ইয়েমেনের মৃত্যুকূপে কাঁদছেন বাংলাদেশীরা by মিজানুর রহমান ও রোকনুজ্জামান পিয়াস
ইয়েমেনের
মৃত্যুকূপে কাঁদছেন বাংলাদেশীরা। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাটছে আতঙ্কে।
একদিকে বিমান হামলার ভয়, অন্যদিকে খাদ্য সংকট অনিশ্চিত করে তুলেছে তাদের
জীবন। তারা প্রাণে বাঁচতে চান। যে কোন মূল্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশ থেকে
বেরিয়ে আসতে চান। কিন্তু সব পথ বন্ধ! নেই কোন কমার্শিয়াল ফ্লাইট। পাশের
সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশের বর্ডারে কড়া নজরদারি। ইয়েমেন থেকে যাতে কেউ
ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করেছে সীমান্তের দেশগুলো। এ অবস্থায়
রাজধানী সানা, বন্দর নগরী এডেনসহ দেশটির বিভিন্ন এলাকায় আটকাপড়া কয়েক
হাজার বাংলাদেশীকে উদ্ধারে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের
ওপর পরিচালিত সৌদি জোটের বিমান হামলায় বাংলাদেশ সমর্থন দেয়ার পর প্রবাসীদের
ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। যে কোন মুহূর্তে বাংলাদেশীরা বিদ্রোহীদের
আক্রমণের শিকার হতে পারেন- এমন আশঙ্কা রয়েছে। দেশটিতে বাংলাদেশের কোন
দূতাবাস নেই। সানায় একজন অনারারি কনসাল থাকলেও কর্মীদের সঙ্গে তার তেমন
যোগাযোগ নেই। এ অবস্থায় সরকারের তরফে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাশের তিন
গুরুত্বপূর্ণ মিশন কুয়েত, রিয়াদ ও মাস্কাটে সর্বশেষ পরিস্থিতির বিস্তারিত
রিপোর্ট চায়। সেখানে দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকায় আটকাপড়া বাংলাদেশীদের উদ্ধার
এবং সহজে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়ার বিষয়ে দূতাবাসের পরামর্শও চাওয়া হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাওয়ার প্রেক্ষিতে ওমানে
নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলী একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।
ওই কূটনীতিক তার রিপোর্টে ইয়েমেন পরিস্থিতির বিস্তারিত উল্লেখ করার
পাশাপাশি বাংলাদেশীদের অবস্থান এবং তাদের উদ্ধার ও দেশে ফেরত পাঠানোর একটি
প্লান বা পরিকল্পনা পেশ করেছেন। দেশটিতে আটকাপড়া বেশ কিছু বাংলাদেশীর সঙ্গে
তার যোগাযোগ হয়েছে জানিয়ে রিপোর্টের শুরুতে রাষ্ট্রদূত বলেন, তাদের দেয়া
তথ্য মতে, এডেনে ১০০০ এবং সানায় ৩শ’র মতো বাংলাদেশী এখনও রয়েছেন। তাদের
বেশির ভাগই দেশে ফিরতে আকুল হয়ে আছেন। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কেউ কেউ এ
অবস্থায়ও দেশটিতে থাকতে চায় জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিভিন্ন এলাকায়
বাংলাদেশীরা থাকলেও সানা, এডেন, তাইজ ও আল মুকাল্লা শহর ও এর আশপাশের
এলাকাগুলোতেই বেশির ভাগ বাংলাদেশী থাকেন। রাষ্ট্রদূত জানান, উদ্ভূত
পরিস্থিতিতে ইয়েমেনের আকাশসীমার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সৌদি আরব নিয়ে নিয়েছে।
দেশটির সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়মিত কমার্শিয়াল ফ্লাইট ছিল তা বন্ধ
হয়ে গেছে বহু আগেই। কিছু কিছু বিশেষ ফ্লাইট চলছে সৌদি কর্তৃপক্ষের
পূর্বানুুমতি নিয়ে। রাজধানীর প্রধান বিমানবন্দর ব্যবহার অনুপযোগী। সেখান
থেকে প্রায় ৫শ’ কিলোমিটার দূরের দুই শহর আল-মুকাল্লা ও আল-হুদাইদায়
বিমানবন্দর রয়েছে। সেখানে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ রয়েছে, তবে তাতেও
সৌদি কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতির প্রয়োজন হবে। মাস্কাটের ইয়েমেন, ভারত ও
পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতের
আলোচনা হয়েছে জানিয়ে রিপোর্ট বলা হয়, পাকিস্তান সরকার এরই মধ্যে দেশটি থেকে
তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে। তারা বিশেষ বিমান পাঠিয়ে তাদের কর্মী বের
করে নিয়েছে। সেখানে সৌদি কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছিল। এখনও অনেক পাকিস্তানি
দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে এবার আর বিশেষ বিমান নয়, এডেন বন্দর থেকে
নৌ-পথেই তাদের বের করে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পকিস্তান সরকার সানায়
তাদের দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে নিযুক্ত কূটনীতিক ও
স্টাফদের ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। তবে সানায় ভারতীয়
দূতাবাসের কার্যক্রম পুরোপুরি সচল রয়েছে। এডেন বন্দর থেকে হাজার খানেক
ভারতীয় নাগরিককে বিশেষ জাহাজে করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিদের ফেরাতে
দিল্লির আরেকটি জাহাজ এডেন বন্দরের পথে রয়েছে। একই সঙ্গে দুটি বিশেষ বিমান
মাস্কাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে বিমান
দুটি ইয়েমেনের কোন বিমানবন্দরে যাবে এবং দেশটি থেকে তাদের আটকাপড়া কর্মীদের
উদ্ধার করে নিয়ে আসবে বলে জানানো হয়েছে। ওমান কর্তৃপক্ষ ইয়েমেনে থাকা
দেশটির দূতাবাস বন্ধ করে দিলেও তারা সৌদি জোট পরিচালিত অভিযানে শামিল হয়নি।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেনিদের মানবিক ত্রাণ সহায়তায় ওমান কাজ করছে জানিয়ে
রিপোর্টে বলা হয়, দেশটির সঙ্গে ওমানের সীমান্ত সিল করে দেয়া হয়েছে। ওই
এলাকা গুলোতে কড়া নরজদারি রয়েছে। ইয়েমেন থেকে কেউ যাতে ওই এলাকাগুলোতে
ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে ওমান কর্তৃপক্ষ। আটকাপড়া
বাংলাদেশীদের ওই সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে উদ্ধার করে ওমান থেকে বিমানে করে
দেশে ফেরত পাঠানোর একটি চিন্তা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু রাষ্ট্রদূত তার
রিপোর্টে সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ওই পয়েন্টগুলো দিয়ে কোন
বাংলাদেশীকে উদ্ধারে ওমান কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ
অবস্থায় এডেনবন্দর দিয়ে ভারতীয় ও পাকিস্তানের নাগরিকদের মতো বাংলাদেশের
নাগরিকদের জাহাজে করে বের করে আনাই নিরাপদ হবে বলে মত দিয়েছেন ওমানে
নিযুক্ত ওই পেশাদার কূটনীতিক। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ওই এলাকাকে বিদ্রোহী
হুতি মুক্ত নিরাপদ জায়গা হিসাবে রাখার চেষ্টা করছে। বিপদগ্রস্ত
বাংলাদেশীদের উদ্ধারে সৌদি ও জাতিসংঘকে সহায়তার অনুরোধ জানানোর বিষয়টি
সরকারের বিবেচনায় নেয়ার পরামর্শ দেন রাষ্ট্রদূত। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও
যোগাযোগের পরামর্শ দেন রাষ্ট্রদূত। ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের
ফেরানো যেতে পারে জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়- কমার্শিয়াল ফ্লাইট না থাকায়
বিশেষ বিমান পাঠানো কিংবা নৌ-পথই একমাত্র বিকল্প।
ওদিকে, ইয়েমেনে থাকা বাংলাদেশীরা দিনের পর দিন এক প্রকার অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্য সরবরাহ। মজুদ খাদ্যসামগ্রীও এখন শেষের পথে। অচিরেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন অসহায় বাংলাদেশীরা। এ অবস্থায় বাঁচার আকুতি জানিয়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তারা জানান, ইয়েমেনের সানা, এডেন, তাইজ, হুদাইফা, মোকলাসহ প্রায় সব এলাকাতেই চলছে সংঘর্ষ। গোলাগুলি আর মুহুর্মুহু বিমান হামলায় ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। সামরিক অস্ত্রাগারে হামলা হচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই অনেক দেশ ইয়েমেন থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশীরা সেই মৃত্যুকূপেই রয়ে গেছেন। এডেন শহরে অবস্থান করা বাংলাদেশীরা জানান, শহরের অধিকাংশ এলাকা হুতি বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় শহরটি ত্যাগ করে স্থানীয় লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। ওই এলাকায় বিদ্রোহীরা আক্রমণের আগেই সেখান থেকে ফিলিপাইন, ভারত, চীন, পাকিস্তান তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। এডেন শহরে আটকেপড়া অসহায় বাংলাদেশী ফজলুল হক জানান, প্রথমদিকে তারা বাংলাদেশী কোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বা বাংলাদেশের কোন কর্তৃপক্ষও যোগাযোগ করেনি। তিনি দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে বলেন, স্থানীয়রাসহ সবাই শহর ছেড়ে নিরাপদে চলে গেছে। তারা যে বাসায় অবস্থান করছেন ৪ বাংলাদেশীসহ ১১জন ছিলেন। যার মধ্যে বাড়ির মালিকও ছিলেন। কিন্তু এখন বাড়িটিতে শুধুমাত্র তারা ৪ বাংলাদেশীই আছেন। অন্যরা সবাই নিরাপদে চলে গেছেন। যুদ্ধের পর থেকে তারা বাড়ির বাইরে যেতে পারেননি। বর্তমান পুরো এলাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ধ্বংসস্তূপ। এক শহর থেকে অন্য শহর বা শহরের অভ্যন্তরেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াতের কোন যানবাহন নেই। খাদ্য সরবরাহও সম্পূর্ণ বন্ধ। যে সামান্য কিছু খাদ্যসামগ্রী মজুদ ছিল তাও শেষের পথে। আজকালই এখান থেকে বের হতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। তিনি আরও বলেন, এখানে আটকেপড়া বাংলাদেশীরা যে যেভাবে পারছে যোগাযোগ করছেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তারা ফোন করে তাদের উদ্ধারের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। ফজলুল হক বলেন, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কুয়েতি দূতাবাসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। দূতাবাসের কনস্যুলার মাহবুবুল আলম তাদের জানিয়েছেন তিনিসহ দূতাবাসের আরও দুই কর্মকর্তা আজই সেখানে পৌঁছাবেন। মাহবুবুল তাদের জানিয়েছেন প্রথমে তারা কুয়েত থেকে বিমানে করে জেবুতি যাবেন। তারপর সেখান থেকে জাহাজে করে এডেন পৌঁছাবেন। সেখান থেকেই জাহাজ ভাড়া করে তাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করবেন বলেও ওই কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন। তবে ওই শহরে তাদের মতো আরও ক’জন বাংলাদেশী আছেন তা তারা বলতে পারেননি। সানায় আটকেপড়া বাংলাদেশী শিবলু বলেন, এখানকার পরিস্থিতি এত ভয়াবহ যে বর্ণনা করার মতো না। শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের ভাগ্যে কি আছে তা বলতে পারছেন না। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকছেন। এমন কি সারা রাত ঘুমাতেও পারছেন না। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় বাসবাস করা বাংলাদেশীরা এক জায়গায় চলে আসেন। কিন্তু ওই সময় যারা আসতে পারেননি তারা নিজ এলাকায়ই আটকা পড়েছেন। তারা একসঙ্গে ২০-২১ জনের মতো অবস্থান করছেন বলেও জানান। তিনি আরও বলেন, তারা বাইরে বের হতে পারেন না। খাদ্য সরবরাহ না থাকায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সৌদি দূতাবাসসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। প্রায় ১১ বছর ধরে সানায় বসবাস করা অপর বাংলাদেশী জহিরুল ইসলাম গতকাল বিবিসিকে জানান, গত কয়েক দিন ধরে সেখানে মুহুর্মুহু বিমান হামলা হচ্ছে। কুয়েতের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন দূতাবাস থেকে ফোন করে কয়েকজনের খোঁজ নেয়া হয়েছে। তবে এতে মোটেই আশস্ত হতে পারছেন না সেখানকার বাংলাদেশীরা। দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে সহযোগিতা পেতে প্রতিদিন ভারতের দূতাবাসের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছে রয়েছেন কয়েক শ’ বাংলাদেশী। মি. ইসলাম বলেন সানাতে রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা শুকনা খাবার রাখছেন সঙ্গে। সব অফিস আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক বন্ধ আর তাই সব রকম আর্থিক আদান প্রদান বন্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া বিমান হামলা সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ফজরের আজান পর্যন্ত চলে। এক রকম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
ওদিকে, ইয়েমেনে থাকা বাংলাদেশীরা দিনের পর দিন এক প্রকার অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছেন। বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্য সরবরাহ। মজুদ খাদ্যসামগ্রীও এখন শেষের পথে। অচিরেই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন অসহায় বাংলাদেশীরা। এ অবস্থায় বাঁচার আকুতি জানিয়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তারা জানান, ইয়েমেনের সানা, এডেন, তাইজ, হুদাইফা, মোকলাসহ প্রায় সব এলাকাতেই চলছে সংঘর্ষ। গোলাগুলি আর মুহুর্মুহু বিমান হামলায় ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। সামরিক অস্ত্রাগারে হামলা হচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই অনেক দেশ ইয়েমেন থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশীরা সেই মৃত্যুকূপেই রয়ে গেছেন। এডেন শহরে অবস্থান করা বাংলাদেশীরা জানান, শহরের অধিকাংশ এলাকা হুতি বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় শহরটি ত্যাগ করে স্থানীয় লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। ওই এলাকায় বিদ্রোহীরা আক্রমণের আগেই সেখান থেকে ফিলিপাইন, ভারত, চীন, পাকিস্তান তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। এডেন শহরে আটকেপড়া অসহায় বাংলাদেশী ফজলুল হক জানান, প্রথমদিকে তারা বাংলাদেশী কোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বা বাংলাদেশের কোন কর্তৃপক্ষও যোগাযোগ করেনি। তিনি দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে বলেন, স্থানীয়রাসহ সবাই শহর ছেড়ে নিরাপদে চলে গেছে। তারা যে বাসায় অবস্থান করছেন ৪ বাংলাদেশীসহ ১১জন ছিলেন। যার মধ্যে বাড়ির মালিকও ছিলেন। কিন্তু এখন বাড়িটিতে শুধুমাত্র তারা ৪ বাংলাদেশীই আছেন। অন্যরা সবাই নিরাপদে চলে গেছেন। যুদ্ধের পর থেকে তারা বাড়ির বাইরে যেতে পারেননি। বর্তমান পুরো এলাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ধ্বংসস্তূপ। এক শহর থেকে অন্য শহর বা শহরের অভ্যন্তরেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াতের কোন যানবাহন নেই। খাদ্য সরবরাহও সম্পূর্ণ বন্ধ। যে সামান্য কিছু খাদ্যসামগ্রী মজুদ ছিল তাও শেষের পথে। আজকালই এখান থেকে বের হতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। তিনি আরও বলেন, এখানে আটকেপড়া বাংলাদেশীরা যে যেভাবে পারছে যোগাযোগ করছেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তারা ফোন করে তাদের উদ্ধারের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। ফজলুল হক বলেন, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কুয়েতি দূতাবাসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। দূতাবাসের কনস্যুলার মাহবুবুল আলম তাদের জানিয়েছেন তিনিসহ দূতাবাসের আরও দুই কর্মকর্তা আজই সেখানে পৌঁছাবেন। মাহবুবুল তাদের জানিয়েছেন প্রথমে তারা কুয়েত থেকে বিমানে করে জেবুতি যাবেন। তারপর সেখান থেকে জাহাজে করে এডেন পৌঁছাবেন। সেখান থেকেই জাহাজ ভাড়া করে তাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করবেন বলেও ওই কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন। তবে ওই শহরে তাদের মতো আরও ক’জন বাংলাদেশী আছেন তা তারা বলতে পারেননি। সানায় আটকেপড়া বাংলাদেশী শিবলু বলেন, এখানকার পরিস্থিতি এত ভয়াবহ যে বর্ণনা করার মতো না। শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের ভাগ্যে কি আছে তা বলতে পারছেন না। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকছেন। এমন কি সারা রাত ঘুমাতেও পারছেন না। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় বাসবাস করা বাংলাদেশীরা এক জায়গায় চলে আসেন। কিন্তু ওই সময় যারা আসতে পারেননি তারা নিজ এলাকায়ই আটকা পড়েছেন। তারা একসঙ্গে ২০-২১ জনের মতো অবস্থান করছেন বলেও জানান। তিনি আরও বলেন, তারা বাইরে বের হতে পারেন না। খাদ্য সরবরাহ না থাকায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সৌদি দূতাবাসসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। প্রায় ১১ বছর ধরে সানায় বসবাস করা অপর বাংলাদেশী জহিরুল ইসলাম গতকাল বিবিসিকে জানান, গত কয়েক দিন ধরে সেখানে মুহুর্মুহু বিমান হামলা হচ্ছে। কুয়েতের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন দূতাবাস থেকে ফোন করে কয়েকজনের খোঁজ নেয়া হয়েছে। তবে এতে মোটেই আশস্ত হতে পারছেন না সেখানকার বাংলাদেশীরা। দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে সহযোগিতা পেতে প্রতিদিন ভারতের দূতাবাসের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছে রয়েছেন কয়েক শ’ বাংলাদেশী। মি. ইসলাম বলেন সানাতে রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা শুকনা খাবার রাখছেন সঙ্গে। সব অফিস আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক বন্ধ আর তাই সব রকম আর্থিক আদান প্রদান বন্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া বিমান হামলা সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ফজরের আজান পর্যন্ত চলে। এক রকম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
No comments