তিতাসের বুক ভারী ৫ শ’ ঘেরে by জাবেদ রহিম বিজন
শান্ত
নদীর বুকে যেন সবুজের পাটি। দীর্ঘ পথে ঘেরের সমারোহ। যা স্থানীয় ভাবে
‘খেও’ নামে পরিচিত। তিতাস নদীর বুক ভারী করে রেখেছে এমন প্রায় ৫শ’ মাছের
ঘের বা খেও। দেখতে নয়নাভিরাম হলেও এই ঘের বা খেও অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলেছে
তিতাসকে। ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। মাছের অবাধ বিচরণে বড় বাধা এই ঘের।
মাছের বংশ বিনাশও হচ্ছে ঘেরের সবুজ ছায়াতলে। ব্যাহত হচ্ছে নৌ চলাচল। নবীনগর
এলাকায় তিতাস নদী ছাড়াও পাগলিনী নদী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পূর্বাংশে
তিতাস নদীতে আছে এমন আরও অসংখ্য ঘের। সরজমিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট
থেকে নবীনগর পর্যন্ত তিতাস নদীর দীর্ঘ প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথের দু’-ধারে এই
ঘেরের অবস্থান চোখে পড়ে। মধ্যাংশের সামান্য ফাঁক গলিয়ে চলে লঞ্চসহ
অন্যান্য নৌযান। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, নদীটির এই অংশেই
তারা প্রায় ৪শ’ ঘেরের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এসব ঘের মালিকদের
নাম-ঠিকানাও সংগ্রহ করেছেন তারা। জানা গেছে-জলাশয় নীতিমালা অনুসারে নদী
সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে সবার। মাছও অবাধ বিচরণ
করবে এখানে। কিন্তু এর কোনটাই হচ্ছে না। নদীবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে
প্রভাবশালী লোকজন এই ঘের বানিয়ে নদীর মাছের নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাছ লুটে
নিচ্ছেন। দেশী প্রজাতির মাছের বংশ শেষ করছেন। সচেতন মানুষ ও মৎস্য অফিসের
কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুসারে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই খেওয়ের মাধ্যমে
নদীর ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। কিন্তু অবৈধ ঘেরে তারা ভাল লাভবান হচ্ছেন।
লাখ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করছেন। চাউর আছে স্থানীয় থানা পুলিশ ও প্রশাসন
ঘেরের সজীব-সুস্বাদু মাছে তুষ্ট হয়ে এ নিয়ে আর ভাবেন না। নবীনগরের একজন
পরিবেশ সচেতন মানুষ শামসুল হক বলেন- মূল তিতাস নদী অনেক দূর পর্যন্ত ভরাট
হয়ে গেছে। কোন কোন জায়গায় দু’টি লঞ্চ একসঙ্গে পারাপার হতে পারে না। তার মতে
গত ৫০ বছরে তিতাস নদীর যে এই অবস্থা হলো, নদী জীর্ণশীর্ন হলো এর পেছনে
অনেক কারণ আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে কারণ তা হচ্ছে মাছের এই অবৈধ ঘের। ঘের
করার জন্য নদীর পানিতে প্রচুর পরিমাণ গাছের ডালপালা ফেলা হয়। আর উপরে থাকে
কচুরিপানা-কলমিলতা ইত্যাদি। এর নিচেই মাছের আশ্রয়স্থল। এখান থেকে বিশেষ
জালে সব ধরনের দেশী মাছ নিঃশেষ করা হয়। ওদিকে ঘের ভাঙার পর গাছপালাগুলো
নদীর তলদেশে পড়ে থাকে। তাছাড়া বছরের ২/৩ মাস ছাড়া সারা বছরই এই ঘের থাকে।
এতে নদীর পানির সঙ্গে প্রবহমান বালি এসব গাছের ডালপালায় আটকে নিচে স্তূপ
হয়। এভাবে পলি ভরাট হয়ে নদী সঙ্কুচিত হচ্ছে। ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী।
যেখানে এখন চাষাবাদ হচ্ছে ইরি ফসল। স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে
রফাদফায় এই জমিও ভোগদখল করছে প্রভাবশালীরা। অবৈধ ঘের মালিকদের একজন
বিল্লাল মিয়া জানান, নদীর বুকে কমপক্ষে ১৫০ শতাংশ জায়গা নিয়ে একেকটি ঘের
হয়। একটি ঘের করতে খরচ পড়ে আড়াই তিন লাখ টাকা। এসব ঘের প্রায় সারা বছরই
থাকে নদীর বুকে। ঘের থেকে শৈল, গজার, পাবদা, পুটা, চিংড়িসহ নানাজাতের দেশী
মাছ আহরণ করেন তারা। বলেন এসব করতে প্রশাসনের কোন অনুমতি লাগে না। আগে
নবীনগরে গিয়ে স্যারদের মাছ দিয়ে আসতাম। বিল্লাল মিয়া ঘেরে লাভ হন না বলে
দাবি করেন। তবে ওয়াকিবহাল একজন জানিয়েছেন এসব ঘের থেকে প্রতিদিন মণের মণ
মাছ আহরণ হয়। ৩ লাখ টাকা খরচ করে ঘের দিয়ে লাভ হয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন- এসব ঘেরকে আমরা বলি মিনি
অভয়াশ্রম। এখানে মা মাছ ডিম পাড়তে পারে নির্বিঘ্নে। ছোট মাছ আশ্রয় পায়। এটা
ঠিক আছে। কিন্তু ঘেরের নিচে আশ্রয় নেয়া সবমাছই ধরে ফেলে ঘের মালিকরা। এতে
দেশী প্রজাতির নানারকম মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তিনি আরও বলেন, ২০
একরের ঊর্ধ্বে জলাশয় দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এখানে আমাদের কোন
কর্তৃত্ব নেই। এসব জলাশয় সবার জন্য উন্মুক্ত। এসব ঘের উচ্ছেদে তিতাস নদীর
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও নবীনগর অংশে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার প্রশাসনের সহায়তা
নিয়ে তারা অভিযান চালিয়েছেন বলে জানান। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে
৫টি। নবীনগর উপজেলা মৎস্য অফিস এ পর্যন্ত প্রায় ৪শ’ ঘেরের অস্তিত্ব পেয়েছে
তিতাস নদীর ওই অংশে। সেগুলো উচ্ছেদের চিন্তা-ভাবনা করছে তারা। এই তালিকা
অনুসারে অবৈধ ঘের মালিকদের কয়েকজন হচ্ছেন- ভৈরবনগরের হাজী সিরাজুল ইসলাম,
ধন মিয়া, মনিপুরের ওয়াহেদ মিয়া, আক্তার মিয়া, উরখুলিয়ার আবদুল খালেক,
ওয়াহেদ মিয়া, নারুইয়ের সুধীর চন্দ্রদাশ, শিবনগরের হরিধন চন্দ্র বর্মণ,
নাটঘরের ঝাড়ু সর্দার, মোহল্লার মো. ফুলন মিয়া, সোনাপাড়ার পরেশ চন্দ্র
দাশ, চান্দেরচরের বিল্লাল মিয়া, ধোপাকান্দার কানু মিয়া, হুরন আলী, মেরাতলীর
সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার, মো. আবুল কাশেম, গোসাইপুরের আলীম, আশিক
মিয়া, চর গোসাইপুরের বিল্লাল মিয়া, কৃষ্ণনগরের আলাল উদ্দিন ও তাজুল ইসলাম
মেম্বার। নবীনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোবারক হোসেন বলেন, অবৈধ ঘেরের
মালিকের নামসহ একটি তালিকা আমরা করেছি। তিতাস ছাড়াও পাগলিনী নদীতে আরও
কিছু ঘের রয়েছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে অভিযান চালানো হবে। উপজেলা উন্নয়ন
সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বিভাগের পক্ষে
একা এই অভিযান চালানো সম্ভব নয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত
উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ঘের উচ্ছেদে আমরা ৪টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা
করেছি। এসব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে প্রতিবার খরচ হয়েছে ৬/৭ হাজার টাকা।
এ টাকা সংস্থানেরও একটি ব্যাপার আছে। তিনি জানান, বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় ৮ মাসই এই ঘের থাকে নদীতে। নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু শাহেদ চৌধুরী বলেন- নদীর কি ক্ষতি হচ্ছে না হচ্ছে- সেটা আমার জানার বিষয় নয়। এগুলো অবৈধ এটাই বড় বিষয়। অবৈধ যেহেতু এর বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। এসব ঘের মুক্ত মৎস্য প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে বলে জানান ইউএনও।
এ টাকা সংস্থানেরও একটি ব্যাপার আছে। তিনি জানান, বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় ৮ মাসই এই ঘের থাকে নদীতে। নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু শাহেদ চৌধুরী বলেন- নদীর কি ক্ষতি হচ্ছে না হচ্ছে- সেটা আমার জানার বিষয় নয়। এগুলো অবৈধ এটাই বড় বিষয়। অবৈধ যেহেতু এর বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। এসব ঘের মুক্ত মৎস্য প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে বলে জানান ইউএনও।
No comments