দলিত মানুষের নেতা ড. আম্বেদকারের প্রতি শ্রদ্ধা by মিজানুর রহমান খান
সে ছিল এক নিরীহ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত স্কুল বালক। কিন্তু সারাক্ষণ তার মন খারাপ থাকত। শ্রেণিকক্ষে কেউ তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত না। অনেকেই তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। কারণ, সে ছিল নিম্নবর্ণের। এ জন্য তাকে কখনো ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হতো। তাকে বসতে হতো ক্লাসের বাইরে। তার যদি পানির তেষ্টা পেত, তাহলে তার পক্ষে দ্রুত তা মেটানো সম্ভব হতো না। তাকে স্কুলের উচ্চবর্ণের কারও দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো। কারণ, নীচু জাতের বলে তাকে মগ বা জগ ছুঁতে দেওয়া হতো না। সহপাঠীদের মধ্যে উঁচু জাতের কেউ বেশ উঁচু থেকে পানি ঢেলে দিলে পরেই তার সেই অবাক জলপান সম্পন্ন হতো। এই ছেলেটি আর কেউ নন, তিনি অবিভক্ত ভারতে আমাদের পূর্বপুরুষদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন নেতা ড. বি আর আম্বেদকার, যাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মুখ্য প্রণেতা টমাস জেফারসনের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তিনি ভারতের নয়, বিশ্বের দলিত ও অস্পৃশ্য মানুষের অবিসংবাদী নেতা। তাঁকে নিশ্চয় মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও তুলনা করা চলে। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল ড. আম্বেদকারের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী, যিনি ভারতে বাবাসাহেব হিসেবেও সমধিক পরিচিত। তাঁর জন্মদিনের এক দিন আগে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. বি আর আম্বেদকারের মতো নেতাদের আমরা সময়-সুযোগ পেলে কালেভদ্রে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করি। অথচ তাঁরা আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমরা আজ যে সংবিধান অনুসরণ করছি, তাতে আমরা ১৯৪৯ সালের ভারতীয় সংবিধান ও ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ঋণ স্বীকার না করে পারি না। কিন্তু অনেক সময় আমরা মনে রাখি না, ওই দুটি সংবিধানই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইনের কাছে অনেকাংশে ঋণী। আবার এই দুটি আইন ব্রিটেন ধুপ করে চাপিয়ে দেয়নি, ওই আইনের অনেকখানি অবিভক্ত ভারতের জাতীয় নেতাদের সম্মিলিত চিন্তার ফসল ছিল। ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একটা দীর্ঘসময় ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। তারা গত শতাব্দীর গোড়াতেই স্বরাজ সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ড. আম্বেদকার সেই প্রক্রিয়া থেকেই মাথা উঁচু করে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ।
১৯৪৩ সালে পুনের গোখলে মেমোরিয়াল হলে রানাদের ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে ‘রানাডে, গান্ধী ও জিন্নাহ’ শিরোনামের এক আলোচনা সভায় আম্বেদকার বলেছিলেন, সামাজিক উন্নতি ও নবায়নে মহান মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রানাডে জানতেন বর্ণব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। আর ইতিহাস হলো মহান মানুষের আত্মজীবনী। মহান মানুষের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের অপরিহার্য উপাদান বলেই আমরা চিত্রতারকাদের চেয়ে তাঁদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করি।’ কিন্তু যেটা বিপজ্জনক, তা হলো ব্যক্তিবন্দনা। মুক্তচিন্তার বড় বাধা ব্যক্তিবন্দনা। আমাদের জাতীয় রাজনীতির সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও তার বিকাশের জন্য ব্যক্তিবন্দনা একটা বিরাট দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। পুনের ওই ভাষণে ড. আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘এ কারণে আমি আজ নিন্দিত যে ভারতের রাজনীতিতে নৈরাজ্য ডেকে আনার জন্য আমি গান্ধী ও জিন্নাহর সমালোচনা করেছিলাম। আর করেছি সমালোচনা অথচ বলা হচ্ছে, আমি নাকি তাঁদের প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ছড়িয়েছি। এর উত্তরে আমি বলতে চাই, আমি একজন সমালোচক এবং সেই ভূমিকাটাই অব্যাহত রাখতে চাই। হতে পারে আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি সব সময় এটা ভাবি যে অন্যের কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা ও আদেশ অনুসরণ কিংবা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে দেখেও নীরবে বসে থাকার চেয়ে এই ভুল করা উত্তম।’
আমরা আম্বেদকারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আমরা কি নিজেদের দিকে প্রশ্ন তুলব যে আমরা কোন পথ বেছে নেব? মহান নেতাদের সমালোচনা করা, নাকি স্তুতি করা? দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া মানুষদের নেতার অনুসারীদের কি আজ এ কথা বলতে হবে না যে ‘আমি ঘৃণা করি অবিচার, কর্তৃত্ববাদিতা, মোসাহেবি, বাগাড়ম্বর এবং আমার ঘৃণা তাদের প্রতি, যারা এসবের জন্য অভিযুক্ত। আমি আমার সমালোচকদের বলতে চাই, আমার ঘৃণা করার সামর্থ্যকেই আমি আমার প্রকৃত শক্তি হিসেবে গণ্য করি। তাই মি. গান্ধী ও মি. জিন্নাহ, এই দুই ব্যক্তি যারা ভারতীয় রাজনৈতিক অগ্রগতিকে একটি অচলাবস্থার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সমালোচনা করার জন্য আমি কোনো ক্ষমা প্রার্থনা করি না। কংগ্রেসি পত্রিকাগুলো আমার নিন্দা করে, সেটা আমি জানি। আমি এর কোনো মূল্য দিই না। তারা কখনো আমার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেনি। আমার প্রতি কংগ্রেসি প্রেসের ব্যথাটা কোথায় তা বুঝতে পারি, এটা বলা অশোভন হবে না যে আমার প্রতি তাদের অসূয়াপ্রসূত মনোভাব আসলে অস্পৃশ্যদের প্রতি হিন্দুদের বীতরাগেরই প্রতিফলন। আমি আদর্শিক ব্যক্তির বন্দনা অপছন্দ করি। আমি গান্ধী ও জিন্নাহকে ঘৃণা করি না, অপছন্দ করি, কারণ আমি ভারতকে অধিকতর ভালোবাসি। এটাই একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদীর বিশ্বাস হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস আছে যে আমার দেশবাসী একদিন বুঝতে পারবে যে মানুষের চেয়ে দেশ বড়। গান্ধী বা জিন্নাহর বন্দনা করার চেয়ে দেশসেবা মহত্তম এবং দুটি বিষয় কেবলই যে আলাদা তা-ই নয়, এমনকি কখনো তা পরস্পরবিরোধী হতে পারে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আম্বেদকারের জন্মস্থানে গিয়ে ১৪ এপ্রিল শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে নিজকেই আম্বেদকারের স্বপ্নের ফসল বলে বর্ণনা করেছেন। মোদি বলেছেন, ‘একটি শিশু, যার মা অন্যের বাড়িতে গিয়ে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহার করতেন, সেই সন্তান বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হলে তার কৃতিত্ব বাবাসাহেবকেই দিতে হবে।’ গত সোমবার নাগপুরে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী আম্বেদকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সোনিয়া সেখানে এক জনসভায় বলেন, ‘দক্ষিণপন্থী শক্তি আজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে নষ্ট করছে, এর মাধ্যমে তারা ড. আম্বেদকারের রচিত সংবিধানের চরিত্র বদলে দিচ্ছে।’
এনডিটিভির এক খবরে বলা হয়, এটা লক্ষণীয় যে রাহুল গান্ধী আম্বেদকারের ১২৫তম জন্মদিনের দুদিন আগে গিয়ে নাগপুরের এক গ্রামে হাজির হয়েছেন, যেখানে আম্বেদকার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, রাহুল সেখানে একটি পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন, যেখানে সম্প্রতি দলিত মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষদের জন্য আমরা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে যতটা পারা যেত, সেটুকু রক্ষাকবচ রাখিনি। আজও তেমন কোনো প্রবণতা দেখাই না। আইন কমিশন দলিত শ্রেণির জন্য কতিপয় অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইনের মুসাবিদা করে দিয়েছে, সেটাও শতভাগ দেশীয় উদ্যোগে নয়, বিদেশি সংস্থার তদারকি ছিল। কিন্তু সেই আইনের খসড়াটা অনাদরে ফেলে রাখা হয়েছে। তারা সংখ্যায় অল্প, কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। শেষ করি আম্বেদকারের একটি উক্তি দিয়ে। গান্ধী আম্বেদকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতেই কংগ্রেসের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনার কারণ জানতে চাইলেন। সেটা ১৯৩১ সাল। উত্তরে আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘গান্ধীজি আমার কোনো মাতৃভূমি নেই।’ অস্পৃশ্যতা তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা কিন্তু এই ভূখণ্ড নিয়ে গর্বিত হবেন না।’ তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সংবিধানে বিশেষ তফসিল করে আম্বেদকার তাদের জাতে তোলার রক্ষাকবচ নিশ্চয় তৈরি করে রেখে যেতে পেরেছেন। সে কারণে আমি আম্বেদকারকে নিয়ে খুবই গর্বিত হই, যখন শুনি, ফরিদপুরের ওড়াকান্দিখ্যাত আমাদের মতুয়া সম্প্রদায়ের এক মেয়ে ভারতের লোকসভার সদস্য হয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ। নির্বাচিত হওয়ার পরে আমাদের এই দিদিকে টেলিফোনে অভিবাদন জানিয়েছিলাম। প্রচারবিমুখ এই ভারতীয় সাংসদ এ মাসেই এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসতে পারেন।
আমরা ড. আম্বেদকারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। জগৎ-জুড়ে অস্পৃশ্য মানুষের জয় হোক।
গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. বি আর আম্বেদকারের মতো নেতাদের আমরা সময়-সুযোগ পেলে কালেভদ্রে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করি। অথচ তাঁরা আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমরা আজ যে সংবিধান অনুসরণ করছি, তাতে আমরা ১৯৪৯ সালের ভারতীয় সংবিধান ও ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ঋণ স্বীকার না করে পারি না। কিন্তু অনেক সময় আমরা মনে রাখি না, ওই দুটি সংবিধানই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইনের কাছে অনেকাংশে ঋণী। আবার এই দুটি আইন ব্রিটেন ধুপ করে চাপিয়ে দেয়নি, ওই আইনের অনেকখানি অবিভক্ত ভারতের জাতীয় নেতাদের সম্মিলিত চিন্তার ফসল ছিল। ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একটা দীর্ঘসময় ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। তারা গত শতাব্দীর গোড়াতেই স্বরাজ সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ড. আম্বেদকার সেই প্রক্রিয়া থেকেই মাথা উঁচু করে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ।
১৯৪৩ সালে পুনের গোখলে মেমোরিয়াল হলে রানাদের ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে ‘রানাডে, গান্ধী ও জিন্নাহ’ শিরোনামের এক আলোচনা সভায় আম্বেদকার বলেছিলেন, সামাজিক উন্নতি ও নবায়নে মহান মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রানাডে জানতেন বর্ণব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। আর ইতিহাস হলো মহান মানুষের আত্মজীবনী। মহান মানুষের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের অপরিহার্য উপাদান বলেই আমরা চিত্রতারকাদের চেয়ে তাঁদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করি।’ কিন্তু যেটা বিপজ্জনক, তা হলো ব্যক্তিবন্দনা। মুক্তচিন্তার বড় বাধা ব্যক্তিবন্দনা। আমাদের জাতীয় রাজনীতির সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও তার বিকাশের জন্য ব্যক্তিবন্দনা একটা বিরাট দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। পুনের ওই ভাষণে ড. আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘এ কারণে আমি আজ নিন্দিত যে ভারতের রাজনীতিতে নৈরাজ্য ডেকে আনার জন্য আমি গান্ধী ও জিন্নাহর সমালোচনা করেছিলাম। আর করেছি সমালোচনা অথচ বলা হচ্ছে, আমি নাকি তাঁদের প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ছড়িয়েছি। এর উত্তরে আমি বলতে চাই, আমি একজন সমালোচক এবং সেই ভূমিকাটাই অব্যাহত রাখতে চাই। হতে পারে আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি সব সময় এটা ভাবি যে অন্যের কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা ও আদেশ অনুসরণ কিংবা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে দেখেও নীরবে বসে থাকার চেয়ে এই ভুল করা উত্তম।’
আমরা আম্বেদকারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আমরা কি নিজেদের দিকে প্রশ্ন তুলব যে আমরা কোন পথ বেছে নেব? মহান নেতাদের সমালোচনা করা, নাকি স্তুতি করা? দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া মানুষদের নেতার অনুসারীদের কি আজ এ কথা বলতে হবে না যে ‘আমি ঘৃণা করি অবিচার, কর্তৃত্ববাদিতা, মোসাহেবি, বাগাড়ম্বর এবং আমার ঘৃণা তাদের প্রতি, যারা এসবের জন্য অভিযুক্ত। আমি আমার সমালোচকদের বলতে চাই, আমার ঘৃণা করার সামর্থ্যকেই আমি আমার প্রকৃত শক্তি হিসেবে গণ্য করি। তাই মি. গান্ধী ও মি. জিন্নাহ, এই দুই ব্যক্তি যারা ভারতীয় রাজনৈতিক অগ্রগতিকে একটি অচলাবস্থার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সমালোচনা করার জন্য আমি কোনো ক্ষমা প্রার্থনা করি না। কংগ্রেসি পত্রিকাগুলো আমার নিন্দা করে, সেটা আমি জানি। আমি এর কোনো মূল্য দিই না। তারা কখনো আমার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেনি। আমার প্রতি কংগ্রেসি প্রেসের ব্যথাটা কোথায় তা বুঝতে পারি, এটা বলা অশোভন হবে না যে আমার প্রতি তাদের অসূয়াপ্রসূত মনোভাব আসলে অস্পৃশ্যদের প্রতি হিন্দুদের বীতরাগেরই প্রতিফলন। আমি আদর্শিক ব্যক্তির বন্দনা অপছন্দ করি। আমি গান্ধী ও জিন্নাহকে ঘৃণা করি না, অপছন্দ করি, কারণ আমি ভারতকে অধিকতর ভালোবাসি। এটাই একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদীর বিশ্বাস হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস আছে যে আমার দেশবাসী একদিন বুঝতে পারবে যে মানুষের চেয়ে দেশ বড়। গান্ধী বা জিন্নাহর বন্দনা করার চেয়ে দেশসেবা মহত্তম এবং দুটি বিষয় কেবলই যে আলাদা তা-ই নয়, এমনকি কখনো তা পরস্পরবিরোধী হতে পারে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আম্বেদকারের জন্মস্থানে গিয়ে ১৪ এপ্রিল শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে নিজকেই আম্বেদকারের স্বপ্নের ফসল বলে বর্ণনা করেছেন। মোদি বলেছেন, ‘একটি শিশু, যার মা অন্যের বাড়িতে গিয়ে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহার করতেন, সেই সন্তান বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হলে তার কৃতিত্ব বাবাসাহেবকেই দিতে হবে।’ গত সোমবার নাগপুরে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী আম্বেদকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সোনিয়া সেখানে এক জনসভায় বলেন, ‘দক্ষিণপন্থী শক্তি আজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে নষ্ট করছে, এর মাধ্যমে তারা ড. আম্বেদকারের রচিত সংবিধানের চরিত্র বদলে দিচ্ছে।’
এনডিটিভির এক খবরে বলা হয়, এটা লক্ষণীয় যে রাহুল গান্ধী আম্বেদকারের ১২৫তম জন্মদিনের দুদিন আগে গিয়ে নাগপুরের এক গ্রামে হাজির হয়েছেন, যেখানে আম্বেদকার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, রাহুল সেখানে একটি পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন, যেখানে সম্প্রতি দলিত মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষদের জন্য আমরা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে যতটা পারা যেত, সেটুকু রক্ষাকবচ রাখিনি। আজও তেমন কোনো প্রবণতা দেখাই না। আইন কমিশন দলিত শ্রেণির জন্য কতিপয় অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইনের মুসাবিদা করে দিয়েছে, সেটাও শতভাগ দেশীয় উদ্যোগে নয়, বিদেশি সংস্থার তদারকি ছিল। কিন্তু সেই আইনের খসড়াটা অনাদরে ফেলে রাখা হয়েছে। তারা সংখ্যায় অল্প, কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। শেষ করি আম্বেদকারের একটি উক্তি দিয়ে। গান্ধী আম্বেদকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতেই কংগ্রেসের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনার কারণ জানতে চাইলেন। সেটা ১৯৩১ সাল। উত্তরে আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘গান্ধীজি আমার কোনো মাতৃভূমি নেই।’ অস্পৃশ্যতা তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা কিন্তু এই ভূখণ্ড নিয়ে গর্বিত হবেন না।’ তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সংবিধানে বিশেষ তফসিল করে আম্বেদকার তাদের জাতে তোলার রক্ষাকবচ নিশ্চয় তৈরি করে রেখে যেতে পেরেছেন। সে কারণে আমি আম্বেদকারকে নিয়ে খুবই গর্বিত হই, যখন শুনি, ফরিদপুরের ওড়াকান্দিখ্যাত আমাদের মতুয়া সম্প্রদায়ের এক মেয়ে ভারতের লোকসভার সদস্য হয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ। নির্বাচিত হওয়ার পরে আমাদের এই দিদিকে টেলিফোনে অভিবাদন জানিয়েছিলাম। প্রচারবিমুখ এই ভারতীয় সাংসদ এ মাসেই এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসতে পারেন।
আমরা ড. আম্বেদকারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। জগৎ-জুড়ে অস্পৃশ্য মানুষের জয় হোক।
No comments