সুশাসন ও উন্নয়ন by হাসান ফেরদৌস
আজকাল সব মহলেই উন্নয়ন উন্নয়ন বলে নানা কথা শোনা যাচ্ছে, যদিও খুব স্পষ্ট নয় এই কথা বলে তারা ঠিক কী বোঝাতে চায়। একদল লোক, তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক রয়েছেন, পেশাদার কলম লিখিয়েও রয়েছেন, উন্নয়ন মানে প্রবৃদ্ধি, সে কথা বোঝাতে বিস্তর কসরত করছেন। কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনও গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাও কেউ কেউ বলছেন। এই দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্ক থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, একটা বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে যে সুশাসন ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সে উন্নয়নের সুফল কমবেশি সবার কাছে অর্থপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়া। সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম গভর্নেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের জন্য সুশাসন—এই নামে একটি বই লিখেছেন (পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, নিউইয়র্ক ২০১৬)। এই গ্রন্থে জাতিসংঘে কর্মরত এই অর্থনীতিবিদের মোদ্দা বক্তব্য, উন্নয়নের অধিকাংশ সূচকের নিক্তিতে বাংলাদেশ গেল কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জন করেছে, কিন্তু এই উন্নয়নকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, তার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব, যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও একটু মনোযোগী হয়। আর সে জন্য দরকার গোটা কয়েক কাঠামোগত পরিবর্তন। সুশাসনের দুটো দিক, তার একদিকে দেশের মানুষ, যারা সে দেশের প্রকৃত মালিক। অন্যদিকে সরকার ও আমলাতন্ত্র, যারা দেশের মানুষের নামে সে দেশ শাসন করে। সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান জন্মে, তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ। আর এই বিরোধের কারণটা খুব সোজা। সরকার, তা নির্বাচিত বা ওপর থেকে জুড়ে বসা হোক, যখন দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন প্রতিবাদ ওঠে দেশের মানুষের কাছ থেকে। ফলে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যার ঢেউ এসে লাগে অর্থনীতিতে, বিঘ্নিত হয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনচারিতা। সুশাসন ব্যাপারটা শুনতে বেশ বায়বীয় মনে হলেও বস্তুত তা নির্ণয়যোগ্য একটি ধারণা। আমাদের দেশ খুব সুশাসিত, সে কথা বললেই হবে না, তা মেপে ও ওজন করে দেখতে হবে। আর সে কাজটা করা খুব কঠিন এমন কিছু নয়। পণ্ডিতদের সূত্র অনুসরণ করে নজরুল ইসলাম সুশাসনের মোট ছয়টি সূচক বা ইন্ডিকেটর চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা, নিয়মবিধির প্রায়োগিকতা, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ। সুনির্দিষ্ট উপাত্ত-ভিত্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই সূচকের প্রতিটির গুণাগুণ আমরা খুবই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করতে পারি। এই পদ্ধতির ভিত্তিতেই কোন দেশ কতটা দুর্নীতিপরায়ণ বা কোন দেশ কতটা মুক্ত, তার বছরওয়ারি হিসাব চালু হয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের তিক্ত-মধুর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা যদি এই ছয়টি সূচকের ব্যবহার করি, তাহলে ফল কী দাঁড়ায়? নজরুল প্রধানত বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত ব্যবহার করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন চার্ট প্রস্তুত করেছেন, দেখা যাচ্ছে তার অধিকাংশেই বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্থিতি নেতিবাচক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মবিধির প্রতিপালন ও আইনের শাসন, এই সূচকসমূহে বাংলাদেশ এই গ্রুপের সবার নিচে। সরকারের কার্যকারিতার প্রশ্নে বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে সামান্য ওপরে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এক দায়বদ্ধতার প্রশ্নেই বাংলাদেশ ভারত ছাড়া বাকি সার্কভুক্ত দেশ থেকে এগিয়ে।
যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এত কথা, সেখানেও কিন্তু আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ বা ভারত থেকে পিছিয়ে। নজরুল জানাচ্ছেন, ১৯৮১-২০১০ এই সময়কালে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোতে অবশ্য বাংলাদেশ ৬ শতাংশ বা তার চেয়েও অধিক বার্ষিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আবক্রপথ বা ট্রাজেকটরি যে সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী, তা নয়। অনেক সময় তাকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি-পথ যে মোটেই ঋজু নয়, সে কথা আরও স্পষ্ট হয় যখন একই সময়ে অন্যান্য দেশ বা গ্রুপ কোনো আবক্রপথ ধরে চলেছে, তার একটা তুলনামূলক হিসাব নেই। ১৯৬১-১৯৮০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ। ১৯৮৪-২০১২ সময়কালে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও অধিক হারে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯১-২০১০ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আমরা যদি সুশাসনের ভিতটি অর্থাৎ নজরুল যে ছয়টি সূচক চিহ্নিত করেছেন, তা আরও খানিকটা মজবুত করতে পারতাম, তার ফল হতো দুই রকম। প্রথমত, আইনের শাসনের অভাব বা দুর্নীতি আমাদের প্রতিদিন নানাভাবে আক্রান্ত করে, জীবনের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই দুই খাতে পরিবর্তন অর্জিত হলে নাগরিক জীবন কিছুটা হলেও দুর্ভাবনামুক্ত হতো। অন্যদিকে দায়বদ্ধতা বাড়লে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হলে, সহিংসতা ঠেকানো গেলে বা সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়, তার আবক্রপথ অনেক বেশি আস্থাপূর্ণ হয়। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হলে নাগরিক জীবনে অধিক স্বস্তি আসে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান আস্থা জন্মে।
অতএব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম একটি ব্যবস্থাপত্র নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলানোর জন্য নজরুল সরকারের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চারে আনার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তি, সরকারের মেয়াদ কম হলে হরতাল বা সহিংস রাজনীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি তিনি বর্তমানের নির্বাচন পদ্ধতি বদলিয়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছেন। মোট ভোটের ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম পেয়ে বাংলাদেশে গত পাঁচটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হলে একদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেমন জোরদার হবে, তেমনি এখন যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন।
সুশাসনের একটি লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দুর্নীতি বলতে আমরা অনেক সময় নাগরিক জীবনে ব্যক্তিগতভাবে কী সংকটের মুখে পড়ি, সে বিবেচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। অথচ দুর্নীতির ফলে আসল ক্ষতি হয় পুরো দেশের, বিশেষত যখন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে এটা কত বড় সমস্যা নজরুল তার গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন নিজস্ব ক্ষমতাভিত্তিক উদ্যোগের বদলে বিদেশি কোম্পানিভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ খাত ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারত, তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
একইভাবে নীতিগত ভুলের জন্য বাংলাদেশকে এখন নিজের গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে ফের তাদের কাছ থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে কারও কারও পকেট ভারী হয়তো হয়েছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে দেশের।
এসব রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যার অভাব এখন পর্যন্ত প্রবল। তবে মানতে হবে বাংলাদেশ নানা সময়ে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে তার সাধুতা অস্বীকার করা যায় না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন হারের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিবিমুখ করতে হলে তাঁদের যথোপযুক্ত বেতন দিতে হবে, এ ব্যাপারে সব মহলেই একমত। রাজনৈতিক সংস্কার ও অধিক গণতান্ত্রিক কর্মপন্থার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী, সাম্প্রতিক সময়ে তারও ইঙ্গিত মিলেছে। তবে এসব শুধু লোক দেখানো, না এর পেছনে প্রকৃত সংস্কারের কোনো সদিচ্ছা আছে, তা অবশ্য এখনো প্রমাণের অপেক্ষায়। সংস্কারের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে নজরুল ঠিকই বলেছেন, কী পরিবর্তন চাই, কেন পরিবর্তন চাই, সে ব্যাপারে খুবই জরুরি ব্যাপক নাগরিক সংলাপ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সহমত ছাড়া কোনো সংস্কারই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এ ব্যাপারে আইন পরিষদের পাশাপাশি তথ্যমাধ্যমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মোটের ওপর নজরুল ইসলামের এই বইটি আমাদের চলতি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ কী হতে পারে, তার বাস্তবসম্মত কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সব যে আমাদের বিনা তর্কে মানতে হবে তা নয়। কিন্তু তর্ক হোক, আলোচনা হোক, সামনে এগোনোর সেটি সবচেয়ে উত্তম পথ। নজরুল ইসলামের এই গ্রন্থ সেই বিতর্ক শুরুর একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করল, এ কথা বলা বোধ হয় ভুল হবে না।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এত কথা, সেখানেও কিন্তু আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ বা ভারত থেকে পিছিয়ে। নজরুল জানাচ্ছেন, ১৯৮১-২০১০ এই সময়কালে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোতে অবশ্য বাংলাদেশ ৬ শতাংশ বা তার চেয়েও অধিক বার্ষিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আবক্রপথ বা ট্রাজেকটরি যে সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী, তা নয়। অনেক সময় তাকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি-পথ যে মোটেই ঋজু নয়, সে কথা আরও স্পষ্ট হয় যখন একই সময়ে অন্যান্য দেশ বা গ্রুপ কোনো আবক্রপথ ধরে চলেছে, তার একটা তুলনামূলক হিসাব নেই। ১৯৬১-১৯৮০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ। ১৯৮৪-২০১২ সময়কালে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও অধিক হারে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯১-২০১০ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আমরা যদি সুশাসনের ভিতটি অর্থাৎ নজরুল যে ছয়টি সূচক চিহ্নিত করেছেন, তা আরও খানিকটা মজবুত করতে পারতাম, তার ফল হতো দুই রকম। প্রথমত, আইনের শাসনের অভাব বা দুর্নীতি আমাদের প্রতিদিন নানাভাবে আক্রান্ত করে, জীবনের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই দুই খাতে পরিবর্তন অর্জিত হলে নাগরিক জীবন কিছুটা হলেও দুর্ভাবনামুক্ত হতো। অন্যদিকে দায়বদ্ধতা বাড়লে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হলে, সহিংসতা ঠেকানো গেলে বা সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়, তার আবক্রপথ অনেক বেশি আস্থাপূর্ণ হয়। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হলে নাগরিক জীবনে অধিক স্বস্তি আসে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ক্রমবর্ধমান আস্থা জন্মে।
অতএব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম একটি ব্যবস্থাপত্র নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলানোর জন্য নজরুল সরকারের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চারে আনার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তি, সরকারের মেয়াদ কম হলে হরতাল বা সহিংস রাজনীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি তিনি বর্তমানের নির্বাচন পদ্ধতি বদলিয়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছেন। মোট ভোটের ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও কম পেয়ে বাংলাদেশে গত পাঁচটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হলে একদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেমন জোরদার হবে, তেমনি এখন যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন।
সুশাসনের একটি লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দুর্নীতি বলতে আমরা অনেক সময় নাগরিক জীবনে ব্যক্তিগতভাবে কী সংকটের মুখে পড়ি, সে বিবেচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। অথচ দুর্নীতির ফলে আসল ক্ষতি হয় পুরো দেশের, বিশেষত যখন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে এটা কত বড় সমস্যা নজরুল তার গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন নিজস্ব ক্ষমতাভিত্তিক উদ্যোগের বদলে বিদেশি কোম্পানিভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ খাত ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারত, তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
একইভাবে নীতিগত ভুলের জন্য বাংলাদেশকে এখন নিজের গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে ফের তাদের কাছ থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে কারও কারও পকেট ভারী হয়তো হয়েছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে দেশের।
এসব রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যার অভাব এখন পর্যন্ত প্রবল। তবে মানতে হবে বাংলাদেশ নানা সময়ে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে তার সাধুতা অস্বীকার করা যায় না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন হারের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিবিমুখ করতে হলে তাঁদের যথোপযুক্ত বেতন দিতে হবে, এ ব্যাপারে সব মহলেই একমত। রাজনৈতিক সংস্কার ও অধিক গণতান্ত্রিক কর্মপন্থার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী, সাম্প্রতিক সময়ে তারও ইঙ্গিত মিলেছে। তবে এসব শুধু লোক দেখানো, না এর পেছনে প্রকৃত সংস্কারের কোনো সদিচ্ছা আছে, তা অবশ্য এখনো প্রমাণের অপেক্ষায়। সংস্কারের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে নজরুল ঠিকই বলেছেন, কী পরিবর্তন চাই, কেন পরিবর্তন চাই, সে ব্যাপারে খুবই জরুরি ব্যাপক নাগরিক সংলাপ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সহমত ছাড়া কোনো সংস্কারই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এ ব্যাপারে আইন পরিষদের পাশাপাশি তথ্যমাধ্যমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মোটের ওপর নজরুল ইসলামের এই বইটি আমাদের চলতি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ কী হতে পারে, তার বাস্তবসম্মত কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সব যে আমাদের বিনা তর্কে মানতে হবে তা নয়। কিন্তু তর্ক হোক, আলোচনা হোক, সামনে এগোনোর সেটি সবচেয়ে উত্তম পথ। নজরুল ইসলামের এই গ্রন্থ সেই বিতর্ক শুরুর একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করল, এ কথা বলা বোধ হয় ভুল হবে না।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments