যেভাবে বেপরোয়া কাউন্সিলর মোস্তাকিম by প্রতীক ওমর
শুরুটা
টোকাই থেকেই। আজ থেকে বছর দশেক আগেও তার পরিচয় ছিল টোকাই। এলাকায় ছোটখাটো
চুরি-ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়েই আলোচনায় আসে মোস্তাকিম। ২০০৮-৯ সালের দিকে
খান্দার এলাকার টপটেরর সুজনের নজরে আসে সে। ওই সময় সুজন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে
চলতো বগুড়ার একটা অংশ। মোস্তাকিমের সাহস এবং কাজকর্মে অনেকটা সন্তুষ্ট
হয়েই সেই সময় সুজন তাকে তার বাহিনীর সদস্য করে নেয়। মাস্তানির ওস্তাদ সুজন।
মারামারি, দখল, চাঁদাবাজির সব আয়োজনে মোস্তাকিমের উপস্থিতি ছিল তখন।
একপর্যায়ে সুজনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হয়ে ওঠে। ওই বাহিনীর ভয়ে পুরো এলাকার
সাধারণ মানুষ তটস্থ হয়ে ওঠে। দোকানে চাঁদা, জমি দখল, বাড়ি তৈরিতে চাঁদা,
মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন সরকারি অফিসে টেন্ডারবাজি এমনকি ভাড়াটিয়া খুনের সঙ্গে
জড়িয়ে পড়ে মোস্তাকিম। ভাড়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার হয়ে গুণ্ডামি করতো
নিয়মিত। সুজন বাহিনীতে যোগ দেয়ার বছর তিনেকের মধ্যেই মোস্তাকিম অপ্রতিরোধ্য
ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। নিজেকে তখন কারো অধীনে সন্ত্রাসী করার প্রয়োজন মনে
করেনি। সুজনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লেগে যায় মোস্তাকিমের। একপর্যায়ে ২০১২ সালের
নভেম্বর মাসে মোস্তাকিমের হাতে খুন হয় তার ওস্তাদ সুজন। ওস্তাদকে খুন করে
পুরোপুরি ওস্তাদ বনে যায় মোস্তাকিম। ২০১২ সালের ৩রা নভেম্বর সুজন হত্যার
দায়ে তার নামে মামলা হয়। ক্ষমতার দাপটের কাছে ওই মামলা অসহায় হয়ে পড়ে। ঢিমে
তালে চলতে থাকে মামলা। ক্রমান্বয়ে মামলাটির গতি আরো কমে যায়। এখন অনেকটাই
নিখোঁজের পর্যায়ে সেই মামলা। এ ছাড়াও মোস্তাকিমের নামে আরো যেসব মামলা হয়,
২০১২ সালের ২রা অক্টোবর একটি মারামারির মামলা, একই বছরের ২৩শে এপ্রিল
অস্ত্রমামলা, ২০১১ সালের ২রা আগস্ট চাঁদাবাজির মামলা।
মোস্তাকিমের দাপটে বগুড়া শহরের খান্দার, কৈগাড়ী, ছিলিমপুর, মালগ্রাম, শাকপালার সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে ওঠে। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার সাহস কারোই ছিলো না। পুলিশের কাছে নালিশ দিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার কেউ সহজে হতে চায়নি। পুলিশের সঙ্গে মোস্তাকিমের সখ্য দেখে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মোস্তাকিমের অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ব্যবসার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব পুলিশের কাছে আছে। তার পরেও মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে কোনো দিন পুলিশ অ্যাকশন নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার মানুষ তাকে ম্যানেজ করেই এলাকায় থাকতো।
মোস্তাকিমকে এত ক্ষমতাধর করে তোলার পেছনে বগুড়ার একজন প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার সরাসরি হাত আছে। তার ছত্রছায়ায় মোস্তাকিম এক সময় শহর যুবলীগের শহর কমিটির দপ্তর সম্পাদকের পদ পেয়ে যায়। এর পর তাকে আর কে রোখে? গেল পৌরসভা নির্বাচনে ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন করে সে। ভোটারদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার পক্ষে সিল মারতে বাধ্য করে। কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে যায়।
বেপরোয়া মোস্তাকিম বাহিনী বগুড়ায় যা করছে: টোকাই মোস্তাকিম কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাহিনীর পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার অধীনে দেড় শতাধিক টোকাই কাজ করে। এদের দ্বারা এমন কোনো অন্যায় নেই যা সে করে না। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তার এলাকাতেই অবস্থিত। ওই হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কেনার প্রায় টেন্ডার সে বিভিন্ন কৌশলে নিতো। কখনো নিজের নামে আবার কখনো অন্যের নামে টেন্ডার ড্রপ করতো। তার ভয়ে অন্য কেউ সেখানে টেন্ডার দিতে পারে না। অপরদিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলকেন্দ্রিক প্রায় ২৫-৩০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স আছে। মোস্তাকিম এসব অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ করে। পালাক্রমে তার বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান নেয়। ওই মেডিকেল থেকে কোনো রোগী ঢাকায় স্থানান্তর হলে অথবা অন্যকোনো হাসপাতালে চলে গেলে অ্যাম্বুলেন্স লাগে। আর এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিকদের কোনো কারণ ছাড়াই মোস্তাকিম বাহিনীর হাতে প্রতি খেপে ৫০০ টাকা দিতে হয়। অপর একটি গ্রুপ সার্বক্ষণিক মেডিকেলের ইমারজেন্সি বিভাগের সামনে কাজ করে। গুরুতর রোগীদের ভর্তি হতে সাহাস্য করার নাম করে অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ওষুধ একটি দোকান থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করে।
মেডিকেল ছাড়াও মোস্তাকিমের আরেক বাহিনী উল্লিখিত এলাকায় জমিজমা নিয়ে কাজ করে। তারা কাগজপত্রের সমস্যা আছে এমন জমির মালিকদের খুঁজে বের করে। তারপর এক পক্ষের দ্বারা কাউন্সিলর বরাবর বিচার চেয়ে দরখাস্ত করায়। মোস্তাকিম কৌশলে এক পক্ষের হয়ে বিচার করে দেয়। এতে লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়। আরেকটি কৌশল হচ্ছে, জমিজমা নিয়ে দুই পক্ষের মামলা চলছে তাদের একপক্ষের থেকে জোর করে নামমাত্র টাকা দিয়ে বায়না দলিল করে নেয় সে। তার পর সেখানে বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয় বায়না সূত্রে এই জমির মালিক মোস্তাকিম রহমান। ব্যস, ওই জমিতে আর কেউ আসার সুযোগ পায় না। বগুড়া শহরে এরকম শতশত একর জমি এখন মোস্তাকিমের দখলে। সেই জমিগুলোতে এখনো ঝুলছে মোস্তাকিমের সাইনবোর্ড।
এ ছাড়াও খান্দার গোহাইল রোডে প্রতিদিন প্রায় ৩ শতাধিক অটোরিকশা চলাচল করে। ওই সব অটোরিকশার চালকরা প্রতিদিন মোস্তাকিম বাহিনীর হাতে চাঁদা দিতে হয় ৬০ টাকা করে। এ ছাড়া নতুন কেউ অটোরিকশা রাস্তায় নামাতে হলে তার দরবারে মোটা অঙ্কের নজরানা দিতে হয়।
মোস্তাকিম বাহিনীকে বগুড়া শহরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে যে কেউ নতুন বাড়ি করতে চাইলে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয়। পরিমাণ কমপক্ষে ২ লাখ। বড় বাড়ি হলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত তাকে দিতে হয়। টাকা না দিলে কেউ বাড়ির কাজ করতে পারে না।
যেভাবে ফেঁসে গেলেন মোস্তাকিম: বগুড়ার পাসপোর্ট অফিসের আগের সহকারী চালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোজসাজশ করে মোস্তাকিম বাহিনীর সদস্যরা সেখানে দালালি করতো। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভাবে হয়রানির শিকার হতো। বর্তমান সহকারী পরিচালক (এডি) সাজাহান কবির ৬-৭ মাস আগে বগুড়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগদানের পর থেকে তিনি অফিস থেকে দালালদেরকে বিতাড়িত করেছেন। পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনের কাছে অফিসের কোনো কর্মচারী ঘুষ দাবি, ঘুষ না পেয়ে খারাপ ব্যবহার করলে তাদের ব্যাপারে অভিযোগ জমা দেয়ার জন্য তিনি অফিসের খোলা জায়গায় স্বচ্ছ কাচের বাক্স স্থাপন করেছেন। এতে সাধারণ মানুষ কোনো হয়নারানি ছাড়াই অফিসিয়াল কাজ শেষ করতে পারতো। ফলে অফিসের অন্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় দালালদের দৌরাত্ম্য। সাজাহান কবির তার অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করার কারণে তার সহকর্মীদের মধ্যে দিনদিন ক্ষোভের দানা বড় হতে থাকে। তার প্রতিফলন ঘটে ২৯শে মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে। নির্মম ভাবে রাস্তায় একা পেয়ে তার ওপর হামলা চালায় মোস্তাকিম বাহিনী। তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য ওই দিন দুপুর দেড়টার দিকে অটোরিকশাযোগে শহরতলির শাকপালা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কৈগাড়ি এলাকায় বিভাগীয় বন অফিসের সামনে মোটরসাইকেলযোগে তিন দুর্বৃত্ত তার অটোরিকশার গতি রোধ করে। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে রাম দা দিয়ে ডান পায়ে কোপ দেয়। এ সময় তিনি রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে বন অফিসের ভিতরে একটি কক্ষে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেয়। দুর্বৃত্তরা ওই কক্ষের দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। এ সময় বন অফিসের কর্মচারীরা পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে মসজিদ থেকে লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। ওই রাতেই বগুড়া পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী শাজেনুর আলম বাদী হয়ে মোস্তাকিমকে প্রধান আসামি করে শাজাহানপুর থানায় আরো ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজন এবং দিনাজপুরে হাকিমপুর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া সাতকুড়ি বাজার থেকে শুক্রবার সকালে মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা জানান, অপরাধী যত শক্তিশালী হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি মোস্তাকিমের উপযুক্ত শাস্তি হবে বলে জানান।
সাজাহান কবিরের স্ত্রী নাহিদ কবির জানান, সাজাহান কবিরের অবস্থা বর্তমানে আশঙ্কা মুক্ত। তিনিও তার স্বামীর উপর হামলাকারীদের কঠিন শাস্তি দাবি করেন।
পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর: শনিবার মোস্তাকিমকে বগুড়ার সিনিয়র চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। বিচারক আবু রায়হান শুনানি শেষে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মোস্তাকিমের দাপটে বগুড়া শহরের খান্দার, কৈগাড়ী, ছিলিমপুর, মালগ্রাম, শাকপালার সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে ওঠে। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার সাহস কারোই ছিলো না। পুলিশের কাছে নালিশ দিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার কেউ সহজে হতে চায়নি। পুলিশের সঙ্গে মোস্তাকিমের সখ্য দেখে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মোস্তাকিমের অপ্রতিরোধ্য চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ব্যবসার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব পুলিশের কাছে আছে। তার পরেও মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে কোনো দিন পুলিশ অ্যাকশন নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার মানুষ তাকে ম্যানেজ করেই এলাকায় থাকতো।
মোস্তাকিমকে এত ক্ষমতাধর করে তোলার পেছনে বগুড়ার একজন প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার সরাসরি হাত আছে। তার ছত্রছায়ায় মোস্তাকিম এক সময় শহর যুবলীগের শহর কমিটির দপ্তর সম্পাদকের পদ পেয়ে যায়। এর পর তাকে আর কে রোখে? গেল পৌরসভা নির্বাচনে ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন করে সে। ভোটারদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার পক্ষে সিল মারতে বাধ্য করে। কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে যায়।
বেপরোয়া মোস্তাকিম বাহিনী বগুড়ায় যা করছে: টোকাই মোস্তাকিম কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাহিনীর পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার অধীনে দেড় শতাধিক টোকাই কাজ করে। এদের দ্বারা এমন কোনো অন্যায় নেই যা সে করে না। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তার এলাকাতেই অবস্থিত। ওই হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কেনার প্রায় টেন্ডার সে বিভিন্ন কৌশলে নিতো। কখনো নিজের নামে আবার কখনো অন্যের নামে টেন্ডার ড্রপ করতো। তার ভয়ে অন্য কেউ সেখানে টেন্ডার দিতে পারে না। অপরদিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলকেন্দ্রিক প্রায় ২৫-৩০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স আছে। মোস্তাকিম এসব অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ করে। পালাক্রমে তার বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান নেয়। ওই মেডিকেল থেকে কোনো রোগী ঢাকায় স্থানান্তর হলে অথবা অন্যকোনো হাসপাতালে চলে গেলে অ্যাম্বুলেন্স লাগে। আর এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিকদের কোনো কারণ ছাড়াই মোস্তাকিম বাহিনীর হাতে প্রতি খেপে ৫০০ টাকা দিতে হয়। অপর একটি গ্রুপ সার্বক্ষণিক মেডিকেলের ইমারজেন্সি বিভাগের সামনে কাজ করে। গুরুতর রোগীদের ভর্তি হতে সাহাস্য করার নাম করে অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ওষুধ একটি দোকান থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করে।
মেডিকেল ছাড়াও মোস্তাকিমের আরেক বাহিনী উল্লিখিত এলাকায় জমিজমা নিয়ে কাজ করে। তারা কাগজপত্রের সমস্যা আছে এমন জমির মালিকদের খুঁজে বের করে। তারপর এক পক্ষের দ্বারা কাউন্সিলর বরাবর বিচার চেয়ে দরখাস্ত করায়। মোস্তাকিম কৌশলে এক পক্ষের হয়ে বিচার করে দেয়। এতে লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়। আরেকটি কৌশল হচ্ছে, জমিজমা নিয়ে দুই পক্ষের মামলা চলছে তাদের একপক্ষের থেকে জোর করে নামমাত্র টাকা দিয়ে বায়না দলিল করে নেয় সে। তার পর সেখানে বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয় বায়না সূত্রে এই জমির মালিক মোস্তাকিম রহমান। ব্যস, ওই জমিতে আর কেউ আসার সুযোগ পায় না। বগুড়া শহরে এরকম শতশত একর জমি এখন মোস্তাকিমের দখলে। সেই জমিগুলোতে এখনো ঝুলছে মোস্তাকিমের সাইনবোর্ড।
এ ছাড়াও খান্দার গোহাইল রোডে প্রতিদিন প্রায় ৩ শতাধিক অটোরিকশা চলাচল করে। ওই সব অটোরিকশার চালকরা প্রতিদিন মোস্তাকিম বাহিনীর হাতে চাঁদা দিতে হয় ৬০ টাকা করে। এ ছাড়া নতুন কেউ অটোরিকশা রাস্তায় নামাতে হলে তার দরবারে মোটা অঙ্কের নজরানা দিতে হয়।
মোস্তাকিম বাহিনীকে বগুড়া শহরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে যে কেউ নতুন বাড়ি করতে চাইলে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয়। পরিমাণ কমপক্ষে ২ লাখ। বড় বাড়ি হলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত তাকে দিতে হয়। টাকা না দিলে কেউ বাড়ির কাজ করতে পারে না।
যেভাবে ফেঁসে গেলেন মোস্তাকিম: বগুড়ার পাসপোর্ট অফিসের আগের সহকারী চালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোজসাজশ করে মোস্তাকিম বাহিনীর সদস্যরা সেখানে দালালি করতো। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভাবে হয়রানির শিকার হতো। বর্তমান সহকারী পরিচালক (এডি) সাজাহান কবির ৬-৭ মাস আগে বগুড়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগদানের পর থেকে তিনি অফিস থেকে দালালদেরকে বিতাড়িত করেছেন। পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনের কাছে অফিসের কোনো কর্মচারী ঘুষ দাবি, ঘুষ না পেয়ে খারাপ ব্যবহার করলে তাদের ব্যাপারে অভিযোগ জমা দেয়ার জন্য তিনি অফিসের খোলা জায়গায় স্বচ্ছ কাচের বাক্স স্থাপন করেছেন। এতে সাধারণ মানুষ কোনো হয়নারানি ছাড়াই অফিসিয়াল কাজ শেষ করতে পারতো। ফলে অফিসের অন্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় দালালদের দৌরাত্ম্য। সাজাহান কবির তার অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করার কারণে তার সহকর্মীদের মধ্যে দিনদিন ক্ষোভের দানা বড় হতে থাকে। তার প্রতিফলন ঘটে ২৯শে মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে। নির্মম ভাবে রাস্তায় একা পেয়ে তার ওপর হামলা চালায় মোস্তাকিম বাহিনী। তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য ওই দিন দুপুর দেড়টার দিকে অটোরিকশাযোগে শহরতলির শাকপালা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কৈগাড়ি এলাকায় বিভাগীয় বন অফিসের সামনে মোটরসাইকেলযোগে তিন দুর্বৃত্ত তার অটোরিকশার গতি রোধ করে। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে রাম দা দিয়ে ডান পায়ে কোপ দেয়। এ সময় তিনি রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে বন অফিসের ভিতরে একটি কক্ষে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেয়। দুর্বৃত্তরা ওই কক্ষের দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। এ সময় বন অফিসের কর্মচারীরা পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে মসজিদ থেকে লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। ওই রাতেই বগুড়া পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী শাজেনুর আলম বাদী হয়ে মোস্তাকিমকে প্রধান আসামি করে শাজাহানপুর থানায় আরো ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজন এবং দিনাজপুরে হাকিমপুর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া সাতকুড়ি বাজার থেকে শুক্রবার সকালে মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা জানান, অপরাধী যত শক্তিশালী হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি মোস্তাকিমের উপযুক্ত শাস্তি হবে বলে জানান।
সাজাহান কবিরের স্ত্রী নাহিদ কবির জানান, সাজাহান কবিরের অবস্থা বর্তমানে আশঙ্কা মুক্ত। তিনিও তার স্বামীর উপর হামলাকারীদের কঠিন শাস্তি দাবি করেন।
পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর: শনিবার মোস্তাকিমকে বগুড়ার সিনিয়র চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। বিচারক আবু রায়হান শুনানি শেষে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
No comments