উত্তরায় জাপানি নাগরিক হত্যা নানা রহস্য
এবার রাজধানীর উত্তরায় এক জাপানি নাগরিক নিখোঁজ হওয়ার পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার ৫ জনকে নেয়া হয়েছে ৪ দিনের রিমান্ডে। হিরোয়ি মিয়েতা নামের এই জাপানি নারী প্রায় একমাস আগে নিখোঁজ হন। ঢাকায় তিনি একটি বায়িং হাউজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার নিখোঁজ, ‘হত্যা’ এবং লাশ গুমের চেষ্টায় তৈরি হয়েছে রহস্য। এর আগে গত ৩রা অক্টোবর রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও। ২৮শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় একই কায়দায় গুলিতে মারা যান ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলা। এই দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এদিকে রাজধানীতে জাপানি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে নিহত ওই জাপানি নাগরিকের কথিত ব্যবসায়িক পার্টনারদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। নিহত জাপানি নাগরিকের কথিত ব্যবসায়িক অংশীদারসহ গ্রেপ্তার ৫ জনকে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে চাইলে আদালত চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। যাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তারা হলো মারুফুল ইসলাম (৩০), রাশেদুল হক বাপ্পি (৪২), ফখরুল ইসলাম (২৭), ডা. বিমল চন্দ্র শীল (৪০) ও জাহাঙ্গীর (২৮)। রিমান্ড আবেদনের বরাত দিয়ে আদালত পুলিশের এস আই উজির আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, গত ২৯শে অক্টোবর জাপানি নারী মিয়েতাকে হত্যা করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে ওই জাপানি নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য দশদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এদিকে, গতাকল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও করা হয়েছিল। কিন্তু ‘অনিবার্য কারণে’ সেই সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়। বলা হচ্ছে, জাপানি দূতাবাস সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি পছন্দ করছে না। এ কারণে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ওই জাপানি নাগরিককে হালিমা খাতুন পরিচয়ে উত্তরার ১২নং সেক্টরের সিটি কর্পোরেশনের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৯শে নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় জাপান দূতাবাসের ভাইস কনসাল কোসিউকি মাৎসুনাগা বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নম্বর ৯৩৫। ওই জিডিতে বলা হয়েছে ৪ঠা নভেম্বর জাপানি নাগরিক মাকিকো হিরাবায়্যাসি ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসে ফোন করেন। তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেন, তার কন্যার নাম হিরোয়ি মিয়েতা। তার পাসপোর্ট নম্বর টিজি-০৪৪৫৭৭৮। জন্ম তারিখ ১৬ই আগস্ট ১৯৫৫। হিরোয়ি মিয়েতা বেশ কিছুদিন ধরে উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি সড়কের ৪ নম্বর বাসার সিটি হোমস নামের ডরমিটরিতে থাকতেন। প্রতি সপ্তাহেই তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু ২৬শে অক্টোবর থেকে তিনি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া এবং নিরাপত্তা বিধানের জন্য দূতাবাসকে অনুরোধ করেন। দূতাবাস সেই অনুরোধে ১৯শে নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই জিডি’র তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারেন জাপানি ওই নারী সিটি হোমস হোটেলে বেশ কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছিলেন। তার কথিত ব্যবসায়িক পার্টনার জাকির পাটোয়ারী রতন ও মারুফুল ইসলাম তাকে দেখভাল করতেন। এছাড়া রাশেদুল হক বাপ্পী নামে আরেক ব্যবসায়িক পার্টনারও মাঝে-মধ্যে ওই হোটেলে গিয়ে জাপানি নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, গত ২৬শে আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে রাশেদুল হক বাপ্পী কৌশলে জাপানি ওই নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে জাকির পাটোয়ারী রতন, মারুফুল ইসলাম ও রাশেদুল হক বাপ্পী পরস্পর যোগসাজশে ফখরুল ইসলাম নামে তাদের আরেক ব্যবসায়িক পার্টনারের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এ-ব্লকের ১২ নম্বর সড়কের ২৮৮ নম্বর প্লটের কৃষ্ণচূড়া-৬ অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থ তলায় নিয়ে আটকে রাখে। পরে তারা জাপানি নাগরিকের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা এনে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে ২৯শে অক্টোবর ভোর ৪টার দিকে কথিত এই ব্যবসায়িক পার্টনাররা তাদের পূর্ব পরিচিত এক চিকিৎসক ডা. বিমল চন্দ্র শীলসহ কৌশলে জাপানি নাগরিককে হত্যা করে এবং লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারবাহিকতায় জাকির পাটোয়ারী প্রাইভেটকারযোগে নিহত জাপানি নারীর লাশ মারুফুলের উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর বাসায় নিয়ে যায়। তারা অপর এক সহযোগী জাহাঙ্গীর ও অজ্ঞাত কয়েকজনের সহযোগিতায় জাপানি নাগরিকের প্রকৃত নাম-ঠিকানা ও নাগরিকত্ব গোপন করে হালিমা খাতুন, স্বামী মৃত বাবুল মৃধা, সাং পোতাপাড়া, থানা অভয়নগর জেলা যশোর পরিচয়ে উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে ওইদিন বিকালেই দাফন করে। তারা ভিকটিম হিরোয়ি মিয়েতার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যায়। পরে পুলিশ রাশেদুল হক বাপ্পীর অফিস থেকে এসব মালামাল উদ্ধার করে।
উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান বাদী হয়ে দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে জাপানি নাগরিককে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। তারা বিষয়টি জাপানি দূতাবাসকে অবহিত করে একটি মামলা দায়ের করার অনুরোধ করেন। কিন্তু জাপানি দূতাবাস মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করলে পুলিশই বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবৎ বাংলাদেশে বাস করছেন মিয়েতা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যে বাসায় তাকে নিয়ে আটকে রাখার অভিযোগ করছে পুলিশ বলেছে, ওই বাসাটি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলামের। পাঁচ তলা ওই বাড়ির চতুর্থ তলার বি-৩ নম্বর ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছিল মিয়েতাকে। গতকাল ওই ফ্ল্যাটে গেলে দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। ফ্ল্যাটটির মালিক রামপুরার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ সালেকিন জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম। উত্তরায় তার একটি বায়িং হাউজ রয়েছে বলে জানেন সালেকিন। তিনি বলেন, পাঁচ কক্ষের ওই বাসায় ফখরুলের পরিবারের সদস্যরা থাকতেন। কোন বিদেশী থাকতেন কি-না তা জানা নেই তার। তবে বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী উজ্জ্বল জানান, প্রায় এক মাস আগে এক বিদেশী নারীকে নিয়ে বাসায় উঠেন ফখরুল। এসময় ওই নারীর সঙ্গে কয়েকটি ব্যাগ ছিল বলে জানান তিনি। ব্যাগগুলো গাড়ির চালক ওপরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ওই নারীকে আর দেখেননি তিনি। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তুহিন খন্দকার ও তার স্ত্রী পাখি খন্দকার জানান, গত মাসে ওই বাসা ভাড়া নেন তারা। ফখরুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কখনও তাদের পরিচয় হয়নি। একইভাবে ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা নাশাররুল নাইস সুইটি জানান, ফখরুল ইসলামের বাসায় কোন বিদেশী থাকতেন তা জানা নেই তাদের।
এদিকে সরজমিনে গতকাল উত্তরা ১২নং সেক্টরের সিটি করপোরেশনের ওই কবরস্থানে গেলে কথা হয় দায়িত্বে থাকা মোহরার আবদুল কুদ্দুস ও মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। কবরস্থানের পশ্চিম দিকে শেফালী হাবীব ও আহমদ আলীর কবরস্থানের মধ্যের কবরে ইসলাম ধর্মের নিয়মে দাফন করা হয়েছে মিয়েতাকে। আব্দুল কুদ্দুস ও মনিরুল ইসলাম জানান, ওই দিন দুপুরের পর একজন নারীকে দাফন করার জন্য ১০-১২ জন ব্যক্তি কবরস্থানে যান। তার কয়েক ঘণ্টা আগে নিহতের দাফনের ব্যাপারে তাদের অবগত করেন। কাফন পরিয়ে লাশটি আনা হয় সেখানে। কবরস্থানের রেজিস্ট্রি খাতায় ওই নারীর নাম লেখা হয়েছে হালিমা খাতুন। পিতার নাম শাহজাহান আলী মৃধা। মাতা হাজেরা বেগম। স্বামী মৃত বাবুল মৃধা। বয়স ৭৪ বছর। মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে বার্ধ্যকজনিত। ঠিাকানা ১২ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়ি। গ্রামের বাড়ি পোতপাড়া, অভয়নগর, যশোর। ফি দাতার নাম লেখা রয়েছে মারুফ। সঙ্গে মারুফুল ইসলামের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানানুসারে মারুফের বাসায় গেলেও সেখানে তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই বাড়ির বাসিন্দা ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আবদুল্লাহ জানান, মারুফ নামে কেউ সেখানে থাকে না। হিরোয়ি মিয়েতা দীর্ঘদিন থেকেছেন উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের ১৩/বি সড়কের চার নম্বর সিটি হোমস নামক আবাসিক হোটেলে। ওই হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী থেকে শুরু করে পরিচালক কেউ এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি এই হিরোয়ি মিয়েতা নামে কেউ সেখানে ছিলেন কি-না তাও নিশ্চিত করতে পারেননি তারা। নিরাপত্তাকর্মী জসিম উদ্দিন, অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা রত্না, আরাফাত চৌধুরী জানান, তারা এই মাসের শুরুর দিকে কাজে যোগ দিয়েছেন। যে কারণে এ বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই। সিটি হোমসের খাতায় হিরোয়ি মিয়েতার নাম আছে কি-না জানতে চাইলে রত্না জানান, কয়েক দিন আগে এসব খাতা পুলিশ নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে হোটেলের পরিচালক আইয়ুব আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, নভেম্বরের শুরু থেকে হোটেলের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। আগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নেই। তিনজন পরিচালকের মধ্যে শাহাদাত ফিরোজ শিকদার পুরনো হলেও তার সঙ্গে কোন কথা বলা যায়নি। আইয়ুব হোসেন জানান, তিনি অসুস্থ। তার ফোনও বন্ধ রয়েছে। বাসার ঠিাকানাও জানা নেই তার। তবে ওই হোটেলের পাশের চা-বিক্রেতা আলমগীর হোসেন জানান, কয়েক মাস আগে একজন জাপানি নারীকে নিয়মিত ওই হোটেলে আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন তিনি। গত সোমবার পুলিশের কাছ থেকে জেনেছেন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আলমগীর বলেন, সন্ধ্যার আগে হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরতে দেখতেন ওই নারীকে। সন্ধ্যার দিকে হোটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতেন। মাঝে মাঝে তার দোকানে চা পান করতেন হিরোয়ি মিয়েতা। আধো আধো বাংলায় কথা বলতেন তিনি।
এ বিষয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় গেলে কথা হয় এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক কাজী সাহান হকের সঙ্গে। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। একপর্যায়ে সাহান হক বলেন, এটি তাভেলা সিজার বা হোশিও কুনি হত্যার মতো কোন ঘটনা নয়। এমনকি এটি হত্যাকাণ্ড কি-না এ বিষয়েও নিশ্চিত নন তারা। তাহলে হত্যা মামলা করা হলো কেন এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
লাশ উত্তোলনের শুনানি কাল: এদিকে পুলিশ গত সোমবার নিহত জাপানি নাগরিকের হিরোয়ি মিয়েতার লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। আদালত আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই আবেদনের শুনানীর দিন ধার্য করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লাশ ময়নাতদন্ত করা হলে বোঝা যাবে তাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের আগেই পুলিশের হত্যা মামলা দায়ের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে পুলিশ আগে ময়নাতদন্ত করে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই হত্যা মামলা করা হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে জাপানি নাগরিক হত্যার বিষয়টি রাখা হয়েছিল।
গ্রেপ্তারকৃত ৫ জন ৪ দিনের রিমান্ডে: এদিকে জাপানি নাগরিক হিরোই মিয়েতা হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৫ আসামিকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক আবু বকর মিয়া গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট স্নিগ্ধা রানী সাহার আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন। আদালতে আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন। তবে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের ৪ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে রাজধানীতে জাপানি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে নিহত ওই জাপানি নাগরিকের কথিত ব্যবসায়িক পার্টনারদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। নিহত জাপানি নাগরিকের কথিত ব্যবসায়িক অংশীদারসহ গ্রেপ্তার ৫ জনকে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে চাইলে আদালত চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। যাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তারা হলো মারুফুল ইসলাম (৩০), রাশেদুল হক বাপ্পি (৪২), ফখরুল ইসলাম (২৭), ডা. বিমল চন্দ্র শীল (৪০) ও জাহাঙ্গীর (২৮)। রিমান্ড আবেদনের বরাত দিয়ে আদালত পুলিশের এস আই উজির আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, গত ২৯শে অক্টোবর জাপানি নারী মিয়েতাকে হত্যা করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে ওই জাপানি নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য দশদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এদিকে, গতাকল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও করা হয়েছিল। কিন্তু ‘অনিবার্য কারণে’ সেই সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়। বলা হচ্ছে, জাপানি দূতাবাস সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি পছন্দ করছে না। এ কারণে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ওই জাপানি নাগরিককে হালিমা খাতুন পরিচয়ে উত্তরার ১২নং সেক্টরের সিটি কর্পোরেশনের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৯শে নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় জাপান দূতাবাসের ভাইস কনসাল কোসিউকি মাৎসুনাগা বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নম্বর ৯৩৫। ওই জিডিতে বলা হয়েছে ৪ঠা নভেম্বর জাপানি নাগরিক মাকিকো হিরাবায়্যাসি ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসে ফোন করেন। তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেন, তার কন্যার নাম হিরোয়ি মিয়েতা। তার পাসপোর্ট নম্বর টিজি-০৪৪৫৭৭৮। জন্ম তারিখ ১৬ই আগস্ট ১৯৫৫। হিরোয়ি মিয়েতা বেশ কিছুদিন ধরে উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি সড়কের ৪ নম্বর বাসার সিটি হোমস নামের ডরমিটরিতে থাকতেন। প্রতি সপ্তাহেই তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু ২৬শে অক্টোবর থেকে তিনি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া এবং নিরাপত্তা বিধানের জন্য দূতাবাসকে অনুরোধ করেন। দূতাবাস সেই অনুরোধে ১৯শে নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই জিডি’র তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারেন জাপানি ওই নারী সিটি হোমস হোটেলে বেশ কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছিলেন। তার কথিত ব্যবসায়িক পার্টনার জাকির পাটোয়ারী রতন ও মারুফুল ইসলাম তাকে দেখভাল করতেন। এছাড়া রাশেদুল হক বাপ্পী নামে আরেক ব্যবসায়িক পার্টনারও মাঝে-মধ্যে ওই হোটেলে গিয়ে জাপানি নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, গত ২৬শে আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে রাশেদুল হক বাপ্পী কৌশলে জাপানি ওই নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে জাকির পাটোয়ারী রতন, মারুফুল ইসলাম ও রাশেদুল হক বাপ্পী পরস্পর যোগসাজশে ফখরুল ইসলাম নামে তাদের আরেক ব্যবসায়িক পার্টনারের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এ-ব্লকের ১২ নম্বর সড়কের ২৮৮ নম্বর প্লটের কৃষ্ণচূড়া-৬ অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থ তলায় নিয়ে আটকে রাখে। পরে তারা জাপানি নাগরিকের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা এনে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে ২৯শে অক্টোবর ভোর ৪টার দিকে কথিত এই ব্যবসায়িক পার্টনাররা তাদের পূর্ব পরিচিত এক চিকিৎসক ডা. বিমল চন্দ্র শীলসহ কৌশলে জাপানি নাগরিককে হত্যা করে এবং লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারবাহিকতায় জাকির পাটোয়ারী প্রাইভেটকারযোগে নিহত জাপানি নারীর লাশ মারুফুলের উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর বাসায় নিয়ে যায়। তারা অপর এক সহযোগী জাহাঙ্গীর ও অজ্ঞাত কয়েকজনের সহযোগিতায় জাপানি নাগরিকের প্রকৃত নাম-ঠিকানা ও নাগরিকত্ব গোপন করে হালিমা খাতুন, স্বামী মৃত বাবুল মৃধা, সাং পোতাপাড়া, থানা অভয়নগর জেলা যশোর পরিচয়ে উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে ওইদিন বিকালেই দাফন করে। তারা ভিকটিম হিরোয়ি মিয়েতার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যায়। পরে পুলিশ রাশেদুল হক বাপ্পীর অফিস থেকে এসব মালামাল উদ্ধার করে।
উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান বাদী হয়ে দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে জাপানি নাগরিককে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। তারা বিষয়টি জাপানি দূতাবাসকে অবহিত করে একটি মামলা দায়ের করার অনুরোধ করেন। কিন্তু জাপানি দূতাবাস মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করলে পুলিশই বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবৎ বাংলাদেশে বাস করছেন মিয়েতা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যে বাসায় তাকে নিয়ে আটকে রাখার অভিযোগ করছে পুলিশ বলেছে, ওই বাসাটি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলামের। পাঁচ তলা ওই বাড়ির চতুর্থ তলার বি-৩ নম্বর ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছিল মিয়েতাকে। গতকাল ওই ফ্ল্যাটে গেলে দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। ফ্ল্যাটটির মালিক রামপুরার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ সালেকিন জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম। উত্তরায় তার একটি বায়িং হাউজ রয়েছে বলে জানেন সালেকিন। তিনি বলেন, পাঁচ কক্ষের ওই বাসায় ফখরুলের পরিবারের সদস্যরা থাকতেন। কোন বিদেশী থাকতেন কি-না তা জানা নেই তার। তবে বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী উজ্জ্বল জানান, প্রায় এক মাস আগে এক বিদেশী নারীকে নিয়ে বাসায় উঠেন ফখরুল। এসময় ওই নারীর সঙ্গে কয়েকটি ব্যাগ ছিল বলে জানান তিনি। ব্যাগগুলো গাড়ির চালক ওপরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ওই নারীকে আর দেখেননি তিনি। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তুহিন খন্দকার ও তার স্ত্রী পাখি খন্দকার জানান, গত মাসে ওই বাসা ভাড়া নেন তারা। ফখরুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কখনও তাদের পরিচয় হয়নি। একইভাবে ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা নাশাররুল নাইস সুইটি জানান, ফখরুল ইসলামের বাসায় কোন বিদেশী থাকতেন তা জানা নেই তাদের।
এদিকে সরজমিনে গতকাল উত্তরা ১২নং সেক্টরের সিটি করপোরেশনের ওই কবরস্থানে গেলে কথা হয় দায়িত্বে থাকা মোহরার আবদুল কুদ্দুস ও মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। কবরস্থানের পশ্চিম দিকে শেফালী হাবীব ও আহমদ আলীর কবরস্থানের মধ্যের কবরে ইসলাম ধর্মের নিয়মে দাফন করা হয়েছে মিয়েতাকে। আব্দুল কুদ্দুস ও মনিরুল ইসলাম জানান, ওই দিন দুপুরের পর একজন নারীকে দাফন করার জন্য ১০-১২ জন ব্যক্তি কবরস্থানে যান। তার কয়েক ঘণ্টা আগে নিহতের দাফনের ব্যাপারে তাদের অবগত করেন। কাফন পরিয়ে লাশটি আনা হয় সেখানে। কবরস্থানের রেজিস্ট্রি খাতায় ওই নারীর নাম লেখা হয়েছে হালিমা খাতুন। পিতার নাম শাহজাহান আলী মৃধা। মাতা হাজেরা বেগম। স্বামী মৃত বাবুল মৃধা। বয়স ৭৪ বছর। মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে বার্ধ্যকজনিত। ঠিাকানা ১২ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়ি। গ্রামের বাড়ি পোতপাড়া, অভয়নগর, যশোর। ফি দাতার নাম লেখা রয়েছে মারুফ। সঙ্গে মারুফুল ইসলামের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানানুসারে মারুফের বাসায় গেলেও সেখানে তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই বাড়ির বাসিন্দা ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আবদুল্লাহ জানান, মারুফ নামে কেউ সেখানে থাকে না। হিরোয়ি মিয়েতা দীর্ঘদিন থেকেছেন উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের ১৩/বি সড়কের চার নম্বর সিটি হোমস নামক আবাসিক হোটেলে। ওই হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী থেকে শুরু করে পরিচালক কেউ এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি এই হিরোয়ি মিয়েতা নামে কেউ সেখানে ছিলেন কি-না তাও নিশ্চিত করতে পারেননি তারা। নিরাপত্তাকর্মী জসিম উদ্দিন, অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা রত্না, আরাফাত চৌধুরী জানান, তারা এই মাসের শুরুর দিকে কাজে যোগ দিয়েছেন। যে কারণে এ বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই। সিটি হোমসের খাতায় হিরোয়ি মিয়েতার নাম আছে কি-না জানতে চাইলে রত্না জানান, কয়েক দিন আগে এসব খাতা পুলিশ নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে হোটেলের পরিচালক আইয়ুব আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, নভেম্বরের শুরু থেকে হোটেলের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। আগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নেই। তিনজন পরিচালকের মধ্যে শাহাদাত ফিরোজ শিকদার পুরনো হলেও তার সঙ্গে কোন কথা বলা যায়নি। আইয়ুব হোসেন জানান, তিনি অসুস্থ। তার ফোনও বন্ধ রয়েছে। বাসার ঠিাকানাও জানা নেই তার। তবে ওই হোটেলের পাশের চা-বিক্রেতা আলমগীর হোসেন জানান, কয়েক মাস আগে একজন জাপানি নারীকে নিয়মিত ওই হোটেলে আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন তিনি। গত সোমবার পুলিশের কাছ থেকে জেনেছেন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আলমগীর বলেন, সন্ধ্যার আগে হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরতে দেখতেন ওই নারীকে। সন্ধ্যার দিকে হোটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতেন। মাঝে মাঝে তার দোকানে চা পান করতেন হিরোয়ি মিয়েতা। আধো আধো বাংলায় কথা বলতেন তিনি।
এ বিষয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় গেলে কথা হয় এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক কাজী সাহান হকের সঙ্গে। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। একপর্যায়ে সাহান হক বলেন, এটি তাভেলা সিজার বা হোশিও কুনি হত্যার মতো কোন ঘটনা নয়। এমনকি এটি হত্যাকাণ্ড কি-না এ বিষয়েও নিশ্চিত নন তারা। তাহলে হত্যা মামলা করা হলো কেন এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
লাশ উত্তোলনের শুনানি কাল: এদিকে পুলিশ গত সোমবার নিহত জাপানি নাগরিকের হিরোয়ি মিয়েতার লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। আদালত আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই আবেদনের শুনানীর দিন ধার্য করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লাশ ময়নাতদন্ত করা হলে বোঝা যাবে তাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের আগেই পুলিশের হত্যা মামলা দায়ের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে পুলিশ আগে ময়নাতদন্ত করে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই হত্যা মামলা করা হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে জাপানি নাগরিক হত্যার বিষয়টি রাখা হয়েছিল।
গ্রেপ্তারকৃত ৫ জন ৪ দিনের রিমান্ডে: এদিকে জাপানি নাগরিক হিরোই মিয়েতা হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৫ আসামিকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক আবু বকর মিয়া গ্রেপ্তারকৃতদের ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট স্নিগ্ধা রানী সাহার আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন। আদালতে আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন। তবে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের ৪ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
No comments