দেশটা জাগুক, মানুষ জাগুক by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
দরজায় দাঁড়িয়ে ১৪২৩ সাল। বরাবরের মতো আমরা নতুন বছরকে বরণ করছি অনেক আশাবাদ নিয়ে—আমাদের আশাবাদের কেন্দ্রে দেশ ও মানুষ, সমাজ ও পরিবার। অনেক মানুষ নিশ্চয় আছেন, যাঁরা নতুন বছরে নিজেদের তরক্কিটাই সবকিছুর ওপরে রাখেন। কিন্তু অনেক বেশি সংখ্যার মানুষ নিজেদের বাইরেও দৃষ্টি দেন। তাঁদের চিন্তায় দেশ থাকে; প্রিয়জনদের পাশে প্রতিবেশীরাও থাকেন, থাকেন দেশের মানুষ। এঁরা জানেন দেশটা ভালো না থাকলে নিজের ভালো থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে, সম্ভবও হয় না।
১৪২৩–জুড়ে ভালো থাকুক বাংলাদেশ, এ রকম প্রত্যাশা বৈশাখের শুরুতে আমাদের সবার। বাংলাদেশের ভালো থাকা অবশ্য শুধু এর অর্থনীতি মজবুত থাকা নয়, শুধু এর যোগাযোগ অথবা শিক্ষায় উন্নতি সাধন নয়, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের জীবনে হাসি-আনন্দ থাকাটাও বাংলাদেশের ভালো থাকার শর্ত; নিরাপদ জীবনযাপন আর নিজেদের অধিকারগুলোর সুরক্ষাও বাংলাদেশের ভালো থাকার শর্ত। যে দেশে পরিবেশ বিপন্ন, ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য প্রকট; যে দেশে সুশাসন নেই, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী—সে দেশের মানুষ ভালো থাকে না, দেশটাও ভালো থাকে না। যে দেশের নারীরা ঘরের বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ নয়, যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন—হয় সরকারি নানা কানুনের বেড়াজালে রুদ্ধ হয়ে অথবা নানা উগ্র চিন্তার আগ্রাসনে, সে দেশ ভালো আছে, তা বলা যাবে না। যে দেশে শিশুরা থাকে নির্যাতনকারী অথবা ততায়ীর চাবুক-ছুরির নিচে, সে দেশ মোটেও ভালো থাকে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য, একেকটা বছর যায়, সেই বছরের হিসাবনিকাশ অথবা সালতামামি হয় এবং আমরা দেখি আমাদের অর্জনগুলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে নানা নেতি-অপ্রাপ্তির আড়ালে। তারপরও আমরা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি নতুন বছরের দিকে। ১৪২৩ সালের দিকেও আমরা তাকিয়ে থাকব এবং আশা করব ১৪২২ সালের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি এ বছর হবে না; পুরোনো বছরের অন্যায়-অবিচার-সহিংসতা এ বছর আমরা দেখব না। বরং ১৪২২-এ আমরা যা অর্জন করেছি, সেগুলো আমরা এ বছরও ধরে রাখব; আমাদের অর্জনের তালিকা আরও বড় হবে।
১৪২২ সালে আমাদের অর্থনীতি অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করেছে, আমাদের কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে নগরায়ণ যেখানে বাড়ছে ঝড়ের গতিতে, কৃষিজমি খেয়ে নিচ্ছে ইট আর কংক্রিট, সেখানে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি যেন একটা দৈবের ঘটনা। কিন্তু আমাদের কৃষকেরা কঠোর পরিশ্রম করে মানুষকে তিন বেলা খাইয়ে রপ্তানির জন্যও ফসল ফলাচ্ছেন। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা বিশাল অঙ্কের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু অর্থনীতির এই গতিশীলতার পেছনে যে কৃষক ও শ্রমিকেরা রয়েছেন, তাঁদের ভাগ্যের উন্নতি খুবই কম। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন তো সত্যিকার অর্থেই কঠিন। সারা বছর তাঁদের নিয়ে আমরা কি খুব ভেবেছি? ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যখন একজন প্রবাসী শ্রমিক তাঁর সামান্য মালামাল নিয়ে নামেন, তাঁকে যে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তা-ই আমাদের বলে দেয় তাঁদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী।
১৪২২ সালে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যচিত্রে উন্নতি হয়েছে, আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে। এক পদ্মা সেতু প্রকল্পই আমাদের একটা নতুন যুগে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে যুগে বিশ্বের বড় বড় মোড়লের অবাধ্য আমরা হতে পারি। আমাদের এই সাহসটা ধরে রাখতে হবে। ১৪২২ সালজুড়ে আমি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হতে দেখেছি। আত্মবিশ্বাসী মানুষের একটা পরিচয়, সে প্রশ্নহীন কোনো কিছুই মেনে নেয় না। জেনে-বুঝে, যাচাই করে সে সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, আগে বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি বড় কোনো সংস্থার সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দেশে তেমন প্রশ্ন হতো না, অথবা প্রশ্ন উঠলেও, প্রতিবাদ হলেও, তারা তা আমলে নিত না। এখন তাদের নিতে হয়। কারণ, এখন আমাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হচ্ছে।
কিন্তু একইভাবে যখন জেনে-বুঝে আমরা দেশের ভেতরের কোনো সংস্থার বা সরকারের কোনো সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করি, তখন এসব প্রতিষ্ঠান বা সরকার নাখোশ হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। পরিবেশবিদেরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য বিপদ ডেকে আনবে, এর পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করবে। তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধী নন, তাঁরা শুধু চান এটি অন্য কোথাও হোক। আমাদের অর্থনীতি যে হারে গতি পাচ্ছে, তাতে এ রকম একটি জায়গায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা একসময় বানাতে পারব, কিন্তু সুন্দরবন হারিয়ে গেলে আরেকটা সুন্দরবন কি তৈরি করতে পারব? অথচ এই উদ্বেগটাকে সরকার দেখছে উন্নয়নবিরোধী হিসেবে, পরিবেশের পক্ষের যুক্তিগুলোকে দেখছে সরকারবিরোধিতা হিসেবে। মুশকিল হচ্ছে, পরিবেশবিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হয়, তাহলে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে থাকলে, এটি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকলে, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার জন্য আমরা ছুটবও পশ্চিমা সংস্থাগুলোর কাছে, তাদের হাতেই তুলে দেব সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব।
১৪২৩ সালে সরকার একটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিক, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোনোখানে করার জন্য, বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোথাও করার জন্য। বাঁশখালীতে চারজন মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন, অথচ তাঁদের দাবিগুলো ছিল জীবনবাদী—তাঁরা পরিবেশ নষ্ট হতে দিতে চাননি, তাঁরা তাঁদের পেশা হারানোর ভয়ে ছিলেন। অথচ কাগজে দেখেছি, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রই পায়নি।
১৪২৩ সালে আমরা চাইব একটি বৃথা বিতর্কের অবসান হোক, যে বিতর্কের শিরোনাম ‘উন্নয়ন না গণতন্ত্র’। এই বিতর্কের একদিকে আছেন ক্ষমতাসীনেরা। তাঁরা বলেন, উন্নয়ন সর্বাগ্রে এবং উদাহরণ দেখান সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার, যেখানে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত এবং উন্নয়ন সততই ঊর্ধ্বমুখী। অথচ পশ্চিমা গণতন্ত্রী দেশগুলো অথবা জাপানে এ দুই বিষয় নিয়ে বিবাদ নেই, বিরোধ নেই। এমনকি ভারতেও, এই বিজেপি আমলেও উন্নয়ন যখন ঊর্ধ্বমুখী, গণতন্ত্রও অনেক দেশ থেকে বেশি জবাবদিহিমূলক। আমরা একাত্তরে যে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তার চারটি লক্ষ্যের একটি ছিল গণতন্ত্র। বলা বাহুল্য, এই চারটি লক্ষ্য একত্র করা গেলে, একাগ্রতার সঙ্গে এগুলোর প্রয়োগ করা গেলে, উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। একাত্তরে আমাদের শক্তি দিয়েছিল তৃণমূল। তৃণমূলে গণতন্ত্র সংহত করা ছিল আমাদের প্রত্যয়। অথচ তৃণমূলের সরকার অর্থাৎ স্থানীয় সরকারকে আমরা শক্তিশালী করতে পারিনি। ১৪২২-এ এসে সরকার ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যায়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করল, অথচ সে নির্বাচন হচ্ছে দলীয় ভিত্তিতে। এর ফলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে (আরও কয়েক দফা বাকি আছে!) প্রায় ৪০ জন প্রাণ হারাল। এক স্কুলছাত্র তার স্কুলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল ভোটের উৎসব দেখতে। কিন্তু সে বলি হলো সহিংস রাজনীতির। ওই ছেলেটির মতো আমরাও কেন জানি ধরে নিয়েছিলাম নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। কিন্তু এখন স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়, সব নির্বাচনেই চলে সহিংসতা। ১৪২৩ সালে এর নিরসন চাই। নারীদের জীবন অনেক বেশি অনিরাপদ হয়েছে ১৪২২ সালে। ধর্ষণ-হত্যা-নির্যাতন যেন প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তনুর মৃত্যু আমাদের বিবেককে নাড়িয়েছে, কিন্তু তনু তো অসংখ্যজনের একজন মাত্র। এই অসংখ্যজন আমাদের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে, বিচারের বাইরেও। বিচারহীনতা এখন একটা সংস্কৃতির নাম; এখন ক্ষমতা আর অর্থ সুরক্ষা দেয় দুর্বৃত্তদের। বিচারের লম্বা হাত তাদের ছুঁতে পারে না, যেমন ছুঁতে পারে না ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেওয়া ব্যাংক আর করপোরেট ঠাকুর, পাঁকা ব্যবসায়ী আর লগ্নি বাজারের খেলোয়াড়দের। ১৪২৩ যদি এরা আইনের জালে আটকায়, তাহলে নতুন বছরটা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হবে।
১৪২২-এর সালতামামির আপাতত ইতি টানা যাক। নেতির ছবিগুলো করুণ, বিবর্ণ, ভয় ধরানো। সেসবকে আড়ালে না ফেলেও আমরা বরং নতুন বছরের জন্য আমাদের আশাবাদটাই ব্যক্ত করি। শুরুতেই আমাদের প্রত্যাশা মানুষ ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক, দেশটা জাগুক। বৈশাখ তো জাগরণের মাস, শক্তির মাস। মানুষও জাগুক, অন্যায়কে-অবিচারকে প্রতিহত করার, দশের জন্য দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে। আমরা চাই আমাদের অর্থনীতি আরও সুদৃঢ় হোক, গণতন্ত্র সুদৃঢ় হোক। ১৪২২ ছিল বিরোধী রাজনীতিবিদদের জন্য ভুলে থাকার মতো একটি বছর; ১৪২৩-এ যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়, যেন তাঁদের পরিসরটা বাড়ে। আমরা চাই মানুষের অধিকারগুলো সুরক্ষিত হোক, শিশুদের জীবন হোক অনাবিল আনন্দের। আমাদের প্রত্যাশা অনেক, সেগুলো মূর্ত করার জন্য চাই সারা বছর নববর্ষের মেজাজ আর উৎসবের আমেজটি ধরে রাখা। এটি নিশ্চিত হয় যদি রাষ্ট্র সহনশীল হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো জনবান্ধব হয়, আইন ও বিচারের হাত শক্ত হয়, সাংস্কৃতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটে, অর্থনীতির মুখটি মানবিক হয়, মিডিয়া অকুতোভয় হয়।
এসবই সম্ভব। একাত্তরে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। এখন কেন পারব না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৪২৩–জুড়ে ভালো থাকুক বাংলাদেশ, এ রকম প্রত্যাশা বৈশাখের শুরুতে আমাদের সবার। বাংলাদেশের ভালো থাকা অবশ্য শুধু এর অর্থনীতি মজবুত থাকা নয়, শুধু এর যোগাযোগ অথবা শিক্ষায় উন্নতি সাধন নয়, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের জীবনে হাসি-আনন্দ থাকাটাও বাংলাদেশের ভালো থাকার শর্ত; নিরাপদ জীবনযাপন আর নিজেদের অধিকারগুলোর সুরক্ষাও বাংলাদেশের ভালো থাকার শর্ত। যে দেশে পরিবেশ বিপন্ন, ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য প্রকট; যে দেশে সুশাসন নেই, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী—সে দেশের মানুষ ভালো থাকে না, দেশটাও ভালো থাকে না। যে দেশের নারীরা ঘরের বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ নয়, যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন—হয় সরকারি নানা কানুনের বেড়াজালে রুদ্ধ হয়ে অথবা নানা উগ্র চিন্তার আগ্রাসনে, সে দেশ ভালো আছে, তা বলা যাবে না। যে দেশে শিশুরা থাকে নির্যাতনকারী অথবা ততায়ীর চাবুক-ছুরির নিচে, সে দেশ মোটেও ভালো থাকে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য, একেকটা বছর যায়, সেই বছরের হিসাবনিকাশ অথবা সালতামামি হয় এবং আমরা দেখি আমাদের অর্জনগুলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে নানা নেতি-অপ্রাপ্তির আড়ালে। তারপরও আমরা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি নতুন বছরের দিকে। ১৪২৩ সালের দিকেও আমরা তাকিয়ে থাকব এবং আশা করব ১৪২২ সালের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি এ বছর হবে না; পুরোনো বছরের অন্যায়-অবিচার-সহিংসতা এ বছর আমরা দেখব না। বরং ১৪২২-এ আমরা যা অর্জন করেছি, সেগুলো আমরা এ বছরও ধরে রাখব; আমাদের অর্জনের তালিকা আরও বড় হবে।
১৪২২ সালে আমাদের অর্থনীতি অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করেছে, আমাদের কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে নগরায়ণ যেখানে বাড়ছে ঝড়ের গতিতে, কৃষিজমি খেয়ে নিচ্ছে ইট আর কংক্রিট, সেখানে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি যেন একটা দৈবের ঘটনা। কিন্তু আমাদের কৃষকেরা কঠোর পরিশ্রম করে মানুষকে তিন বেলা খাইয়ে রপ্তানির জন্যও ফসল ফলাচ্ছেন। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা বিশাল অঙ্কের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু অর্থনীতির এই গতিশীলতার পেছনে যে কৃষক ও শ্রমিকেরা রয়েছেন, তাঁদের ভাগ্যের উন্নতি খুবই কম। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন তো সত্যিকার অর্থেই কঠিন। সারা বছর তাঁদের নিয়ে আমরা কি খুব ভেবেছি? ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যখন একজন প্রবাসী শ্রমিক তাঁর সামান্য মালামাল নিয়ে নামেন, তাঁকে যে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তা-ই আমাদের বলে দেয় তাঁদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী।
১৪২২ সালে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যচিত্রে উন্নতি হয়েছে, আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে। এক পদ্মা সেতু প্রকল্পই আমাদের একটা নতুন যুগে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে যুগে বিশ্বের বড় বড় মোড়লের অবাধ্য আমরা হতে পারি। আমাদের এই সাহসটা ধরে রাখতে হবে। ১৪২২ সালজুড়ে আমি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হতে দেখেছি। আত্মবিশ্বাসী মানুষের একটা পরিচয়, সে প্রশ্নহীন কোনো কিছুই মেনে নেয় না। জেনে-বুঝে, যাচাই করে সে সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, আগে বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি বড় কোনো সংস্থার সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দেশে তেমন প্রশ্ন হতো না, অথবা প্রশ্ন উঠলেও, প্রতিবাদ হলেও, তারা তা আমলে নিত না। এখন তাদের নিতে হয়। কারণ, এখন আমাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হচ্ছে।
কিন্তু একইভাবে যখন জেনে-বুঝে আমরা দেশের ভেতরের কোনো সংস্থার বা সরকারের কোনো সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করি, তখন এসব প্রতিষ্ঠান বা সরকার নাখোশ হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। পরিবেশবিদেরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য বিপদ ডেকে আনবে, এর পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করবে। তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধী নন, তাঁরা শুধু চান এটি অন্য কোথাও হোক। আমাদের অর্থনীতি যে হারে গতি পাচ্ছে, তাতে এ রকম একটি জায়গায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা একসময় বানাতে পারব, কিন্তু সুন্দরবন হারিয়ে গেলে আরেকটা সুন্দরবন কি তৈরি করতে পারব? অথচ এই উদ্বেগটাকে সরকার দেখছে উন্নয়নবিরোধী হিসেবে, পরিবেশের পক্ষের যুক্তিগুলোকে দেখছে সরকারবিরোধিতা হিসেবে। মুশকিল হচ্ছে, পরিবেশবিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হয়, তাহলে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে থাকলে, এটি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকলে, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার জন্য আমরা ছুটবও পশ্চিমা সংস্থাগুলোর কাছে, তাদের হাতেই তুলে দেব সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব।
১৪২৩ সালে সরকার একটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিক, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোনোখানে করার জন্য, বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্য কোথাও করার জন্য। বাঁশখালীতে চারজন মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন, অথচ তাঁদের দাবিগুলো ছিল জীবনবাদী—তাঁরা পরিবেশ নষ্ট হতে দিতে চাননি, তাঁরা তাঁদের পেশা হারানোর ভয়ে ছিলেন। অথচ কাগজে দেখেছি, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রই পায়নি।
১৪২৩ সালে আমরা চাইব একটি বৃথা বিতর্কের অবসান হোক, যে বিতর্কের শিরোনাম ‘উন্নয়ন না গণতন্ত্র’। এই বিতর্কের একদিকে আছেন ক্ষমতাসীনেরা। তাঁরা বলেন, উন্নয়ন সর্বাগ্রে এবং উদাহরণ দেখান সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার, যেখানে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত এবং উন্নয়ন সততই ঊর্ধ্বমুখী। অথচ পশ্চিমা গণতন্ত্রী দেশগুলো অথবা জাপানে এ দুই বিষয় নিয়ে বিবাদ নেই, বিরোধ নেই। এমনকি ভারতেও, এই বিজেপি আমলেও উন্নয়ন যখন ঊর্ধ্বমুখী, গণতন্ত্রও অনেক দেশ থেকে বেশি জবাবদিহিমূলক। আমরা একাত্তরে যে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তার চারটি লক্ষ্যের একটি ছিল গণতন্ত্র। বলা বাহুল্য, এই চারটি লক্ষ্য একত্র করা গেলে, একাগ্রতার সঙ্গে এগুলোর প্রয়োগ করা গেলে, উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। একাত্তরে আমাদের শক্তি দিয়েছিল তৃণমূল। তৃণমূলে গণতন্ত্র সংহত করা ছিল আমাদের প্রত্যয়। অথচ তৃণমূলের সরকার অর্থাৎ স্থানীয় সরকারকে আমরা শক্তিশালী করতে পারিনি। ১৪২২-এ এসে সরকার ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যায়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করল, অথচ সে নির্বাচন হচ্ছে দলীয় ভিত্তিতে। এর ফলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে (আরও কয়েক দফা বাকি আছে!) প্রায় ৪০ জন প্রাণ হারাল। এক স্কুলছাত্র তার স্কুলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল ভোটের উৎসব দেখতে। কিন্তু সে বলি হলো সহিংস রাজনীতির। ওই ছেলেটির মতো আমরাও কেন জানি ধরে নিয়েছিলাম নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। কিন্তু এখন স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়, সব নির্বাচনেই চলে সহিংসতা। ১৪২৩ সালে এর নিরসন চাই। নারীদের জীবন অনেক বেশি অনিরাপদ হয়েছে ১৪২২ সালে। ধর্ষণ-হত্যা-নির্যাতন যেন প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তনুর মৃত্যু আমাদের বিবেককে নাড়িয়েছে, কিন্তু তনু তো অসংখ্যজনের একজন মাত্র। এই অসংখ্যজন আমাদের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে, বিচারের বাইরেও। বিচারহীনতা এখন একটা সংস্কৃতির নাম; এখন ক্ষমতা আর অর্থ সুরক্ষা দেয় দুর্বৃত্তদের। বিচারের লম্বা হাত তাদের ছুঁতে পারে না, যেমন ছুঁতে পারে না ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেওয়া ব্যাংক আর করপোরেট ঠাকুর, পাঁকা ব্যবসায়ী আর লগ্নি বাজারের খেলোয়াড়দের। ১৪২৩ যদি এরা আইনের জালে আটকায়, তাহলে নতুন বছরটা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হবে।
১৪২২-এর সালতামামির আপাতত ইতি টানা যাক। নেতির ছবিগুলো করুণ, বিবর্ণ, ভয় ধরানো। সেসবকে আড়ালে না ফেলেও আমরা বরং নতুন বছরের জন্য আমাদের আশাবাদটাই ব্যক্ত করি। শুরুতেই আমাদের প্রত্যাশা মানুষ ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক, দেশটা জাগুক। বৈশাখ তো জাগরণের মাস, শক্তির মাস। মানুষও জাগুক, অন্যায়কে-অবিচারকে প্রতিহত করার, দশের জন্য দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে। আমরা চাই আমাদের অর্থনীতি আরও সুদৃঢ় হোক, গণতন্ত্র সুদৃঢ় হোক। ১৪২২ ছিল বিরোধী রাজনীতিবিদদের জন্য ভুলে থাকার মতো একটি বছর; ১৪২৩-এ যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়, যেন তাঁদের পরিসরটা বাড়ে। আমরা চাই মানুষের অধিকারগুলো সুরক্ষিত হোক, শিশুদের জীবন হোক অনাবিল আনন্দের। আমাদের প্রত্যাশা অনেক, সেগুলো মূর্ত করার জন্য চাই সারা বছর নববর্ষের মেজাজ আর উৎসবের আমেজটি ধরে রাখা। এটি নিশ্চিত হয় যদি রাষ্ট্র সহনশীল হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো জনবান্ধব হয়, আইন ও বিচারের হাত শক্ত হয়, সাংস্কৃতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটে, অর্থনীতির মুখটি মানবিক হয়, মিডিয়া অকুতোভয় হয়।
এসবই সম্ভব। একাত্তরে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। এখন কেন পারব না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments