বোতলে করে রোদ বিক্রি by আনিসুল হক
স্থপতি হাসান চৌধুরীর নিজের জীবনে এই ঘটনা
ঘটবে তিনি ভাবেননি। ঢাকা শহরে সবাই গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে,
কেউ এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে চাইছে না। রাস্তা থেকে এক ইঞ্চি দূরেও কেউ বাড়ি
বানাবে না, পারলে রাস্তার এক ফুট জায়গা নিয়ে নেবে। এক বাড়ির সঙ্গে আরেক
বাড়ির মধ্যে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। এই সব দেখে-শুনে হাসান চৌধুরী বলে
বসলেন, সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন ঢাকা শহরের লোকেরা ১০০ টাকা খরচ করে ১০
মিনিটের জন্য রোদ কিনে খাবে।
কথাটা বলার পরে লোকে বলল, রূপকথা হিসেবে কথাটা মূল্যবান, কিন্তু বাস্তবে সেটা কি আর সম্ভব?
নিশ্চয়ই। কারণ প্রথম যেদিন বোতলের পানি নিয়ে লোকে আমার অফিসে এসেছিল, একজন সেলসম্যান, বলেছিল, সে এসেছে পানি বেচতে, তখন ওই লোকটাকে আমরা সবাই পাগল ভেবেছিলাম। আর আজকে কোনো রেস্টুরেন্টে বসলে বিনা পয়সার পানি কেউ খেতে চায় না, বলে মিনােরল ওয়াটার দেন।
মানুষ পয়সা দিয়ে সফট ড্রিংকস খায় না, পানি কিনে খায়। কয়েক দিন পরে লোকে রোদ কিনে খাবে।
হাসান ভাবেন, ধরা যাক, কারও ছাদে রোদ এসে পড়ে। তিনি বলবেন, আসুন আসুন, রোদ খান। ভেজালমুক্ত রোদ। ১০ মিনিট মাত্র ১০ টাকা। লোকে আধঘণ্টার জন্য ২৫ টাকার স্পেশাল প্যাকেজ কিনে রোদ খাবে।
তাঁর এই ধারণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। তাঁর নাতনি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নাতাশা। বয়স সাড়ে তিন। সে খুবই স্মার্ট মেয়ে।
কিন্তু তার একটা সমস্যা হচ্ছে। স্কুলে ঢুকেই সে কাঁদতে শুরু করে। আবার ক্লাসরুমে ঢুকলেই সে শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
এই রহস্য হাসান সাহেবরা ভেদ করতে পারছেন না। স্কুলের টিচাররাও চিন্তিত। নাতাশার বাবা-মাও উদ্বিগ্ন। শেষে হাসান চৌধুরী নিজেই নামলেন এই কান্না রহস্য ভেদ করতে।
সবার সঙ্গে কথা বলে তিনি বুঝলেন, নাতাশা কিছু একটা ভয় পায়। কী ভয় পায়?
হাসান চৌধুরী নাতাশার সঙ্গে স্কুলে গেলেন। মেয়ে কাঁদতে লাগল।
পরের দিন মেয়ে কাঁদল না।
তার পরের দিন আবার কাঁদল।
অনেক ভাবার পর হাসান চৌধুরী রহস্যটা উদ্ঘাটন করে ফেলতে পারলেন।
গতকাল সে কাঁদেনি। গতকাল ছিল মেঘ। আজ আবার রোদ উঠেছে। তাহলে কি নাতাশা রোদ ভয় পায়।
তাকে রোদে নিয়ে যাওয়া হলো। না তো সে তো রোদে ভয় পায় না।
শেষে নাতাশাই বলল, সে ভয় পায় শ্যাডো। ছায়া।
স্কুলে ঢুকতেই তার ছায়া তার সামনে পড়ে। এটা সে এর আগে কোনো দিনও দেখেনি।
এইটাও আবার মিলে গেল আলেকজান্ডারের ঘোড়ার কাহিনির সঙ্গে। আলেকজান্ডারের ঘোড়া নিজের ছায়া ভয় পেয়ে পাগলামো করেছিল।
আলেকজান্ডার সেটা ধরতে পেরেছিলেন।
হাসান চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রোদ বিক্রির প্রজেক্টটা কি তিনিই শুরু করবেন?
এই গল্পটা আমি লিখেছিলাম বেশ ক বছর আগে। প্রথম আলো বন্ধুসভার একটা সংকলন বেরোবে। তারা গল্প চাইল। আমি বসে লিখে ফেললাম। ওই সময় আমার পাওনাদার দাঁড় করিয়ে রেখে গল্প লিখে দেওয়ার প্রতিভা বজায় ছিল। সেই প্রতিভা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু এবার ভাবছি, গল্পের শেষটা বদল করা যেতে পারে। তার আগে এই খবরটা পড়ে নিন।
এখন বাজারে বিশুদ্ধ পানির নামে ‘বোতলজাত’ নানা ব্র্যান্ডের পানি পাওয়া যায়। পানির পাশাপাশি বাজারে এখন বিক্রি শুরু হয়েছে ‘বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস’। কানাডার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ভাইটালিটি এয়ার বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রি শুরু করেছে। তাদের দাবি, এ বাতাস সংগ্রহ করা হয় মানববসতি নেই এমন বনাঞ্চল থেকে আর তা সারা বিশ্বের দূষণপূর্ণ শহরগুলোতে বিক্রি করা হয়। ভাইটালিটি এয়ারের সবচেয়ে বড় বাজার এখন চীনে।
ভাইটালিটি এয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোসেস লাম টেলিগ্রাফকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনে ভাইটালিটি এয়ারের বিক্রি বেড়েছে। প্রথমে মাত্র ৫০০ বোতল বাতাস তারা চীনের বাজারে ছেড়েছিল, যা মাত্র চার দিনেই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর চার হাজার বোতল বিশুদ্ধ বাতাস চীনে ছাড়া হয়েছে। প্রথমে মজা করে এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে বাতাসের চাহিদার কথা ভেবে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে।
ভাইটালিটি এয়ারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার রকি পর্বতমালার জনমানবহীন অঞ্চল থেকে বিশুদ্ধ বাতাস সংগ্রহ করে তা কমপ্রেস করে ক্যান ভর্তি করা হয় এবং পরে তা সিল করা হয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বোতলে কোনো ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) থাকে না। একটি বিশেষ মাস্কের সাহায্যে এই বাতাস শ্বাস হিসেবে গ্রহণ করা যায় বলে তা নষ্ট হয় না।
ভাইটালিটি এয়ারের বাজারজাত করা এই বাতাস কোনো স্প্রে নয়, বরং তা অক্সিজেন ভরা বিশুদ্ধ বাতাস।
বায়ুদূষণের ফলে বিপদে থাকা চীন, ভারত, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই বোতলজাত বাতাস ভালো বিক্রি হবে বলে মনে করছে ভাইটালিটি। ইতিমধ্যে চীনের শহরগুলোর দূষণ নিয়ে প্রচার চালিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রির কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। (প্রথম আলো, অনলাইন সংস্করণ, ১৮ ডিসেম্বর)
হাসান চৌধুরী খবরটা পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন তাঁর বোস্টনের বন্ধু ডা. রুহুল আবিদ ও প্রকৌশলী জাভেদ ইকবালকে। তোমরা দুজনে মিলে একটা কাজ করো। বোতলজাত রোদ বিক্রি, এই আইডিয়াটাকে প্যাটেন্ট করে ফেলো। কপিরাইট কিনে ফেলো। আমরা বোতলে করে রোদ বেচব।
বোতলে করে রোদ বিক্রি করব? এও কি সম্ভব?
হ্যাঁ। সম্ভব। এ তো কোয়ান্টাম থিওরির অ আ ক খ। আলো আসলে কণা, আলো তরঙ্গ। রোদ কণা হিসেবে বোতলে থাকবে, তরঙ্গ হয়ে বের হবে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে এই রোদ ভরে আমরা আইসল্যান্ডে বেচব। দেখো না কী বড়লোকটাই হয়ে যাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কথাটা বলার পরে লোকে বলল, রূপকথা হিসেবে কথাটা মূল্যবান, কিন্তু বাস্তবে সেটা কি আর সম্ভব?
নিশ্চয়ই। কারণ প্রথম যেদিন বোতলের পানি নিয়ে লোকে আমার অফিসে এসেছিল, একজন সেলসম্যান, বলেছিল, সে এসেছে পানি বেচতে, তখন ওই লোকটাকে আমরা সবাই পাগল ভেবেছিলাম। আর আজকে কোনো রেস্টুরেন্টে বসলে বিনা পয়সার পানি কেউ খেতে চায় না, বলে মিনােরল ওয়াটার দেন।
মানুষ পয়সা দিয়ে সফট ড্রিংকস খায় না, পানি কিনে খায়। কয়েক দিন পরে লোকে রোদ কিনে খাবে।
হাসান ভাবেন, ধরা যাক, কারও ছাদে রোদ এসে পড়ে। তিনি বলবেন, আসুন আসুন, রোদ খান। ভেজালমুক্ত রোদ। ১০ মিনিট মাত্র ১০ টাকা। লোকে আধঘণ্টার জন্য ২৫ টাকার স্পেশাল প্যাকেজ কিনে রোদ খাবে।
তাঁর এই ধারণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। তাঁর নাতনি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নাতাশা। বয়স সাড়ে তিন। সে খুবই স্মার্ট মেয়ে।
কিন্তু তার একটা সমস্যা হচ্ছে। স্কুলে ঢুকেই সে কাঁদতে শুরু করে। আবার ক্লাসরুমে ঢুকলেই সে শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
এই রহস্য হাসান সাহেবরা ভেদ করতে পারছেন না। স্কুলের টিচাররাও চিন্তিত। নাতাশার বাবা-মাও উদ্বিগ্ন। শেষে হাসান চৌধুরী নিজেই নামলেন এই কান্না রহস্য ভেদ করতে।
সবার সঙ্গে কথা বলে তিনি বুঝলেন, নাতাশা কিছু একটা ভয় পায়। কী ভয় পায়?
হাসান চৌধুরী নাতাশার সঙ্গে স্কুলে গেলেন। মেয়ে কাঁদতে লাগল।
পরের দিন মেয়ে কাঁদল না।
তার পরের দিন আবার কাঁদল।
অনেক ভাবার পর হাসান চৌধুরী রহস্যটা উদ্ঘাটন করে ফেলতে পারলেন।
গতকাল সে কাঁদেনি। গতকাল ছিল মেঘ। আজ আবার রোদ উঠেছে। তাহলে কি নাতাশা রোদ ভয় পায়।
তাকে রোদে নিয়ে যাওয়া হলো। না তো সে তো রোদে ভয় পায় না।
শেষে নাতাশাই বলল, সে ভয় পায় শ্যাডো। ছায়া।
স্কুলে ঢুকতেই তার ছায়া তার সামনে পড়ে। এটা সে এর আগে কোনো দিনও দেখেনি।
এইটাও আবার মিলে গেল আলেকজান্ডারের ঘোড়ার কাহিনির সঙ্গে। আলেকজান্ডারের ঘোড়া নিজের ছায়া ভয় পেয়ে পাগলামো করেছিল।
আলেকজান্ডার সেটা ধরতে পেরেছিলেন।
হাসান চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রোদ বিক্রির প্রজেক্টটা কি তিনিই শুরু করবেন?
এই গল্পটা আমি লিখেছিলাম বেশ ক বছর আগে। প্রথম আলো বন্ধুসভার একটা সংকলন বেরোবে। তারা গল্প চাইল। আমি বসে লিখে ফেললাম। ওই সময় আমার পাওনাদার দাঁড় করিয়ে রেখে গল্প লিখে দেওয়ার প্রতিভা বজায় ছিল। সেই প্রতিভা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু এবার ভাবছি, গল্পের শেষটা বদল করা যেতে পারে। তার আগে এই খবরটা পড়ে নিন।
এখন বাজারে বিশুদ্ধ পানির নামে ‘বোতলজাত’ নানা ব্র্যান্ডের পানি পাওয়া যায়। পানির পাশাপাশি বাজারে এখন বিক্রি শুরু হয়েছে ‘বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস’। কানাডার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ভাইটালিটি এয়ার বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রি শুরু করেছে। তাদের দাবি, এ বাতাস সংগ্রহ করা হয় মানববসতি নেই এমন বনাঞ্চল থেকে আর তা সারা বিশ্বের দূষণপূর্ণ শহরগুলোতে বিক্রি করা হয়। ভাইটালিটি এয়ারের সবচেয়ে বড় বাজার এখন চীনে।
ভাইটালিটি এয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোসেস লাম টেলিগ্রাফকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনে ভাইটালিটি এয়ারের বিক্রি বেড়েছে। প্রথমে মাত্র ৫০০ বোতল বাতাস তারা চীনের বাজারে ছেড়েছিল, যা মাত্র চার দিনেই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর চার হাজার বোতল বিশুদ্ধ বাতাস চীনে ছাড়া হয়েছে। প্রথমে মজা করে এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে বাতাসের চাহিদার কথা ভেবে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে।
ভাইটালিটি এয়ারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার রকি পর্বতমালার জনমানবহীন অঞ্চল থেকে বিশুদ্ধ বাতাস সংগ্রহ করে তা কমপ্রেস করে ক্যান ভর্তি করা হয় এবং পরে তা সিল করা হয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বোতলে কোনো ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) থাকে না। একটি বিশেষ মাস্কের সাহায্যে এই বাতাস শ্বাস হিসেবে গ্রহণ করা যায় বলে তা নষ্ট হয় না।
ভাইটালিটি এয়ারের বাজারজাত করা এই বাতাস কোনো স্প্রে নয়, বরং তা অক্সিজেন ভরা বিশুদ্ধ বাতাস।
বায়ুদূষণের ফলে বিপদে থাকা চীন, ভারত, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই বোতলজাত বাতাস ভালো বিক্রি হবে বলে মনে করছে ভাইটালিটি। ইতিমধ্যে চীনের শহরগুলোর দূষণ নিয়ে প্রচার চালিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রির কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। (প্রথম আলো, অনলাইন সংস্করণ, ১৮ ডিসেম্বর)
হাসান চৌধুরী খবরটা পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন তাঁর বোস্টনের বন্ধু ডা. রুহুল আবিদ ও প্রকৌশলী জাভেদ ইকবালকে। তোমরা দুজনে মিলে একটা কাজ করো। বোতলজাত রোদ বিক্রি, এই আইডিয়াটাকে প্যাটেন্ট করে ফেলো। কপিরাইট কিনে ফেলো। আমরা বোতলে করে রোদ বেচব।
বোতলে করে রোদ বিক্রি করব? এও কি সম্ভব?
হ্যাঁ। সম্ভব। এ তো কোয়ান্টাম থিওরির অ আ ক খ। আলো আসলে কণা, আলো তরঙ্গ। রোদ কণা হিসেবে বোতলে থাকবে, তরঙ্গ হয়ে বের হবে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে এই রোদ ভরে আমরা আইসল্যান্ডে বেচব। দেখো না কী বড়লোকটাই হয়ে যাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments