ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের আলামত by জাহিদ হাসান
বন্দুকের
নলই ক্ষমতার উৎস-উনবিংশ শতাব্দির জাতীয়তাবাদী নেতা চীনের মাও সেতুং এর এই
বিপ্লবী উক্তি বা স্লোগান মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাছে
পরাজিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিরোধী জনমত বা মানুষের মত প্রকাশের
স্বাধীনতাকে গায়ের তথা বন্দুকের গুলির জোরে স্তব্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে রেখে
স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার মানসিকতা থেকেই এই তথাকথিত
বিপ্লবী উক্তি বা স্লোগানের জন্ম হয়েছিল। জনগণই সকল ক্ষমতার একমাত্র উৎস’
বিংশ শতাব্দির গণতান্ত্রিক বিশ্বের এই সার্বজনীন বিশ্বাস বা স্লোগানই এখন
দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দেশে জনমানুষের
সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। এই বিশ্বাস ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার
জন্যই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জনমানুষের জনযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছরে শাসক শ্রেণীর ধারাবাহিক শাসনের মাধ্যমে
বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত
ও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যৌক্তিক প্রত্যাশা পূরনের পরিবর্তে তা
এখন বর্তমান শাসকদের কবলে পড়ে আবারও বিরোধী জনমত বা মানুষের মত প্রকাশের
স্বাধীনতাকে গায়ের তথা বন্দুকের গুলির জোরে স্তব্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে রেখে
স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার মানসিকতা বা ইচ্ছায় উনবিংশ
শতাব্দির সেই মাও সেতুং এর উক্তি বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস বা ক্ষমতা ধরে
রাখার একমাত্র শক্তি বলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা করার ভয়ানক
প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের
দায়িত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে থাকলেও সশস্ত্রবাহিনীর
সর্বাধিনায়ক হলেন পদাধিকার বলে বা সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল
হামিদ। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই
সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে গার্ড অব অনার বা সালাম
গ্রহণ, কুচকাওয়াচ পরিদর্শন, প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা সমাপনি অনুষ্ঠানে সনদ
প্রদানসহ সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় সকল অনুষ্ঠানেই বেশ আগ্রহ ও প্রফুল্ল চিত্তে
অংশগ্রহণ করছে।
সশস্ত্রবাহিনীর তিন শাখা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তির অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠন যেমন বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার, কোস্টগার্ডসহ আরও অন্যান্য বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতিনিয়তই তিনি নিয়মিতভাবে যোগদান করছেন। পেশাগতভাবে রাষ্ট্রের এসব অরাজনৈতিক ও শৃংখলিত বাহিনীর ঐসব অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক ও প্রাসঙ্গিক ভাষণ বা বক্তৃতা দেয়ার সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থানগত দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তথাকথিত জঙ্গিবাদের হুমকির কথা তুলে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে তার স্বভাবসূলভ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্বিধায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।
রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি বা বন্দুকধারীদের প্রতি শেখ হাসিনার এমন আগ্রহ, আকর্ষণ বা মনোযোগ ১৯৯৬ -২০০১ বা ২০০৯ - ২০১৩ সময়ে তার শাসনামলে এত প্রকটভাবে দেখা যায়নি। বরং ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত সশস্ত্রবাহিনীকে ইংগিত করে শেখ হাসিনা প্রায়ই বলতেন কোন উর্দী পড়া অসাংবিধানিক শক্তি যাতে আর কখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তথা তার ভাষায় গণতন্ত্রের ধারাকে ব্যহত করতে না পারে সেজন্য তার সরকার সংবিধানে বিশেষ বিধান সংযোজনসহ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং করেছেও। এমনকি জেনারেল মইনের ১/১১ এর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরেও তত্ত্বাবধায়কের নামে সেনাসমর্থিত সেই সরকারের দীর্ঘ ২ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সামরিক ডিক্টেটরদেরকেই পরোক্ষভাবে তিনি দায়ী করেছেন। কিন্তু বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানদের শক্তিকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন করতে সক্ষম হওয়ায় এবং পরবর্তিতে সরকার গঠন করার পর থেকেই শেখ হাসিনার বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রতি এত গুরুত্ব ও আগ্রহ বেড়ে গেছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট ও প্রতিহত করার হুমকির বিপরীতে শেখ হাসিনা ৫ই জানুয়ারী সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার শক্তি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থেকেও ১০-১৫ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে সক্ষম হয়নি। তারপরেও রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার অর্থাৎ বন্দুকধারী বিশাল শক্তির জোরে ৫ই জানুয়ারী একতরফা ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এক বছর হল ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন এবং ২০১৯ বা ২০২১ সাল পর্যন্ত পারবে বলে মনে করছেন।
এখানে উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দল ও জোটের নেতা নেত্রীরা বিভিন্ন সূচকে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা ( সাধারন জনগণের কাছে যা দৃশ্যমান নয় বা প্রাত্যহিক জনজীবনে যার কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব বা সুফল রয়েছে বলে মনে হয়না) এবং তার সরকারের আমলে বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে এত প্রচার ও প্রচারনা সত্তেও ২০১৩ সালে গাজীপুরসহ দেশের প্রধান ৫টা জেলা শহরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী জোট সমর্থিত প্রার্থীদের বিরোধী বিএনপি জোট সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। ঐ ফলাফল দেখে শেখ হাসিনা তখন প্রকাশ্যে উষ্মা, ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশ করে বিভিন্ন সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে বলেছিলেন তার সরকারের এত উন্নয়ন ও ভাল কাজগুলো জনগণ চোখে দেখেনি, বিরোধী দলের ‘অপপ্রচারে’ জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছে। আর ঠিক তখন থেকেই শেখ হাসিনার মাথায় একটা অগণতান্ত্রিক মনোভাব বা চিন্তা বাসা বেঁধেছে, যা হল ক্ষমতা ধরে রাখতে বা আবারও ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ক্ষমতায় বহাল থেকে তার দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
বিরোধী জোট সকল দলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হওয়ায় ৫ই জানুয়ারীর ঐ নির্বাচন বর্জন ও বয়কট করলেও পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলার উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এসব নির্বাচনেও সরকারী দলের সমর্থকদের তুলনায় তারা ভাল ফলাফল করে। ৫ই জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার অর্থাৎ বন্দুকধারী বিশাল শক্তি ব্যবহার করেও ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে ন্যূনতম প্রত্যাশিত সংখ্যক ভোটার উপস্থিত করতে না পারা এবং ঐ নির্বাচনের পর বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আওয়ামী জোট সরকার বিশেষ করে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার চিন্তা চেতনায় আরও যে একটা ভয়ানক, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী মনোভাব শক্তভাবে গেড়ে বসেছে তা হল ক্ষমতায় থাকতে বা ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে শুধু জনগণ বা জনগণের ম্যান্ডেটের উপর নির্ভরশীল থাকার প্রয়োজন নাই বা থাকলেই চলবে না।
উল্লেখ্য, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী জোটের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের মূখে শেখ হাসিনাসহ তার দলের শীর্ষ অনেক নেতাই বলেছিল সংবিধান রক্ষা তথা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ৫ই জানুয়ারী নির্বাচন করার পর পরই বিরোধী জোটের সাথে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ১১তম সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা হবে। কিন্তু এখন যদি ঐ কথা রাখতে বা কার্যকর করতে হয় তবে হয়ত সে নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকে তার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারবে না এবং আবারও নির্বাচনে গেলে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন না পেলে ক্ষমতায় আসা বা ফেরা যাবে না, যে ভয় শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন এবং ৫ই জানুয়ারী পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল থেকে পেয়েছিলেন, তাই তিনি আবারও জনগণের কাছে গিয়ে ম্যান্ডেট নেয়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেননা। যে কারণে এখন ৫ই জানুয়ারী পূর্ববর্তী অঙ্গিকার বা ওয়াদা অনুযায়ী বিরোধী জোটের জোরালো দাবি ও জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী কয়েকটা বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ সত্তেও সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আর একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যেতে তিনি মোটেও চাইছেন না বা সাহস পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সরকার ও আওয়ামী মহল থেকে এত জোরালো দাবি করা সত্ত্বেও (হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে তা সত্যও হতে পারে) নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের স্বার্থে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নামক কলঙ্কটা মুছে দিয়ে জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে বলে শেখ হাসিনার সরকার মোটেও আশাবাদী নয়। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা বা আসার জন্য জনমত বা জনগণের উপর সে কিছুতেই নির্ভরশীল হতে পারছে না বা চাচ্ছে না। তাই ২০১৯/২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হলে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তান বাহিনীর (ছাত্রলীগ/যুবলীগ/স্বেচ্ছাসেবক লীগ) উপর নির্ভরশীল হওয়া বা থাকাকেই শেখ হাসিনা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ এই বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তান বাহিনীর সহায়তাতেই সে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির কথিত নির্বাচন করে গায়ের জোরে সরকার গঠন করতে পেরেছে এবং নির্বাচন পরবর্তী বিগত এক বছর বিরোধী জোট বা দলের আন্দোলনকেও এই শক্তির দ্বারা দমন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে। যে কারণে জনগণ নয়, বন্দুকের গুলিই এখন শেখ হাসিনা সরকারের কাছে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রধান উৎস বা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
তাই এটা অতি স্বাভাবিক বা প্রচলিত নিয়ম যে, যাদের সহায়তা, সহযোগিতা অর্থাৎ যাদের শক্তির উপর নির্ভর করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি বা রক্ষা করা হয় বিনিময়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা বা তাদের উদ্দেশ্যের প্রতিও অনুগত হতে বা থাকতে হয় (দেয়া-নেয়ার স্বাভাবিক নিয়ম)। কিন্তু স্বার্থ রক্ষার এই স্বাভাবিক ও ভাগাভাগির প্রক্রিয়া যদি জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট বা রায় ছাড়া অবৈধভাবে বা জোর করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বা বন্দুকধারী শক্তির মধ্যে হয় তবে সেখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থ, অধিকার, জানমাল ও সম্পদের উপর মারাত্মক ক্ষতি ও ভয়ানক পরিণতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
শেখ হাসিনা তাই এখন ঘন ঘন সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও তাদেরকে আরো শক্তিশালী করা এবং তাদের জন্য হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন বা গ্রহণ করে নেয়ার বিনিময়ে ঘুষ/উৎকোচ অর্থাৎ তাদেরকে খুশি করা বা সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য ইতিমধ্যে রাশিয়া ও রুশপন্থি কয়েকটা পূর্ব ইউরোপীয় দেশ এবং চীন থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে। এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর আওয়ামী শাসক ও মহল থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটা নীতি বা মতামত জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের বন্ধু (?) বা স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী মিত্র প্রতিবেশী সুতরাং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কখনও যুদ্ধ হবে না। তাই বাংলাদেশের মতো সদ্য স্বাধীন ও গরিব দেশের জন্য একটা বিশাল সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা বা এর পেছনে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করার কোন প্রয়োজন নাই। শোনা যায় বা কথিত আছে, এ বিষয়টা নিয়ে টানাপড়েন বা মনকষাকষির কারণে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী না বানিয়ে তাকে সশস্ত্র বাহিনী থেকে পৃথক রাখার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রী বানিয়ে রাখা হয়েছিল। তাছাড়া, ঐ সময় এটাও পরিলক্ষিত হয়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করে স্বৈরাচারী কায়দায় দীর্ঘদিন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন ও চকচকে জমকালো উর্দি (পোশাক) দিয়ে সাজিয়ে বিশাল রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তখন এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আওয়ামী শাসক ও তাদের মদতদাতা কথিত বুদ্ধিজীবী মহল সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল, সীমিত ও নামকা ওয়াস্তে একটা বাহিনী হিসেবে রেখে দেয়ার পক্ষেই ছিল। এব্যাপারে তখন ভারত সরকারের পরামর্শ বা চাপ থাকার কথাও আলোচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীকে খুশি রাখতে, আশ্বস্ত করতে তথা তার প্রতি অনুগত রাখতে ইদানীং সশস্ত্র বাহিনীর সকল অনুষ্ঠানে বক্তব্য বা ভাষণ দেয়ার সময় ডাহা মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে যে জাতির পিতা (তার পিতা) বাংলাদেশে একটা শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্ন দেখেছিলেন বা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ও প্রধান শক্তিই ছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সংগতকারণে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তেমন কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না।
কিন্তু জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক আর লক্কর মার্কা মান্ধাতা আমলের কিছু অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করানো স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বন্ধু/মিত্র দেশ ভারতের কাছ থেকে কি কিছু অস্ত্রশস্ত্র (যুদ্ধ করার জন্য নয়, প্রশিক্ষণের জন্য) চাওয়া যেত না বা ভারতও কি তাদের তরফ থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ উপহার হিসেবেও দিতে পারতো না? অথচ ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রায় এক মাস যাবৎ তাদের শত শত ট্রাকভর্তি করে ভারতে নিয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সুবাদে তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৬৭ সালে ইসরাইল যুদ্ধে ব্যবহৃত ১৩টা পুরাতন ট্যাংক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উপহার দিয়েছিল। এছাড়া, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান মিত্র দেশ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে উপহার হিসেবে এক স্কোয়াড্রন মিগ-২১ জঙ্গি বিমান দিয়েছিল (যে বিমান দিয়ে ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শান্তিবাহিনী/বিদ্রোহীদের উপর বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল)।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করে তোলার কোন ইচ্ছা বা আন্তরিকতা আওয়ামী লীগের আগেও ছিল না, এখনও নাই। আসল বা অন্তর্নিহিত সত্য হলো বিগত ৫ই জানুয়ারি যে ধরনেরই হউক একটা নির্বাচন করতে পারা এবং নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকার জনগণ নয় বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানদেরকেই একমাত্র ভরসা ও শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছিল, তাই এখন তার রাষ্ট্রীয় কর্মকা- বা অধিকাংশ অনুষ্ঠানের মধ্যে সশস্ত্র/ বন্দুকধারী বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রাধান্যই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়াও শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জের হাজার হাজার তরুণ ও ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, বিরোধী দলের ওপর পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের সর্বাত্মক ব্যবহার এখন চলছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে সহসাই এমন (দলীয় আনুগত্য অনুযায়ী) আরো ৫০ হাজার নতুন পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ দেশকে মনে হয় পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষোলকলাই শেখ হাসিনার সরকার পূর্ণ করে ছাড়বে। তবে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে এসব রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানরা যখন মনে করবে বা বুঝতে শুরু করবে যে সরকার তাদের উপর নির্ভর করেই ক্ষমতায় আছে বা থাকতে চাচ্ছে তখন তারা একদিকে যেমন সরকারি নির্দেশ-আদেশের তোয়াক্কা না করে নিজেদের স্বার্থে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে যা ইচ্ছা তাই করতে উৎসাহিত হবে (যেমন পুলিশ ও র্যাবের বিভিন্ন সদস্য ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, গুম, খুন ও কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, দলীয় সশস্ত্র মাস্তানরা সারা দেশে বেপরোয়া সন্ত্রাস চালাচ্ছে) অপরদিকে তারা স্বভাবতই সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যেই এসব বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করছেন তার কাছে খোলাখুলি আলোচনার সময় ঐসব বাহিনীর সদস্যরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করতে ও পূরণ করার দাবি জানাতে শুরু করেছে।
সুতরাং তাদের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকতে হলে তাদেরকে অপরাধ থেকেও দায়মুক্তি দিতে হবে আবার তাদের দাবি-দাওয়া কিছু না কিছু বা সবটুকু কোন না কোন সময় মানতেই হবে। তা না হলেই বিপদ। এখানে উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ১৯৮১ সালের মার্চে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার কাছে ১১-দফা দাবিনামা পেশ করা হয়েছিল, কথিত আছে জেনারেল জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ওইসব দাবি-দাওয়া না মেনে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসার পর ওইদিন রাতেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে একই ধরনের খেলা শুরু করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের দেয়া লিস্ট অনুযায়ী সেনাবাহিনী থেকে কথিত বিএনপি-জামায়াতপন্থি বা সমর্থক প্রায় ৪৪ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরি থেকে সরিয়ে বর্তমান সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এখন আওয়ামী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী সৈনিকদের বহাল করা হয়েছে বলে শোনা যায়। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকেও এখন দলীয়করণ করা হচ্ছে। এছাড়া তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার ওয়াদা বা ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র সংগ্রহের ঘোষণাও দেয়া হচ্ছে। কেন বা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন বা তাদের জন্য অত্যাধুনিক (সাবমেরিনসহ) অস্ত্রশস্ত্র কেনা হচ্ছে? বাংলাদেশ কি ভারতের বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধ করবে বা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কি আদৌ কোনদিন বাংলাদেশের হবে? এমনকি রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর কারণে এত সমস্যা ভোগ করার পর বা সীমান্তে নাসাকা বাহিনী কর্তৃক বিজিবি সদস্যদের বিনা উস্কানি বা অজুহাতে হত্যা করার পরেও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার কোন সাহস কখনও দেখা যায়নি। তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে শক্তিশালী করার মুখরোচক ও আকর্ষণীয় বক্তব্য বা ঘোষণা উচ্চারণের উদ্দেশ্যটা তাহলে কি? বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার এই তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য অবশ্যই বুঝতে সক্ষম। এখানে উল্লেখ করা যায়, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের একটা প্রতিরক্ষা নীতি আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। প্রায় চতুর্দিকে ভারত কর্তৃক বেষ্টিত ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আয়তন, শক্তি বা ক্ষমতা কেমন হওয়া উচিত, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ( সমুদ্র সীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ) রক্ষায় ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমমানের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজন বা সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা বা উচিত হবে কিনা, নাকি বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গ্যারান্টি প্রদানের বিনিময়ে অন্য কোন পরাশক্তির সঙ্গে সামরিক চুক্তি (ইসরাইল ও তাইওয়ানের মতো) করা বা বাংলাদেশের নৌসীমানায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়া এসব কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা বা বিবেচনা না করেই উদ্দেশ্যহীন ও অপরিণামদর্শীতার মতো সশস্ত্র বাহিনীর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্য ওই একটাই- বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা ধরে রাখা। মাঝে মাঝে যুক্তি দেয়া হয় এসব অস্ত্র জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা যায়। অথচ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য কোথাও উন্নত জঙ্গি বিমান, বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বা সাব-মেরিনের কোন প্রয়োজন পড়ে না। কারণ যেসব দেশে বিদ্রোহী বা জঙ্গি শান্তি ভঙ্গ করছে তারা জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে ( আকাশে) সর্বাত্মক যুদ্ধ করে না।
স্থলভাগে হাল্কা ও মাঝাড়ি অস্ত্র নিয়ে জঙ্গি, উগ্র বা গেরিলা তৎপরতা চালায়, তাদের জন্য স্থলভাগে চলাচলকারী সামরিক সাঁজোয়া যান বা ট্যাঙ্কই যথেষ্ট। এসব খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে সশস্ত্র বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য অস্ত্র কেনা বেকার ও দরিদ্র জনসংখ্যায় জর্জরিত এই তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশটার জন্য আত্মহত্যার শামিল। যেখানে এখনও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মতো দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাতে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য জ্বালানী, বিদ্যুৎ ও সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন সেখানে ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রীয় বন্দুকধারী শক্তির জন্য অস্ত্র কেনা দেশ ও জনগণের সঙ্গে প্রচণ্ড বেইমানি ও অত্যাচারের শামিল।
বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের জন্য আরও ভয়ানক দুঃসংবাদ হলো শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে ছোট আয়তনের এই বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরও ক্যান্টনমেন্ট এবং সামরিক স্থাপনা ও বাসস্থান নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার একর জমি বা ভূখণ্ড বরাদ্দ দিয়েছে। এজন্য এখনই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ জনগণকে উচ্ছেদের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়ে গেছে, এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জনগণের বিরোধিতা ও সমালোচনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার নেশায় অন্ধ শেখ হাসিনার সরকার সাধারণ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীকে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সশস্ত্র বাহিনীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের পেশাগত দক্ষতা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, মর্যাদা ও গাম্ভীর্যতা বজায় রাখার জন্য তাদেরকে সারা পৃথিবীতেই সাধারণ জনগণের সহজ সংস্পর্শতা থেকে মুক্ত বা পৃথক রাখার জন্য তাদের বিভিন্ন স্থাপনা ও বাসস্থান গোপন জায়গায় অর্থাৎ জনসমক্ষের বাইরে রাখা বা তৈরি করা হয়। এজন্য দুর্গম পাহাড়-পর্বত জঙ্গল অর্থাৎ পার্বত্য এলাকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর সদস্যরা যাতে অনায়াসে সাধারণ জনগণের সংস্পর্শে এসে সাধারণ জনগণের মতো আয়াসী ও শৃঙ্খলাহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত, আকৃষ্ট বা আগ্রহী হয়ে না পড়ে সেজন্যই তাদের বসবাস ও স্থাপনার জন্য বিশ্বের সকল দেশে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এখন নতুন করে তাদেরকে ৫০ হাজার একর জায়গা দিতে হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বসবাস বা চাষাবাদের জায়গা থেকেই বের করে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আর পেশাগত বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা ধরে রাখার সুযোগ মনে হয় পরিকল্পিতভাবেই ধ্বংস করে দেয়ার ব্যবস্থা শেখ হাসিনা সরকার হাতে নিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকে তবে এজন্য অনেক সময় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানার আশেপাশের এলাকায় ও রাস্তাঘাটে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদুপরি সশস্ত্র বাহিনীর স্থাপনা ও বাসস্থান যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অথবা শহরের অভ্যন্তরে হয় তবে সেখানে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার ও চলাচলও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহাযানজটের ঢাকা শহরে এখন সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি’র স্থাপনাসমূহ সত্যিই বিষফোঁড়ার মতো হয়ে উঠেছে। তেজগাঁয়ে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি থাকায় এ্যালিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের নকশাও পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী যদি একটা বিশাল শক্তিতে পরিণত হয় তবে তারা যে শুধু ক্যান্টনমেন্টে বসে ও ঘুমিয়ে নীরবে দিনযাপন করবে এর কোন গ্যারান্টি নেই, তারা তখন নিজেদেরকেও রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করবে এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড তথা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপও করতে দ্বিধা বোধ করবে না। যেমন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৪৭ সালের পর থেকেই যা করে আসছে, সেখানে সব রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতায় যেতে হলে বা থাকতে হলে সেনাবাহিনীর পরামর্শ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আমলে নিতে হয়- যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি ও ক্ষতিকর। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনাও মনে হয় বাংলাদেশকেও পাকিস্তানের মতো মিলিটারি রাষ্ট্রে পরিণত করার ভয়ঙ্কর পথে অগ্রসর হচ্ছে। বিরোধী জনমত ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনগণ নয় বন্দুকের নলকেই এখন সে ক্ষমতা ধরে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশেও বন্দুকের নল যে কোন কোন সময় সাপের চেয়েও বিষাক্ত ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে এ অভিজ্ঞতার কথা কি শেখ হাসিনার জানা নেই?
সশস্ত্রবাহিনীর তিন শাখা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তির অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠন যেমন বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার, কোস্টগার্ডসহ আরও অন্যান্য বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতিনিয়তই তিনি নিয়মিতভাবে যোগদান করছেন। পেশাগতভাবে রাষ্ট্রের এসব অরাজনৈতিক ও শৃংখলিত বাহিনীর ঐসব অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক ও প্রাসঙ্গিক ভাষণ বা বক্তৃতা দেয়ার সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থানগত দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তথাকথিত জঙ্গিবাদের হুমকির কথা তুলে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে তার স্বভাবসূলভ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্বিধায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।
রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি বা বন্দুকধারীদের প্রতি শেখ হাসিনার এমন আগ্রহ, আকর্ষণ বা মনোযোগ ১৯৯৬ -২০০১ বা ২০০৯ - ২০১৩ সময়ে তার শাসনামলে এত প্রকটভাবে দেখা যায়নি। বরং ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত সশস্ত্রবাহিনীকে ইংগিত করে শেখ হাসিনা প্রায়ই বলতেন কোন উর্দী পড়া অসাংবিধানিক শক্তি যাতে আর কখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তথা তার ভাষায় গণতন্ত্রের ধারাকে ব্যহত করতে না পারে সেজন্য তার সরকার সংবিধানে বিশেষ বিধান সংযোজনসহ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং করেছেও। এমনকি জেনারেল মইনের ১/১১ এর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরেও তত্ত্বাবধায়কের নামে সেনাসমর্থিত সেই সরকারের দীর্ঘ ২ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সামরিক ডিক্টেটরদেরকেই পরোক্ষভাবে তিনি দায়ী করেছেন। কিন্তু বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানদের শক্তিকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন করতে সক্ষম হওয়ায় এবং পরবর্তিতে সরকার গঠন করার পর থেকেই শেখ হাসিনার বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রতি এত গুরুত্ব ও আগ্রহ বেড়ে গেছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট ও প্রতিহত করার হুমকির বিপরীতে শেখ হাসিনা ৫ই জানুয়ারী সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার শক্তি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থেকেও ১০-১৫ শতাংশ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে সক্ষম হয়নি। তারপরেও রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার অর্থাৎ বন্দুকধারী বিশাল শক্তির জোরে ৫ই জানুয়ারী একতরফা ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এক বছর হল ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন এবং ২০১৯ বা ২০২১ সাল পর্যন্ত পারবে বলে মনে করছেন।
এখানে উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দল ও জোটের নেতা নেত্রীরা বিভিন্ন সূচকে অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা ( সাধারন জনগণের কাছে যা দৃশ্যমান নয় বা প্রাত্যহিক জনজীবনে যার কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব বা সুফল রয়েছে বলে মনে হয়না) এবং তার সরকারের আমলে বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে এত প্রচার ও প্রচারনা সত্তেও ২০১৩ সালে গাজীপুরসহ দেশের প্রধান ৫টা জেলা শহরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী জোট সমর্থিত প্রার্থীদের বিরোধী বিএনপি জোট সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। ঐ ফলাফল দেখে শেখ হাসিনা তখন প্রকাশ্যে উষ্মা, ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশ করে বিভিন্ন সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে বলেছিলেন তার সরকারের এত উন্নয়ন ও ভাল কাজগুলো জনগণ চোখে দেখেনি, বিরোধী দলের ‘অপপ্রচারে’ জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছে। আর ঠিক তখন থেকেই শেখ হাসিনার মাথায় একটা অগণতান্ত্রিক মনোভাব বা চিন্তা বাসা বেঁধেছে, যা হল ক্ষমতা ধরে রাখতে বা আবারও ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ক্ষমতায় বহাল থেকে তার দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
বিরোধী জোট সকল দলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হওয়ায় ৫ই জানুয়ারীর ঐ নির্বাচন বর্জন ও বয়কট করলেও পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলার উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এসব নির্বাচনেও সরকারী দলের সমর্থকদের তুলনায় তারা ভাল ফলাফল করে। ৫ই জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার অর্থাৎ বন্দুকধারী বিশাল শক্তি ব্যবহার করেও ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে ন্যূনতম প্রত্যাশিত সংখ্যক ভোটার উপস্থিত করতে না পারা এবং ঐ নির্বাচনের পর বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আওয়ামী জোট সরকার বিশেষ করে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার চিন্তা চেতনায় আরও যে একটা ভয়ানক, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী মনোভাব শক্তভাবে গেড়ে বসেছে তা হল ক্ষমতায় থাকতে বা ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে শুধু জনগণ বা জনগণের ম্যান্ডেটের উপর নির্ভরশীল থাকার প্রয়োজন নাই বা থাকলেই চলবে না।
উল্লেখ্য, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী জোটের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের মূখে শেখ হাসিনাসহ তার দলের শীর্ষ অনেক নেতাই বলেছিল সংবিধান রক্ষা তথা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ৫ই জানুয়ারী নির্বাচন করার পর পরই বিরোধী জোটের সাথে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ১১তম সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা হবে। কিন্তু এখন যদি ঐ কথা রাখতে বা কার্যকর করতে হয় তবে হয়ত সে নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকে তার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারবে না এবং আবারও নির্বাচনে গেলে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন না পেলে ক্ষমতায় আসা বা ফেরা যাবে না, যে ভয় শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন এবং ৫ই জানুয়ারী পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল থেকে পেয়েছিলেন, তাই তিনি আবারও জনগণের কাছে গিয়ে ম্যান্ডেট নেয়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেননা। যে কারণে এখন ৫ই জানুয়ারী পূর্ববর্তী অঙ্গিকার বা ওয়াদা অনুযায়ী বিরোধী জোটের জোরালো দাবি ও জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী কয়েকটা বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ সত্তেও সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আর একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যেতে তিনি মোটেও চাইছেন না বা সাহস পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সরকার ও আওয়ামী মহল থেকে এত জোরালো দাবি করা সত্ত্বেও (হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে তা সত্যও হতে পারে) নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের স্বার্থে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নামক কলঙ্কটা মুছে দিয়ে জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে বলে শেখ হাসিনার সরকার মোটেও আশাবাদী নয়। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা বা আসার জন্য জনমত বা জনগণের উপর সে কিছুতেই নির্ভরশীল হতে পারছে না বা চাচ্ছে না। তাই ২০১৯/২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হলে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তান বাহিনীর (ছাত্রলীগ/যুবলীগ/স্বেচ্ছাসেবক লীগ) উপর নির্ভরশীল হওয়া বা থাকাকেই শেখ হাসিনা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ এই বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তান বাহিনীর সহায়তাতেই সে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির কথিত নির্বাচন করে গায়ের জোরে সরকার গঠন করতে পেরেছে এবং নির্বাচন পরবর্তী বিগত এক বছর বিরোধী জোট বা দলের আন্দোলনকেও এই শক্তির দ্বারা দমন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে। যে কারণে জনগণ নয়, বন্দুকের গুলিই এখন শেখ হাসিনা সরকারের কাছে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রধান উৎস বা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
তাই এটা অতি স্বাভাবিক বা প্রচলিত নিয়ম যে, যাদের সহায়তা, সহযোগিতা অর্থাৎ যাদের শক্তির উপর নির্ভর করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি বা রক্ষা করা হয় বিনিময়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা বা তাদের উদ্দেশ্যের প্রতিও অনুগত হতে বা থাকতে হয় (দেয়া-নেয়ার স্বাভাবিক নিয়ম)। কিন্তু স্বার্থ রক্ষার এই স্বাভাবিক ও ভাগাভাগির প্রক্রিয়া যদি জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট বা রায় ছাড়া অবৈধভাবে বা জোর করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বা বন্দুকধারী শক্তির মধ্যে হয় তবে সেখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থ, অধিকার, জানমাল ও সম্পদের উপর মারাত্মক ক্ষতি ও ভয়ানক পরিণতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
শেখ হাসিনা তাই এখন ঘন ঘন সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও তাদেরকে আরো শক্তিশালী করা এবং তাদের জন্য হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন বা গ্রহণ করে নেয়ার বিনিময়ে ঘুষ/উৎকোচ অর্থাৎ তাদেরকে খুশি করা বা সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য ইতিমধ্যে রাশিয়া ও রুশপন্থি কয়েকটা পূর্ব ইউরোপীয় দেশ এবং চীন থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে। এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর আওয়ামী শাসক ও মহল থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটা নীতি বা মতামত জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের বন্ধু (?) বা স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী মিত্র প্রতিবেশী সুতরাং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কখনও যুদ্ধ হবে না। তাই বাংলাদেশের মতো সদ্য স্বাধীন ও গরিব দেশের জন্য একটা বিশাল সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা বা এর পেছনে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করার কোন প্রয়োজন নাই। শোনা যায় বা কথিত আছে, এ বিষয়টা নিয়ে টানাপড়েন বা মনকষাকষির কারণে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী না বানিয়ে তাকে সশস্ত্র বাহিনী থেকে পৃথক রাখার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রী বানিয়ে রাখা হয়েছিল। তাছাড়া, ঐ সময় এটাও পরিলক্ষিত হয়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করে স্বৈরাচারী কায়দায় দীর্ঘদিন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন ও চকচকে জমকালো উর্দি (পোশাক) দিয়ে সাজিয়ে বিশাল রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তখন এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আওয়ামী শাসক ও তাদের মদতদাতা কথিত বুদ্ধিজীবী মহল সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল, সীমিত ও নামকা ওয়াস্তে একটা বাহিনী হিসেবে রেখে দেয়ার পক্ষেই ছিল। এব্যাপারে তখন ভারত সরকারের পরামর্শ বা চাপ থাকার কথাও আলোচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীকে খুশি রাখতে, আশ্বস্ত করতে তথা তার প্রতি অনুগত রাখতে ইদানীং সশস্ত্র বাহিনীর সকল অনুষ্ঠানে বক্তব্য বা ভাষণ দেয়ার সময় ডাহা মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে যে জাতির পিতা (তার পিতা) বাংলাদেশে একটা শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্ন দেখেছিলেন বা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ও প্রধান শক্তিই ছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সংগতকারণে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তেমন কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না।
কিন্তু জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক আর লক্কর মার্কা মান্ধাতা আমলের কিছু অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করানো স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বন্ধু/মিত্র দেশ ভারতের কাছ থেকে কি কিছু অস্ত্রশস্ত্র (যুদ্ধ করার জন্য নয়, প্রশিক্ষণের জন্য) চাওয়া যেত না বা ভারতও কি তাদের তরফ থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ উপহার হিসেবেও দিতে পারতো না? অথচ ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রায় এক মাস যাবৎ তাদের শত শত ট্রাকভর্তি করে ভারতে নিয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সুবাদে তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৬৭ সালে ইসরাইল যুদ্ধে ব্যবহৃত ১৩টা পুরাতন ট্যাংক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উপহার দিয়েছিল। এছাড়া, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান মিত্র দেশ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে উপহার হিসেবে এক স্কোয়াড্রন মিগ-২১ জঙ্গি বিমান দিয়েছিল (যে বিমান দিয়ে ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শান্তিবাহিনী/বিদ্রোহীদের উপর বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল)।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করে তোলার কোন ইচ্ছা বা আন্তরিকতা আওয়ামী লীগের আগেও ছিল না, এখনও নাই। আসল বা অন্তর্নিহিত সত্য হলো বিগত ৫ই জানুয়ারি যে ধরনেরই হউক একটা নির্বাচন করতে পারা এবং নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকার জনগণ নয় বন্দুকধারী রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানদেরকেই একমাত্র ভরসা ও শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছিল, তাই এখন তার রাষ্ট্রীয় কর্মকা- বা অধিকাংশ অনুষ্ঠানের মধ্যে সশস্ত্র/ বন্দুকধারী বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রাধান্যই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়াও শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জের হাজার হাজার তরুণ ও ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, বিরোধী দলের ওপর পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের সর্বাত্মক ব্যবহার এখন চলছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে সহসাই এমন (দলীয় আনুগত্য অনুযায়ী) আরো ৫০ হাজার নতুন পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ দেশকে মনে হয় পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষোলকলাই শেখ হাসিনার সরকার পূর্ণ করে ছাড়বে। তবে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে এসব রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ও দলীয় সশস্ত্র মাস্তানরা যখন মনে করবে বা বুঝতে শুরু করবে যে সরকার তাদের উপর নির্ভর করেই ক্ষমতায় আছে বা থাকতে চাচ্ছে তখন তারা একদিকে যেমন সরকারি নির্দেশ-আদেশের তোয়াক্কা না করে নিজেদের স্বার্থে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে যা ইচ্ছা তাই করতে উৎসাহিত হবে (যেমন পুলিশ ও র্যাবের বিভিন্ন সদস্য ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, গুম, খুন ও কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, দলীয় সশস্ত্র মাস্তানরা সারা দেশে বেপরোয়া সন্ত্রাস চালাচ্ছে) অপরদিকে তারা স্বভাবতই সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যেই এসব বাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করছেন তার কাছে খোলাখুলি আলোচনার সময় ঐসব বাহিনীর সদস্যরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করতে ও পূরণ করার দাবি জানাতে শুরু করেছে।
সুতরাং তাদের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকতে হলে তাদেরকে অপরাধ থেকেও দায়মুক্তি দিতে হবে আবার তাদের দাবি-দাওয়া কিছু না কিছু বা সবটুকু কোন না কোন সময় মানতেই হবে। তা না হলেই বিপদ। এখানে উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ১৯৮১ সালের মার্চে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার কাছে ১১-দফা দাবিনামা পেশ করা হয়েছিল, কথিত আছে জেনারেল জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ওইসব দাবি-দাওয়া না মেনে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসার পর ওইদিন রাতেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে একই ধরনের খেলা শুরু করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের দেয়া লিস্ট অনুযায়ী সেনাবাহিনী থেকে কথিত বিএনপি-জামায়াতপন্থি বা সমর্থক প্রায় ৪৪ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরি থেকে সরিয়ে বর্তমান সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এখন আওয়ামী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী সৈনিকদের বহাল করা হয়েছে বলে শোনা যায়। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকেও এখন দলীয়করণ করা হচ্ছে। এছাড়া তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার ওয়াদা বা ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র সংগ্রহের ঘোষণাও দেয়া হচ্ছে। কেন বা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন বা তাদের জন্য অত্যাধুনিক (সাবমেরিনসহ) অস্ত্রশস্ত্র কেনা হচ্ছে? বাংলাদেশ কি ভারতের বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধ করবে বা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কি আদৌ কোনদিন বাংলাদেশের হবে? এমনকি রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর কারণে এত সমস্যা ভোগ করার পর বা সীমান্তে নাসাকা বাহিনী কর্তৃক বিজিবি সদস্যদের বিনা উস্কানি বা অজুহাতে হত্যা করার পরেও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার কোন সাহস কখনও দেখা যায়নি। তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে শক্তিশালী করার মুখরোচক ও আকর্ষণীয় বক্তব্য বা ঘোষণা উচ্চারণের উদ্দেশ্যটা তাহলে কি? বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার এই তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য অবশ্যই বুঝতে সক্ষম। এখানে উল্লেখ করা যায়, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের একটা প্রতিরক্ষা নীতি আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। প্রায় চতুর্দিকে ভারত কর্তৃক বেষ্টিত ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আয়তন, শক্তি বা ক্ষমতা কেমন হওয়া উচিত, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ( সমুদ্র সীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ) রক্ষায় ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমমানের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজন বা সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা বা উচিত হবে কিনা, নাকি বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গ্যারান্টি প্রদানের বিনিময়ে অন্য কোন পরাশক্তির সঙ্গে সামরিক চুক্তি (ইসরাইল ও তাইওয়ানের মতো) করা বা বাংলাদেশের নৌসীমানায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়া এসব কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা বা বিবেচনা না করেই উদ্দেশ্যহীন ও অপরিণামদর্শীতার মতো সশস্ত্র বাহিনীর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্য ওই একটাই- বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা ধরে রাখা। মাঝে মাঝে যুক্তি দেয়া হয় এসব অস্ত্র জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা যায়। অথচ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য কোথাও উন্নত জঙ্গি বিমান, বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বা সাব-মেরিনের কোন প্রয়োজন পড়ে না। কারণ যেসব দেশে বিদ্রোহী বা জঙ্গি শান্তি ভঙ্গ করছে তারা জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে ( আকাশে) সর্বাত্মক যুদ্ধ করে না।
স্থলভাগে হাল্কা ও মাঝাড়ি অস্ত্র নিয়ে জঙ্গি, উগ্র বা গেরিলা তৎপরতা চালায়, তাদের জন্য স্থলভাগে চলাচলকারী সামরিক সাঁজোয়া যান বা ট্যাঙ্কই যথেষ্ট। এসব খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে সশস্ত্র বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য অস্ত্র কেনা বেকার ও দরিদ্র জনসংখ্যায় জর্জরিত এই তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশটার জন্য আত্মহত্যার শামিল। যেখানে এখনও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মতো দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাতে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য জ্বালানী, বিদ্যুৎ ও সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন সেখানে ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রীয় বন্দুকধারী শক্তির জন্য অস্ত্র কেনা দেশ ও জনগণের সঙ্গে প্রচণ্ড বেইমানি ও অত্যাচারের শামিল।
বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের জন্য আরও ভয়ানক দুঃসংবাদ হলো শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে ছোট আয়তনের এই বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরও ক্যান্টনমেন্ট এবং সামরিক স্থাপনা ও বাসস্থান নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার একর জমি বা ভূখণ্ড বরাদ্দ দিয়েছে। এজন্য এখনই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ জনগণকে উচ্ছেদের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়ে গেছে, এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জনগণের বিরোধিতা ও সমালোচনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার নেশায় অন্ধ শেখ হাসিনার সরকার সাধারণ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীকে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সশস্ত্র বাহিনীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের পেশাগত দক্ষতা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, মর্যাদা ও গাম্ভীর্যতা বজায় রাখার জন্য তাদেরকে সারা পৃথিবীতেই সাধারণ জনগণের সহজ সংস্পর্শতা থেকে মুক্ত বা পৃথক রাখার জন্য তাদের বিভিন্ন স্থাপনা ও বাসস্থান গোপন জায়গায় অর্থাৎ জনসমক্ষের বাইরে রাখা বা তৈরি করা হয়। এজন্য দুর্গম পাহাড়-পর্বত জঙ্গল অর্থাৎ পার্বত্য এলাকাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর সদস্যরা যাতে অনায়াসে সাধারণ জনগণের সংস্পর্শে এসে সাধারণ জনগণের মতো আয়াসী ও শৃঙ্খলাহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত, আকৃষ্ট বা আগ্রহী হয়ে না পড়ে সেজন্যই তাদের বসবাস ও স্থাপনার জন্য বিশ্বের সকল দেশে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এখন নতুন করে তাদেরকে ৫০ হাজার একর জায়গা দিতে হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বসবাস বা চাষাবাদের জায়গা থেকেই বের করে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আর পেশাগত বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা ধরে রাখার সুযোগ মনে হয় পরিকল্পিতভাবেই ধ্বংস করে দেয়ার ব্যবস্থা শেখ হাসিনা সরকার হাতে নিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকে তবে এজন্য অনেক সময় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানার আশেপাশের এলাকায় ও রাস্তাঘাটে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদুপরি সশস্ত্র বাহিনীর স্থাপনা ও বাসস্থান যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অথবা শহরের অভ্যন্তরে হয় তবে সেখানে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার ও চলাচলও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহাযানজটের ঢাকা শহরে এখন সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি’র স্থাপনাসমূহ সত্যিই বিষফোঁড়ার মতো হয়ে উঠেছে। তেজগাঁয়ে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি থাকায় এ্যালিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের নকশাও পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী যদি একটা বিশাল শক্তিতে পরিণত হয় তবে তারা যে শুধু ক্যান্টনমেন্টে বসে ও ঘুমিয়ে নীরবে দিনযাপন করবে এর কোন গ্যারান্টি নেই, তারা তখন নিজেদেরকেও রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করবে এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড তথা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপও করতে দ্বিধা বোধ করবে না। যেমন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৪৭ সালের পর থেকেই যা করে আসছে, সেখানে সব রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতায় যেতে হলে বা থাকতে হলে সেনাবাহিনীর পরামর্শ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আমলে নিতে হয়- যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি ও ক্ষতিকর। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনাও মনে হয় বাংলাদেশকেও পাকিস্তানের মতো মিলিটারি রাষ্ট্রে পরিণত করার ভয়ঙ্কর পথে অগ্রসর হচ্ছে। বিরোধী জনমত ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনগণ নয় বন্দুকের নলকেই এখন সে ক্ষমতা ধরে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশেও বন্দুকের নল যে কোন কোন সময় সাপের চেয়েও বিষাক্ত ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে এ অভিজ্ঞতার কথা কি শেখ হাসিনার জানা নেই?
লেখক :জাহিদ হাসান রিয়াদ, সৌদি প্রবাসী
No comments