ধসের কোনো চিহ্ন ছিল না তাঁর আচরণে
হালকা
ছাই রঙের স্যুট, সাদা শার্ট আর প্রিন্টের টাই পরা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু
সপ্রতিভই ছিলেন। আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে গেলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা কোনো
অভিযোগই এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সরকারি খাতের সবচেয়ে ভালো ব্যাংকটি ধসের
কোনো চিহ্ন ছিল না তাঁর আচরণে, কথাবার্তায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)
নোটিশ পেয়ে গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সংস্থাটির কার্যালয়ে এভাবেই
হাজির হয়েছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান। সেখানে দুদকের
কর্মকর্তারা প্রায় চার ঘণ্টা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদ
শেষে তিনি মুখে হাসি নিয়েই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই
তিনি দুই হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলেন, এখনো তদন্ত চলছে, তার
আগেই যেন গণমাধ্যম কোনো উপসংহার না টানে। এদিকে গতকালই দুদকের কর্মকর্তারা
জানিয়েছেন, আবদুল হাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়নি, তাঁকে আবারও ডাকা হবে।
ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার প্রায়
চার বছর পর এই প্রথম দৃশ্যমান কোনো আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হলেন আবদুল
হাই বাচ্চু। ২০১৪ সালের ৬ জুলাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে
পদত্যাগ করার পর এই প্রথম প্রকাশ্যেও এলেন তিনি। চেয়ারম্যান থাকার মেয়াদে
২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে মাত্র ১১ মাসে
নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অর্থ
আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। চার বছর ধরে সমালোচনার মুখে
থাকলেও সব রকম আইনি প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বেই ছিলেন তিনি। বেসিক ব্যাংক
কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালের শেষ দিকে রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও
গুলশান থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। কিন্তু কোনো
মামলাতেই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। বাচ্চুর এ দায়মুক্তি পাওয়ার সমালোচনা
হয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ-ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞ মহলে
এবং সর্বশেষ তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন,
‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ একই বছরের ৮ জুলাই অর্থমন্ত্রী
সচিবালয়ে বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক
চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ আবার চলতি বছরের ২৩
ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানান, ‘বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিতে শেখ
আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।’ এ বছরেরই ২৯ মার্চ অর্থমন্ত্রী
শিল্পকলা একাডেমিতে দুদক আয়োজিত দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষেও বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায়
দুদকের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আবদুল হাই বাচ্চু
অভিযুক্ত (হ্যাজ বিন ব্লেমড) হয়েছেন। এখন দেখা যাক দুদক কী ব্যবস্থা নেয়।’
অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও একাধিকবার আবদুল হাই
বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। অবশেষে জিজ্ঞাসাবাদের
জন্য ডাকলেও দুদক স্বেচ্ছায় এই উদ্যোগ নেয়নি। মূলত উচ্চ আদালতের নির্দেশেই
দুদক বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আবদুল হাই বাচ্চুকে। বেসিক ব্যাংক ঘটনায়
দুদকের করা ৫৬ মামলার মধ্যে একটি মামলায় অনিয়মের মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা ঋণ
নেওয়ার অভিযোগ ছিল। সেই মামলায় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও পরিচালনা
পর্ষদের সদস্যদের আইন ও তদন্তের আওতায় এনে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন
দিতে গত ২৬ জুলাই দুদকের প্রতি নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরপরই তৎপর হয় দুদক।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরে গত ১৮ নভেম্বর বাচ্চুসহ পর্ষদের সাবেক ১১ জন
সদস্যকে (পরিচালককে) তলব করে দুদক। ২২ নভেম্বর থেকে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
গতকাল পর্যন্ত বাচ্চুসহ ১১ জনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্পন্ন হলো।
জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া বাকি ১০ সাবেক পরিচালক হলেন বর্তমানে ডাক ও
টেলিযোগাযোগসচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ,
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আখতার হোসেন, মো.
আনোয়ারুল ইসলাম, এ কে এম কামরুল ইসলাম, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)
কাজী ফখরুল ইসলাম, বিসিকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক
কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, উত্তরণ নামের একটি পত্রিকার সহকারী
সম্পাদক আনিস মাহমুদ এবং চাঁদপুর চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাহাঙ্গীর
আকন্দ সেলিম। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচার দুর্নীতি
দমন কমিশনের কার্যালয়ের ফটকে কালো প্রাডো গাড়িটি রেখে আবদুল হাই বাচ্চু
হেঁটে ভেতরে ঢোকেন। সকাল পৌনে ১০টা থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন দুদকের
পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও সৈয়দ ইকবাল হোসেন। ওই দুই পরিচালকের নেতৃত্বে ৯
জন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্ত কর্মকর্তারা একে একে পৃথক মামলায়
বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। দুদক সূত্র জানায়, গতকাল মূলত ঋণের কাগজপত্র
নিয়ে বাচ্চুর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ঋণ অনুমোদনের বিভিন্ন
কাগজ দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ওই সব কাগজে তিনিই স্বাক্ষর করেছেন কি না।
বেশির ভাগ কাগজেই বাচ্চু তাঁর স্বাক্ষর শনাক্ত করেছেন। তবে এ সময় তিনি সব
ধরনের অনিয়মের জন্য ব্যাংকটির সাবেক এমডি ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে
দায়ী করেছেন। বলেছেন, এমডির পক্ষ থেকেই সব কাগজপত্র তৈরি করে দেওয়া হতো।
তবে এর আগে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একাধিক পরিচালক বলেছেন, পর্ষদ সভা অনুষ্ঠানের
নোটিশ দেওয়া হতো শেষ সময়ে; যাতে পর্ষদে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে না আসতে
পারেন। এমনও হয়েছে যে পর্ষদ সভা নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়েছে এবং তাঁরা
এসে দেখেন, সভা শেষ। সভার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হলেও স্বাক্ষরের জন্য
চাপ তৈরি করা হতো বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এসব অভিযোগের বিষয়েও সাবেক
চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান দুদকের কর্মকর্তারা। জবাবে আবদুল হাই বাচ্চু
সবকিছুই অস্বীকার করেছেন। তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন না বলে
দাবি করেন। বেলা পৌনে দুইটার দিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিচে নেমে এলে
সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরেন তাঁকে। কিছুটা নিচু গলায় আবদুল হাই বাচ্চু বলেন, ‘যে
অভিযোগগুলো দুদক তদন্ত অবস্থায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, সে উত্তরগুলো দেওয়া
হয়েছে। প্রয়োজনবোধে আমি দুদককে আরও সহযোগিতা করব, যেটুকু আমার পক্ষে সম্ভব।
যেটুকু আমার পক্ষে দেওয়ার সেটুকু দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ আপনার সময়ই ঋণের এই
কেলেঙ্কারিটা ঘটে—এক সাংবাদিকের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তরে আবদুল হাই
বলেন, ‘অভিযোগটার এখনো তদন্ত চলছে, সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাজেই এখন এভাবে
বলা ঠিক হবে না।’ এরপর গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়ের মধ্য দিয়েই হেঁটে তিনি
প্রধান ফটকে রাস্তার ওপর দাঁড়ানো কালো প্রাডো গাড়িতে করে চলে যান।
জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর আগে গতকাল সকাল ১০টার দিকে কার্যালয়ে ঢোকার মুখে
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এ সময় বেসিক
ব্যাংকের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যন
বলেন, ‘আদালতের বিষয়ে আপনাদেরও প্রশ্ন করা ঠিক না, আমারও কথা বলা উচিত না।’
বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীও অনেক কথা বলেছেন। তাঁর কথার প্রতিপালন হবে কি না
জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘তিনি যেভাবে বলেছেন, পুরোপুরি সেভাবে
তা হবে না। দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা। এখানে সবকিছু আমার হাতেও নেই।’ আবদুল
হাইকে আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে এত বিলম্বের কারণ হিসেবে দুদক চেয়ারম্যান
বলেন, এখানে দীর্ঘসূত্রতা হয়েছে, টাইমলাইন মানা হয়নি এটা ঠিক। টাকাগুলো
অনেক স্তরে ভাগ হওয়ায় বুঝতে সময় লেগেছে। বিলম্বের কারণে মামলার আলামত নষ্ট
হবে কি না প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আলামত কি পচনশীল দ্রব্য
যে নষ্ট হবে। সবই তো কাগজ।’ এর মধ্যে একটি আলামত হারিয়েছে উল্লেখ করে
চেয়ারম্যান বলেন, এ ঘটনায় একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
No comments