কলেজশিক্ষার বেহাল অবস্থা by আমিরুল আলম খান
বিশ্বাস করা কঠিন; তবু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত হলো কলেজশিক্ষা। সেখানে বিরাজ করছে নৈরাজ্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সরকারি-বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের বেলায় তা একেবারেই অনুপস্থিত। এমনকি এ ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতাও নেই।
একজন শিক্ষকের দুটি বিষয়ে পারদর্শিতা অপরিহার্য: বিষয় জ্ঞান এবং শিক্ষণ ও গবেষণা দক্ষতা। শিক্ষণ দক্ষতা নির্ভর করে শিক্ষার মৌল ধারণাসমূহ, কারিকুলাম ও সিলেবাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, শিক্ষার ইতিহাস, শিক্ষার্থীর মনোজগৎ, জ্ঞান বিতরণে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল-সম্পর্কিত জ্ঞান, পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষা-উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার, শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার্থীর শিখনফল পরিমাপ ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এবং নতুন নতুন শিক্ষণ কৌশল উদ্ভাবনের দক্ষতার ওপর। আধুনিক শিক্ষা হলো অংশগ্রহণমূলক এবং তা আবশ্যিকভাবেই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও ব্যবহারিক। পঠন-পাঠনে সৃজনশীলতা ব্যতিরেকে আধুনিক কালে শিক্ষা দান ও গ্রহণ অসম্ভব। শিক্ষাবিজ্ঞানে উপযুক্ত শিক্ষা/প্রশিক্ষণ, গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষক নিজেকে সৃষ্টিশীল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। বর্তমান পৃথিবীতে তাই শিক্ষা বিষয়ে উপযুক্ত ডিগ্রি/ডিপ্লোমা ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হওয়া যায় না।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি কলেজশিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) মাস্টার ডিগ্রি। সেখানে প্রার্থীকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। সকল পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণি/সমমানের গ্রেড থাকতে হয়।
সরকারি কর্মকমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজশিক্ষক নিয়োগ হয়। হালে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে কর্মকমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেসরকারি কলেজের জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিবন্ধন পরীক্ষা প্রায় এক দশকেও কোনো বিশ্বাসযোগ্য মান অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় বিষয় জ্ঞান ছাড়া পেডাগজি ও শিক্ষণ-দক্ষতার কিছুই যাচাই করা হয় না। তা করতে হলে হবু শিক্ষককের শিক্ষায় প্রি-সার্ভিস ডিগ্রি আবশ্যিক করতে হবে। কিন্তু সেটিই করা হয়নি।
বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা তামাশার চূড়ান্ত। মোট শিক্ষকসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সিনিয়র শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। অন্যদের প্রভাষক হিসেবেই জীবনপাত করতে হয়। ফলে মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা থেকে বেসরকারি কলেজশিক্ষকেরা আমৃত্যু বঞ্চিত থাকেন। তাঁরা হতাশার শিকার হন, কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলেন। আখেরে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। পদোন্নতিহীন এমন অমানবিক ব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। অথচ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ কলেজই বেসরকারি এবং এই বেসরকারি কলেজগুলোই বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক, স্নাতক (সম্মান), এমনকি মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষার চাকা সচল রেখেছে।
শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়। তার কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ৯০ ভাগ কলেজশিক্ষকের ধারণা নেতিবাচক। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণ যে দুটি আলাদা বিজ্ঞান, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা পর্যন্ত নেই সরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির শর্ত হচ্ছে চার মাসের বুনিয়াদি ট্রেনিং আর বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পদ শূন্য সাপেক্ষে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি হয়। পেশাগত নতুন, উন্নত জ্ঞান যাচাই বা পেশাগত ট্রেনিং বা গবেষণাপত্র প্রকাশ পদোন্নতির কোনো মানদণ্ড নয়। পদোন্নতির কোনো স্তরেই এসবের প্রয়োজন হয় না। পদায়নেও নেই কোনো শৃঙ্খলা। সেখানে দলবাজি, তদবিরের প্রাধান্য। এমনকি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শেখার সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। তা হলে একজন শিক্ষক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্য প্রসারমাণ ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হবেন কীভাবে? কীভাবে তিনি নিজেকে একজন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবেন? দাসত্বের এক চরম দৃষ্টান্ত হলো এ দেশের সরকারি শিক্ষকেরা। তাঁদের স্বাধীন চিন্তার পথে পথে হাজারো কাঁটা বিছানো। সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত একই আইনে শিক্ষকদের স্বাধীন চিন্তার দরজা চিররুদ্ধ। অথচ চিন্তার স্বাধীনতা ও নির্ভাবনায় প্রকাশ হলো শিক্ষকতার মৌলিক অধিকার। এমন বন্দিদশায় কীভাবে শিক্ষক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন? কীভাবে তিনি নিজেকে আরও যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবেন? শিক্ষকতা যে অনুগত দাসের কাজ নয়, এ কথা বুঝতেও অক্ষম আমরা।
কেন কলেজশিক্ষকতায় পেডাগজি (শিক্ষাবিজ্ঞান) জানা আবশ্যকীয় করা হবে না, এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণে বিএড/এমএড বা সমমানের ডিগ্রিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিশেষ ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে তা বিবেচনা করা উচিত। শিক্ষকতায় প্রবেশের আগেই শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি। তাতে শিক্ষার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি বাঁচবে সরকারি অর্থ। যাঁরা ইতিমধ্যে এ পেশায় প্রবেশ করেছেন, তাঁদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি/ডিপ্লোমা অর্জন/প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
আশ্চর্যের বিষয়, প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা চাকরিজীবনে কমপক্ষে ১৫ বার বিদেশে শিক্ষা ভ্রমণের সুযোগ পান। অথচ ৯৯ শতাংশ শিক্ষকই সারা জীবনে মাত্র একবারও সে সুযোগ পান না! কূপমণ্ডূকের জীবন কাটে আমাদের কলেজশিক্ষকদের। এ দেশে একজন চৌকিদারেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, নেই কোনো কলেজশিক্ষকের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা/প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো পঠন-পাঠনের পাশাপাশি গবেষণা ও উত্তম শিক্ষক তৈরি। বাংলাদেশে তা বলতে গেলে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বাংলাদেশে সে জন্য কোনো প্রস্তুতিও নেই। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, হালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশে মাত্র ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এই ডিগ্রি প্রদানের মানসম্মত ব্যবস্থা আছে। দেশে বেসরকারি প্রায় দেড় শ প্রতিষ্ঠান বিএড কোর্স করালেও তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবাই ডিগ্রি বিক্রির বাণিজ্যে মেতেছে বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে নায়েম, পাঁচটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখে না। নায়েমে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ মূলত শিক্ষকদের কেরানি ও অনুগত ভৃত্য বানানোর কারখানা; পেডাগজি সেখানে অস্পৃশ্য।
বাংলাদেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার চিন্তা করা হয়নি। বিশ্বের বহু উন্নত ও বিকাশশীল দেশে এখন শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষের জন্য পঠন-পাঠন, গবেষণা চলে। কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ আয়োজন, দেশের শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের যাবতীয় বিষয় দেখভাল এবং দেশীয় বাস্তবতা ও বৈশ্বিক চাহিদার নিরিখে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা–বিষয়ক গবেষণা, গবেষণা জার্নাল প্রকাশ, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ দায়িত্ব। অর্থাৎ দেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্রভূমি হলো শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে কলেজশিক্ষকদের ৯০ শতাংশই শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রি একান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। কোনো প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন ছাড়া শুধু মাঠে বা টেলিভিশনে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা জার্মানির খেলা দেখেই ভালো খেলোয়াড় হওয়া যেমন হাস্যকর, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু বিষয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েই ভালো শিক্ষক হওয়াও তেমনি অসম্ভব।
শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়। তার কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ৯০ শতাংশ কলেজশিক্ষকের ধারণা নেতিবাচক। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণ যে দুটি আলাদা বিজ্ঞান, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা পর্যন্ত নেই। ফলে শেখানোর আধুনিক কলাকৌশলের সঙ্গে আমাদের কলেজশিক্ষকেরা পরিচিত হওয়ারই সুযোগ পান না। বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির জন্য শিক্ষা–বিষয়ক প্রশিক্ষণ, উচ্চতর ডিগ্রি/ডিপ্লোমা, নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সেদিকে কারও আগ্রহ নেই। দেশে-বিদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণেরও সুযোগ নেই। চাকরির দৈর্ঘ্য (লেন্থ অব সার্ভিস) হিসেবে পদোন্নতি মেলে। তাই উপরিউক্ত বিষয়গুলো তাঁদের চিন্তায়ও আসে না। উচ্চতর ডিগ্রি, নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশ, পদোন্নতি পরীক্ষা ছাড়া পদোন্নতি বন্ধ করার সময় এসেছে।
কলেজশিক্ষার বর্তমান ধারা পরিবর্তন করে তা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত করার বিকল্প নেই। সে জন্য ঢেলে সাজাতে হবে বর্তমান কলেজশিক্ষাব্যবস্থা। নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নের বিদ্যমান আইনের ব্যাপক সংশোধন জরুরি হয়ে উঠেছে। এ জন্য দরকার জাতীয় সংলাপ শুরু করা।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
amirulkhan7@gmail.com
একজন শিক্ষকের দুটি বিষয়ে পারদর্শিতা অপরিহার্য: বিষয় জ্ঞান এবং শিক্ষণ ও গবেষণা দক্ষতা। শিক্ষণ দক্ষতা নির্ভর করে শিক্ষার মৌল ধারণাসমূহ, কারিকুলাম ও সিলেবাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, শিক্ষার ইতিহাস, শিক্ষার্থীর মনোজগৎ, জ্ঞান বিতরণে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল-সম্পর্কিত জ্ঞান, পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষা-উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার, শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার্থীর শিখনফল পরিমাপ ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এবং নতুন নতুন শিক্ষণ কৌশল উদ্ভাবনের দক্ষতার ওপর। আধুনিক শিক্ষা হলো অংশগ্রহণমূলক এবং তা আবশ্যিকভাবেই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও ব্যবহারিক। পঠন-পাঠনে সৃজনশীলতা ব্যতিরেকে আধুনিক কালে শিক্ষা দান ও গ্রহণ অসম্ভব। শিক্ষাবিজ্ঞানে উপযুক্ত শিক্ষা/প্রশিক্ষণ, গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষক নিজেকে সৃষ্টিশীল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। বর্তমান পৃথিবীতে তাই শিক্ষা বিষয়ে উপযুক্ত ডিগ্রি/ডিপ্লোমা ছাড়া শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হওয়া যায় না।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি কলেজশিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) মাস্টার ডিগ্রি। সেখানে প্রার্থীকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। সকল পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণি/সমমানের গ্রেড থাকতে হয়।
সরকারি কর্মকমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজশিক্ষক নিয়োগ হয়। হালে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে কর্মকমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেসরকারি কলেজের জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিবন্ধন পরীক্ষা প্রায় এক দশকেও কোনো বিশ্বাসযোগ্য মান অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় বিষয় জ্ঞান ছাড়া পেডাগজি ও শিক্ষণ-দক্ষতার কিছুই যাচাই করা হয় না। তা করতে হলে হবু শিক্ষককের শিক্ষায় প্রি-সার্ভিস ডিগ্রি আবশ্যিক করতে হবে। কিন্তু সেটিই করা হয়নি।
বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা তামাশার চূড়ান্ত। মোট শিক্ষকসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সিনিয়র শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। অন্যদের প্রভাষক হিসেবেই জীবনপাত করতে হয়। ফলে মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা থেকে বেসরকারি কলেজশিক্ষকেরা আমৃত্যু বঞ্চিত থাকেন। তাঁরা হতাশার শিকার হন, কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলেন। আখেরে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। পদোন্নতিহীন এমন অমানবিক ব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। অথচ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ কলেজই বেসরকারি এবং এই বেসরকারি কলেজগুলোই বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক, স্নাতক (সম্মান), এমনকি মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষার চাকা সচল রেখেছে।
শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়। তার কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ৯০ ভাগ কলেজশিক্ষকের ধারণা নেতিবাচক। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণ যে দুটি আলাদা বিজ্ঞান, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা পর্যন্ত নেই সরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির শর্ত হচ্ছে চার মাসের বুনিয়াদি ট্রেনিং আর বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পদ শূন্য সাপেক্ষে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি হয়। পেশাগত নতুন, উন্নত জ্ঞান যাচাই বা পেশাগত ট্রেনিং বা গবেষণাপত্র প্রকাশ পদোন্নতির কোনো মানদণ্ড নয়। পদোন্নতির কোনো স্তরেই এসবের প্রয়োজন হয় না। পদায়নেও নেই কোনো শৃঙ্খলা। সেখানে দলবাজি, তদবিরের প্রাধান্য। এমনকি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শেখার সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। তা হলে একজন শিক্ষক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিত্য প্রসারমাণ ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হবেন কীভাবে? কীভাবে তিনি নিজেকে একজন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবেন? দাসত্বের এক চরম দৃষ্টান্ত হলো এ দেশের সরকারি শিক্ষকেরা। তাঁদের স্বাধীন চিন্তার পথে পথে হাজারো কাঁটা বিছানো। সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত একই আইনে শিক্ষকদের স্বাধীন চিন্তার দরজা চিররুদ্ধ। অথচ চিন্তার স্বাধীনতা ও নির্ভাবনায় প্রকাশ হলো শিক্ষকতার মৌলিক অধিকার। এমন বন্দিদশায় কীভাবে শিক্ষক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন? কীভাবে তিনি নিজেকে আরও যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবেন? শিক্ষকতা যে অনুগত দাসের কাজ নয়, এ কথা বুঝতেও অক্ষম আমরা।
কেন কলেজশিক্ষকতায় পেডাগজি (শিক্ষাবিজ্ঞান) জানা আবশ্যকীয় করা হবে না, এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণে বিএড/এমএড বা সমমানের ডিগ্রিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিশেষ ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে তা বিবেচনা করা উচিত। শিক্ষকতায় প্রবেশের আগেই শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি। তাতে শিক্ষার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি বাঁচবে সরকারি অর্থ। যাঁরা ইতিমধ্যে এ পেশায় প্রবেশ করেছেন, তাঁদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি/ডিপ্লোমা অর্জন/প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
আশ্চর্যের বিষয়, প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা চাকরিজীবনে কমপক্ষে ১৫ বার বিদেশে শিক্ষা ভ্রমণের সুযোগ পান। অথচ ৯৯ শতাংশ শিক্ষকই সারা জীবনে মাত্র একবারও সে সুযোগ পান না! কূপমণ্ডূকের জীবন কাটে আমাদের কলেজশিক্ষকদের। এ দেশে একজন চৌকিদারেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, নেই কোনো কলেজশিক্ষকের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা/প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো পঠন-পাঠনের পাশাপাশি গবেষণা ও উত্তম শিক্ষক তৈরি। বাংলাদেশে তা বলতে গেলে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বাংলাদেশে সে জন্য কোনো প্রস্তুতিও নেই। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, হালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশে মাত্র ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এই ডিগ্রি প্রদানের মানসম্মত ব্যবস্থা আছে। দেশে বেসরকারি প্রায় দেড় শ প্রতিষ্ঠান বিএড কোর্স করালেও তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবাই ডিগ্রি বিক্রির বাণিজ্যে মেতেছে বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে নায়েম, পাঁচটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখে না। নায়েমে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ মূলত শিক্ষকদের কেরানি ও অনুগত ভৃত্য বানানোর কারখানা; পেডাগজি সেখানে অস্পৃশ্য।
বাংলাদেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার চিন্তা করা হয়নি। বিশ্বের বহু উন্নত ও বিকাশশীল দেশে এখন শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষের জন্য পঠন-পাঠন, গবেষণা চলে। কারিকুলাম প্রণয়ন থেকে নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ আয়োজন, দেশের শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের যাবতীয় বিষয় দেখভাল এবং দেশীয় বাস্তবতা ও বৈশ্বিক চাহিদার নিরিখে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা–বিষয়ক গবেষণা, গবেষণা জার্নাল প্রকাশ, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ দায়িত্ব। অর্থাৎ দেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্রভূমি হলো শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে কলেজশিক্ষকদের ৯০ শতাংশই শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রি একান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। কোনো প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন ছাড়া শুধু মাঠে বা টেলিভিশনে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা জার্মানির খেলা দেখেই ভালো খেলোয়াড় হওয়া যেমন হাস্যকর, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু বিষয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়েই ভালো শিক্ষক হওয়াও তেমনি অসম্ভব।
শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়। তার কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ৯০ শতাংশ কলেজশিক্ষকের ধারণা নেতিবাচক। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণ যে দুটি আলাদা বিজ্ঞান, সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা পর্যন্ত নেই। ফলে শেখানোর আধুনিক কলাকৌশলের সঙ্গে আমাদের কলেজশিক্ষকেরা পরিচিত হওয়ারই সুযোগ পান না। বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির জন্য শিক্ষা–বিষয়ক প্রশিক্ষণ, উচ্চতর ডিগ্রি/ডিপ্লোমা, নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সেদিকে কারও আগ্রহ নেই। দেশে-বিদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণেরও সুযোগ নেই। চাকরির দৈর্ঘ্য (লেন্থ অব সার্ভিস) হিসেবে পদোন্নতি মেলে। তাই উপরিউক্ত বিষয়গুলো তাঁদের চিন্তায়ও আসে না। উচ্চতর ডিগ্রি, নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশ, পদোন্নতি পরীক্ষা ছাড়া পদোন্নতি বন্ধ করার সময় এসেছে।
কলেজশিক্ষার বর্তমান ধারা পরিবর্তন করে তা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত করার বিকল্প নেই। সে জন্য ঢেলে সাজাতে হবে বর্তমান কলেজশিক্ষাব্যবস্থা। নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নের বিদ্যমান আইনের ব্যাপক সংশোধন জরুরি হয়ে উঠেছে। এ জন্য দরকার জাতীয় সংলাপ শুরু করা।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
amirulkhan7@gmail.com
No comments