সফরকারী বিজেপি নেতার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন by ড. মাহবুব উল্লাহ্
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কেন্দ্রীয়
নেতা তথাগত রায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভারতের পূর্ণ সমর্থন
রয়েছে।’ তিনি বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের একজোট হয়ে আওয়ামী লীগকে
সর্বশক্তি দিয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানান (প্রথম আলো, ৩ জানুয়ারি ২০১৫)।
‘বেদান্ত সংস্কৃত মঞ্চ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন ‘পূজা পুনর্মিলনী, বিশ্বজুড়ে বিশ্বময়ী’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তথাগত রায় বলেছেন, ‘আমি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এটা বলতে পারি না। আমরা একটি দেশের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করি। তবে বাংলাদেশের বিষয়টা ভিন্ন, আপনাদের (উপস্থিতদের উদ্দেশে) বোঝার জন্য বলছি। ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ভারত সরকার উপলব্ধি করেছে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো কোনো সরকার হতে পারে না। এখানকার হিন্দুদের জন্যও এর চেয়ে ভালো সরকার কি হতে পারে?’
তথাগত রায় বলেন, ‘আমরা এটা মনে করি। আপনারা কি মনে করেন এদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো সরকারের ওপর ভরসা করা যায়? ভাবুন, যদি অন্যদের ওপর ভরসা করা না যায়, তাহলে পুরো সমর্থন আওয়ামী লীগকে দিন। প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলে আওয়ামী লীগ আপনাদের ব্যাপারে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।’ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক এ সভাপতি বলেন, ‘বাংলাদেশের পাওনা ভারত বুঝিয়ে দেবে। তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তি হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। তবে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পাবে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।’ বিজেপির এ কেন্দ্রীয় নেতা একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ জনের মধ্যে ৮০ হিন্দু ও ২০ জন মুসলমান ছিল। কিন্তু এখন হিন্দু ৭২ আর মুসলমান ২৮। বাংলাদেশে হিন্দু কমার কারণ আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কেন? এর কারণ, অনুপ্রবেশ ও হিন্দুদের কম প্রজনন। তার আশংকা, একদিন বাঙালি হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্যকে খুব হালকাভাবে নেয়া যায় না। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে কথাগুলো বলেছেন এমন এক সময়, যখন এর দু’দিন পর ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পালন করছে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিবসটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে চাইছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। তথাগত বাবু কেবল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাই নন, তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের মনোভাব সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা থাকারই কথা। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত অন্য দেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়টি ভিন্ন। তিনি আরও জানিয়ে দিয়েছেন ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের চেয়ে ভালো কোনো সরকার হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একজোট হয়ে প্রকাশ্যে এ সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কী হতে পারে? তার বক্তব্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির পরিষ্কার উসকানি বিদ্যমান। অথচ আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী আছে। তবে তারা ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজিত হতে পারে না। বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু প্রশ্নটি অবান্তর। একথা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একাধিকবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশী। তাহলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাদের বিশেষ একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান কেন জানানো হচ্ছে? এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর অপকৌশল ছাড়া আর কী হতে পারে?
তথাগত বাবুর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক থেকে আলাদা। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের দাদাগিরি সুবিদিত। বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত অতিরিক্ত সুবিধা নিতে চায়। এজন্যই বাংলাদেশের বিষয়টি ভারতের কাছে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারত তার অন্য প্রতিবেশীদের বেলাতেও প্রায় একই ধরনের নীতিতে বিশ্বাসী। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলে ভারত বাংলাদেশকে ঘিরে অতিরিক্ত অনেক কিছু পেতে চায়। এ ব্যাপারটি বাংলাদেশের অনেক নাগরিকের কাছে স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় নেত্রীবর্গের বিভিন্ন উক্তির ফলে আজ হোক, কাল হোক স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই কামনা করে। তবে তাদের সেই সৎ আকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছা ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশীসুলভ দাম্ভিকতার ফলে সঠিক পথে এগোতে পারছে না। পৃথিবীর অনেক দেশেরই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ যে বৃহৎ রাষ্ট্রকে প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছে তার আচরণ পৃথিবীর অন্য যে কোনো বৃহৎ প্রতিবেশীর আচরণকে ম্লান করে দেবে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায়শই বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। সীমান্ত হত্যার ইতিহাসে ফেলানী হত্যা সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তথাগত বাবু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাওনা ভারত বুঝিয়ে দেবে। ভারত কি বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশী নাগরিকদের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে? সমকালীন বিশ্বে মানবাধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বন্দিদের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র নিষ্ঠুর নির্যাতনের কাহিনী মার্কিন সিনেটের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিলম্বে হলেও সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বিশ্বময় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ কর্কট রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতীয় লোকসভার একটি কমিটি যদি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করত, তাহলে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণজনিত কষ্টের উপশম হতো। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বিশেষ করে উভয় দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক খানিকটা হলেও সুখকর হতো। তথাগত বাবুর মতে তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। তবে বাংলাদেশ কতটুকু পানি পাবে সেটা নির্ধারিত হবে আলোচনা করে। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, বাংলাদেশের ভাগ্যে অতিরিক্ত কয় ফোঁটা পানি মিলবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারত ইতিমধ্যেই সিকিম ও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে গজলডোবায় অনেক বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অবশিষ্ট যে পানি আছে তাতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কয়েকশ’ কিউসেকের বেশি পানি পায় না। তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহের পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করতে হলে ভারতকে তার নির্মিত বাঁধগুলো অপসারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেও একতরফাভাবে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করা যায় না। ভারত এসব নিয়মনীতির থোড়াই তোয়াক্কা করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছিলেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত কমে যাওয়া সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তথাগত বাবু মোদির নির্বাচনপূর্বক ঘোষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছেন। আবারও যদি পুশইনের মতো ঘটনা ঘটতে শুরু করে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে?
ভারতের জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর বিএনপিকে আশ্বস্তবোধ করতে দেখা গেছে। বিএনপি দ্রুত গতিতে মোদির বিজয়কে অভিনন্দিত করেছে। এর অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। মোদির পূর্বসূরি মোরারজি দেশাইর সরকার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার একটি প্রকল্প থামিয়ে দিয়েছিল। ওই সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও উন্নতি ঘটেছিল। যদিও বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। মোদির বিজয়ের পর অনুরূপ কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে বিএনপি নেতৃত্ব আশা করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কী হয়েছে সেটা তারাই বলতে পারবে। তবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা কূটনৈতিক দিক থেকে সঠিক পদক্ষেপই বলা যায়। এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না ভারত রাষ্ট্রটির চরিত্র কী। এটি একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। এ সম্প্র্রসারণবাদের দর্শন চালু করেছিল দীর্ঘদিন ভারতের ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসদলীয় সরকার। মনে করা হয়েছিল, এটা নিছকই একটা দলীয় উপসর্গ। দলবদল হলে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু সে রকম কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশ সফরে আসেন, তাহলে দৃশ্যত সেটা হবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সংহতি। বর্তমান ভারত সরকার বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করছে তা আমরা জানি না। তবে মোদি যদি এ সফরের সুযোগে সেরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনচক্ষুর আড়ালেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাগাদা দেন, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার পথে সেটি হবে একটি শুভ উদ্যোগ। নরেন্দ্র মোদির সরকার নিশ্চয়ই তার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে অবগত আছেন, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা’ খুব শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারেননি। তাদের মন্দির-বিগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের জমিজমা, বাড়িঘর দখল হয়েছে। এসব কিছু ঘটেছে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির লোভের ফলে। ক্ষমতাসীন সরকার এদের কতটা দমন ও নিবৃত্ত করতে পেরেছে সেটাও দেখার বিষয়। সবশেষে বলতে হয়, তথাগত রায় যা বলেছেন, তা যদি সত্যি সত্যি ভারতের বিজেপি সরকারের নীতি হয়, তাহলে দুই দেশের জনগণের সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে। সে রকম কিছু কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘বেদান্ত সংস্কৃত মঞ্চ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন ‘পূজা পুনর্মিলনী, বিশ্বজুড়ে বিশ্বময়ী’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তথাগত রায় বলেছেন, ‘আমি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এটা বলতে পারি না। আমরা একটি দেশের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করি। তবে বাংলাদেশের বিষয়টা ভিন্ন, আপনাদের (উপস্থিতদের উদ্দেশে) বোঝার জন্য বলছি। ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ভারত সরকার উপলব্ধি করেছে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো কোনো সরকার হতে পারে না। এখানকার হিন্দুদের জন্যও এর চেয়ে ভালো সরকার কি হতে পারে?’
তথাগত রায় বলেন, ‘আমরা এটা মনে করি। আপনারা কি মনে করেন এদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো সরকারের ওপর ভরসা করা যায়? ভাবুন, যদি অন্যদের ওপর ভরসা করা না যায়, তাহলে পুরো সমর্থন আওয়ামী লীগকে দিন। প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলে আওয়ামী লীগ আপনাদের ব্যাপারে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।’ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক এ সভাপতি বলেন, ‘বাংলাদেশের পাওনা ভারত বুঝিয়ে দেবে। তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তি হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। তবে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পাবে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।’ বিজেপির এ কেন্দ্রীয় নেতা একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ জনের মধ্যে ৮০ হিন্দু ও ২০ জন মুসলমান ছিল। কিন্তু এখন হিন্দু ৭২ আর মুসলমান ২৮। বাংলাদেশে হিন্দু কমার কারণ আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কেন? এর কারণ, অনুপ্রবেশ ও হিন্দুদের কম প্রজনন। তার আশংকা, একদিন বাঙালি হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্যকে খুব হালকাভাবে নেয়া যায় না। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে কথাগুলো বলেছেন এমন এক সময়, যখন এর দু’দিন পর ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পালন করছে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিবসটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে চাইছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। তথাগত বাবু কেবল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাই নন, তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের মনোভাব সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা থাকারই কথা। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত অন্য দেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়টি ভিন্ন। তিনি আরও জানিয়ে দিয়েছেন ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের চেয়ে ভালো কোনো সরকার হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একজোট হয়ে প্রকাশ্যে এ সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কী হতে পারে? তার বক্তব্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির পরিষ্কার উসকানি বিদ্যমান। অথচ আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী আছে। তবে তারা ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজিত হতে পারে না। বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু প্রশ্নটি অবান্তর। একথা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একাধিকবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশী। তাহলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাদের বিশেষ একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান কেন জানানো হচ্ছে? এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর অপকৌশল ছাড়া আর কী হতে পারে?
তথাগত বাবুর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক থেকে আলাদা। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের দাদাগিরি সুবিদিত। বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত অতিরিক্ত সুবিধা নিতে চায়। এজন্যই বাংলাদেশের বিষয়টি ভারতের কাছে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারত তার অন্য প্রতিবেশীদের বেলাতেও প্রায় একই ধরনের নীতিতে বিশ্বাসী। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলে ভারত বাংলাদেশকে ঘিরে অতিরিক্ত অনেক কিছু পেতে চায়। এ ব্যাপারটি বাংলাদেশের অনেক নাগরিকের কাছে স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় নেত্রীবর্গের বিভিন্ন উক্তির ফলে আজ হোক, কাল হোক স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই কামনা করে। তবে তাদের সেই সৎ আকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছা ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশীসুলভ দাম্ভিকতার ফলে সঠিক পথে এগোতে পারছে না। পৃথিবীর অনেক দেশেরই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ যে বৃহৎ রাষ্ট্রকে প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছে তার আচরণ পৃথিবীর অন্য যে কোনো বৃহৎ প্রতিবেশীর আচরণকে ম্লান করে দেবে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায়শই বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। সীমান্ত হত্যার ইতিহাসে ফেলানী হত্যা সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তথাগত বাবু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাওনা ভারত বুঝিয়ে দেবে। ভারত কি বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশী নাগরিকদের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে? সমকালীন বিশ্বে মানবাধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বন্দিদের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র নিষ্ঠুর নির্যাতনের কাহিনী মার্কিন সিনেটের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিলম্বে হলেও সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বিশ্বময় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ কর্কট রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতীয় লোকসভার একটি কমিটি যদি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করত, তাহলে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণজনিত কষ্টের উপশম হতো। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বিশেষ করে উভয় দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক খানিকটা হলেও সুখকর হতো। তথাগত বাবুর মতে তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। তবে বাংলাদেশ কতটুকু পানি পাবে সেটা নির্ধারিত হবে আলোচনা করে। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, বাংলাদেশের ভাগ্যে অতিরিক্ত কয় ফোঁটা পানি মিলবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারত ইতিমধ্যেই সিকিম ও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে গজলডোবায় অনেক বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অবশিষ্ট যে পানি আছে তাতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কয়েকশ’ কিউসেকের বেশি পানি পায় না। তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহের পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করতে হলে ভারতকে তার নির্মিত বাঁধগুলো অপসারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেও একতরফাভাবে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করা যায় না। ভারত এসব নিয়মনীতির থোড়াই তোয়াক্কা করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছিলেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত কমে যাওয়া সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তথাগত বাবু মোদির নির্বাচনপূর্বক ঘোষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছেন। আবারও যদি পুশইনের মতো ঘটনা ঘটতে শুরু করে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে?
ভারতের জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর বিএনপিকে আশ্বস্তবোধ করতে দেখা গেছে। বিএনপি দ্রুত গতিতে মোদির বিজয়কে অভিনন্দিত করেছে। এর অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। মোদির পূর্বসূরি মোরারজি দেশাইর সরকার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার একটি প্রকল্প থামিয়ে দিয়েছিল। ওই সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও উন্নতি ঘটেছিল। যদিও বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। মোদির বিজয়ের পর অনুরূপ কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে বিএনপি নেতৃত্ব আশা করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কী হয়েছে সেটা তারাই বলতে পারবে। তবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা কূটনৈতিক দিক থেকে সঠিক পদক্ষেপই বলা যায়। এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না ভারত রাষ্ট্রটির চরিত্র কী। এটি একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। এ সম্প্র্রসারণবাদের দর্শন চালু করেছিল দীর্ঘদিন ভারতের ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসদলীয় সরকার। মনে করা হয়েছিল, এটা নিছকই একটা দলীয় উপসর্গ। দলবদল হলে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু সে রকম কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশ সফরে আসেন, তাহলে দৃশ্যত সেটা হবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সংহতি। বর্তমান ভারত সরকার বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করছে তা আমরা জানি না। তবে মোদি যদি এ সফরের সুযোগে সেরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনচক্ষুর আড়ালেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাগাদা দেন, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার পথে সেটি হবে একটি শুভ উদ্যোগ। নরেন্দ্র মোদির সরকার নিশ্চয়ই তার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে অবগত আছেন, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা’ খুব শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারেননি। তাদের মন্দির-বিগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের জমিজমা, বাড়িঘর দখল হয়েছে। এসব কিছু ঘটেছে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির লোভের ফলে। ক্ষমতাসীন সরকার এদের কতটা দমন ও নিবৃত্ত করতে পেরেছে সেটাও দেখার বিষয়। সবশেষে বলতে হয়, তথাগত রায় যা বলেছেন, তা যদি সত্যি সত্যি ভারতের বিজেপি সরকারের নীতি হয়, তাহলে দুই দেশের জনগণের সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে। সে রকম কিছু কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments