পুরান ঢাকায় হালখাতার পরিসর কমেছে
বর্ষবরণের আগে এক জুয়েলারি ব্যবসায়ী দোকান পরিষ্কার করছেন। ছবিটি গতকাল পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকা থেকে তোলা |
দোকানের সব আসবাব বের করে দ্য সিলভার স্টোর নামের রুপার অলংকার বিক্রির ছোট্ট দোকানটি ধোয়া-মোছার কাজ করছিলেন বিজয় বসাক। বললেন, কাল নববর্ষ। পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খুলতে হবে। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের কোতোয়ালি রোডে গতকাল বুধবার দুপুরের দিকে গিয়ে বিজয় বসাকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য খুব মন্দা। তাই বড় ব্যবসায়ীরা ছাড়া এখন কেউ আর আগের মতো হালখাতা করেন না।’ তাঁতীবাজার ও শঁাখািরবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেল, অনেক জুয়েলার্সের কর্মচারীরা দোকানের আসবাব ও অলংকার প্রদর্শনের ট্রে পরিষ্কার করছেন। কোনো কোনো দোকানের দেয়ালে নতুন রং চড়ছে। ঝকঝকে সাইনবোর্ড উঠছে দু-একটি দোকানে। এ ছাড়া অলংকার তৈরির কারখানার কারিগরেরা নিজেদের যন্ত্রপাতি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করছেন। দেয়ালে জমে যাওয়া ময়লা ঘষে ঘষে তুলছেন। ফুল দিয়ে দোকান সাজানোর কাজ শুরু করেছে দুই–তিনটি দোকান। অলংকার তৈরির কারিগর সুজন সাহা বললেন, ‘প্রতিবছরই আমরা পয়লা বৈশাখের আগের দিন কারখানার সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করি। সবাই একসঙ্গে করি বলে উৎসব উৎসব মনে হয়। বেশ ভালোই লাগে।’ আজ বৃহস্পতিবার ১ বৈশাখ, ১৪২৩। নববর্ষের শুরুতেই হয় ‘হালখাতা’। পুরোনো হিসাব চুকিয়ে ফেলে ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার উৎসব। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলে আসছে। তবে আগের সেই জৌলুশ অনেকটাই বর্তমানে ভাটা পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারিবাজারের জুয়েলার্স ও অলংকার তৈরির কারখানা, শ্যামবাজার ও মৌলভীবাজারের আড়ত এবং ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানে কম-বেশি হালখাতা হয়। চৈত্র মাসেই ব্যবসায়ীরা তাঁদের ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানান। কেউ কেউ নিমন্ত্রণপত্র ছাপান। তবে মুঠোফোনেও কাজটি সারেন অনেকে। পুরান ঢাকার ‘হালখাতা’ উৎসব সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরাই বেশি করেন। সাধারণত লোকনাথ পঞ্জিকার তারিখ অনুযায়ী পয়লা বৈশাখের দিন হালখাতা হয়। দোকানগুলো ফুলে ফুলে সাজানো হবে। বাদ্যবাজনাও থাকবে। আমন্ত্রিত অতিথিদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন ব্যবসায়ীরা। তাঁতীবাজারের ঘোষ অ্যান্ড সন্সের পবিত্র চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘কার্ড ছাপিয়ে ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে হালখাতা করেন অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী। তবে সবাই দোকানপাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। কেউ কেউ নতুন রং করেন।’ তিনি জানান, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার ও ইসলামপুরে কয়েক হাজার অলংকার তৈরির কারখানা আছে। জুয়েলার্সের সংখ্যা হবে শ দুয়েক। এ ছাড়া সোনা বেচা-কেনা, বন্ধকি এবং অলংকার তৈরির সরঞ্জাম বিক্রির দোকান আছে ৬০০-৭০০। ব্যবসায়ীদের বর্ষবরণের আয়োজনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা মিলল তাঁতীবাজারে। শাহ আলম ১৫-১৬ বছর ধরে পয়লা বৈশাখের আগে লাল মলাটের নতুন খাতা বিক্রি করতে আসেন। তাঁকে পাওয়া গেল কোতোয়ালি রোডে। তিনি বলেন, ‘বিক্রি বাট্টা ভালো হচ্ছে। গতকাল (মঙ্গলবার) হাজার তিনেক টাকার খাতা বিক্রি করেছেন। তবে মূল বিক্রি হবে আজ (কাল) রাতে’। বিভিন্ন আকারের শীতল পাটি বিক্রি করছেন শহীদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, ২০০ থেকে ৬০০ টাকা দামের পাটি আছে তাঁর কাছে। মঙ্গলবার বিক্রি করেছেন হাজার দশেক টাকার পাটি। মূলত অলংকার তৈরির কারখানার মেঝেতে পাটি ব্যবহার করা হয়। নবাবগঞ্জ থেকে অপূর্ব মিষ্টান্ন ভান্ডারের অজয় ঘোষ বিভিন্ন ধরনের রসগোল্লা নিয়ে এসেছেন। প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা। অজয় বললেন, ‘৫ মণ মিষ্টি নিয়ে এসেছি। মনে হচ্ছে আজই (বুধবার) সব বিক্রি হয়ে যাবে।’ বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ১১১টি জুয়েলারি দোকান আছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন, কম-বেশি সব ব্যবসায়ী নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী হালখাতা করবেন। কার্ড ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে তিন থেকে চার হাজার ক্রেতাকে আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। দোকানপাট ধোয়া-মোছা শেষে সাজসজ্জার কাজ গতকাল রাতের মধ্যেই শেষ হবে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটের শারমীন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক খান বলেন, ‘আমরা ৫০০ ক্রেতাকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে হালখাতার দাওয়াত দিয়েছি। তবে যানজটের কারণে উপস্থিতি মনে হয় কম হবে।’ এদিকে ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইসলামপুরে কাপড় কিনতে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন। রোজার সময়ই তাঁদের আনাগোনা বেশি থাকে। তাই অধিকাংশ বকেয়া ওই সময়ই আদায় হয়। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী এখনো নিয়মরক্ষার জন্য হালখাতা করবেন। অনেকে আবার খ্রিষ্টীয় নববর্ষের সময় হালখাতা করে থাকেন। জানতে চাইলে ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি আবদুস সাত্তার ঢালী বলেন, ‘ইসলামপুরে আগে একসময় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে হালখাতা উদ্যাপন হতো। তবে সেই জৌলুশ আর নাই।’
No comments