সু চির জমানায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক by সোহরাব হাসান
আমরা আমাদের পুবের প্রতিবেশী মিয়ানমার সম্পর্কে খুবই কম জানি। আর সেই দেশটির মানুষ আরও কম জানে বাংলাদেশ সম্পর্কে। অথচ এই দুটি দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নেও আরাকান রাজসভার বিশেষ অবদান আছে। গত আড়াই দশকের রোহিঙ্গা সমস্যা দুই দেশের মধ্যকার দূরত্ব বহুগুণে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ‘ঐতিহ্য’ হয়তো রামুর ঘটনা বিস্তৃত হতে দেয়নি। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা রোহিঙ্গা সমস্যাটি জিইয়ে রেখেছেন বছরের পর বছর। এই অবস্থায় মিয়ানমারের পালাবদল তথা গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে কীভাবে দেখব আমরা? সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে কি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন হবে? অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আশা করা যায়? পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে জাতিগত নিপীড়ন ও গৃহযুদ্ধের শিকার হওয়া বাস্তুত্যাগী মানুষেরা যেভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কেড়েছে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। পশ্চিমারা বিবৃতিদানের বেশি কিছু করেনি। জাতিসংঘ উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনও মানবিক সাহায্যের মধ্যেই তাদের কর্তব্য সীমিত রেখেছে। গণতন্ত্রের নেত্রী বলে পরিচিত অং সান সু চিও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের ভয়ে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বরাবরই সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়ে আসছেন। রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ-রোহিঙ্গা বিরোধ নিষ্পত্তি কীভাবে হবে—জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সবার মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। এখন তাঁর নেতৃত্বে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গারা তাদের মৌলিক মানবাধিকারগুলো আশা করতে পারেন বৈকি। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক খবর নেই। দুই বছর আগে বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গার পর রাখাইন প্রদেশে যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, সম্প্রতি তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এটি ইতিবাচক। কিন্তু নতুন সরকারের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য মুসলমানদের (রোহিঙ্গাদের বাইরেও মিয়ানমারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমান আছে) ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় বেতারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুসলমানদের অভিহিত করেছেন অ্যাসোসিয়েট বা সহযোগী নাগরিক হিসেবে। মুসলমান নেতারা বলেছেন, এর মাধ্যমে তাঁদের দেশপ্রেমকে হেয় করা হয়েছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো তাঁরাও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে নির্বাচনে এনএলডি একজন মুসলমান প্রার্থী না দিলেও তাদের শতভাগ ভোট দলটি পেয়েছে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে এনএলডি এমন কিছু করবে না, যাতে উগ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কিংবা সেনাবাহিনী নাখোশ হয়।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পরও শঙ্কা ছিল যে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি না। নব্বইয়ে এনএলডি জয়ী হলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়েনি; বরং সেনাশাসন আরও জোরদার করেছিল। এনএলডির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। অং সান সু চি ছিলেন হয় গৃহান্তরীণ, না হয় কারাগারে। এবারে সেনাবাহিনী বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও মুঠো পুরোটা আগলা করেনি। স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষার মতো মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে।
২০০৮ সালে সামরিক জান্তা প্রণীত সংবিধানের ৫৯ ধারায় আছে, অং সান সু চির স্বামী ও সন্তান যেহেতু বিদেশি নাগরিক, সেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এটা মেনে নিয়েই সু চি ২০১২ সালের উপনির্বাচন করেন এবং সংসদে বিরোধী দলে নেতা হন। বলা যায়, রাজবন্দী থেকে সু চির ক্ষমতারোহণের সেটাই ছিল প্রথম ধাপ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সেনাবাহিনীর একগুঁয়েমিই বিগত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপির ভরাডুবি ও অং সান সু চির বিপুল বিজয় নিশ্চিত করেছে। এনএলডির বিজয়ে সেনা নেতৃত্ব হতবিহ্বল হলেও কিছু করার ছিল না। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তোর পতনের পর আগের নিয়মে অর্থাৎ সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত আসন রেখেই পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। পরে সেই ‘কোটা প্রথা’ তুলে নেওয়া হয়। মিয়ানমারে কত দিন থাকবে?
সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে অং সান সু চিকে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা বা স্টেট অ্যাডভাইজার করা হয়েছে। পররাষ্ট্র, প্রেসিডেন্টের দপ্তরসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও তিনি নিজের হাতে রেখেছেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর সু চি বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও তাঁর অবস্থান হবে প্রেসিডেন্টের ওপরে। এবং একজন বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকেই সু চি প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরাও তাঁর অনুগত। এর সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে। তৃতীয় বিশ্বের বহু জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রের আপসহীন নেতা-নেত্রী ক্ষমতার বাইরে থাকতে অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা লালন করলেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব ভুলে যান। মনে করেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। সু চি কথাটি মনে রাখবেন কি না ভবিষ্যতেই জানা যাবে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর এনএলডি সরকার যে প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাতে জাতিগত বিরোধের অবসান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আছে, যার অনেকগুলো সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নির্বাচনের আগে ও পরে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের শান্তিচুক্তি সই হলেও এখনো বেশ কিছু গ্রুপ অস্ত্র সংবরণ করেনি। সে ক্ষেত্রে সু চির প্রথম কর্তব্য হবে তাদের আলোচনার টেবিলে আনা।
গত সপ্তাহে কথা হয় মিয়ানমারে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে। কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে বিগত ও বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের আলোচনা হয়ে থাকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রোহিঙ্গা সমস্যা কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে নতুন সরকারের চিন্তাভাবনা কী? তিনি জানান, এনএলডির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চাইলেও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ মুহূর্তে কিছু ভাবছেন না।
গত পাঁচ বছরে থেইন সেইনের আধা সামরিক সরকার বেশ কিছু সংস্কারকাজ করেছে। সু চির দায়িত্ব হবে সেই সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়া। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব ছাত্র-তরুণ ও রাজনীতিক কারাবন্দী হয়েছেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া। এনএলডি সরকার ইতিমধ্যে আটক দুই শতাধিক ছাত্র ও রাজনীতিককে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব রাজবন্দী ও ছাত্রদের ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি বিশাল অগ্রগতি।
দেশটির গণমাধ্যম এখন মোটামুটি স্বাধীনতা ভোগ করলেও যেসব কালাকানুন রয়ে গেছে, সেসব বাতিলের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকেরা। সেনাশাসকদের সঙ্গে নিজের ফারাকটা যদি স্পষ্ট করতে চান, সেই দাবিও দ্রুত পূরণ করতে হবে সু চিকে। তবে নতুন সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সাধারণ মানুষের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য আনা। বর্তমানে সংবিধানে অনেক বিষয়ে সেনাবাহিনীর দায়মুক্তি দেওয়া আছে।
অং সান সু চির বাবা অং সান, যিনি স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাও, জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ পরিচালনার কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিপক্ষের হাতে ছয় সহযোগীসহ তিনি খুন হলে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরপর সামরিক শাসকেরা গায়ের জোরে জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে তাকে আরও উসকে দিয়েছেন। এনএলডির অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল প্রদেশগুলোকে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে জাতিগত বিরোধের অবসান ঘটানো। এ কারণে দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন নেওয়া হয়েছে সান জাতিগোষ্ঠী থেকে। তবে এ ক্ষেত্রেও সু চি ধীরে চলার পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন, ‘আমি সবাইকে নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে চাই।’ এই সবার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হবে কি?
বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সরকারের সম্পর্ক নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না পাওয়া গেলেও সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান আশাবাদী। সম্প্রতি মিয়ানমারের সাপ্তাহিক মিজিমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি আছে। বিশেষ করে সীমান্তে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলায় দুই দেশের সরকারই একযোগে কাজ করছে। এতে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে উচ্চপর্যায়ের সফর হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সেটি হয়নি নানা কারণে। তিনি আশা করছেন, মিয়ানমারের নতুন সরকার এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যও বেড়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ঋদ্ধ মিয়ানমারে বাংলাদেশের বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ আছে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিবিড় হলেও অতীতের সবটা মধুর, তা বলা যাবে না। মিয়ানমারের দাবি, সরকার বিরোধী একাধিক সশস্ত্র গ্রুপকে তারা সহায়তা করছে। তবে দেশটি যখন বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন চীনই পাশে দাঁড়িয়েছিল। অং সান সু চি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম যে বিদেশি অতিথি ইয়াঙ্গুনে এসেছেন, তিনি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, নতুন সরকারের সঙ্গে তাঁরা আরও বেশি আস্থা নিয়ে কাজ এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে চান। মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ১৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার পেতেই আমাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। গত জুনে সু চি যখন বেইজিং গিয়েছিলেন, তখন চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। যদিও চীন সামরিক সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কখনোই কথা বলেনি। চীনের দেখাদেখি ভারতও সেখানে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়িয়েছে। মিয়ানমার থেকে ভারত পাইপলাইনে গ্যাস আমদানি করছে, যাতে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি সরকারের অসহযোগিতার জন্য সম্ভব হয়নি। একদা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ও চীন তার সুযোগ নিতে তৎপর। আমরা কী করব?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
গত নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পরও শঙ্কা ছিল যে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি না। নব্বইয়ে এনএলডি জয়ী হলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়েনি; বরং সেনাশাসন আরও জোরদার করেছিল। এনএলডির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। অং সান সু চি ছিলেন হয় গৃহান্তরীণ, না হয় কারাগারে। এবারে সেনাবাহিনী বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও মুঠো পুরোটা আগলা করেনি। স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষার মতো মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে।
২০০৮ সালে সামরিক জান্তা প্রণীত সংবিধানের ৫৯ ধারায় আছে, অং সান সু চির স্বামী ও সন্তান যেহেতু বিদেশি নাগরিক, সেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এটা মেনে নিয়েই সু চি ২০১২ সালের উপনির্বাচন করেন এবং সংসদে বিরোধী দলে নেতা হন। বলা যায়, রাজবন্দী থেকে সু চির ক্ষমতারোহণের সেটাই ছিল প্রথম ধাপ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সেনাবাহিনীর একগুঁয়েমিই বিগত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপির ভরাডুবি ও অং সান সু চির বিপুল বিজয় নিশ্চিত করেছে। এনএলডির বিজয়ে সেনা নেতৃত্ব হতবিহ্বল হলেও কিছু করার ছিল না। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তোর পতনের পর আগের নিয়মে অর্থাৎ সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত আসন রেখেই পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। পরে সেই ‘কোটা প্রথা’ তুলে নেওয়া হয়। মিয়ানমারে কত দিন থাকবে?
সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে অং সান সু চিকে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা বা স্টেট অ্যাডভাইজার করা হয়েছে। পররাষ্ট্র, প্রেসিডেন্টের দপ্তরসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও তিনি নিজের হাতে রেখেছেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর সু চি বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও তাঁর অবস্থান হবে প্রেসিডেন্টের ওপরে। এবং একজন বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকেই সু চি প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরাও তাঁর অনুগত। এর সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে। তৃতীয় বিশ্বের বহু জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রের আপসহীন নেতা-নেত্রী ক্ষমতার বাইরে থাকতে অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা লালন করলেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব ভুলে যান। মনে করেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। সু চি কথাটি মনে রাখবেন কি না ভবিষ্যতেই জানা যাবে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর এনএলডি সরকার যে প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাতে জাতিগত বিরোধের অবসান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আছে, যার অনেকগুলো সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নির্বাচনের আগে ও পরে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের শান্তিচুক্তি সই হলেও এখনো বেশ কিছু গ্রুপ অস্ত্র সংবরণ করেনি। সে ক্ষেত্রে সু চির প্রথম কর্তব্য হবে তাদের আলোচনার টেবিলে আনা।
গত সপ্তাহে কথা হয় মিয়ানমারে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে। কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে বিগত ও বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের আলোচনা হয়ে থাকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রোহিঙ্গা সমস্যা কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে নতুন সরকারের চিন্তাভাবনা কী? তিনি জানান, এনএলডির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চাইলেও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ মুহূর্তে কিছু ভাবছেন না।
গত পাঁচ বছরে থেইন সেইনের আধা সামরিক সরকার বেশ কিছু সংস্কারকাজ করেছে। সু চির দায়িত্ব হবে সেই সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়া। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব ছাত্র-তরুণ ও রাজনীতিক কারাবন্দী হয়েছেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া। এনএলডি সরকার ইতিমধ্যে আটক দুই শতাধিক ছাত্র ও রাজনীতিককে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব রাজবন্দী ও ছাত্রদের ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি বিশাল অগ্রগতি।
দেশটির গণমাধ্যম এখন মোটামুটি স্বাধীনতা ভোগ করলেও যেসব কালাকানুন রয়ে গেছে, সেসব বাতিলের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকেরা। সেনাশাসকদের সঙ্গে নিজের ফারাকটা যদি স্পষ্ট করতে চান, সেই দাবিও দ্রুত পূরণ করতে হবে সু চিকে। তবে নতুন সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সাধারণ মানুষের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য আনা। বর্তমানে সংবিধানে অনেক বিষয়ে সেনাবাহিনীর দায়মুক্তি দেওয়া আছে।
অং সান সু চির বাবা অং সান, যিনি স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাও, জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ পরিচালনার কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিপক্ষের হাতে ছয় সহযোগীসহ তিনি খুন হলে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরপর সামরিক শাসকেরা গায়ের জোরে জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে তাকে আরও উসকে দিয়েছেন। এনএলডির অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল প্রদেশগুলোকে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে জাতিগত বিরোধের অবসান ঘটানো। এ কারণে দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন নেওয়া হয়েছে সান জাতিগোষ্ঠী থেকে। তবে এ ক্ষেত্রেও সু চি ধীরে চলার পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন, ‘আমি সবাইকে নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে চাই।’ এই সবার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হবে কি?
বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সরকারের সম্পর্ক নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না পাওয়া গেলেও সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান আশাবাদী। সম্প্রতি মিয়ানমারের সাপ্তাহিক মিজিমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি আছে। বিশেষ করে সীমান্তে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলায় দুই দেশের সরকারই একযোগে কাজ করছে। এতে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে উচ্চপর্যায়ের সফর হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সেটি হয়নি নানা কারণে। তিনি আশা করছেন, মিয়ানমারের নতুন সরকার এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যও বেড়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ঋদ্ধ মিয়ানমারে বাংলাদেশের বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ আছে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিবিড় হলেও অতীতের সবটা মধুর, তা বলা যাবে না। মিয়ানমারের দাবি, সরকার বিরোধী একাধিক সশস্ত্র গ্রুপকে তারা সহায়তা করছে। তবে দেশটি যখন বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন চীনই পাশে দাঁড়িয়েছিল। অং সান সু চি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম যে বিদেশি অতিথি ইয়াঙ্গুনে এসেছেন, তিনি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, নতুন সরকারের সঙ্গে তাঁরা আরও বেশি আস্থা নিয়ে কাজ এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে চান। মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ১৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার পেতেই আমাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। গত জুনে সু চি যখন বেইজিং গিয়েছিলেন, তখন চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। যদিও চীন সামরিক সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কখনোই কথা বলেনি। চীনের দেখাদেখি ভারতও সেখানে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়িয়েছে। মিয়ানমার থেকে ভারত পাইপলাইনে গ্যাস আমদানি করছে, যাতে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি সরকারের অসহযোগিতার জন্য সম্ভব হয়নি। একদা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ও চীন তার সুযোগ নিতে তৎপর। আমরা কী করব?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments