বাড়ছে খেলাপি ঋণ, দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো
জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরক্ষা দিতে পারছে না ব্যাংক। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোতে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমানত ও সুদের হারে। দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য। ২০১৬ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। যদিও ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল মাত্র ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এর বাইরে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ ঋণ হিসাবে এলে খেলাপি ঋণ হতো ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বছরের শেষে আর্থিক হিসাব ভালো রাখতে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। মূলত শেয়ারধারীদের বেশি হারে লভ্যাংশ দিতেই খেলাপি কমানো হয়েছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পায়নি। ফলে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে তা আদায়ে উদ্যোগের বড় অভাব আছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংকগুলো অর্থ আদায় করতে পারছে না। ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদের কিছু করা যাচ্ছে না। তারা আবারও ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে একটা দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে অন্যরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাবে। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যয় সমন্বয় করতে আমানতের সুদের হার কমিয়ে আনছে। ঋণের সুদের হার কমানোর চাপ সামলাতেই আমানতের সুদ হার কমানো হচ্ছে। অথচ ৫ বছর আগেও এই সুদের হার ছিল ১২-১৪ শতাংশ।
বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। খাদ্যপণ্যের বর্তমান মূল্যস্ফীতিও এর চেয়ে বেশি, ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন সুদ আয়নির্ভর অল্প আয়ের গ্রাহকেরা। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমানতের সুদ হার আর না কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদের হার কমাতে খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে ওই নির্দেশনায়। এ অবস্থায় সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মূলধনের ওপর আঘাত আসছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক নতুন নতুন মাশুল আদায় করে আয় সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। নতুন গ্রাহকেরাও ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমানত ও ঋণ উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে খেলাপি ঋণ। যার প্রভাব পড়ছে পুরো অর্থনীতিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০১৬ সাল শেষে হয়েছে ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের শেষে ব্যাংক ৬টির খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা, গত বছর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। জনতার খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২২৪ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ৩৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত বছর শেষে হয়েছে ২৩ হাজার ৫৭ কোটি।
২০১৫ সাল শেষে তা ছিল ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা, ২০১৫ সাল শেষে যা ছিল ১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ২ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে তা ছিল ৪ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বছরের শেষ সময়ে সব ব্যাংকই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছে। এ সময়ে নগদ আদায়ও ভালো হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পুনর্গঠন ও পুনঃ তফসিল করা ঋণ আবারও খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া নতুন করে নেওয়া ঋণও আদায় করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে এখনো অনিয়ম চলছে। এ ছাড়া বিশেষ ব্যবস্থায় পুনর্গঠন করা ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের কয়েকটি খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমানে খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামলিয়ে ব্যাংকের পক্ষে ওপরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে।
No comments