ফারমার্স ব্যাংকে খাঁ-খাঁ
ঋণ
কেলেঙ্কারির ঘটনায় ধুঁকতে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের শাখাগুলো এখন খাঁ-খাঁ
করছে। নেই গ্রাহক-আমানতকারীর আনাগোনা। যারা যাচ্ছেন তাদের গচ্ছিত আমানতের
খোঁজখবর নিতে। আমানতের টাকা তুলতে গিয়ে খালি হাতে ফেরত আসছেন অনেকে।
গ্রাহকের জমা রাখা টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। গ্রাহকদের কাছে সময়
চাওয়া হচ্ছে টাকা ফেরত দিতে। এদিকে মূলধন সংকটের কারণে ব্যাংকটির এটিএম
বুথের কার্যক্রমও ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ রাখা হয়েছে। ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে
কার্যক্রমে আসা বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে
ইতিমধ্যেই ২৮৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে
ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটির কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। বৃহস্পতিবার
গুলশানের প্রধান কার্যালয়সহ চারটি শাখা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
গুলশান-১ এ অবস্থিত ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই সেখানে। দু’একজন গ্রাহক আসেন দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে। কাঙ্ক্ষিত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকক্ষণ অবস্থান করেও দেখা পাননি। অবশেষে হতাশ হয়ে ফেরত গেছেন। এছাড়া কয়েকজন শাখা ব্যবস্থাপক এসেছিলেন নিজ নিজ শাখার সমস্যা নিয়ে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্যা সমাধানে সময় চেয়েছেন। তারা বলছেন, খুব শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন আর সমস্যা থাকবে না। একজন শাখা ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি অনেকটাই হতাশ। একদিকে চাকরির চিন্তা, অন্যদিকে আমানতকারীদের চাপ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি শাখায় কর্মরত ওই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকটিতে তার চাকরির বয়স এক বছর। এরই মধ্যে ব্যাংকটি সংকটে পড়ে। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে আমানতকারীদের চাপ। তিনি জানান, তার শাখায় গ্রাহকের আমানতের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমানতকারী এসে ধর্না দেন। এতে করে তারা বিপদে পড়েছেন। নতুন করে আমানত সংগ্রহ করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগ্রহ তো দূরের কথা, যারা এর আগে টাকা রেখেছে তারাই উল্টো ধর্না দিচ্ছে প্রতিদিন। তিনি আরো বলেন, সব পরিচিত মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা, তাই বিড়ম্বনা বেশি। তবে তিনি বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করেছেন। শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে ব্যাংক।
গুলশান-১ এর জব্বার টাওয়ারের ১৩ তলায় অবস্থিত ব্যাংকটির করপোরেট শাখা। সেখানে কথা হয় জনসংযোগ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে বেশ চাপে রয়েছি। তবে বেশিদিন এই অবস্থা থাকবে না।
ফারমার্স ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় সরজমিনে দেখা গেছে, দুপুর বেলায় ব্যাংকের ভেতরে অনেকটা ফাঁকা পরিবেশ। অধিকাংশ চেয়ার ফাঁকা। কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থানের পর দুইজন গ্রাহকের দেখা মেলে। তাদের একজন হিসাব বন্ধ করতে এসেছেন। আরেকজন এসেছেন টাকা তুলে নিতে। তাদের মধ্যে একজন জানান, পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছেন ব্যাংকের অবস্থা ভালো না। তাই খোঁজ নিতে এসেছেন এবং সম্ভব হলে টাকা উত্তোলন করবেন। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে তারা টাকা দিতে পারবেন না। ব্যাংকের নিচেই এটিএম বুথ। কিন্তু টাকা না থাকায় বুথের দরজায় ‘আউট অব সার্ভিস’ নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ হাজার টাকা গ্রাহককে দেয়ার মতো অবস্থা নেই ধানমন্ডি শাখার। যারা টাকা তুলতে আসছেন তাদের পরবর্তী সপ্তাহে যোগাযোগ করে আসতে বলা হচ্ছে। তবে নিজেদের বেতন পেতে সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু অপর এক কর্মচারী জানান, তিনি বেতনের টাকা তুলতে কয়েক দফা ক্যাশে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু টাকা না থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সকাল থেকে যারা টাকা তুলতে এসেছেন তাদের অনুরোধ করা হয়েছে অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করার জন্য। ওই কর্মচারী আরো বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন দু’একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।
ওই শাখার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, গত কয়েকদিন যাবৎ রহস্যজনক লেনদেন হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংকে। কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কমে গেছে। কিন্তু কারা এই টাকা সরাচ্ছে তা ধরতে পারছেন না তারা। গতকাল দুপুরেও একটি বিদেশি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে অস্বাভাবিক টাকা কমে যায়। অন্য কোনো ব্রাঞ্চ থেকে টাকা উঠানো হচ্ছে কিনা তাও বুঝতে পারছিলেন না তারা।
ব্যাংকটির মতিঝিল শাখায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর উত্তরা শাখায়ও একই পরিবেশ বলে জানান কর্মকর্তারা। শাখাটির নেটিশ বোর্ডে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইতিবাচক সংবাদগুলো। এসব সংবাদ দেখানোর মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করাই আশা কর্মকর্তাদের। এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, টাকা তুলতে প্রতিদিন ভিড় করছেন গ্রাহকরা। জমা রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। কিন্তু তাদের হতাশ করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আবার ব্যাংকের হিসাবে টাকা না থাকায় বারবার চেক ডিজঅনার (প্রত্যাখ্যাত) হচ্ছে। যার জমা ৫ লাখ টাকা, তাকে দেয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। কাউকে কয়েকদিন পর আসতে বলা হচ্ছে। এদিকে চরম অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণ প্রদান বেশি হওয়ায় গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আগের সমস্যার কারণে ফারমার্স ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ এখন বেশি। তবে ধীরে ধীরে সব সমস্যা কেটে যাচ্ছে। গ্রাহকদের টাকার সমস্যাও প্রায় সমাধানের পর্যায়ে চলে এসেছে।
সূত্র জানায়, তারল্য সংকটে পড়ায় এখন নতুন করে মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এ জন্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) উদ্যোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক থেকে মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেয়ার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে বসতে চাইছে। তবে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ তা মানতে কিছুটা দোটানায় রয়েছে। এ কারণে গত জানুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের নামে লিখে দিতে হবে। ওই পরিমাণ শেয়ার লিখে দিলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে টাকা দেয়া হবে।
ফারমার্স ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যাত্রার পর ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে মুনাফা হয় ৩ কোটি, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ও ২০১৬ সালে ২৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭ সালে এসে লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। বিতরণ করা ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭২৩ কোটি টাকাই খেলাপি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন ৯টি ব্যাংকের ১টি ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।
ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে আমানত নেয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
এরপরই মূলত ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেয়া শুরু হয়। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে গত বছরের ২৭শে নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। এরপর ১৯শে ডিসেম্বর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপরই বেরিয়ে আসে যে সরকারি খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের আমানত আটকে গেছে ব্যাংকটিতে। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা আছে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায়। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে। এ ছাড়া জীবন বীমা করপোরেশনের আটকা পড়েছে শতকোটি টাকার বেশি। এসব টাকা চেয়ে আমানতকারী প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়েও ব্যাংকটির সাড়া পাচ্ছে না। এদিকে গতকাল এক বিবৃতিতে ফারমার্স ব্যাংক কর্তৃক আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে ক্রমাগত ব্যর্থতায় উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করা হয়েছে মূলত মতিঝিল ও গুলশান শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা ও গুলশান শাখার ঋণ ১,৪০০ কোটি টাকা। এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে।
গুলশান-১ এ অবস্থিত ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই সেখানে। দু’একজন গ্রাহক আসেন দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে। কাঙ্ক্ষিত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকক্ষণ অবস্থান করেও দেখা পাননি। অবশেষে হতাশ হয়ে ফেরত গেছেন। এছাড়া কয়েকজন শাখা ব্যবস্থাপক এসেছিলেন নিজ নিজ শাখার সমস্যা নিয়ে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্যা সমাধানে সময় চেয়েছেন। তারা বলছেন, খুব শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন আর সমস্যা থাকবে না। একজন শাখা ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি অনেকটাই হতাশ। একদিকে চাকরির চিন্তা, অন্যদিকে আমানতকারীদের চাপ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি শাখায় কর্মরত ওই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকটিতে তার চাকরির বয়স এক বছর। এরই মধ্যে ব্যাংকটি সংকটে পড়ে। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে আমানতকারীদের চাপ। তিনি জানান, তার শাখায় গ্রাহকের আমানতের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমানতকারী এসে ধর্না দেন। এতে করে তারা বিপদে পড়েছেন। নতুন করে আমানত সংগ্রহ করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগ্রহ তো দূরের কথা, যারা এর আগে টাকা রেখেছে তারাই উল্টো ধর্না দিচ্ছে প্রতিদিন। তিনি আরো বলেন, সব পরিচিত মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা, তাই বিড়ম্বনা বেশি। তবে তিনি বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করেছেন। শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে ব্যাংক।
গুলশান-১ এর জব্বার টাওয়ারের ১৩ তলায় অবস্থিত ব্যাংকটির করপোরেট শাখা। সেখানে কথা হয় জনসংযোগ কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে বেশ চাপে রয়েছি। তবে বেশিদিন এই অবস্থা থাকবে না।
ফারমার্স ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় সরজমিনে দেখা গেছে, দুপুর বেলায় ব্যাংকের ভেতরে অনেকটা ফাঁকা পরিবেশ। অধিকাংশ চেয়ার ফাঁকা। কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থানের পর দুইজন গ্রাহকের দেখা মেলে। তাদের একজন হিসাব বন্ধ করতে এসেছেন। আরেকজন এসেছেন টাকা তুলে নিতে। তাদের মধ্যে একজন জানান, পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছেন ব্যাংকের অবস্থা ভালো না। তাই খোঁজ নিতে এসেছেন এবং সম্ভব হলে টাকা উত্তোলন করবেন। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে তারা টাকা দিতে পারবেন না। ব্যাংকের নিচেই এটিএম বুথ। কিন্তু টাকা না থাকায় বুথের দরজায় ‘আউট অব সার্ভিস’ নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ হাজার টাকা গ্রাহককে দেয়ার মতো অবস্থা নেই ধানমন্ডি শাখার। যারা টাকা তুলতে আসছেন তাদের পরবর্তী সপ্তাহে যোগাযোগ করে আসতে বলা হচ্ছে। তবে নিজেদের বেতন পেতে সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু অপর এক কর্মচারী জানান, তিনি বেতনের টাকা তুলতে কয়েক দফা ক্যাশে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু টাকা না থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সকাল থেকে যারা টাকা তুলতে এসেছেন তাদের অনুরোধ করা হয়েছে অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করার জন্য। ওই কর্মচারী আরো বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন দু’একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।
ওই শাখার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, গত কয়েকদিন যাবৎ রহস্যজনক লেনদেন হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংকে। কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কমে গেছে। কিন্তু কারা এই টাকা সরাচ্ছে তা ধরতে পারছেন না তারা। গতকাল দুপুরেও একটি বিদেশি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে অস্বাভাবিক টাকা কমে যায়। অন্য কোনো ব্রাঞ্চ থেকে টাকা উঠানো হচ্ছে কিনা তাও বুঝতে পারছিলেন না তারা।
ব্যাংকটির মতিঝিল শাখায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর উত্তরা শাখায়ও একই পরিবেশ বলে জানান কর্মকর্তারা। শাখাটির নেটিশ বোর্ডে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইতিবাচক সংবাদগুলো। এসব সংবাদ দেখানোর মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করাই আশা কর্মকর্তাদের। এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, টাকা তুলতে প্রতিদিন ভিড় করছেন গ্রাহকরা। জমা রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। কিন্তু তাদের হতাশ করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আবার ব্যাংকের হিসাবে টাকা না থাকায় বারবার চেক ডিজঅনার (প্রত্যাখ্যাত) হচ্ছে। যার জমা ৫ লাখ টাকা, তাকে দেয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। কাউকে কয়েকদিন পর আসতে বলা হচ্ছে। এদিকে চরম অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণ প্রদান বেশি হওয়ায় গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আগের সমস্যার কারণে ফারমার্স ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ এখন বেশি। তবে ধীরে ধীরে সব সমস্যা কেটে যাচ্ছে। গ্রাহকদের টাকার সমস্যাও প্রায় সমাধানের পর্যায়ে চলে এসেছে।
সূত্র জানায়, তারল্য সংকটে পড়ায় এখন নতুন করে মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এ জন্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) উদ্যোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক থেকে মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেয়ার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে বসতে চাইছে। তবে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ তা মানতে কিছুটা দোটানায় রয়েছে। এ কারণে গত জানুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের নামে লিখে দিতে হবে। ওই পরিমাণ শেয়ার লিখে দিলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে টাকা দেয়া হবে।
ফারমার্স ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যাত্রার পর ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে মুনাফা হয় ৩ কোটি, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ও ২০১৬ সালে ২৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭ সালে এসে লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। বিতরণ করা ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭২৩ কোটি টাকাই খেলাপি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন ৯টি ব্যাংকের ১টি ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।
ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে আমানত নেয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
এরপরই মূলত ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেয়া শুরু হয়। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে গত বছরের ২৭শে নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। এরপর ১৯শে ডিসেম্বর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপরই বেরিয়ে আসে যে সরকারি খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের আমানত আটকে গেছে ব্যাংকটিতে। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা আছে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায়। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে। এ ছাড়া জীবন বীমা করপোরেশনের আটকা পড়েছে শতকোটি টাকার বেশি। এসব টাকা চেয়ে আমানতকারী প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়েও ব্যাংকটির সাড়া পাচ্ছে না। এদিকে গতকাল এক বিবৃতিতে ফারমার্স ব্যাংক কর্তৃক আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে ক্রমাগত ব্যর্থতায় উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করা হয়েছে মূলত মতিঝিল ও গুলশান শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা ও গুলশান শাখার ঋণ ১,৪০০ কোটি টাকা। এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে।
No comments