গণতান্ত্রিক আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ কেন? by সোহরাব হাসান
স্বৈরাচারের
পতনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর (প্রকৃত তারিখ ৬ ডিসেম্বর) প্রথম
আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসেছিলেন নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী
অভ্যুত্থানের কয়েকজন ছাত্রনেতা। তাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন এবং
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী হলেও সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তাঁরা এক
কাতারে ছিলেন। এর সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী
ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে চাকসু নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ
প্যানেলের জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে।
এখানে উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে না যে গোটা আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সশস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন এবং অব্যাহত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলেও অন্যান্য জায়গায় সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে ছাত্রশিবির যেখানে যাকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করেছে, সেখানে তার ওপরই আক্রমণ করেছে। বিএনপির নেতারা স্বীকার করবেন কি না জানি না, তবে পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, শিবিরের হাতে এককভাবে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীই বেশি খুন হয়েছেন। আবার একইভাবে আট বছরব্যাপী আন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের হাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বেশি জীবন দিয়েছেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ মার্চ চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার মিছিলে গুলি চালিয়ে এক দিনে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজ ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো, সেই ইসলামী ছাত্রশিবির ও তার অভিভাবক জামায়াতে ইসলামী বিএনপির দোসর এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সহযোগী।
জাতীয় রাজনীতি অনেক সময় আপসের চোরাগলিতে প্রবেশ করলেও সেদিন ছাত্রসংগঠনগুলো আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুতে যে আওয়ামী-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি একবার ভিপি পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে, তাও এই ঐক্যের কারণে। সেটাই প্রথম এবং শেষ। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়া আন্দোলনকারী সব কটি ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলার পরই এরশাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন অসীম কুমার উকিল, নাজমুল হক প্রধান, শামসুজ্জামান দুদু, জহিরউদ্দিন স্বপন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আবদুল্লাহ আল কাফী রতন, বজলুর রশীদ ও মোশরেফা মিশু। নব্বইয়ের ছাত্রনেতাদের মধ্যে আরও অনেকে ছিলেন। তাঁদের কেউ বিদেশে, কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউবা এখন সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান করছেন। তাই বলে ইতিহাসে তাঁদের যে উজ্জ্বল ভূমিকা, তা অস্বীকার করা যাবে না। একই কথা প্রযোজ্য একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কেও। তাঁরাও এখন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেলেও যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতেন, তাহলে স্বৈরাচার কিংবা রাজাকার—কারও সঙ্গে আপসরফা করার প্রয়োজন হতো না। ৪৪ বছর পর দেশের রাজনীতিও এমন ঘূর্ণিপাকে পড়ত না।
গোলটেবিল বৈঠকে ছাত্রনেতারা যা বলেছিলেন, তার সারকথা হলো, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হলেও স্বৈরাচার রাজনীতিতে যে দুষ্টক্ষত রেখে গেছে, সেগুলো মুছে ফেলা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্বৈরাচারের তৈরি পথেই হাঁটছি। তাঁরা আরও বলেছেন, সেদিন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী প্রধান দুই দলের একটি স্বৈরাচারকে এবং অপরটি রাজাকারকে পুনর্বাসিত করেছে। ছাত্রনেতারা এও স্বীকার করেছেন যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁরা সেদিন আন্দোলন করেছিলেন, তার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি।
আলোচনা প্রসঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও আসে। নব্বইয়ের কিংবা তার আগের ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সামরিক স্বৈরাচারের আমলে ডাকসুসহ দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচন হলেও নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে সেই পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ বছরে কোথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি।
কেন এমনটি ঘটল, গণতান্ত্রিক নেতারা কেন ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিতে ভয় পান, সেটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। দখলবাজি-চাঁদাবাজির থেকে বের করে এনে ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক ও সুস্থ পথে নিয়ে আসার এটি একটি উপায় হতে পারত। আমাদের নেতা-নেত্রীরা ছাত্রদের জাতির ভবিষ্যৎ বলে প্রচার করতে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ গড়ার বিষয়টি পুরোপুরি অবজ্ঞা করে চলেছেন।
পাকিস্তান আমলে দেশে গণতন্ত্র ছিল—এ দাবি কেউ করবেন না। বাংলাদেশেও দুই সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র ছিল, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তারপরও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন হতো। নির্বাচন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ছাত্রাবাসগুলোতেও। পাকিস্তান আমলে ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের নামে নির্বাচন করতে পারত না। তারা নির্বাচন করত অগ্রগামী, যাত্রিক প্রভৃতি নাম দিয়ে। এসব নামের মধ্য দিয়ে সংগঠনের চরিত্রও বোঝা যেত।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কিংবা তার আগে ও পরের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র সংসদগুলো অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের শুরুতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারও মূলেও ছিল নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। সেখানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। উনসত্তরের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানও ঘটতে পেরেছিল নির্বাচিত ছাত্র সংসদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ নেতৃত্বের কারণে। ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি সে সময়ে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হয়েছিল। একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতেও সারা দেশের নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
এমনকি স্বাধীনতার পরও যাত্রাটা ভালো ছিল। বাহাত্তরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচন হয়। ডাকসু, ইউকসুসহ বেশ কিছু ছাত্রসংগঠন যেমন ছাত্র ইউনিয়নের হাতে চলে যায়, তেমনি চাকসুসহ অনেকটিতে নেতৃত্ব ভাগাভাগিও হয়ে যায়। বাহাত্তরে ছাত্রলীগ বিভক্ত না হলে হয়তো অধিকাংশ ছাত্র সংসদের ফল ভিন্ন হতো। আজ যাঁরা সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে ভিপি-জিএস হয়েছেন।
স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির দুর্গতিটা শুরু হয় শফিউল আলম প্রধানের হাত ধরে। তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকতে যেমন ডাকসুর নির্বাচনটি বানচাল করা হয়, তেমনি কয়েক মাসের মাথায় মুহসীন হলে ঘটানো হয় সাত খুনের ঘটনা। সাত খুনের দায়ে প্রধানের সাত বছর জেল হলেও জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিকে চাঙা করতেই তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এখনো তিনি বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক।
জিয়াউর রহমান পৃথিবীর দীর্ঘতম কারফিউ জারি করলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে মাহমুদুর রহমান মান্না দুবার ডাকসুর ভিপি ও আখতারুজ্জামান জিএস হন। পরের নির্বাচনে আখতারুজ্জামান ভিপি ও জিয়াউদ্দিন বাবলু জিএস হন। ইতিমধ্যে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেন। তিরাশিতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আখতারুজ্জামান নেতৃত্ব দিলেও বাবলু এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ডাকসু নির্বাচনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও দ্বিতীয় দফা ডাকসু নির্বাচনে আমান উল্লাহ আমান ভিপি নির্বাচিত হন।
কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদের পর একানব্বইয়ে আমরা যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করলাম, সেই সরকার কোনো ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেয়নি। বিএনপির পাঁচ বছর এভাবেই কেটে গেল। তারপর বিএনপিকে হটিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এল। কিন্তু সেই সরকারও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই? আরও অনেক বিষয়ের মধ্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেওয়াটা তাদের অন্যতম মিল। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। দুই সরকারের আমলেই বিরোধী দল ছিল ন্যুব্জ ও ভঙ্গুর। তারপরও ক্ষমতাসীনেরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস পাননি। এমনকি ২০০৯ সালে দিনবদলের সনদ নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোটও ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়।
বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা আছে, সেই মন্ত্রিসভায় অনেকেই ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শাখার ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন ও তোফায়েল আহমেদ ডাকসুর ভিপি ছিলেন, মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর জিএস ছিলেন। ইয়াফেস ওসমান ইউকসুর ভিপি ছিলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের ভিপি, আমির হোসেন আমু বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ ও হাসানুল হক ইনুও নিজ নিজ ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। বর্তমান সাংসদদের মধ্যে যাঁরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ফজলে হোসেন বাদশা রাকসুর ভিপি ছিলেন; পঙ্কজ দেবনাথ প্রমুখ। হয়তো আরও অনেকে আছেন। সবার নাম এখানে উল্লেখ করা গেল না বলে দুঃখিত।
কিন্তু মন্ত্রিসভায় ও সংসদে এসে দেশের ছাত্র আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী নেতা-নেত্রীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা কেন ভুলে গেলেন? পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তিনটি সামরিক সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই নির্বাচন বন্ধ থাকা একটি জটিল ধাঁধাও বটে। মাঝখানে দুই বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব আপনারা না নিলেও, বাকি ২৩ বছরের দায় এড়াবেন কীভাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
এখানে উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে না যে গোটা আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সশস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন এবং অব্যাহত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলেও অন্যান্য জায়গায় সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে ছাত্রশিবির যেখানে যাকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করেছে, সেখানে তার ওপরই আক্রমণ করেছে। বিএনপির নেতারা স্বীকার করবেন কি না জানি না, তবে পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, শিবিরের হাতে এককভাবে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীই বেশি খুন হয়েছেন। আবার একইভাবে আট বছরব্যাপী আন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের হাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বেশি জীবন দিয়েছেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ মার্চ চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার মিছিলে গুলি চালিয়ে এক দিনে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজ ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো, সেই ইসলামী ছাত্রশিবির ও তার অভিভাবক জামায়াতে ইসলামী বিএনপির দোসর এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সহযোগী।
জাতীয় রাজনীতি অনেক সময় আপসের চোরাগলিতে প্রবেশ করলেও সেদিন ছাত্রসংগঠনগুলো আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুতে যে আওয়ামী-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি একবার ভিপি পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে, তাও এই ঐক্যের কারণে। সেটাই প্রথম এবং শেষ। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়া আন্দোলনকারী সব কটি ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলার পরই এরশাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন অসীম কুমার উকিল, নাজমুল হক প্রধান, শামসুজ্জামান দুদু, জহিরউদ্দিন স্বপন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আবদুল্লাহ আল কাফী রতন, বজলুর রশীদ ও মোশরেফা মিশু। নব্বইয়ের ছাত্রনেতাদের মধ্যে আরও অনেকে ছিলেন। তাঁদের কেউ বিদেশে, কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউবা এখন সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান করছেন। তাই বলে ইতিহাসে তাঁদের যে উজ্জ্বল ভূমিকা, তা অস্বীকার করা যাবে না। একই কথা প্রযোজ্য একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কেও। তাঁরাও এখন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেলেও যদি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতেন, তাহলে স্বৈরাচার কিংবা রাজাকার—কারও সঙ্গে আপসরফা করার প্রয়োজন হতো না। ৪৪ বছর পর দেশের রাজনীতিও এমন ঘূর্ণিপাকে পড়ত না।
গোলটেবিল বৈঠকে ছাত্রনেতারা যা বলেছিলেন, তার সারকথা হলো, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হলেও স্বৈরাচার রাজনীতিতে যে দুষ্টক্ষত রেখে গেছে, সেগুলো মুছে ফেলা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্বৈরাচারের তৈরি পথেই হাঁটছি। তাঁরা আরও বলেছেন, সেদিন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী প্রধান দুই দলের একটি স্বৈরাচারকে এবং অপরটি রাজাকারকে পুনর্বাসিত করেছে। ছাত্রনেতারা এও স্বীকার করেছেন যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁরা সেদিন আন্দোলন করেছিলেন, তার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি।
আলোচনা প্রসঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও আসে। নব্বইয়ের কিংবা তার আগের ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সামরিক স্বৈরাচারের আমলে ডাকসুসহ দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচন হলেও নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে সেই পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ বছরে কোথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি।
কেন এমনটি ঘটল, গণতান্ত্রিক নেতারা কেন ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিতে ভয় পান, সেটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। দখলবাজি-চাঁদাবাজির থেকে বের করে এনে ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক ও সুস্থ পথে নিয়ে আসার এটি একটি উপায় হতে পারত। আমাদের নেতা-নেত্রীরা ছাত্রদের জাতির ভবিষ্যৎ বলে প্রচার করতে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ গড়ার বিষয়টি পুরোপুরি অবজ্ঞা করে চলেছেন।
পাকিস্তান আমলে দেশে গণতন্ত্র ছিল—এ দাবি কেউ করবেন না। বাংলাদেশেও দুই সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র ছিল, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তারপরও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন হতো। নির্বাচন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ছাত্রাবাসগুলোতেও। পাকিস্তান আমলে ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের নামে নির্বাচন করতে পারত না। তারা নির্বাচন করত অগ্রগামী, যাত্রিক প্রভৃতি নাম দিয়ে। এসব নামের মধ্য দিয়ে সংগঠনের চরিত্রও বোঝা যেত।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কিংবা তার আগে ও পরের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র সংসদগুলো অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের শুরুতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারও মূলেও ছিল নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। সেখানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। উনসত্তরের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানও ঘটতে পেরেছিল নির্বাচিত ছাত্র সংসদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ নেতৃত্বের কারণে। ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি সে সময়ে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হয়েছিল। একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতেও সারা দেশের নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
এমনকি স্বাধীনতার পরও যাত্রাটা ভালো ছিল। বাহাত্তরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচন হয়। ডাকসু, ইউকসুসহ বেশ কিছু ছাত্রসংগঠন যেমন ছাত্র ইউনিয়নের হাতে চলে যায়, তেমনি চাকসুসহ অনেকটিতে নেতৃত্ব ভাগাভাগিও হয়ে যায়। বাহাত্তরে ছাত্রলীগ বিভক্ত না হলে হয়তো অধিকাংশ ছাত্র সংসদের ফল ভিন্ন হতো। আজ যাঁরা সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে ভিপি-জিএস হয়েছেন।
স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির দুর্গতিটা শুরু হয় শফিউল আলম প্রধানের হাত ধরে। তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকতে যেমন ডাকসুর নির্বাচনটি বানচাল করা হয়, তেমনি কয়েক মাসের মাথায় মুহসীন হলে ঘটানো হয় সাত খুনের ঘটনা। সাত খুনের দায়ে প্রধানের সাত বছর জেল হলেও জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিকে চাঙা করতেই তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এখনো তিনি বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক।
জিয়াউর রহমান পৃথিবীর দীর্ঘতম কারফিউ জারি করলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে মাহমুদুর রহমান মান্না দুবার ডাকসুর ভিপি ও আখতারুজ্জামান জিএস হন। পরের নির্বাচনে আখতারুজ্জামান ভিপি ও জিয়াউদ্দিন বাবলু জিএস হন। ইতিমধ্যে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেন। তিরাশিতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আখতারুজ্জামান নেতৃত্ব দিলেও বাবলু এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত প্রথম দফা ডাকসু নির্বাচনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও দ্বিতীয় দফা ডাকসু নির্বাচনে আমান উল্লাহ আমান ভিপি নির্বাচিত হন।
কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদের পর একানব্বইয়ে আমরা যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করলাম, সেই সরকার কোনো ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেয়নি। বিএনপির পাঁচ বছর এভাবেই কেটে গেল। তারপর বিএনপিকে হটিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এল। কিন্তু সেই সরকারও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই? আরও অনেক বিষয়ের মধ্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেওয়াটা তাদের অন্যতম মিল। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। দুই সরকারের আমলেই বিরোধী দল ছিল ন্যুব্জ ও ভঙ্গুর। তারপরও ক্ষমতাসীনেরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস পাননি। এমনকি ২০০৯ সালে দিনবদলের সনদ নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোটও ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়।
বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা আছে, সেই মন্ত্রিসভায় অনেকেই ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শাখার ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন ও তোফায়েল আহমেদ ডাকসুর ভিপি ছিলেন, মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর জিএস ছিলেন। ইয়াফেস ওসমান ইউকসুর ভিপি ছিলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের ভিপি, আমির হোসেন আমু বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ ও হাসানুল হক ইনুও নিজ নিজ ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। বর্তমান সাংসদদের মধ্যে যাঁরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ফজলে হোসেন বাদশা রাকসুর ভিপি ছিলেন; পঙ্কজ দেবনাথ প্রমুখ। হয়তো আরও অনেকে আছেন। সবার নাম এখানে উল্লেখ করা গেল না বলে দুঃখিত।
কিন্তু মন্ত্রিসভায় ও সংসদে এসে দেশের ছাত্র আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী নেতা-নেত্রীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা কেন ভুলে গেলেন? পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তিনটি সামরিক সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই নির্বাচন বন্ধ থাকা একটি জটিল ধাঁধাও বটে। মাঝখানে দুই বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব আপনারা না নিলেও, বাকি ২৩ বছরের দায় এড়াবেন কীভাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments