সন্ত্রাস বন্ধ হলেই কেবল সংলাপ সম্ভব by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

সংসদের বাইরে থাকা বিরোধীদলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও মাঝে মধ্যে হরতালের মধ্যেই খবর দেখছি যে, সংঘাতময় রাজনীতি থেকে পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে আকুল আবেদন করেছে বস্ত্র ও পোশাকশিল্প খাতের তিনটি প্রধান সংগঠনসহ এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৩টি সংগঠন (সমকাল, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫)। আমার মনে আছে, সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, তাদের হিসাবে চলমান অবরোধে ও হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্যের দৈনিক গড় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ২৯৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তারও আগে টানা অবরোধের গোড়ার দিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই কাছাকাছি অঙ্কের হিসাব দিয়ে নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরত রাখতে আইনগত ব্যবস্থার দাবি তুলেছিল। বস্তুত হরতাল-অবরোধে এ ধরনের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য তো বটেই, খেটে খাওয়া মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এগুলো আরও বড় আঘাত হয়ে আসে। অনেকের সারাজীবনের সম্বল ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ কেউ আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে কেবল গুরুতর আঘাতকারী নয়; সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিনষ্টকারী এসব 'কর্মসূচি' কি আসলেই 'রাজনৈতিক'?
মনে রাখতে হবে, রাজনীতি ও সন্ত্রাস কখনও এক হতে পারে না। এখন দেশজুড়ে যে অবরোধ চলছে, তা রাজনীতির পথ ধরে আমাদের সামনে এলেও কার্যত সন্ত্রাসের রূপ গ্রহণ করেছে। যেভাবে গাড়িতে, যাত্রীর গায়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে, তা নাশকতা ছাড়া আর কী। এ ক্ষেত্রে এগুলো রাজনীতির নয়, আইন-শৃঙ্খলার বিষয়। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কখনও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমাধান হয় না। সন্ত্রাস দমন করতে হয় আইন-শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেই।
স্বীকার করতে হবে যে, অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি আহ্বান, রাস্তায় নেতাকর্মীদের পিকেটিং বাংলাদেশে নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে থেকে এটা দাবি আদায়ের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আমি বেদনার সঙ্গে দেখছি, গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যেন বদলে গেছে। আগে রাজনীতি করা হতো মানুষের দাবিকে সামনে রেখে। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য তখনও ছিল; কিন্তু সেটা থাকত পেছনে। অন্তত প্রকাশ্যে মানুষের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের কথাই বলা হতো। কিন্তু এখন যেসব ইস্যুতে অবরোধ-হরতাল চলছে, সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো দাবি-দাওয়া নেই। নগ্নভাবেই বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় যেতে চান।
আরও একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। আগে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার ক্ষেত্রে উপরের সারির নেতৃত্ব সামনে থাকতেন। বক্তব্য দিতেন, নির্দেশ দিতেন, কর্মসূচির ব্যাখ্যা করতেন। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকত, ভরসা থাকত। আশা করত, তারা হঠকারিতামূলক কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। কিন্তু এখন দেখছি বিরোধী দলের উপরের সারির নেতারা নন, মধ্যসারির বা অনেক ক্ষেত্রে স্টাফরা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। আর রাজপথে বা মহাসড়কে অবরোধ বা হরতালের সময় মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বদলে ক্যাডার বা সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, যারা 'কর্মসূচি' বাস্তবায়ন করতে নামে, তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তও নন, নিছক ভাড়াটে সন্ত্রাসী।
এই রাজনীতির নামে সন্ত্রাসের আমদানি, সেটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। নিছক একটি নির্বাচন হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্ন এখানে যুক্ত নেই। এখন যেমন বিরোধী দল বলছে, নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হতে হবে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে তো সরকারের পক্ষেই নির্বাচন নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন কিন্তু বিরোধী দল সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হতে হবে। আবার তারও আগে ওয়ান-ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে সরকার যখন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিল, তখন বিরোধী দল সংসদই বর্জন করেছিল। কেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন হয়েছিল? কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস দানা বেঁধেছিল। সেই অবিশ্বাসের মূল হচ্ছে অগণতান্ত্রিক সরকার। বাংলাদেশ দুই দফা সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেছে। আর সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কারা এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল? স্বাধীনতারবিরোধী শক্তি। সামরিক শাসনে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী। এই শক্তিই গণতান্ত্রিক রাজনীতি চায় না। তারা রাজনীতিতে হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস আমদানি করতে চায়। অগণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তিশালী করতে চায়। তারা চায় না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হোক। সে কারণেই সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে উদ্যোগী হয়েছে, তখন থেকেই তারা সর্বশক্তি দিয়ে সন্ত্রাসবাদে নেমেছিল। ফলে আজকে রাজনীতির নামে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কেবল নির্বাচন, ক্ষমতায় যাওয়া না-যাওয়ার সম্পর্ক নেই; এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটিও গভীরভাবে জড়িত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারত না। তাদের ছেড়ে নির্বাচনে যেতে চায়নি বলেই কি অন্যান্য শরিক দল নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিল?
আমি মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করতে হবে। কারণ এখনও যুদ্ধাপরাধীদের দোসর ও সমর্থকরা এই আশায় সন্ত্রাস চালিয়ে থাকে যে, বর্তমান সরকার না থাকলে যুদ্ধাপরাধের বিচারও থমকে যাবে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী তিন দশকে সেটাই হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও কোনো নজির না থাকলেও এ দেশে যুদ্ধাপরাধীরা প্রতাপের সঙ্গে রাজনীতি করে গেছে। আমি বিশ্বাস করি, যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি সম্পন্ন হয়, দেশমাতৃকার বিরোধী শক্তি যদি যথাযথ শাস্তি পায়, তাহলে সন্ত্রাসবাদের বিস্তৃতি ও ঘনত্ব কমে আসবে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদেরও শাস্তি হতে হবে। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার হলে অগণতান্ত্রিক শক্তি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীরা নিশ্চয়ই হতোদ্যম হয়ে পড়বে। রাজনীতির ভাষা ও মূল্যবোধ এখন যে নির্বাসনে গেছে, তারও কারণ কিন্তু সন্ত্রাসবাদের প্রতি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর অতি নির্ভরতা। রাজনীতিতে রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে তা পরিচালিত ও চর্চিত হতে হবে রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমেই। সন্ত্রাসীদের যেহেতু সন্ত্রাসী, রাজনীতিক নয়; তারা রাজনীতির ভাষা জানে না। জনসাধারণের জীবন ও সম্পদের মূল্য দিতে চায় না।
স্বীকার করি, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য, ঐকমত্যের জন্য আলাপ-আলোচনা, সংলাপ জরুরি। কিন্তু সেই সংলাপ কাদের সঙ্গে? সন্ত্রাসীর সঙ্গে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সংলাপ হতে পারে না। রাজনৈতিক সংলাপের আগে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। সেই পরিবেশ সৃষ্টির বিকল্পও নেই। কেবল রাজনীতির প্রয়োজনে নয়, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হবে অর্থনীতি ও উন্নয়নের প্রয়োজনে। সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। বিগত দিনগুলোতে টানা অবরোধে ইতিমধ্যে অর্থনীতি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
এবারের অবরোধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থনীতি ক্রমাগত চাঙ্গা হচ্ছিল। সামাজিক সূচকে ঈর্ষণীয় উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু এখন সব থমকে গেছে। রফতানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক কার্যাদেশ বাতিল হচ্ছে। এসব অর্ডার আবার ফিরে পাওয়া যাবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। এবারের ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অর্থনীতির সময় লাগবে।
রফতানিমুখী শিল্পের বাইরে গ্রামীণ অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিপণ্য ও উপকরণ চলাচল করতে পারছে না। কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো সবই অর্থনীতির মূল ভিত্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মূল ভিত যদি এভাবে নড়ে যায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতি ধাক্কায় পড়বে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে, দারিদ্র্য বিমোচনে।
তাই এখন জরুরি হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে যে অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল, সেটা আবার নিশ্চিত করা। সন্ত্রাসবাদ কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষতি করছে না, সামাজিকভাবেও দুর্যোগের ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে রাখতে হবে। ফলে নাগরিকদেরও এখন কর্তব্য হচ্ছে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। দ্বিধা না করে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। অনেকের কাছ থেকে সংলাপের আহ্বান জানানো হচ্ছে, দেখছি। কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধ না করে আলাপ-আলোচনা কীভাবে সম্ভব?
অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.