালো একটা চাকরির স্বপ্ন দেখেন। দারিদ্র্যতাকে হার মানিয়ে পরিবারের হাল ধরার স্বপ্নে বিভোর আহম্মেদ আলী সামনে এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। তিনি বলেন, তাদের অভাব ও কষ্টের সংসার। এরমধ্যেও কোনো মাসে অনেক কষ্ট করে গ্রামের বাড়ি থেকে ৫০০-৭০০ টাকা পাঠায় তার বাবা কোনো কোনো মাসে আবার টাকা দিতেও পারে না। তবে অভাব ও কষ্টের মধ্যেও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চান। কারো কাছে হাত পেতে নয় বরং যদি কেউ স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তবেই তিনি সাড়া দেন বলে জানান। আলী বলেন, ঈদের সময় মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যান তিনি। এছাড়া যাওয়ার সুযোগ হয় না।
No comments