কারা প্রার্থী হলেন? by বদিউল আলম মজুমদার
নির্বাচন
কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে কারা প্রার্থী হয়েছেন তার ওপর নির্ভর করবে কারা
আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হবেন এবং আগামী পাঁচ বছর এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন
চলবে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার ওপরই গণতন্ত্রের ক্রিয়াশীলতা ও
সুশাসন বহুলাংশে নির্ভর করবে। কারণ, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসনের সব
স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠিত হয়।
এবার ২৩৪টি পৌরসভায় ৯২৩ জন মেয়র পদে, ৮ হাজার ৫৮৯ জন সাধারণ কাউন্সিলর পদে এবং ২ হাজার ৫৩৩ জন সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে (মোট প্রার্থী ১২ হাজার ৪৫ জন) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত ২৩২টি পৌরসভায় মেয়র পদে (বাগেরহাটের মংলা ও চাঁদপুরের মতলব ব্যতীত) সর্বমোট ৯০৪ জনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২১ জন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ২০৬ জন প্রার্থী। কমিশন দলভিত্তিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সংখ্যা কত, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা ৪৭৭ জন।
দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবার প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। দলীয় মনোনয়নের কারণে স্থানীয়ভাবে অনেক সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তি, যাঁরা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে আসেননি। গড় মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি সীমিত হয়ে গেছে এবং তাঁরা যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের সর্বোচ্চ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
২৩৪টি পৌরসভায় ইতিমধ্যে ছয়জন মেয়র প্রার্থী এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের ১৩৪ জন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ফেনী জেলার ফেনী, পরশুরাম ও দাগনভূঞা পৌরসভার সাধারণ ও সংরক্ষিত আসন মিলে মোট ৪৮টি পদের মধ্যে ৪৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিল করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। কোনো কোনো পৌরসভা থেকে জোর খাটিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর অভিযোগও উঠেছে।
আমাদের বড় দুই দলই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নারীর সক্ষমতা অর্জনে বিশ্বাসী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পৌর নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। রাজনৈতিক দলগুলো মাত্র ১৫ জন নারীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে, যা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২১৯ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ও ৩২১ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২১ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৩ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৬ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে। বিএনপির প্রার্থীদের অনেকেই বর্তমানে হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে মামলা রয়েছে তার কারণ নিশ্চয়ই হয়রানিমূলক নয়। যদিও মামলায় অভিযুক্ত হওয়া মানে দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত রায়ে তাঁদের অনেকেই অভিযুক্ত হতে পারেন। তাই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতার পরিচয় হতে পারে না।
৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৩৪১ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৯০ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৮৩ জন। ২২৪ জন মেয়র প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে, অর্থাৎ তাঁরা হাইস্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৪০ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪০। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা প্রায় একই রকম হলেও নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর শতকরা হার আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিতে সামান্য বেশি।
অন্যান্য নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৬৫২ জন (৭২ দশমিক ১২ শতাংশ) ব্যবসায়ী। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৬৫ জন (৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ) এবং বিএনপির ১৬২ জন (৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ)। এ পরিসংখ্যান বলে দেয় যে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে যাচ্ছে, যা ‘প্লুরালিটি’ ধারণার পরিপন্থী এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ইতিবাচক নয়।
যদিও মামলায় অভিযুক্ত হওয়া মানে দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত রায়ে তাদের অনেকেই অভিযুক্ত হতে পারেন। তাই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতার পরিচয় হতে পারে না সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশের সম্পদ ৫ লাখ টাকা বা তার কম। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৯ জন, বিএনপির ৯৯ জন। ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ৪৭ জন, যার মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০ জন, বিএনপির ১৩ জন। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগে বেশি হলেও কম সম্পদের মালিক আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতে বেশি। প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই (৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ) কর দেন। অন্যান্য নির্বাচনে প্রার্থীদের অনেকেই আয়কর বিবরণী জমা না দিলেও এবার প্রায় সবাই আয়কর বিবরণী জমা দিয়েছেন।
হলফনামা নিয়ে এবারও যথেচ্ছাচার হয়েছে, যা উল্লেখ না করলেই নয়। অনেক প্রার্থীই হলফনামায় বিস্তারিত তথ্য দেননি। যেমন, তাঁদের অনেকে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেননি, যার ফলে প্রার্থীর মোট সম্পদের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আইন অনুযায়ী, সম্পদের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করেন। তাই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তথ্য পেতে হলে ভবিষ্যতে হলফনামায় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া আরও যেসব সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো ওয়েবসাইটে অনেক দেরিতে তথ্য দেওয়া, সব পৌরসভার তথ্য না থাকা, কোনো পৌরসভার তথ্য দেওয়া থাকলেও সব প্রার্থীর তথ্য না থাকা, দলভিত্তিক পরিচয়সংবলিত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করা এবং এক প্রার্থীর জায়গায় অন্য প্রার্থীর তথ্য থাকা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, আদালত ভোটারদের প্রার্থী সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কারণ, ভোটাররা তাঁদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোটের মাধ্যমে। তাই সময়মতো ও যথাযথভাবে তথ্য প্রকাশ না করা ভোটারদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল।
এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং তা বিশ্লেষণ ও বিতরণ ভোটারদের সচেতন করার এবং তাঁদের সৎ ও যোগ্য তথা সঠিক প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে শুধু তথ্য পেলেই হবে না, তথ্য সঠিক হতে হবে। তাই প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে চুলচেরাভাবে যাচাই-বাছাই করে তথ্য গোপনকারী ও ভুল তথ্য প্রদানকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা এবং নির্বাচিত হলে নির্বাচন বাতিল করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সুজন-এর নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং আদালতের নির্দেশে ভোটারদের জন্য প্রার্থী সম্পর্কে জেনে-শুনে-বুঝে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী বেছে নিতে সমর্থ হবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
এবার ২৩৪টি পৌরসভায় ৯২৩ জন মেয়র পদে, ৮ হাজার ৫৮৯ জন সাধারণ কাউন্সিলর পদে এবং ২ হাজার ৫৩৩ জন সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে (মোট প্রার্থী ১২ হাজার ৪৫ জন) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত ২৩২টি পৌরসভায় মেয়র পদে (বাগেরহাটের মংলা ও চাঁদপুরের মতলব ব্যতীত) সর্বমোট ৯০৪ জনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২১ জন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ২০৬ জন প্রার্থী। কমিশন দলভিত্তিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সংখ্যা কত, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা ৪৭৭ জন।
দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবার প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। দলীয় মনোনয়নের কারণে স্থানীয়ভাবে অনেক সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তি, যাঁরা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে আসেননি। গড় মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি সীমিত হয়ে গেছে এবং তাঁরা যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের সর্বোচ্চ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
২৩৪টি পৌরসভায় ইতিমধ্যে ছয়জন মেয়র প্রার্থী এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের ১৩৪ জন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ফেনী জেলার ফেনী, পরশুরাম ও দাগনভূঞা পৌরসভার সাধারণ ও সংরক্ষিত আসন মিলে মোট ৪৮টি পদের মধ্যে ৪৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিল করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। কোনো কোনো পৌরসভা থেকে জোর খাটিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর অভিযোগও উঠেছে।
আমাদের বড় দুই দলই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নারীর সক্ষমতা অর্জনে বিশ্বাসী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পৌর নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। রাজনৈতিক দলগুলো মাত্র ১৫ জন নারীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে, যা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২১৯ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ও ৩২১ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২১ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৩ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৬ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে। বিএনপির প্রার্থীদের অনেকেই বর্তমানে হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে মামলা রয়েছে তার কারণ নিশ্চয়ই হয়রানিমূলক নয়। যদিও মামলায় অভিযুক্ত হওয়া মানে দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত রায়ে তাঁদের অনেকেই অভিযুক্ত হতে পারেন। তাই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতার পরিচয় হতে পারে না।
৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৩৪১ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৯০ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৮৩ জন। ২২৪ জন মেয়র প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে, অর্থাৎ তাঁরা হাইস্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৪০ জন এবং বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪০। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা প্রায় একই রকম হলেও নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত প্রার্থীর শতকরা হার আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিতে সামান্য বেশি।
অন্যান্য নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৬৫২ জন (৭২ দশমিক ১২ শতাংশ) ব্যবসায়ী। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৬৫ জন (৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ) এবং বিএনপির ১৬২ জন (৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ)। এ পরিসংখ্যান বলে দেয় যে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে যাচ্ছে, যা ‘প্লুরালিটি’ ধারণার পরিপন্থী এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ইতিবাচক নয়।
যদিও মামলায় অভিযুক্ত হওয়া মানে দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত রায়ে তাদের অনেকেই অভিযুক্ত হতে পারেন। তাই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতার পরিচয় হতে পারে না সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশের সম্পদ ৫ লাখ টাকা বা তার কম। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৯ জন, বিএনপির ৯৯ জন। ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ৪৭ জন, যার মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০ জন, বিএনপির ১৩ জন। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগে বেশি হলেও কম সম্পদের মালিক আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতে বেশি। প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই (৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ) কর দেন। অন্যান্য নির্বাচনে প্রার্থীদের অনেকেই আয়কর বিবরণী জমা না দিলেও এবার প্রায় সবাই আয়কর বিবরণী জমা দিয়েছেন।
হলফনামা নিয়ে এবারও যথেচ্ছাচার হয়েছে, যা উল্লেখ না করলেই নয়। অনেক প্রার্থীই হলফনামায় বিস্তারিত তথ্য দেননি। যেমন, তাঁদের অনেকে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেননি, যার ফলে প্রার্থীর মোট সম্পদের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আইন অনুযায়ী, সম্পদের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করেন। তাই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তথ্য পেতে হলে ভবিষ্যতে হলফনামায় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া আরও যেসব সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো ওয়েবসাইটে অনেক দেরিতে তথ্য দেওয়া, সব পৌরসভার তথ্য না থাকা, কোনো পৌরসভার তথ্য দেওয়া থাকলেও সব প্রার্থীর তথ্য না থাকা, দলভিত্তিক পরিচয়সংবলিত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করা এবং এক প্রার্থীর জায়গায় অন্য প্রার্থীর তথ্য থাকা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, আদালত ভোটারদের প্রার্থী সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বাক্স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কারণ, ভোটাররা তাঁদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোটের মাধ্যমে। তাই সময়মতো ও যথাযথভাবে তথ্য প্রকাশ না করা ভোটারদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল।
এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং তা বিশ্লেষণ ও বিতরণ ভোটারদের সচেতন করার এবং তাঁদের সৎ ও যোগ্য তথা সঠিক প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে শুধু তথ্য পেলেই হবে না, তথ্য সঠিক হতে হবে। তাই প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে চুলচেরাভাবে যাচাই-বাছাই করে তথ্য গোপনকারী ও ভুল তথ্য প্রদানকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা এবং নির্বাচিত হলে নির্বাচন বাতিল করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সুজন-এর নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং আদালতের নির্দেশে ভোটারদের জন্য প্রার্থী সম্পর্কে জেনে-শুনে-বুঝে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী বেছে নিতে সমর্থ হবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments