মিথ্যার কাছে সত্য পরাজিত হচ্ছে? by তৈমূর আলম খন্দকার
বিচার
বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিয়ে যখন বেশি বেশি প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে
এবং যে সময়ে দেশে-বিদেশে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও
স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বক্তব্যের পর বক্তব্য রাখছেন, এমনই সময়ে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক এ কে এম ফজলুল হক ছেলে দীপনের লাশ
কাঁধে নিয়েই বলেছেন, ‘আমি পুত্রহত্যার বিচার চাই না ...’। তার এ বক্তব্য কি
সমগ্র জাতির বক্তব্য না দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর একটি অনাস্থার
বহিঃপ্রকাশ?
দীপনের বাবা তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সান্ত্বনা তো পানইনি, বরং সরকারি মুখপাত্র তাকে নিয়ে উপহাস করেছেন, যা একজন মার্জিত মানুষ করতে পারেন না। ক্ষমতায় থাকলে মানুষ ধরাকে সরাজ্ঞান করে। ক্ষমতার কালো চশমা তাদের আড়াল করার পূর্বেই জনগণ থেকে নিজেরাই আড়াল হয়ে যান বলে জনতার বুকের আর্তনাদ বোঝা তো দূরের কথা বরং টিপ্পনী ও নোংরা উপহাস করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। ক্ষমতাসীনদের এ উপহাস কি জাতির প্রাপ্য ছিল?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বলেছে, ‘বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।’ সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি খোন্দকার মাহবুব হোসেন স্পষ্টই যে কথা বলেছেন- এ কথার প্রতিবাদ বা বিরূপ মন্তব্য সুশীল বা সরকার পক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে তো আসেইনি; এমনকি প্রধান বিচারপতির দফতর থেকেও কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ঠিক এমনই সময়ে ‘দেখেশুনে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে জামিন দেয়ার জন্য’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার জনসভায় আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান কি আদেশ না নির্দেশ না হুমকি, তা মূল্যায়িত হওয়ার আগে এ কথাটি উঠে আসে যে- রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যে একের পর এক মিথ্যা মোকদ্দমায় না জড়ানোর জন্য তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিতেন, তবে প্রধানমন্ত্রী বিচারক বা বিচারপতিদের প্রতি কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট হতো। প্রধানমন্ত্রীর একতরফা (জামিনের প্রশ্নে) বক্তব্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটুকু রক্ষা পেয়েছে, তা অবশ্যই প্রধান বিচারপতি বিবেচনায় নিয়ে তার পরবর্তী বক্তব্য পেশ করবেন, যা শোনার অপেক্ষায় (রাজনৈতিক কারণে) দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ।
বিচার বিভাগ বা এর নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তবুও বলতে হয়, কারণ দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। ফলে গণমানুষের শেষ আশ্রয় হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সমুন্নত রাখতে না পারলে আমও গেল, ছালাও গেল। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতার প্রশ্নে মহান স্বাধীনতার আগেও যা ছিল বর্তমানেও তা-ই আছে; বরং প্রতিহিংসার পরিমাণটা একটু বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর সত্যতা ও বাস্তবতা (মাননীয় প্রধান বিচারপতি) তার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন নাকি আরো জোরগলায় ব্যর্থতাকে ঢাকা দেয়ার একটি প্রয়াস খুঁজবেন?
আন্দোলনের সময় বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার দায় (দেশনেত্রেী) খালেদা জিয়া এড়িয়ে যেতে পারেন নাÑ এমন মন্তব্য প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যেই করেছেন, যার অনুরূপ বক্তব্য আগেই মাহবুবউল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা দিয়েছেন। আন্দোলনের জন্য বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ বলে আমি মনে করি। বিএনপি সরকার আমলে ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত শুধু বিআরটিসির ৫৩টি বাসে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব প্রধান বিচারপতি মহোদয় কার ওপরে বর্তাবেন? প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করাসহ মিথ্যা মামলায় জড়ানোর জন্য সরকারি লোকেরা বাস পুড়িয়েছে, এমন সংবাদও সংবাদপত্রে ও টিভিতে দেখা গেছে। একজন পুলিশ অফিসারের ভয়েস রেফারেন্স দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বাস পোড়ানো সরকারি দলের কারসাজি বলে দায়িত্ব নিয়েই মন্তব্য করেছেন। সোয়েম্যুটো রুল দিয়ে বিষয়টি কি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করা যায় না?
ন্যায়বিচার ও আইন যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে বিচারপতি মহোদয় বিবেচনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনটার অগ্রাধিকার দেবেন? যে আইন শুধু শাসকদলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার জন্য প্রণীত হয়, সে আইনের রক্ষাকবচ হিসেবে বিচার বিভাগ ব্যবহৃত হতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কার হাতে? অবশ্যই তা পার্লামেন্টের হাতে। পার্লামেন্ট কার নিয়ন্ত্রণে? অবশ্যই তা ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে? ক্ষমতাসীনেরা কার নিয়ন্ত্রণে? অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও তার বহরকে হেফাজত ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার লক্ষ্যেই প্রণীত হচ্ছে বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন করার আইন।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন যে, আমাদের দেশের আইন জনপ্রতিনিধিগণ নয় বরং কেরানীগণ প্রণয়ন করেন; এমপিরা শুধু হাততালি দিয়ে তা পাস করে দেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী পরে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ আনার হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে কেন মন্ত্রী চুপসে গেলেন, তা বোঝা না গেলেও থলের বিড়াল প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় তাকে চুপ করানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
যে আইন জনগণের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে শুধু ক্ষমতাসীনদের রক্ষার জন্য প্রণীত হয়, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সে আইন গ্রহণযোগ্য নয়। সে আইনের হেফাজত করার জন্য যদি বিচারপতিদের বাধ্য করা হয়; তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য এবং বর্তমানে তাই হচ্ছে। বিচার বিভাগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে নিপীড়ন-নির্যাতনে সরকারের বিরুদ্ধে খোন্দকার মাহবুব হোসেন যে অভিযোগ এনেছেন, সময় একদিন আসবে যে দিন তাদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, যারা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
প্রশ্ন আসে- গণতন্ত্র রক্ষায় বিচার বিভাগ কতটুকু সোচ্চার। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, এ নজির বাংলাদেশেই আছে। সামরিক জান্তাদের প্রধান বিচারপতিই শপথবাক্য পাঠ করিয়ে বঙ্গভবনে বসিয়েছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ না করানোর জন্যই কিন্তু হানাদার পাকিস্তান সরকার নড়েচড়ে বসেছিল এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়, যা থেকে জন্ম লাভ করে লাল-সবুজ পতাকা।
বিচারপতি এনায়েতুর রহিম তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিচার অন্ধ হতে পারে, তবে বিচারপতি কিন্তু অন্ধ নন’; জাতি সেটাই চায়। সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়; বিচারপতি কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়েই গণতন্ত্রকে রক্ষার স্বার্থে বিরোধী দলের ওপর অযাচিত নির্যাতনের প্রশ্নে আইনের দোহাই দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না। তাই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বারের যে অভিযোগ, তা খণ্ডানোর ও জবাবদিহিতার দায়িত্বও বিচার বিভাগের অবশ্যই রয়েছে। কারণ তারাও জনগণের অর্থে লালিত-পালিত।
ছেলেহত্যার বিচার চাই না বলে একজন পণ্ডিত বাবার যে আর্তনাদ, এ আর্তনাদ সমগ্র জাতির আর্তনাদ। এ করুণ চিত্র শুধু বিচারব্যবস্থার প্রতি নয়, বরং গোটা সভ্যতার ওপর চপেটাঘাত। এ আর্তনাদ দায়িত্বশীলদের কর্ণকুহরে কতটুকু পৌঁছেছে, তা বোঝা না গেলেও এ আর্তনাদ আকাশে-বাতাসে ইথারে ভাসছে, যা থেকে আরো কোনো বেদনাদায়ক চিত্রের জন্ম নিতে পারে; বিগত ইতিহাস যা সাক্ষ্য দেয়। গণতন্ত্র নির্বাসিত হলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে- এ কথাও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বারবার বলে আসছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব যেমন সরকারের। অন্য দিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো স্বেচ্ছাচারিতা হচ্ছে কি না এবং শাসকদল ভিন্ন পন্থায় নিগৃহীত হচ্ছে কি না, এটা দেখার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। শুধু দারোগার ফরোয়ার্ডিং ও চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয়া বা জামিন না দেয়া বিচার বিভাগের দায়িত্ব নয়। এ বিভাগের যিনি প্রধান তিনি সুপ্রিম কোর্টের নন, বরং সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিকারের এবং আইনের ছদ্মাবরণে রাষ্ট্রীয় জুলুমের প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির।
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত গত ১৫ দিনে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া গোটা দেশে আট হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। প্রতিনিয়তই কোন জেলায় কতজন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুললেই নিয়মিত স্ক্রলে ভেসে আসে। গণগ্রেফতার আর তা নিয়ে বাণিজ্য এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিএনপি ও ২০ দলীয় ঐক্যজোটের কোনো নেতাকর্মী এখন বাড়িতে থাকতে পারেন না। কোনো অভিযোগ না থাকার পরও এ গণগ্রেফতার হওয়া নিরীহ মানুষগুলোর আইনগত অধিকার দেখা তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব কার? গণগ্রেফতার সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গত ১৬ নভেম্বর পুলিশ প্রধান এ কে এম শহিদুল ইসলাম বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে বা যাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই তাদের আটক করা হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, ‘যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যারা বিভিন্ন নাশকতার পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্রকারী ও মদদদাতা ছিল এবং নাশকতার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, পরে জামিন নিয়ে আবারো একই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদেরকেই আটক করা হচ্ছে।’ পুলিশ প্রধানের এ বক্তব্য কি সত্য? বাস্তবতা কী বলে?
পুলিশনির্ভর এ রাষ্ট্রে পুলিশ প্রধানের বক্তব্যই শেষ কথা; কিন্তু বিচার বিভাগ কি পুলিশের বক্তব্য যথার্থ মনে করছে? নতুবা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কপালে এত বড় দুর্দশা কেন? স্মরণ করা দরকার যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জব্বার, সালাম, বরকত, রফিক- তাদের বুকে গুলি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বসুনিয়ার বুকে গুলি, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, সৈরাচার নিপাত যাক’- এ স্লোগান বুকে ধারণকারী নূর হোসেনের বুকে গুলি পাকিস্তান বা চাঁদের দেশ থেকে এসে কেউ করেনি; বরং বাঙালি পুলিশই গুলি চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে ভাড়াটিয়া খুনি (নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে তাদের ওপর বিচার বিভাগের এতটা নির্ভরশীল হওয়া কি নিরাপদ বা যুক্তিসঙ্গত? জাতি বিষয়টি কোন বিবেচনায় নেবে? মিথ্যার কাছে সত্য কি পরাজিত হয়ে যাচ্ছে? বিবেচনার দায় সমগ্র জাতির, কিন্তু জাতিকে শেল্টার দেয়ার দায়িত্ব কার?
লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিআরটিসি ও
সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com
দীপনের বাবা তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সান্ত্বনা তো পানইনি, বরং সরকারি মুখপাত্র তাকে নিয়ে উপহাস করেছেন, যা একজন মার্জিত মানুষ করতে পারেন না। ক্ষমতায় থাকলে মানুষ ধরাকে সরাজ্ঞান করে। ক্ষমতার কালো চশমা তাদের আড়াল করার পূর্বেই জনগণ থেকে নিজেরাই আড়াল হয়ে যান বলে জনতার বুকের আর্তনাদ বোঝা তো দূরের কথা বরং টিপ্পনী ও নোংরা উপহাস করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। ক্ষমতাসীনদের এ উপহাস কি জাতির প্রাপ্য ছিল?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বলেছে, ‘বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।’ সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি খোন্দকার মাহবুব হোসেন স্পষ্টই যে কথা বলেছেন- এ কথার প্রতিবাদ বা বিরূপ মন্তব্য সুশীল বা সরকার পক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে তো আসেইনি; এমনকি প্রধান বিচারপতির দফতর থেকেও কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ঠিক এমনই সময়ে ‘দেখেশুনে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে জামিন দেয়ার জন্য’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার জনসভায় আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান কি আদেশ না নির্দেশ না হুমকি, তা মূল্যায়িত হওয়ার আগে এ কথাটি উঠে আসে যে- রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যে একের পর এক মিথ্যা মোকদ্দমায় না জড়ানোর জন্য তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিতেন, তবে প্রধানমন্ত্রী বিচারক বা বিচারপতিদের প্রতি কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট হতো। প্রধানমন্ত্রীর একতরফা (জামিনের প্রশ্নে) বক্তব্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটুকু রক্ষা পেয়েছে, তা অবশ্যই প্রধান বিচারপতি বিবেচনায় নিয়ে তার পরবর্তী বক্তব্য পেশ করবেন, যা শোনার অপেক্ষায় (রাজনৈতিক কারণে) দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ।
বিচার বিভাগ বা এর নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তবুও বলতে হয়, কারণ দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। ফলে গণমানুষের শেষ আশ্রয় হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সমুন্নত রাখতে না পারলে আমও গেল, ছালাও গেল। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতার প্রশ্নে মহান স্বাধীনতার আগেও যা ছিল বর্তমানেও তা-ই আছে; বরং প্রতিহিংসার পরিমাণটা একটু বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর সত্যতা ও বাস্তবতা (মাননীয় প্রধান বিচারপতি) তার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন নাকি আরো জোরগলায় ব্যর্থতাকে ঢাকা দেয়ার একটি প্রয়াস খুঁজবেন?
আন্দোলনের সময় বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার দায় (দেশনেত্রেী) খালেদা জিয়া এড়িয়ে যেতে পারেন নাÑ এমন মন্তব্য প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যেই করেছেন, যার অনুরূপ বক্তব্য আগেই মাহবুবউল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা দিয়েছেন। আন্দোলনের জন্য বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ বলে আমি মনে করি। বিএনপি সরকার আমলে ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত শুধু বিআরটিসির ৫৩টি বাসে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব প্রধান বিচারপতি মহোদয় কার ওপরে বর্তাবেন? প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করাসহ মিথ্যা মামলায় জড়ানোর জন্য সরকারি লোকেরা বাস পুড়িয়েছে, এমন সংবাদও সংবাদপত্রে ও টিভিতে দেখা গেছে। একজন পুলিশ অফিসারের ভয়েস রেফারেন্স দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বাস পোড়ানো সরকারি দলের কারসাজি বলে দায়িত্ব নিয়েই মন্তব্য করেছেন। সোয়েম্যুটো রুল দিয়ে বিষয়টি কি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করা যায় না?
ন্যায়বিচার ও আইন যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে বিচারপতি মহোদয় বিবেচনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনটার অগ্রাধিকার দেবেন? যে আইন শুধু শাসকদলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার জন্য প্রণীত হয়, সে আইনের রক্ষাকবচ হিসেবে বিচার বিভাগ ব্যবহৃত হতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কার হাতে? অবশ্যই তা পার্লামেন্টের হাতে। পার্লামেন্ট কার নিয়ন্ত্রণে? অবশ্যই তা ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে? ক্ষমতাসীনেরা কার নিয়ন্ত্রণে? অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও তার বহরকে হেফাজত ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার লক্ষ্যেই প্রণীত হচ্ছে বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন করার আইন।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন যে, আমাদের দেশের আইন জনপ্রতিনিধিগণ নয় বরং কেরানীগণ প্রণয়ন করেন; এমপিরা শুধু হাততালি দিয়ে তা পাস করে দেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী পরে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ আনার হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে কেন মন্ত্রী চুপসে গেলেন, তা বোঝা না গেলেও থলের বিড়াল প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় তাকে চুপ করানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
যে আইন জনগণের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে শুধু ক্ষমতাসীনদের রক্ষার জন্য প্রণীত হয়, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সে আইন গ্রহণযোগ্য নয়। সে আইনের হেফাজত করার জন্য যদি বিচারপতিদের বাধ্য করা হয়; তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য এবং বর্তমানে তাই হচ্ছে। বিচার বিভাগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে নিপীড়ন-নির্যাতনে সরকারের বিরুদ্ধে খোন্দকার মাহবুব হোসেন যে অভিযোগ এনেছেন, সময় একদিন আসবে যে দিন তাদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, যারা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
প্রশ্ন আসে- গণতন্ত্র রক্ষায় বিচার বিভাগ কতটুকু সোচ্চার। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, এ নজির বাংলাদেশেই আছে। সামরিক জান্তাদের প্রধান বিচারপতিই শপথবাক্য পাঠ করিয়ে বঙ্গভবনে বসিয়েছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ না করানোর জন্যই কিন্তু হানাদার পাকিস্তান সরকার নড়েচড়ে বসেছিল এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়, যা থেকে জন্ম লাভ করে লাল-সবুজ পতাকা।
বিচারপতি এনায়েতুর রহিম তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিচার অন্ধ হতে পারে, তবে বিচারপতি কিন্তু অন্ধ নন’; জাতি সেটাই চায়। সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়; বিচারপতি কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়েই গণতন্ত্রকে রক্ষার স্বার্থে বিরোধী দলের ওপর অযাচিত নির্যাতনের প্রশ্নে আইনের দোহাই দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না। তাই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বারের যে অভিযোগ, তা খণ্ডানোর ও জবাবদিহিতার দায়িত্বও বিচার বিভাগের অবশ্যই রয়েছে। কারণ তারাও জনগণের অর্থে লালিত-পালিত।
ছেলেহত্যার বিচার চাই না বলে একজন পণ্ডিত বাবার যে আর্তনাদ, এ আর্তনাদ সমগ্র জাতির আর্তনাদ। এ করুণ চিত্র শুধু বিচারব্যবস্থার প্রতি নয়, বরং গোটা সভ্যতার ওপর চপেটাঘাত। এ আর্তনাদ দায়িত্বশীলদের কর্ণকুহরে কতটুকু পৌঁছেছে, তা বোঝা না গেলেও এ আর্তনাদ আকাশে-বাতাসে ইথারে ভাসছে, যা থেকে আরো কোনো বেদনাদায়ক চিত্রের জন্ম নিতে পারে; বিগত ইতিহাস যা সাক্ষ্য দেয়। গণতন্ত্র নির্বাসিত হলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে- এ কথাও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বারবার বলে আসছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব যেমন সরকারের। অন্য দিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো স্বেচ্ছাচারিতা হচ্ছে কি না এবং শাসকদল ভিন্ন পন্থায় নিগৃহীত হচ্ছে কি না, এটা দেখার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। শুধু দারোগার ফরোয়ার্ডিং ও চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয়া বা জামিন না দেয়া বিচার বিভাগের দায়িত্ব নয়। এ বিভাগের যিনি প্রধান তিনি সুপ্রিম কোর্টের নন, বরং সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিকারের এবং আইনের ছদ্মাবরণে রাষ্ট্রীয় জুলুমের প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির।
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত গত ১৫ দিনে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া গোটা দেশে আট হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। প্রতিনিয়তই কোন জেলায় কতজন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুললেই নিয়মিত স্ক্রলে ভেসে আসে। গণগ্রেফতার আর তা নিয়ে বাণিজ্য এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিএনপি ও ২০ দলীয় ঐক্যজোটের কোনো নেতাকর্মী এখন বাড়িতে থাকতে পারেন না। কোনো অভিযোগ না থাকার পরও এ গণগ্রেফতার হওয়া নিরীহ মানুষগুলোর আইনগত অধিকার দেখা তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব কার? গণগ্রেফতার সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গত ১৬ নভেম্বর পুলিশ প্রধান এ কে এম শহিদুল ইসলাম বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে বা যাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই তাদের আটক করা হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, ‘যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যারা বিভিন্ন নাশকতার পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্রকারী ও মদদদাতা ছিল এবং নাশকতার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল, পরে জামিন নিয়ে আবারো একই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদেরকেই আটক করা হচ্ছে।’ পুলিশ প্রধানের এ বক্তব্য কি সত্য? বাস্তবতা কী বলে?
পুলিশনির্ভর এ রাষ্ট্রে পুলিশ প্রধানের বক্তব্যই শেষ কথা; কিন্তু বিচার বিভাগ কি পুলিশের বক্তব্য যথার্থ মনে করছে? নতুবা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কপালে এত বড় দুর্দশা কেন? স্মরণ করা দরকার যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জব্বার, সালাম, বরকত, রফিক- তাদের বুকে গুলি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বসুনিয়ার বুকে গুলি, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, সৈরাচার নিপাত যাক’- এ স্লোগান বুকে ধারণকারী নূর হোসেনের বুকে গুলি পাকিস্তান বা চাঁদের দেশ থেকে এসে কেউ করেনি; বরং বাঙালি পুলিশই গুলি চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে ভাড়াটিয়া খুনি (নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে তাদের ওপর বিচার বিভাগের এতটা নির্ভরশীল হওয়া কি নিরাপদ বা যুক্তিসঙ্গত? জাতি বিষয়টি কোন বিবেচনায় নেবে? মিথ্যার কাছে সত্য কি পরাজিত হয়ে যাচ্ছে? বিবেচনার দায় সমগ্র জাতির, কিন্তু জাতিকে শেল্টার দেয়ার দায়িত্ব কার?
লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিআরটিসি ও
সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com
No comments