আলোকিত প্রজন্মের হাত ধরে
প্রায়
পাঁচ কোটি স্কুলশিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সর্বত্র। হরতাল-অবরোধের
কারণে তাদের বড় অংশ বছরের প্রথম মাসটিতে ভালোভাবে ক্লাস করতে পারেনি। আমরা
ধরে নিতে চাই, এ সমস্যা সাময়িক। অচিরেই শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে
উঠবে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 'প্রায় পাঁচ কোটি'_ এ সংখ্যাটিতেই যে
আলোর বিচ্ছুরণ। এক সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুয়ার কেবল মধ্যবিত্ত ও
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। নিম্নবিত্তদের এ চৌকাঠ
পার হতে হলে বিশেষভাবে প্রমাণ দিতে হতো মেধার। কিন্তু এখন অভিজাত ও ধনবান
পরিবার থেকে পর্ণকুটির_ সব পরিবারের ছেলে ও মেয়েদের জন্য শিক্ষার দুয়ার
অবারিত। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে বাধা তো নেই-ই, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের দিক
থেকে বাড়ানো আছে সহযোগিতার হাত। একবার ভাবুন তো_ এ প্রজন্ম আগামী ১০ বছরের
মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা বা এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে আমাদের সমাজের
চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে? এক সময়ে কোনো এলাকায় মাধ্যমিকের গণ্ডি কেউ পার হলে
দশ গাঁয়ের লোক তাকে দেখতে আসত। এখন যুগ সত্যিই পাল্টে গেছে, অন্তত শিক্ষার
ক্ষেত্রে নিশ্চিত করেই সেটা বলতে পারি। চলতি বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ
নিচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ ছাত্র-ছাত্রী। জেন্ডার ভারসাম্য রয়েছে পুরোপুরি। একটু
পেছনে ফেরা যাক_ ২৫ বছর আগে ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী ছিল ৪ লাখ ৩৬
হাজারের মতো, যাদের তিন ভাগের এক ভাগ ছিল ছাত্রী। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার
ক্ষমতায় আসার সময় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় প্রায় আট লাখ ছাত্রছাত্রী এবং এই
দুই দশকেরও কম সময়ে আমাদের দেশ এ ক্ষেত্রে অর্জন করে জেন্ডার ভারসাম্য। গত
বছর অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল প্রায় ২১ লাখ শিক্ষার্থী
এবং তাদের মধ্যেও ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত সমান রাখায় সমস্যা হয়নি। এই যে
শিক্ষিত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের হাতেই কিন্তু ক্রমে অর্পিত হবে আমাদের
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভার। তারা ছড়িয়ে পড়বে সমাজের নানা প্রান্তে।
অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে এ শিক্ষিত প্রজন্ম। অর্থনীতিবিদরা
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের
সংখ্যাধিক্য অংশ যদি কর্মক্ষম বয়সীদের মধ্য থেকে আসে তাহলে পরিবারে যেমন
সচ্ছলতা বাড়ে, তেমনি দেশ এগিয়ে যেতে পারে দ্রুত। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ
নারী-পুরুষ এখন এ দলে পড়ছে। আমাদের জন্য সৌভাগ্য যে, রাষ্ট্রের
কর্ণধারদের ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং শিক্ষার প্রতি সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের
প্রবল আগ্রহের কারণে নতুন প্রজন্মের প্রায় শতভাগ স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখছে।
রাষ্ট্র যদি তাদের জন্য বিনিয়োগ আরও বাড়ায় তাহলে তারা শিখবে আরও ভালো করে,
যা কাজে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি চাই সমাজেরও বিনিয়োগ।
বিশেষ করে সচ্ছল জনগোষ্ঠী যদি সহায়তার উদার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে
জ্ঞানরাজ্যের বিপুল জিজ্ঞাসার চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন করা
অনেকটাই সহজ হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মান বাড়ানোর যে
প্রবল তাগিদ এখন সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে, এভাবেই হতে পারে তার সমাধান।
পাশাপাশি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আরও একটি বিষয়ে মনোযোগী হওয়া চাই। এই যে
আলোকিত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের মেধা ও প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশের জন্য চাই
উপযুক্ত আয়োজন। এতে ব্যর্থতা ঘটলে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত প্রজন্ম কিন্তু
নিমজ্জিত হবে হতাশার অতল গহ্বরে, যা আমাদের সার্বিক অগ্রগতির পথেও গড়ে
তুলবে বাধার প্রাচীর। এমন পরিণতি নিশ্চয়ই আমরা চাইব না।
No comments