একাত্তরের অহঙ্কার
ডিসেম্বর
মাসকে আমরা উদযাপন করি বিজয়ের মাস হিসেবে। এই মাসজুড়ে সারা দেশের
শহর-গ্রামে (এখন অনেক গ্রামেও উৎসব হয়; তিন বছর আগে শহর থেকে বেশ দূরের এক
গ্রামে এ রকম এক উৎসবে শামিল হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল) নানা আয়োজনে
একাত্তরের বিজয়কে আমরা স্মরণ করি; যারা একাত্তরের বিভীষিকা দেখেছেন,
বাঙালির বীরত্ব দেখেছেন, বিজয়ের মুহূর্তটিতে বাংলাদেশের আবির্ভাবের সাক্ষী
হয়েছেন, তারা সেই দিনগুলোকে স্মৃতিতে জাগান। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে আমরা যখন
বিজয়ের প্রথম জয়ন্তী পালন করলাম তখন দেশটা চাপা পড়েছিল সমস্যা-সংকটের
পাহাড়ের নিচে। স্বজন হারানোর কান্না, সারাশরীরে জখমের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে
থাকা মানুষের বেদনা, সম্ভ্রম হারানো নারীর কষ্ট স্পর্শ করত প্রত্যেক
মানুষকে। তারপরও বিজয়ের দিনে কান্না-বেদনা ভুলে বাঙালি রাস্তায় নেমেছিল।
লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছিল আকাশে এবং মনের সব দিগন্তে। রাস্তায় তরুণদের
ভিড়ে আমিও ছিলাম। অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করতে না পারার কষ্ট এবং গ্লানি
কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল উৎসবের রঙে। আমার একটা প্রত্যয় জন্মেছিল, এই দিনটি
সারা দেশের মানুষকে একটা স্বপ্নের পতাকাতলে, সম্ভাবনার অপার আকাশের নিচে
একত্র করবে। মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়বে। তারুণ্যের
আবেগ আর কল্পনা থেকে এ রকম একটি স্বপ্নও আমি দেখতাম যে, দেশটা সত্যি সত্যি
সোনার বাংলা হওয়ার পথে এগোবে। এই স্বপ্নটা খুব যে অবাস্তব বা অবান্তর ছিল,
তা নয়। দেশের মানুষের ভেতর তখন একটা ঐক্য ছিল। আমাদের অবশ্য কোনো সন্দেহ
ছিল না যে, বাঙালিদের একটি অংশ বাংলাদেশ চায়নি- একাত্তরজুড়ে বর্বর
পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে তারা বাঙালি নিধনে-লুণ্ঠনে-ধর্ষণে সক্রিয়
থেকেছে। যারা এদের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের কেউ কেউ ধরা পড়েছিলেন, অনেকে
পালিয়ে ছিলেন। আমার ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তারা যখন স্বাধীনতার
স্বাদ পাবেন, তাদের আত্মীয়স্বজন-সন্তানরা যখন এক স্বাধীন দেশের গর্বিত
নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, তখন তারা নিজেদের ভুল বুঝে অনুতপ্ত
হবে। দেশ গড়ার কাজে তারাও যোগ দেবে। খুব শিগগিরই আমার ভুলটা ভাঙল। আমি
বুঝলাম, অনেক বাঙালির ভেতরে পাকিস্তানের জন্য ভালোবাসা তাদের গর্ব বা
অহঙ্কারের জায়গাগুলো ঢেকে দিয়েছে। এটি কেন হল, এখনও কেন স্বাধীনতার গৌরবের
বদলে তারা ঔপনিবেশিক এক পরাধীনতাকে বেশি মূল্য দেন, কেন তাদের মনে বাংলাদেশ
নিয়ে অহঙ্কারের পরিবর্তে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার দুঃখটা প্রবল হয়- আমার
পক্ষে আন্দাজ করাটা সম্ভব হয় না। সেজন্য দীর্ঘ একটা সময় আমরা পার করেছি,
যখন বিজয়ের দিন এলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দিনটা নিয়ে ঠোঁট সেবা করতে দেখেছি,
সরকারের দীর্ঘ থেকে নিচু পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা- মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থেকে
সরকারি দলের উপজেলা কাঠামোর লোকজনও দিনটি পালন করেছেন এক মনগড়া ইতিহাসকে
সাক্ষী মেনে, সেই ইতিহাস দিয়ে একাত্তরের গৌরব ও চেতনাকে আড়াল করে দিয়ে।
১৯৭২ সালের পর অনেক দিন কেটে গেছে। এখন আর তারুণ্যের আবেগ নেই, এখন
বাস্তবতার মাপকাঠিতে, যুক্তিতর্ক দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করি। কিন্তু এটি করতে
গিয়ে বিজয়ের মাসের উদযাপনকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন জাগে। যে বিজয় বাঙালির,
প্রত্যেক বাঙালির, সেই বিজয় নিয়ে কেন কারও কারও মনে গর্ব নেই? কেন
একাত্তরের ইতিহাসকে প্রত্যেক বাঙালি নিজের সম্পদ এবং গৌরব ভাবে না? কেন
কোনো কোনো দল ও ব্যক্তি একাত্তরকে বিতর্কিত করতে চায়? কেনই বা কোনো দল
একাত্তরের একমাত্র মালিকানা দাবি করে? একাত্তরে কোনো দল ছিল না, ছিল
বাঙালির মহাসমাবেশ। কেউ দলের সদস্য হিসেবে যুদ্ধে যায়নি, গিয়েছে বাঙালি
হিসেবে, প্রাণের তাগিদে, বাঙালির শৌর্যে আর অহঙ্কার নিয়ে। সেই অহঙ্কার কেন
বিসর্জন দেব। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার যা কিছু
আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দেননি, দিয়েছেন দেশের
সব মানুষকে। প্রশ্ন আরও আছে। দলে দলে বিভেদ থাকে, মানুষে মানুষেও। কিন্তু
ইতিহাসের কিছু মহিমার জায়গা থাকে, যা নিয়ে কোনো জাতি তর্ক করে না।
মুক্তিযুদ্ধ এমনই এক জায়গা। অথচ কিছু দল মুক্তিযুদ্ধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে
নানা অছিলায়। বিজয়ের মাসে তরুণদের বিশাল সমাবেশ দেখে আমার আবারও প্রত্যয়
জাগে- এবং এই প্রত্যয়ের পেছনে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার ভূমিকাই প্রধান যে, এরাই
ইতিহাসকে রক্ষা করবে। এরা যার যা মূল্য, তাকে তাই দেবে। এরা কারও কথা শুনে
বিভ্রান্ত হবে না। এবারের বিজয়ের মাসে আমার প্রত্যাশা, তরুণদের এই সমাবেশ
যেন এক সময় মহাসমাবেশ হয়ে দাঁড়ায়, যাতে আমরা একাত্তরের অহঙ্কার ও প্রেরণায়
আবার ফিরে যেতে পারি।
No comments