বঙ্গবন্ধুর প্রেসবক্সে ব্রিটিশ সাংবাদিকের এক বেলা

ফুটবল নিয়ে তাঁর নতুন বইয়ের রসদ খুঁজতে বাংলাদেশে এসেছেন জেমস মন্টেগো
বুকপকেটে এক টুকরো ময়লা কাগজ নিয়ে ঘুরতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’। সেই কাগজের ওপর ছিল ভুসা-কালিমাখা একটি ছোট হাতের কোমল ছাপ। মেয়ের ওই স্মৃতিচিহ্নটুকু নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ফল বেচতেন রহমত। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসে যখন জেমস মন্টেগোর সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল, হঠাৎই মানিব্যাগ খুলে বসলেন ভদ্রলোক। মানিব্যাগের এক কোণে রাখা পাঁচ মাস বয়সী মেয়ে লিমার ছবিটি দেখালেন ব্রিটিশ সাংবাদিক। মেয়েকে দেশে রেখে বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘুরছেন নিজের বইয়ের রসদ জোগাড় করতে। মন্টেগো একজন ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক। এ ছাড়া তাঁর আরও কিছু পরিচয় আছে। ফুটবল লেখক, এমনকি ফটোগ্রাফার হিসেবেও আলাদা খ্যাতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির ওপর পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু লেখালেখিকে ভালোবেসে জড়িয়ে পড়েছেন সাংবাদিকতায়। বই লিখছেন মনের আনন্দে। নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন ও ওয়ার্ল্ড সকারে নিয়মিতই লেখেন তিনি। বিবিসিতেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ফিলিস্তিনে গিয়ে ফুটবল ম্যাচ কভার করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও ফুটবল ম্যাচ দেখে তা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। কাল সেসব কথাই বলছিলেন, ‘আমি আসলে ফুটবল ও রাজনীতির মধ্যে একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করি।’ আর সেই চেষ্টা থেকেই লিখে ফেলেন নিজের প্রথম বই ‘হোয়েন ফ্রাইডে কামস: ফুটবল ইন দ্য ওয়ার জোন’। এই বই লিখেই সাড়া ফেলে দেন যুক্তরাজ্যে। ২০০৯ সালে জিতেছিলেন যুক্তরাজ্যের সেরা উদীয়মান ক্রীড়া লেখকের পুরস্কার। এবার বাংলাদেশেও ঘুরতে আসা নতুন একটি বইয়ের কাজেই।  মন্টেগোর আরেকটি বইয়ের নাম ‘থার্টি ওয়ান নিল: অন দ্য রোড উইথ ফুটবল আউটসাইডারস, আ ওয়ার্ল্ড কাপ ওডেসি’। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আমেরিকান সামোয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ৩১-০ গোলের ওই জয় এসেছে নামকরণে। সেটির সূত্র ধরেই ফুটবলে তেমন বলার মতো শক্তি নয় এমন দেশগুলোর বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন এই বইয়ের উপজীব্য। গত ফুটবল বিশ্বকাপ কাভার করেছেন ব্রাজিলে। কাভার করেছেন এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক গেমসসহ আরও অনেক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। কেন ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিকতা বেছে নিলেন, প্রশ্নটা করতেই একগাল হেসে বললেন, ‘আমি কাজটা অনেক উপভোগ করি। এখানে স্বাধীনভাবে অনেক কাজ করা যায়।’ তা বাংলাদেশ কেমন লাগছে? ‘প্রথমে শুনেছিলাম এখানে নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা আছে। আমার বাবাও প্রথমে বাংলাদেশের কথা শুনে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু আমি এখানে এসে কোনো সমস্যা দেখলাম না। সবাই খুব বন্ধুবৎসল। অতিথিপরায়ণ। আমার খুবই ভালো লেগেছে সবকিছু।’ ওয়েস্ট হামের বাসিন্দা মন্টেগো। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বাবা-ছেলে মিলে ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডের খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ছুটে যান। বাংলাদেশের ফুটবলের কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এসে দেখছিলেন সবকিছু অন্য দৃষ্টিতেই। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় স্টেডিয়ামের নকশা, স্থাপত্যশৈলীর প্রশংসা করলেন। এই মাঠে খেলে গেছেন লিওনেল মেসি, আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হয়েছিল এই স্টেডিয়ামেই—তথ্যটা জানাতেই অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই নাকি!’ মাঠের মধ্যে ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতা কাপের ম্যাচের অনেক ছবি তুললেন। যে কজন দর্শকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাদের নিয়েই মুগ্ধতা ছড়াল। এত কম দর্শক দেখে একটু আফসোস করে বললেন, ‘আজ শুক্রবার, হয়তো ছুটির দিন বলেই লোক আসেনি।’ ছুটির দিনে তো উল্টো ভিড় হওয়ার কথা। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে যে অনেক দিনই দর্শকখরা, সেটি বলা হলো তাঁকে। মন্টেগো বললেন, ‘নিশ্চয়ই সুদিন ফিরবে বাংলাদেশের ফুটবলে।’ নিজের টুইটারে স্বাধীনতা কাপের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এখনো ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ড দেখতে বেশ ভালোই লাগে।’ বাংলাদেশের সবকিছুই ভালো লেগেছে মন্টেগোর। আগামী জুনে প্রকাশিতব্য তাঁর পরবর্তী বইয়ে ‘বাংলাদেশ’ অধ্যায়টা তাই পড়ার মতোই হবে বলে আশা করা যায়!

No comments

Powered by Blogger.