তিন মাসে নিবন্ধন কমেছে ৩২ হাজার কোটি টাকা
বিনিয়োগে খরা কাটছে না। প্রতি মাসেই কমছে নিবন্ধন। এভাবে টানা কয়েক বছর দেশে বিনিয়োগে দুর্দিন চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবায়নের মিল নেই। এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে অনুকূল পরিবেশকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, ঋণের সুদের হার, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) হিসাবে গত তিন মাসে ৩১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে। শতকরা হিসাবে যা ৪৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও এসব তথ্য উঠে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৪ সালেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নেতিবাচক বিনিয়োগের বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ ইঙ্গিত। এর সঙ্গে জড়িত প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। টানা কয়েক বছর পর্যন্ত বিনিয়োগ কমছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও বিষয়টি স্বীকার করা হচ্ছে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার বাড়তে পারে। কারণ কেউ টাকা ফেলে রাখে না। এ ব্যাপারে বিডার নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন- এটা সত্য, আগের তিন মাসের চেয়ে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে। কিন্তু আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেনি। তিন মাসের তথ্য দিয়ে পুরো বছরের মূল্যায়ন করা যায় না। কারণ বছর শেষে নিবন্ধন বাড়তে পারে। দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার বাড়ছে অর্থনীতিবিদদের এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়। কারণ পুঁজি পাচারের সঙ্গে অনেক কারণ আছে। বেশিরভাগ সময়ই কালো টাকা পাচার হয়। তার মতে, যখন দেশে বিনিয়োগ বেশি হয়, ওই সময়ও অর্থ পাচার হয়। ফলে বিনিয়োগ দিয়ে এটি মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। বিডার তথ্য অনুসারে চলতি বছরের মার্চ থেকে জানুয়ারি প্রান্তিকে সামগ্রিকভাবে মোট ৫১০টি প্রতিষ্ঠান ৩৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছে। এর আগের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাব ছিল ৬৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা।
এ হিসাবে তিন মাসে বিনিয়োগ কমেছে ৩১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। এদিকে খাতভিত্তিক হিসাবে এ সময়ে ২০টি শতভাগ বিদেশি এবং ২১টি যৌথ কোম্পানি ৭ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আগের তিন মাসে যা ছিল ৪৫ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। তবে আলোচ্য সময়ে দেশীয় বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। বিডা জানিয়েছে, আলোচ্য তিন মাসে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেশি এসেছে সেবা খাতে। যা মোট বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া রাসায়নিক শিল্প খাতে সাড়ে ১৭ শতাংশ, বস্ত্র শিল্পে সাড়ে ১০ শতাংশ, খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট খাতে সাড়ে ১২ শতাংশ, প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৫ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে প্রায় ২৩ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। গত বছর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে ব্যবসায়িক পরিবেশে দুই ধাপ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৮৯টি দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক পরিবেশে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। প্রতিবেদনে ব্যবসার পরিবেশকে ১০টি বৃহত্তর নির্দেশিকা বা বিষয়ে বিন্যস্ত করে সেগুলোর অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থান বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে। এ সূচকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৯। এ ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন, অসচ্ছলতা দূরীকরণ সূচকের অবস্থা খুবই খারাপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে ওই পরিবেশ নেই। বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। এতে ব্যবসার ব্যয় কমবে। পণ্যের উৎপাদন খরচও কমবে। অন্যদিকে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত হলেও বাস্তবায়নের হার একেবারেই কম। ২০১৫ সালে বিডার কাছে একাধিক প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয় এমএএফ পেট্রো কেমিক্যাল নামে একটি কোম্পানি। পেট্রোকেমিক্যাল খাতে প্রতিষ্ঠানটি ১১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে জানায়। কিন্তু দেড় বছরের বেশি সময় পার হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া এই বছরে দেশীয় শীর্ষ দশ কোম্পানি মোট ২৯ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করে। কিন্তু কোনো বিনিয়োগেরই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। একই অবস্থা বিদেশি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালে যৌথ অংশীদারিত্বে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করে কানাডার কোম্পানি চুয়াং হুয়া অ্যালুমিনিয়াম। প্রকৌশল খাতে প্রতিষ্ঠানটির ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। সুইডেনের কোম্পানি ডাইনামিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি ছিল ১২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাইওয়ানের ফুয়াং চুং হুয়া প্রপার্টির ৪৮ কোটি টাকা এবং চীনের ইন্টারন্যাশনাল এপ্লিকেন্টস ৪০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছিল। এসবের কোনোটিরই কোনো অগ্রগতি নেই। এ ব্যাপারে নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, নিবন্ধনের পর বাস্তবায়নের হিসাব ওইভাবে করা হয় না। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম বছরে এক-চতুর্থাংশ বাস্তবায়ন হয়। তার দাবি, বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। কিন্তু বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ নেই। যদিও নতুন বিনিয়োগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা আছে। একেক কোম্পানি একেক ধরনের সুবিধা চায়। যেটা সব সময় দেয়া সম্ভব হয় না। এদিকে জিএফআইয়ের রিপোর্ট অনুসারে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা পাচার রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। পাচার করা এ অর্থ দেশের মোট বাণিজ্যের ১৩ শতাংশ।
No comments