সু চি প্রেসিডেন্ট হবেন, না স্পিকার? by সোহরাব হাসান

অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনে পিষ্ট মিয়ানমারের গণতন্ত্রের যে জানালাটি খোলা হয়েছে, তাকে কোনোভাবেই সুপ্রশস্ত বলা যাবে না। ২০০৮ সালে সামরিক শাসকেরা এমনভাবে সংবিধান রচনা করেছেন যে ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি সামরিক বাহিনীর হাতেই রয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের পর গণভোটে এই সংবিধান অনুমোদিত বলে অনেক বিশ্লেষক একে ঠাট্টা করে ‘নার্গিস সংবিধান’ নামেও অভিহিত করেন। তবে গণতন্ত্রের নেত্রী বলে পরিচিত ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সংবিধানের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিলের জন্য দেশব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে মিয়ানমারের রাজনীতি তপ্ত হয়ে উঠেছে, তবে সেটি বাংলাদেশের মতো জ্বালাও-পোড়াওয়ে রূপ নেবে না বলে জানালেন সেখানকার বিশ্লেষেকরা। নির্বাচন নিয়ে আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার কারণ সংবিধানের কতিপয় অগণতান্ত্রিক ধারা। ৪৪০ সদস্যের পার্লামেন্টে এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত; আবার সংবিধানে বলা হয়েছে যে এতে পরিবর্তন আনতে হলে তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। সে ক্ষেত্রে অসামরিক সব সদস্যকে এককাট্টা হতে হবে; যা সম্ভব নয়। পার্লামেন্টের অর্ধেকেরও বেশি সদস্য সাবেক ও বর্তমান সামরিক কর্মকর্তা। সংবিধানের ৫৯(এফ) ধারাবলে অং সান সু চির প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রহিত করে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের নাগরিকদের যদি কেউ কোনো বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করেন এবং তাঁর সন্তানেরা অন্য দেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সংবিধানের ৪৩৬ অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্টের যেকোনো আইনে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। আবার প্রেসিডেন্টকে সেনাপ্রধানের সম্মতি নিয়ে কাজ করতে হয়। ২০০৮ সালের এই অগণতান্ত্রিক সংবিধানের ভিত্তিতে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন এনএলডি বর্জন করলেও ২০১২ সালে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে তারা জয়ী হয়। অং সান এখন পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেত্রী।
উল্লেখ করা দরকার যে সু চিসহ এনএলডির নেতারা পার্লামেন্টের যে ৪৩টি আসন পেয়েছেন, তা সরকারি দল তাঁদের জন্য ছেড়ে দেয়নি। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, কেউ সরকারের মন্ত্রী হলে তিনি আর পার্লামেন্ট সদস্য থাকতে পারেন না; মন্ত্রীকে বিবেচনা করা হয় নির্বাহী বিভাগের লোক হিসেবে। পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি নিজেই নিজের জবাবদিহি আদায় করতে পারেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীরাও কংগ্রেস বা সিনেটের সদস্য থাকতে পারেন না। মিয়ানমারের সরকারকাঠামোর বিন্যাসও অভিনব। প্রেসিডেন্টের পর আছেন দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ৩৬ সদস্যের মন্ত্রিসভার ৩০ জন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত; আর ছয়জন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রত্যেকে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম তদারক করে থাকেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। প্রশ্ন উঠেছে, আগামী নির্বাচনে অং সান সু চি ও তাঁর দল এনএলডির ভূমিকা কী হবে? দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ চায় সু চি প্রেসিডেন্ট হোন। কিন্তু সংবিধান সংশোধন না করলে সেটি সম্ভব নয়। পার্লামেন্টের বর্তমান স্পিকার সুইয়ে মান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ নেই। সে জন্য পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা যখন ইয়াঙ্গুনে, তখন রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছিল। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে একপশলা বিতর্কও হয়ে যায়। সরকারি দলের এক নেতা বলেছিলেন, অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিন্তা বাদ দিয়েছেন এবং তাঁর স্থলে পার্লামেন্টে স্পিকারের পদ গ্রহণ করার জন্য মনস্থির করেছেন। কিন্তু এনএলডির মুখপাত্র উতু মতুন এর সত্যতা অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়া না–নেওয়ার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিইনি, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন-পরবর্তী অং সান সু চির ভূমিকা নিয়ে এখনো কথা বলার সময় আসেনি। বছরের মাঝামাঝি সময়ে জানা যাবে, এনএলডি পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে কি না।
২০১২ সালে পার্লামেন্টে যোগদানের পর থেকেই এনএলডি সংবিধানের ৫৯(এফ) ও ৪৩৬ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা ৫০ লাখ লোকের সই-সংবলিত আবেদনপত্র জমা দিয়েছে স্পিকারের কাছে। কয়েকটি প্রাদেশিক পার্টি এনএলডির এই প্রস্তাব সমর্থন করেছে। তবে এনএলডি খুব আশাবাদী নয় যে বর্তমান পার্লামেন্টে এই আইন বাতিল করা হবে। তাদের মতে, বর্তমান শাসক দল ফেডারেল শাসনপদ্ধতির কথা বললেও কেন্দ্রীয়ভাবেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। মিয়ানমারের স্থপতি ও সু চির বাবা অং সান মিয়ানমারকে একটি প্রকৃত ফেডারেল শাসনব্যবস্থার দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বর্মি। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আশা প্রকাশ করেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং এ নির্বাচনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল অব্যাহত প্রচেষ্টার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে। গত চার বছরে সরকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করবে বলে তিনি দাবি করেন। এর পরপরই সংবাদ সম্মেলনে অং সান সু চি বলেছেন, জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্টে সরকার ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করলেও সরকার সফল হয়েছে, এ রকম নজির পাওয়া কঠিন। এমনকি ২০১৪ সালে আসিয়ানের চেয়ারম্যান হিসেবে মিয়ানমার জনগণের উন্নয়নের কাজ কিছু করতে পারেনি। তিনি বলেন, পার্লামেন্টে এনএলডি সংখ্যালঘু দল হলেও তাদের অনেক প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ খুব কমই সাফল্য দেখাতে পেরেছে। এর জবাবে প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র উ ই হান্ট বলেছেন, ‘নাগরিকেরা জানেন তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার কী? তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারের বিরোধিতাকারী দলগুলোকে রাজপথ থেকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা যে অনেক কিছু অর্জন করেছি, তা নিশ্চয়ই অং সান সু চি স্বীকার করবেন।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এলেও ‘চার বছর ধরে মিয়ানমার সরকার যুদ্ধরত বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপকে বশে আনতে পারেনি। একই রাজ্যে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ থাকায় কোনো একটার সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা হলে অন্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক বার্টিল লিনটনার বলেছেন, নৃতাত্ত্বিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না আসতে পারাকেই আমি সরকারের বড় ধরনের ব্যর্থতা বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে। সম্প্রতি চীনা কোম্পানি পরিচালিত একটি খনির জমি নিয়ে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকেরা প্রতিবাদ করলে পুলিশ গুলি করে এবং একজন নারী মারা যান। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে সরকারের সমালোচনা করে সু চি বলেন, একজন মানুষের জীবনের দাম আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। সাংবাদিক-বিশ্লেষক সিট অং মিল্ট লিখেছেন, আগামী ১২ মাসে আমরা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। প্রশ্ন হলো, আমরা সেটি উত্তরণ ঘটাব কীভাবে। ২০১৫ সালের নির্বাচন কেবল মিয়ানমারের জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ সব বাহিনী-কূটনীতিকেরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছেন।
মিয়ানমারের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি সাপ্তাহিক মিয়ানমার টাইমস-এর সম্পাদক সাংবাদিক থমাস কিনকে যখন মিয়ানমারের রাজনৈতিক হালচাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ অস্থিরতা আছে। তাঁর মতে, মিয়ানমারে এখন তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্র প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন, স্পিকার সুইয়ে মান ও এনএলডি নেত্রী অং সান সু চি। আগামী নির্বাচনের পর মিয়ানমারের রাজনৈতিক স্থিতি আসবে কি না, তা নির্ভর করছে এই তিন ক্ষমতাকেন্দ্রের ভারসাম্য রক্ষার ওপর। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। আবার পার্লামেন্টও উপেক্ষণীয় নয়। মিয়ানমারের কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান স্পিকার ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হতে পারেন। আর অং সান সু চির রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন। তাঁকে বাদ দিয়েও মিয়ানমারের রাজনৈতিক স্থিতি আনার কথা ভাবা যায় না। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। সে ক্ষেত্রে সু চিকে হয়তো সান্ত্বনা হিসেবে স্পিকার পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সবকিছু ঠিক হবে আগামী নির্বাচনে কোন দল কত আসন পায়, তার ওপর। এনএলডি যদি ১৯৯০ সালের মতো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা রহিত করা কঠিন হবে। সেনাসদস্যদের অনেকে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন। তবে সবকিছুর জন্য আমাদের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা, মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা ১৯৯০ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না।
ইয়াঙ্গুন থেকে ফিরে>> সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.