ইংরেজিতে নিমন্ত্রণপত্র: হৃদয়ে উপনিবেশ by মামুনুর রশীদ
বিয়ের
নিমন্ত্রণপত্র প্রবলভাবে ইংরেজিতে লেখা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি যতগুলো
নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছি, তার অধিকাংশই ইংরেজিতে লেখা। কিন্তু বিয়ের
অনুষ্ঠানে একজনও বিদেশি অতিথিকে দেখিনি। সেই ষাটের দশকের কথা মনে পড়ে
যায়, যখন বিয়ের কার্ডগুলো খুব দ্রুত বাংলায় লেখা শুরু হয়ে গেল। কিছু
জমিদার, আমলা ছাড়া সব বিয়ের কার্ডই বাংলায়। একটা সময় পরাধীন শাসনেও
দোকানের সাইনবোর্ড সব ইংরেজি থেকে বাংলায় হয়ে গেল। এমনকি কিছু
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামও বাংলায় (মনে পড়ে বিটপীর কথা)—এসবই তখনকার
জাতীয়তাবাদী চেতনার ফসল। ১৯৫২ সাল থেকে যে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা শুরু
হয়েছিল, তা এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের
জন্ম দেয়। তারপর সর্বস্তরে বাংলার একটা আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হলো। এমনকি
নবজাতকের নামও বাংলায় হতে শুরু করল। শুধু সর্বোচ্চ আদালতে ইংরেজি রয়ে
গেল। অফিস-আদালতের নথিপত্রও বাংলায়। এতে একধরনের উচ্চ আমলাদের বেশ
অসুবিধাই হলো। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
সেনাশাসনের কালে আমলাতন্ত্র বেশি শক্তিশালী থাকাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক
যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োজন আছে, কিন্তু তাও একসময় সম্প্রসারিত
হতে হতে তাদের প্রয়োজনে ইংরেজি হতে থাকে। আশির দশকের শুরু থেকে বিয়ের
নিমন্ত্রণপত্র, প্রতিষ্ঠানের নামকরণে ইংরেজির প্রভাব প্রবল আকার ধারণ করে।
এই সময় ইংরেজি স্কুলের জয়যাত্রা শুরু হয়, যা আগে থেকেই ছোট আকারে শুরু
হয়েছিল। ইংরেজি স্কুলে পড়াটা যেন এক শ্রেণি উত্তরণের সিঁড়ি। শুধু তা-ই
নয়, বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রাথমিক ধাপ। আমলা, রাজনীতিবিদ, সেনা অফিসাররা এ
সময় ছেলেমেয়েদের দেশের স্কুল ছেড়ে বিদেশে স্কুলে পড়াতে শুরু করেন।
বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয় ভারতে, যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে।
দার্জিলিং, কালিম্পং থেকে শিলিগুড়িতেও নতুন স্কুল তৈরি হয় বাংলাদেশের
ছাত্রদের জন্য। যেহেতু নীতিনির্ধারকদের সন্তানেরা বিদেশে পড়ছে, তাই দেশের
শিক্ষাকার্যক্রমে এক চরম অবহেলা দেখা দেয়। সেই অবহেলার একটা বড় ফল
শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা মূলত মধ্যবিত্ত,
নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি অবহেলা। এখন অনেক কিছু আমদানির মধ্যে বিদেশ
থেকে ইংরেজি স্কুল, কলেজ আমদানি করারও একটা হিড়িক দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ লগ্নি
হচ্ছে এই বাণিজ্যে। শিক্ষা এখন একটা বড় বাণিজ্য হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের কোনো গ্রামের একটি কলেজে গিয়েছিলাম। কোনো একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা আমাকে একটি কার্ড দিল। রঙিন কারুকাজ করা ছাত্রসংগঠনের মনোগ্রামসংবলিত। ছেলেটি বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। অনেকক্ষণ কার্ডটা হাতে নিয়ে আমি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কত টাকা খরচ হয়েছে কার্ডটি বানাতে। আর কার্ডটি তার সামাজিক মর্যাদায় কী-ই বা অবদান রাখবে? বারবার প্রশ্ন জাগছিল, ওই বয়সে একটা কার্ড করার মনোবৃত্তিই বা কেন হলো? তারপর কার্ডের ছড়াছড়ি দেখেছি। পৃথিবীর অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের কি কার্ড ছিল? কার্ড বানানোর প্রয়োজন কি ছিল? সেই যুবকটি ওই বয়সেই নিজেকে প্রতিষ্ঠান ভাবতে শুরু করেছে। আর সে প্রতিষ্ঠান কোনো মহৎ কাজে নিয়োজিত নয়। মানুষ যখন তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখনই তার মধ্যে একটা উৎকেন্দ্রিকতা জন্ম নেয়। যে উৎকেন্দ্রিকতা তাকে স্বপ্ন দেখায় উচ্চবিত্ত হওয়ার জন্য, অর্থ উপার্জনের সহজ পথ আবিষ্কারের। পুঁজিবাদ বা বর্তমান বাজার অর্থনীতি এভাবেই মানুষের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে। হয়তো একদা কোনো এক গ্রামে নিজস্ব সংস্কৃতির বন্ধনের মধ্য থেকে কেউ একজন ভালোই ছিলেন। এলেন জেলা শহরে, তারপর রাজধানী ঢাকায়। সেখান থেকে লন্ডন, নিউইয়র্ক বা সিডনিতে। অর্থের উপার্জনটা হয়তো হলো কিন্তু চিরজীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল স্বদেশ থেকে। এই বিচ্ছিন্নতা নতুন নয়। পঞ্চাশের দশকের আমলা, অধ্যাপক যাঁরা ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও অনেকে স্বদেশে থাকেননি। একটা দ্বিতীয় আবাস স্থির করেছেন পশ্চিমের দেশে। আজকে তো প্রায় আমলা, বিজ্ঞজন, অধ্যাপক এবং তাঁদের সন্তানসন্ততিরা ওখানেই বসবাস করছেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরিবারের জন্য মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, নিউইয়র্ক, লন্ডন, টরন্টোতে দ্বিতীয় নিবাস হয়ে গেছে। যে মুনাফাটুকু এখান থেকে অর্জিত হবে, তার সিংহভাগই চলে যাবে বিদেশে। জাতীয় পুঁজিতে সে আর অংশ নিচ্ছে না। দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্মের কালে স্বদেশ বা সংস্কৃতিচিন্তায় এ দেশটা থাকবে না। প্রথম প্রজন্ম হয়তো মাতৃভাষায় কথা বলবে, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে এসবের কোনো বালাই থাকবে না। থাকবে তাদের শুধু হাহাকার আর সন্তান হারানোর বেদনা। আমি অনেক অভিবাসী পরিবার দেখেছি, যেখানে সংস্কৃতির সংকট প্রবলভাবে ঘনীভূত হয়েছে। সংসারে শান্তি নেই, পারিবারিক বন্ধন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তবু মানুষ বিদেশগামী, এ যে পুঁজিবাদের ফাঁদ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ আর পয়লা বৈশাখ দুটোই হয় আমাদের দেশে। থার্টি ফার্স্ট মানেই উচ্ছৃঙ্খলতা, উৎকট আয়োজন, যার জন্য পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখ, গান, মেলা, খাওয়াদাওয়ার এক স্নিগ্ধ আয়োজন। এ দুইয়ের তফাত খুবই স্পষ্ট। আবেগে, আয়তনে এবং অংশগ্রহণে পয়লা বৈশাখ বিশাল। অন্যদিকে থার্টি ফার্স্ট ছোট হলেও তা উচ্চবিত্ত আকাঙ্ক্ষীদের। তাই তার আওয়াজটাও অনেক বড়। ইংরেজিতে নিমন্ত্রণপত্র করা তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। বৈদেশিক বাণিজ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। চীনারা তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরে দ্বীপের মতো নিজেদের আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করে চলেছে শত শত বছর ধরে। চীনা নববর্ষ বা ইরানে নওরোজ পালন রীতিমতো একটা মহোৎসবের রূপ লাভ করে। একই সঙ্গে তারা ওই দেশগুলোর মূলধারাকেও প্রভাবিত করে। অভিবাসী বাঙালিরাও নববর্ষ উদ্যাপন করে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়। সেখানে মূল ভূমিকা প্রথম অভিবাসী প্রজন্মের, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কী হবে তা অনিশ্চিত। কারণ, সংস্কৃতির মূল শক্তিটা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। আমাদের সাহিত্য যে কত সমৃদ্ধ, একজন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল যে পশ্চিমা লেখকদের সমমানের, তা তাঁদের জানতে দেওয়া হয়নি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো মহাকবি যে বাংলা সাহিত্যে আছে, তাও তাঁরা জানে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ জ্ঞান-গরিমা কী উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছিল, তাও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে? এ শুধু অভিবাসীদের বিষয় নয়, স্বদেশেরও। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইংরেজি স্কুলগুলোতে একটা রচনা বা ‘এসে’র মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলা স্কুলগুলোতেও তার প্রকাশভঙ্গি দুর্বল। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মধ্যে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রবল প্রভাব রয়েছে, তার প্রমাণ গণজাগরণ মঞ্চ। লক্ষ করা গেছে প্রভাব শুধু নয়, উন্মাদনাও আছে। সংস্কৃতি মানুষকে যে শক্তি দেয়, তা আমরা টের পেয়েছি পাকিস্তানের ২৪ বছরে। আদিবাসীÿ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো তাদের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু সংস্কৃতির প্রেরণায়। ইংরেজ কোনো সংস্কৃতিমান জাতি নয়। তার রক্তে রয়েছে সুদীর্ঘ দিনের পরের সম্পদ লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষা, যা আমরা এখন সাকিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় দেখতে পাই। শেক্সপিয়ার বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। শেক্সপিয়ারের নাটকেই সেসব ইংরেজ দুর্ধর্ষ চরিত্রগুলো পাই। অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে তিনি উদ্ধত ইংরেজ জাতির কলঙ্কময় অধ্যায় তুলে ধরেছেন। তাই তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের মানুষদের কাছেও বিশ্বকবি। আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিই এত সমৃদ্ধ যে ধার করার, পরের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন, তাই তো বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগের জন্য হাইকোর্টের রুল প্রয়োজন হয়। আমরা ভাষার জন্য লড়াই করে সন্তানের বিয়ের কার্ডখানা কেন ইংরেজিতে করব? বাংলায় কি নিমন্ত্রণের ভাষার অভাব আছে? কী মনোরম, কী বিনয়, কী স্নিগ্ধ শব্দ আছে বাংলায়। চীন, ইরান, জাপানি নিমন্ত্রণের ভাষা আছে ভিন্ন ভিন্ন। আমাদেরও আছে।
আমরা কেন নিজেদের দৈন্যকে এভাবে প্রকাশ করব?
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের কোনো গ্রামের একটি কলেজে গিয়েছিলাম। কোনো একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা আমাকে একটি কার্ড দিল। রঙিন কারুকাজ করা ছাত্রসংগঠনের মনোগ্রামসংবলিত। ছেলেটি বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। অনেকক্ষণ কার্ডটা হাতে নিয়ে আমি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কত টাকা খরচ হয়েছে কার্ডটি বানাতে। আর কার্ডটি তার সামাজিক মর্যাদায় কী-ই বা অবদান রাখবে? বারবার প্রশ্ন জাগছিল, ওই বয়সে একটা কার্ড করার মনোবৃত্তিই বা কেন হলো? তারপর কার্ডের ছড়াছড়ি দেখেছি। পৃথিবীর অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের কি কার্ড ছিল? কার্ড বানানোর প্রয়োজন কি ছিল? সেই যুবকটি ওই বয়সেই নিজেকে প্রতিষ্ঠান ভাবতে শুরু করেছে। আর সে প্রতিষ্ঠান কোনো মহৎ কাজে নিয়োজিত নয়। মানুষ যখন তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখনই তার মধ্যে একটা উৎকেন্দ্রিকতা জন্ম নেয়। যে উৎকেন্দ্রিকতা তাকে স্বপ্ন দেখায় উচ্চবিত্ত হওয়ার জন্য, অর্থ উপার্জনের সহজ পথ আবিষ্কারের। পুঁজিবাদ বা বর্তমান বাজার অর্থনীতি এভাবেই মানুষের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে। হয়তো একদা কোনো এক গ্রামে নিজস্ব সংস্কৃতির বন্ধনের মধ্য থেকে কেউ একজন ভালোই ছিলেন। এলেন জেলা শহরে, তারপর রাজধানী ঢাকায়। সেখান থেকে লন্ডন, নিউইয়র্ক বা সিডনিতে। অর্থের উপার্জনটা হয়তো হলো কিন্তু চিরজীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল স্বদেশ থেকে। এই বিচ্ছিন্নতা নতুন নয়। পঞ্চাশের দশকের আমলা, অধ্যাপক যাঁরা ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও অনেকে স্বদেশে থাকেননি। একটা দ্বিতীয় আবাস স্থির করেছেন পশ্চিমের দেশে। আজকে তো প্রায় আমলা, বিজ্ঞজন, অধ্যাপক এবং তাঁদের সন্তানসন্ততিরা ওখানেই বসবাস করছেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরিবারের জন্য মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, নিউইয়র্ক, লন্ডন, টরন্টোতে দ্বিতীয় নিবাস হয়ে গেছে। যে মুনাফাটুকু এখান থেকে অর্জিত হবে, তার সিংহভাগই চলে যাবে বিদেশে। জাতীয় পুঁজিতে সে আর অংশ নিচ্ছে না। দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্মের কালে স্বদেশ বা সংস্কৃতিচিন্তায় এ দেশটা থাকবে না। প্রথম প্রজন্ম হয়তো মাতৃভাষায় কথা বলবে, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে এসবের কোনো বালাই থাকবে না। থাকবে তাদের শুধু হাহাকার আর সন্তান হারানোর বেদনা। আমি অনেক অভিবাসী পরিবার দেখেছি, যেখানে সংস্কৃতির সংকট প্রবলভাবে ঘনীভূত হয়েছে। সংসারে শান্তি নেই, পারিবারিক বন্ধন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তবু মানুষ বিদেশগামী, এ যে পুঁজিবাদের ফাঁদ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ আর পয়লা বৈশাখ দুটোই হয় আমাদের দেশে। থার্টি ফার্স্ট মানেই উচ্ছৃঙ্খলতা, উৎকট আয়োজন, যার জন্য পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখ, গান, মেলা, খাওয়াদাওয়ার এক স্নিগ্ধ আয়োজন। এ দুইয়ের তফাত খুবই স্পষ্ট। আবেগে, আয়তনে এবং অংশগ্রহণে পয়লা বৈশাখ বিশাল। অন্যদিকে থার্টি ফার্স্ট ছোট হলেও তা উচ্চবিত্ত আকাঙ্ক্ষীদের। তাই তার আওয়াজটাও অনেক বড়। ইংরেজিতে নিমন্ত্রণপত্র করা তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। বৈদেশিক বাণিজ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। চীনারা তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরে দ্বীপের মতো নিজেদের আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করে চলেছে শত শত বছর ধরে। চীনা নববর্ষ বা ইরানে নওরোজ পালন রীতিমতো একটা মহোৎসবের রূপ লাভ করে। একই সঙ্গে তারা ওই দেশগুলোর মূলধারাকেও প্রভাবিত করে। অভিবাসী বাঙালিরাও নববর্ষ উদ্যাপন করে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়। সেখানে মূল ভূমিকা প্রথম অভিবাসী প্রজন্মের, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কী হবে তা অনিশ্চিত। কারণ, সংস্কৃতির মূল শক্তিটা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। আমাদের সাহিত্য যে কত সমৃদ্ধ, একজন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল যে পশ্চিমা লেখকদের সমমানের, তা তাঁদের জানতে দেওয়া হয়নি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো মহাকবি যে বাংলা সাহিত্যে আছে, তাও তাঁরা জানে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ জ্ঞান-গরিমা কী উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছিল, তাও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে? এ শুধু অভিবাসীদের বিষয় নয়, স্বদেশেরও। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইংরেজি স্কুলগুলোতে একটা রচনা বা ‘এসে’র মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলা স্কুলগুলোতেও তার প্রকাশভঙ্গি দুর্বল। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মধ্যে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রবল প্রভাব রয়েছে, তার প্রমাণ গণজাগরণ মঞ্চ। লক্ষ করা গেছে প্রভাব শুধু নয়, উন্মাদনাও আছে। সংস্কৃতি মানুষকে যে শক্তি দেয়, তা আমরা টের পেয়েছি পাকিস্তানের ২৪ বছরে। আদিবাসীÿ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো তাদের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু সংস্কৃতির প্রেরণায়। ইংরেজ কোনো সংস্কৃতিমান জাতি নয়। তার রক্তে রয়েছে সুদীর্ঘ দিনের পরের সম্পদ লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষা, যা আমরা এখন সাকিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় দেখতে পাই। শেক্সপিয়ার বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। শেক্সপিয়ারের নাটকেই সেসব ইংরেজ দুর্ধর্ষ চরিত্রগুলো পাই। অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে তিনি উদ্ধত ইংরেজ জাতির কলঙ্কময় অধ্যায় তুলে ধরেছেন। তাই তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের মানুষদের কাছেও বিশ্বকবি। আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিই এত সমৃদ্ধ যে ধার করার, পরের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন, তাই তো বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগের জন্য হাইকোর্টের রুল প্রয়োজন হয়। আমরা ভাষার জন্য লড়াই করে সন্তানের বিয়ের কার্ডখানা কেন ইংরেজিতে করব? বাংলায় কি নিমন্ত্রণের ভাষার অভাব আছে? কী মনোরম, কী বিনয়, কী স্নিগ্ধ শব্দ আছে বাংলায়। চীন, ইরান, জাপানি নিমন্ত্রণের ভাষা আছে ভিন্ন ভিন্ন। আমাদেরও আছে।
আমরা কেন নিজেদের দৈন্যকে এভাবে প্রকাশ করব?
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments