আমাদের দেশ কি শান্তির জনপদ হবে by রুহুল খান
নটিংহাম শহরের একটি পার্ক |
নটিংহামের এক মহাসড়ক |
আমার
জীবনের তিনটি বছর কাটিয়েছি ইউরোপে। সময়টা ছিল ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল
পর্যন্ত। সে সময়টা ইউরোপ ছিল এক শান্তির জনপদ। শান্তির সে সময়টা যে
কীভাবে চলে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি । সুখের দিনগুলো মনে হয়, একটু
তাড়াতাড়িই চলে যায়। মনে পড়ছে খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। তখন আমি নটিংহাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রবিনহুডের শহর নটিংহাম থেকে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম
মহাবিজ্ঞানী নিউটনের শহর লিংকনশায়ারে। নিউটন জন্মেছিলেন ২৫ ডিসেম্বর ১৬৪২
সালে ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের ওলসথোর্প গ্রামে। যদিও তিনি ঘুমিয়ে আছেন
লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে৷ তিনি বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে জাগ্রত এক
মহাবিজ্ঞানী হিসেবে। নটিংহাম থেকে বাসে করে যাচ্ছিলাম লিংকনশায়ার। সড়কপথে
নটিংহাম থেকে লিংকনশায়ারের দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। সামারের দিনগুলোতে
ইংল্যান্ড দেখতে অসম্ভব সুন্দর৷ চারিদিকে সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে সবুজ
পাতা, হালকা বাতাস। সত্যিই ইংল্যান্ডের সামার এক অসাধারণ। বাস ছুটে চলেছে
নিউটনের শহরে। রাস্তার দুধারে সবুজ ভুট্টাখেত, পাশেই ছোট নদী, মানুষজন তেমন
দেখা যায় না। হাঁসগুলো আপন মনে ভেসে চলেছে ছোট নদীতে। পাখিগুলো উড়ছে
আকাশে। তখন মন চাইত, এই পৃথিবীর কোলাহল ছেড়ে যদি ছোট এই জীবনটা কাটিয়ে
দিতে পারতাম ইংল্যান্ডের কোনো একটি গ্রামে, হোক সেটা বিংহাম বা ফ্লিন্টহাম।
পথিমধ্যে বাস থামল গ্রামের ছোট একটা স্টেশনে। সেখান থেকে উঠলেন একজন
বয়স্ক লোক, আনুমানিক ৭০ থেকে ৭৫ বছর হবে। হাতে একটা বড় ব্যাগ। চালক বাস
ছাড়লেন। বয়স্ক লোকটা আমার পাশের ফাঁকা আসনে বসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেলেন। দেখলাম, একদিকে পড়ে আছে তাঁর ব্যাগ আর
অন্য দিকে অসহায়ভাবে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন তিনি । কিছুই বুঝতে পারছিলাম
না। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন না। চালক বাস থামিয়ে দিলেন। মনে মনে
ভাবলাম, এটা হতে পারে না। এটা তো আমাদের আদর্শ না। আমি এক মুহূর্ত
চিন্তাভাবনা না করে বুড়ো মানুষটাকে কোলে তুলে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর
ইউ অলরাইট?’ বুড়ো মানুষটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ,
তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘আই অ্যাম ওকে।’ দেখলাম, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত
ঝরছে বুড়ো লোকটার আর কাঁপছে শরীরটা, তেমন কথা বলতে পারছিলেন না। আমি
খেয়াল করলাম, পুরো বাসের সব যাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাবটা এমন যে,
আমি বিরাট একটা অন্যায় করে ফেলেছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে এল
প্যারামেডিকের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। নামলেন দুজন লোক। ধরাধরি করে বুড়ো
লোকটাকে টেনে ওঠালেন অ্যাম্বুলেন্সে। আমি তাকিয়ে ছিলাম অসহায় বুড়ো
মানুষটার দিকে। তার দুই চোখ বন্ধ। বুঝতে পারছিলাম না, লোকটা বেঁচে আছেন,
নাকি মারা গেছেন। এদিকে আমার ভয় লাগছে, আমি না আবার আসামি হয়ে যাই! আমিতো
ইংল্যান্ডের নিয়মকানুন তেমন জানি না। যা করেছি, তা আমার বিবেকের তাড়নায়
করেছি। আমি যে দেশের মানুষ, সে দেশের মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে যায় কোনো
কিছু চিন্তা না করেই। অনেক সময় নিজের বিপদের কথা জেনেও অন্যের সাহায্যে
এগিয়ে যায়। এমন সময় দেখলাম, রক্তাক্ত বয়স্ক লোকটি হাত দিয়ে আমাকে
ডাকছেন, আমি অবাক হলাম, খুশিও হলাম যে মানুষটা বেঁচে আছে। সবাই আমার দিকে
তাকিয়ে আছেন। আমি এগিয়ে গেলাম, লোকটা আমাকে বিড়বিড় করে বললেন, ‘তোমার
দেশ কোথায়?’ আমি জানালাম বাংলাদেশ। তিনি আমাকে বললেন, ‘যে দেশের মানুষ
অন্যের বিপদে এগিয়ে যায়, সে দেশটা নিশ্চয় এক শান্তির জনপদ, যদিও সেই
দেশটা দেখার সৌভাগ্য হলো না এই জীবনে।’ আমি বিশ্বাস করি, অবশ্যই বাংলাদেশ
এক শান্তির জনপদ, অশান্তির কালো মেঘ বাংলাদেশের আকাশে বেশি দিন থাকতে পারবে
না ।
(রুহুল খান, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ভ্যানকুভার, কানাডা)
(রুহুল খান, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ভ্যানকুভার, কানাডা)
No comments