বনের জায়গায় পাথর ভাঙার দুই শতাধিক অবৈধ কল
বন বিভাগের প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে স্থাপন করা হয়েছে পাথর ভাঙার দুই শতাধিক কল। এসব কল স্থাপনে পরিবেশের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকায় এসব অবৈধ কলে প্রকাশ্যে পাথর ভাঙার কাজ চলছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন ‘লোকদেখানো’ অভিযান চালানোয় দখলকারদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাফলং বন বিভাগের আওতাধীন রয়েছে মোট ২৩৮৫ দশমিক ১৭ একর জায়গা। এর মধ্যে অন্তত ৫০ একর জায়গা দখল করে রেখেছেন পাথর ভাঙার কল স্থাপনকারীরা। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত গোয়াইনঘাট থানার পাশাপাশি বন বিভাগে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই এখন আদালতে বিচারাধীন। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক লাগোয়া বন বিভাগের উঁচু-নিচু টিলা। সড়কের ঠিক পাশ ঘেঁষে বন বিভাগের জায়গায় পাথর ভাঙার কলগুলো স্থাপন করা হয়েছে। সড়কের নলজুরি, তামাবিল, মোহাম্মদপুর, সোনাটিলা ও বল্লাঘাট এলাকায় বন বিভাগের প্রায় ৫০ একর জায়গায় পাথর ভাঙার ছোট-বড় দুই শতাধিক কল স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রাকে করে ছোট-বড় নানা আকারের পাথর এনে ফেলা হয়। সেসব পাথর ভাঙার কাজ চলে দিনভর। এরপর এসব পাথর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রাকযোগে পাঠানো হয়।
মোহাম্মদপুর ও সোনাটিলা এলাকার চারজন বাসিন্দা জানান, বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বন বিভাগের জায়গা দখল করে নিয়েছেন। এই বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই তাঁরা জায়গা দখল করে নেওয়ার সাহস পেয়েছেন। ২০০৬ সালের দিকে হাতে গোনা কয়েকটি কল বসলেও এখন সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের দুই পাশের বন বিভাগের জায়গা পুরোটাই বেদখল হয়ে রয়েছে। বেদখল হওয়া জায়গায় পাথর ভাঙার কল বসানোয় বন বিভাগের গাছপালা পাথরের গুঁড়ায় ধূসর হয়ে গেছে। এমনকি সেখানে গাছের বিকাশও যথাযথভাবে হচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নলজুরি এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘অবৈধ স্টোন ক্রাশার মেশিন বসানোয় এ এলাকার মানুষ নানা রকম ভোগান্তি ও দুর্ভোগে পড়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বন বিভাগের জায়গা দখল করে অবৈধ এসব মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। একে তো মেশিনগুলো অবৈধ, অন্যদিকে অবৈধ এসব মেশিন বসানো হচ্ছে সরকারি জায়গা দখল করে। দুই ধরনের অপরাধ দখলকারীরা করলেও তাঁদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন।’ বন বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন বিভাগের জায়গা উদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ সময় অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় বন বিভাগের জায়গা বেদখল হতে শুরু করে। বন বিভাগের হিসাবে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। বন বিভাগের জাফলং বিট কর্মকর্তা আবদুল খালিক জায়গা বেদখল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘দখলকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা বাধাও দিতে পারছি না। এ অবস্থায় মামলা করা ছাড়া আমাদের করণীয় খুব বেশি একটা থাকে না। গত ১০ বছরে অন্তত ৫০ জন অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ তবে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জায়গা দখল করে নেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বৈধ স্টোন ক্রাশিং মেশিনগুলো সরিয়ে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এ লক্ষ্যে এখন কাজ চলছে। এটি হয়ে গেলে অবৈধ মেশিনগুলো উচ্ছেদ করতে সহায়তা হবে।’ জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে কেবল সিলেটে যোগদান করেছি। তবে পুরো বিষয়টি খোঁজ নিয়ে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
No comments