কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যৌন নির্যাতনের শিকার এক কিশোর
কক্সবাজার জেলার টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের এক কিশোরকে গত বছরের ২৭ মার্চ টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান সেখানকার একটি আদালত। ওই দিন তাকে ডরমিটরির চারতলার ৪ নম্বর কক্ষে থাকতে দেয়া হয়। এর তিন দিনের মাথায় ৩০ মার্চ গভীর রাতে ওই কক্ষে থাকা অপর চারজন মিলে ওই কিশোরকে নির্যাতন করে। একই সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি মাসুক তাকে বলাৎকার করে। এর আগে একই উন্নয়ন কেন্দ্রের শিশুরা খাবার না পেয়ে শরীর ব্লেট দিয়ে চিরে প্রতিবাদ জানানোর অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু পরে তদন্তে দেখা যায়, তারা মাদক না পেয়ে ওই ঘটনা ঘটায়। শুধু ওই কিশোরকে বলাৎকার করার ঘটনায় নয়, কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রের কিছু কিশোর-কিশোরী ভয়ানক সব অপরাধে জড়াচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যশোর কেন্দ্রে আটক কিশোররাও মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
এর পেছনে শিশু-কিশোরদের মনোজগতে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং অপরাধের ধরন বদলানোকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। টেকনাফের ওই কিশোরের মা গত বছর সুপ্রিম কোর্টের অভিযোগ বক্সে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। ওই অভিযোগে বলা হয়, কক্সবাজারের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আটক ওই কিশোরকে গাজীপুর শিশু কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। গত ৩০ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে আমার ছেলে ফোনে ভীষণ কান্না করে বলে আমাকে প্রতি রাতে কারাগারে নিয়োজিত লোকেরা জোর করে বলাৎকার ও যৌন নির্যাতন করে। আমার পায়ুপথ থেকে ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি বর্তমানে হাসপাতালে। আমি যে কোনো মুহূর্তে মরে যেতে পারি। আমাকে বাঁচাও। অভিযোগপত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজের কাছে তদন্তের জন্য পাঠান। পরে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবদুল হাই এ ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ম্যাজিস্ট্রেট তার প্রতিবেদনে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ওই কিশোরের বর্ণনায় তার মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের অনেকাংশে মিল পাই। জিজ্ঞাসাবাদে ওই কিশোর জানায়, ২৭ মার্চ টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ডরমিটরির চারতলার ৪ নম্বর কক্ষে থাকতে দেয়া হয়। ওই দিন বিকালে ওই কক্ষে অবস্থানরত কিশোর ইমরান, রাকিব হোসেন, সুমন ও ইকবাল তাকে প্রচুর মারধর করে। পরে ওই কক্ষে থাকা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি কিশোরগঞ্জের মাসুক ৩০ মার্চ গভীর রাতে সেখানে থাকা সোহেল নামের অপর এক কিশোরের সহায়তায় শরণার্থী ক্যাম্পের ওই কিশোরকে বলাৎকার করে এবং এ ঘটনা অন্য কাউকে না বলার জন্য হুমকি দেয়। এরপর ওই কিশোর এ ঘটনা কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষকে জানালে কর্তৃপক্ষ তাকে ডরমিটরি ভবন থেকে অন্য ভবনে নিরাপদ হেফাজতে রাখে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় অভিযুক্ত মাসুকের অপর সঙ্গী সোহেলের জামিন হওয়ায় সে কেন্দ্র থেকে চলে যায়। আর মাসুককে এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রথমে অস্বীকার করলেও একপর্যায়ে টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের ওই কিশোরের আনা অভিযোগের কথা স্বীকার করে। এ ছাড়া চারজন মারধর করে বলে স্বীকার করে সে।
এ ক্ষেত্রে ওই কিশোরের অভিযোগ, মাসুক ও অপর চারজনের দোষ স্বীকারের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তদন্তকারী ওই ম্যাজিস্ট্রেট। তবে ওই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে কোনোরূপ নির্যাতন করেনি বলে তদন্তে উঠে আসে। পরে এ তদন্ত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ সমাজসেবা অধিদফতরকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, জেলা জজের তদন্তে যেসব ছেলের ব্যাপারে বলেছিল, আমরা সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পরে ছেলেগুলো জামিন পেয়ে চলে গেছে। কিশোররা সংশোধনাগারে এসেও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিলে তিনি বলেন, স্বাভাবিক ছেলেগুলো তো এখানে আসে না। ধরেই নিতে হয়, তারা এমনই করবে। তার পরও যতটা সংশোধন করা যায়। তিনি দাবি করেন, ‘বর্তমানে সংশোধনের হার অনেক ভালো। প্রথমবারেই ৯৫ ভাগ কিশোরই ভালো হয়ে যায়।’
No comments