দিনমজুরের ছেলের হাতে ‘আলাদিনের চেরাগ’
দিনমজুর
আওয়াল ঢালীর ছেলে শাহজামাল হঠাৎ করে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, এই
তথ্য শুনে ‘অবাক’ তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মানুষ। মুন্সীগঞ্জের
টঙ্গীবাড়ী উপজেলার গোয়ারা গ্রামে শাহজামাল ওরফে সেগা জামাল এক ‘রহস্য
মানব’। গ্রামবাসীর ভাষ্য, ‘আওয়ালের ছেলে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন।’ ১৯৯৭
সালে সেগা জামাল স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকায় আসার পর
থেকেই তার বিষয়ে অন্ধকারে স্থানীয়রা। ঢাকায় তিনি কী করতেন এ বিষয়ে
স্থানীয়রা কিছুই জানতেন না। ঢাকায় তিনি ধীরে ধীরে ইয়াবার ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে
তোলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই কোটিপতি হয়ে যান। ইয়াবার ব্যবসা আড়াল করতে হঠাৎ
করেই তিনি হয়ে যান শিক্ষানুরাগী সেগা জামাল। ২০১০ সালে রাজধানীর ভাটারার
প্রগতি সরণিতে প্রতিষ্ঠা করেন কুইন মেরী কলেজ। সেই কলেজের চেয়ারম্যানও
তিনি। ধূর্ত সেগা জামাল দীর্ঘদিন নির্বিঘেœ ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যান।
শনিবার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে
আসতে শুরু করে সেগা জামালের উত্থানের পেছনের গল্প। অবাক হয়ে যান খোদ মাদক
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা
জানান, সেগা জামাল ঢাকায় এসে হঠাৎ করেই কোটিপতি হয়েছেন, এ তথ্য তাদের কাছে
ছিল না। তিনি তার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে বলছেন না। তবে সেগা
জামাল কীভাবে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, এ বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে
কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় তিনি একেক কথা
বলেছেন। কখনও তিনি বলছেন, তিনি ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
আবার বলছেন, সিটি কলেজ থেকে বিএ সম্পন্ন করেছেন, বিকম পাস করেছেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইয়াবার ব্যবসা করেই শত কোটি
টাকার মালিক হয়েছেন সেগা জামাল। ইয়াবার ব্যবসা আড়াল করতেই তিনি
শিক্ষানুরাগী সেজেছেন। ইয়াবার টাকাতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল-কলেজ। এ
বিষয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের খিলগাঁও সার্কেলের পরিদর্শক সুমনুর রহমান
যুগান্তরকে বলেন, শাহজামাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোনো তথ্য দেননি।
তার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।
আদালতের মাধ্যমে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। যুগান্তরের মুন্সীগঞ্জের
টঙ্গীবাড়ী প্রতিনিধি শাহজামাল ওরফে সেগা জামালের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ
নিয়েছেন। তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে বালীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শাহজামাল
এসএসসি পাস করেছেন। তারপর তিনি ঢাকায় এসে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন কিনা এ
বিষয়ে কোনো তথ্য গ্রামের বাড়ির লোকজন জানেন না। কয়েক বছর আগে তার বাবা
আওয়াল ঢালী মারা গেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে শাহজামাল সবার ছোট। তিনি শত কোটি
টাকার মালিক হলেও তার তিন ভাইয়ের অবস্থা আগের মতোই। তারা অনেকটা ‘দিন আনেন,
দিন খান।’ এ বিষয়ে শাহজামালের প্রতিবেশী ও বালীগাঁও ইউনিয়ন যুবলীগের
সভাপতি সোহেল মোল্লা যুগান্তরকে জানান, এসএসসি পাস করার পর শাহজামাল ঢাকায়
গিয়ে কিভাবে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তা তাদের জানা নেই। তিনি এলাকায়
আগে তেমন আসতেন না। এখন বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসেন। পাশের গ্রামে
তিনি জমি কিনে একটি বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করছেন। তিনি স্থানীয়ভাবে কোনো
রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত নন। সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে তিনি
কুইন মেরী কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ঢাকায় লেখাপড়া
করেছেন কিনা এ বিষয়েও আমরা কিছু জানি না। সেগা জামালের মাদক সিন্ডিকেটের
সন্ধানে গোয়েন্দারা : মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান,
প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইয়াবা ব্যবসা করে শত কোটি টাকার
মালিক হয়েছেন কুইন মেরী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শাহ জামাল ওরফে সেগা
জামাল।
কলেজ ভবনের অষ্টম তলায় তার নিজের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটকে তিনি ইয়াবার
গুদাম (মজুদখানা) হিসেবে ব্যবহার করতেন। কক্সবাজারের দু’জন ইয়াবা ব্যবসায়ী
লবণের ট্রাক, কাঠের ট্রাক এবং শুঁটকির ট্রাকে করে ইয়াবার চালান ঢাকায়
পাঠাত। পরে এসব ইয়াবা চলে আসত সেগা জামালের বাসায়। এসব ইয়াবা ঢাকার বাইরের
বড় বড় ইয়াবার ডিলার ঢাকায় এসে জামালের কাছ থেকে ইয়াবা সরবরাহ করত। জামাল
নিজে তার প্রিমিও গাড়িতে করে ইয়াবার চালান ঢাকার বাইরের ডিলারদের কাছে
পৌঁছে দিত। দেশব্যাপী সেগা জামাল ইয়াবার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। পুরো
সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে এরই মধ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণ
অধিদফতরের গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেছেন। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী
পরিচালক (ঢাকা মেট্রো-দক্ষিণ) শামসুল আলম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, কুইন
মেরী কলেজের চেয়ারম্যান শাহজামালকে সাড়ে ছয় হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতারের
পর ভাটারা থনায় মামলা করা হয়েছে। ওই মামলার তদন্ত এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা পুরো সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করার কাজ করছেন। সেগা জামালকে
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা
বলছেন, সেগা জামাল দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক
হয়েছেন। ইয়াবা ব্যবসাকে আড়াল করতে তিনি ভাটারা এলাকায় কুইন মেরী কলেজ
প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেগা ফাউন্ডেশন।
যুক্তরাজ্যে তিনি কুইন মেরী কলেজের একটি শাখা খোলার চেষ্টা করছেন। ঢাকাতে
যুক্তরাজ্যের একটি কলেজের শাখা খুলে শিক্ষা বাণিজ্য করার চেষ্টা করছেন
তিনি। প্রগতি সরণিতে ক-৯০ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা ক্রয়
করে তিনি কুইন মেরী কলেজ করেছেন। ওই ভবনের ৮ম তলায় রয়েছে তার বিলাসবহুল
ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটটির মালিক তিনি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং
বনশ্রীতে রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে একটি মোটেল
করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন তিনি। জমি কেনা বাবদ ২২ লাখ টাকার বায়না
করেছেন তিনি।
No comments