শান্তিচুক্তির ১৭ বছর: কেমন আছে পাহাড়ি জীবন by নাজমুল আহসান
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে আসে শান্তিবাহিনী। আপাত অবসান হয় প্রায় দুই যুগ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পেরিয়ে গেছে ১৭ বছর। কিন্তু আকাক্সিক্ষত শান্তি কি আদৌ এসেছে? পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি হয়েছে অনেক। তবে পাহাড়ে এখনও পারস্পারিক জাতিগত ক্ষোভ, অশান্তি, অবিশ্বাস বিদ্যমান। প্রায়ই তাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই তৎকালীন শান্তিবাহিনীর একটি অংশ বেরিয়ে যায় সংগঠন থেকে। তাদের দাবি, চুক্তি করে পাহাড়িদের আন্দোলনের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এই অংশটিই পরবর্তীকালে গড়ে তোলে ইউনাইটেড পিপলস রিপাবলিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফ চুক্তির বদলে পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায়। খাগড়াছড়ির প্রায় পুরো অংশ, রাঙ্গামাটির বিশাল অংশসহ বান্দরবানের অনেক এলাকা দলটির দখলে। ইউপিডিএফ ও চুক্তির পক্ষের পার্বত্য জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে এলাকা দখলের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে প্রায়ই। এছাড়া ভাতৃঘাতি সংঘাত, খুন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনাসমূহ ঘটছে নিয়মিত। কয়েক দিন আগেই অপহৃত হয়েছিলেন বনবিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা। এক বন কর্মকর্তা বলেছিলেন, অপহরণকারীরা অপহৃতদের মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে দাবি করে প্রায় কোটি টাকা। পরে অবশ্য ১৯ দিন পর রাঙ্গামাটির লংদুর নানিয়ারচর এলাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সেই তিন কর্মকর্তা। তবে মুক্তিপণ দেয়া হয়েছিল কিনা, তা জানা যায়নি। এরই মধ্যে জেএসএস থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য বের হয়ে গিয়ে গড়ে তোলেন জেএসএস-এর আরেকটি গ্রুপ, যা বর্তমানে জেএসএস (লারমা) নামেই পরিচিত। ১৭ বছর পর পাহাড় নিয়ে নতুন অনেক ইস্যুর জন্ম হয়েছে। সমাধান হয়নি পুরনো অনেক জটিল সমস্যারও। শান্তিবাহিনীর তৎকালীন প্রধান, বর্তমানে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-সন্তু)-এর প্রধান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ৩ দিন আগেও ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এমনকি চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ হুমকিও দেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে, এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ কিংবা অশান্তিপূর্ণ হতে পারে বলেও জানানো হয়। তিনি সরকারকে ২০১৫ সালের ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে ‘কার্যকর উদ্যোগ’ গ্রহণের আহ্বান জানান। এর মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে ১লা মে থেকেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। এরপর থেকে পাহাড়ে কোন ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ঘটনা ঘটলে তার জন্য জনসংহতি সমিতি দায়ী থাকবে না বলেও জানিয়ে দেন তিনি। এছাড়া রাঙ্গামাটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণের বিরুদ্ধে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন বহুদিন ধরে। তার দল জেএসএস এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে আসছে। যদিও স্থানীয় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের দাবিতে পাল্টা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায় থেকে দাবি করা হচ্ছে, চুক্তির বেশির ভাগ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি অংশ খুব শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু জনসংহতি সমিতি বলছে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব- সবাই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। গত সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি আসনে জেএসএস-এর প্রার্থী উষাতন তালুকদারের কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। এ নিয়ে পর¯পরের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ আনে দল দু’টি। দীপংকর তালুকদারসহ বান্দরবান থেকে নির্বাচিত এমপি, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক স¤পাদক ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রায়ই পাহাড় থেকে ‘অস্ত্রের ঝনঝনানি’ দূর করার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের নারী এমপি ফিরোজা বেগম চিনু ও জেএসএস-এর এমপি উষাতন তালুকদারের মধ্যে সংসদীয় কমিটি সহ বিভিন্ন ফোরামে বাহাসের ঘটনা পত্রিকায় আসে নিয়মিত। এছাড়া মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চুক্তির বেশিরভাগ অংশই বাস্তবায়ন হয়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগ উল্টো অভিযোগ ছুড়ে দেন জেএসএস-এর দিকে। তাদের বক্তব্য, চুক্তি অনুযায়ী এখনও সশস্ত্র কার্যকলাপ চালিয়ে জেএসএস বরং চুক্তি লঙ্ঘন করছে এবং এর ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির চলছে তীব্র বিরোধ ও টানাপড়েন। অপরদিকে পাহাড়ের বিপুল সংখ্যক বাঙালিরা নিজেদের ‘অবহেলিত’ ভাবছেন। তাদের দাবি, চুক্তি সহ কোন কিছুতেই তাদের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে না সরকার। সম্প্রতি পাস হওয়া পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্প্রসারণ বিল নিয়ে বিরোধিতা করেছে পাহাড়ি ও বাঙালী উভয়পক্ষই। সন্তু লারমা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এই সম্প্রসারণ করছে সরকার। এছাড়া জেলা পরিষদে নির্বাচন দেয়ার কথা থাকলেও, সরকার নিজেদের ইচ্ছামত দলীয় লোক বসিয়ে অকার্যকর করে রেখেছে জেলা পরিষদ। তাই এটি কেবলমাত্র রাজনৈতিক পুনর্বাসনকেন্দ্র হয়ে পড়ছে। তবে চুক্তির পর আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন হয়নি একবারও।
এখনও সেখানে অনির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন স্বয়ং সন্তু লারমা নিজে। মাঝে হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। যদিও সেই রায় আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। অপরদিকে বাঙালি সংগঠনগুলো বলছে, নতুন করে জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা সম্প্রসারণ করা হলেও, এখানেও ন্যায্যতার ভিত্তিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া বিরোধ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড নিয়েও। চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের প্রায় সবক্ষেত্রে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দেয়া হলেও, উহ্য ছিল উন্নয়ন বোর্ড প্রসঙ্গ। একমাত্র এখানেই প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একজন বাঙালিÑওয়াদুদ ভূঁইয়া। এখন এই পদেও পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দেয়ার অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধন করা হয়। তবুও পাহাড়ি নেতারা এই বোর্ডের প্রয়োজন নেই দাবি করে এর বিলুপ্তি চান। অপরদিকে বাঙালিরা চান এর প্রধান হিসেবে একজন বাঙালিকেই নিয়োগ দেয়া হোক। এছাড়া পার্বত্য এলাকার সবচেয়ে বিরোধ যে বিষয়টি নিয়ে, সেই ভূমি কমিশন দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর। পাহাড়ি নেতাদের দাবি অনুযায়ী নতুন করে আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। আর এই নতুন সংশোধিত আইন মানতে রাজি নন বাঙালিরা। তারা বলছেন, যেভাবে সংশোধনী আনা হচ্ছে তাতে দায়রা আদালতের কার্যপরিধি খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া কোন বিষয়ে ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান আপত্তি দিলেও কাজ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ৩ জন উপজাতীয় সদস্য যে মত দেবেন তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হবে। এছাড়া শিক্ষা ও চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি কোটা ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির বেলায় নিজেদের সমানাধিকার দাবি তাদের। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বিজিবি কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণ নিয়েও চলছে সমস্যা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি ক্যা¤প স্থাপনে যে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। বিজিবি বলছে, এ ভূমি ১৯৯১ সালেই অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ভারত-ফেরত শরণার্থীরা এখানে অবস্থান করছিলেন। তাদের কাউকে উচ্ছেদ না করে এখানে ক্যা¤প স্থাপনের কাজ চলছে। এমনকি হাইকোর্টে ভূমির যে অংশ নিয়ে মামলা চলছে তা বাদ দিয়েই ক্যা¤প স্থাপনের কাজ চলছে বলে জানান বাবুছড়া ৫১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। সেখানে বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় ‘স্বাভাবিক চাল-চলনে বাধা সৃষ্টি হওয়ায়’ প্রায় একুশটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অপরদিকে বিজিবি বলছে, তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা। তারা অপকৌশলের শিকার। একই অবস্থা বান্দরবানেও। সেখানে স্থানীয় এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি বিজিবি’র। অপরদিকে স্থানীয় উচহ্লা ভান্তে দাবি করছেন, প্রায় ১০০ একর ভূমি তার মালিকানাধীন। অপরদিকে স্থানীয় পাহাড়িরা অনেকে নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের শ্মশানে যেতে পারছেন না বলে এখান থেকে বিজিবি ক্যা¤প স্থাপনের বিরোধিতা করছেন। আর বিজিবি’র দাবি ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অরক্ষিত সীমান্ত নিরাপত্তায় এখানে ক্যা¤প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখনও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে উত্তেজনা নিরসন হয়নি। আলোচনায় রয়েছে আদিবাসী-উপজাতি-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিতর্ক। আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিতে বহুদিন ধরে আন্দোলন করছে পাহাড়ি সংগঠনগুলো। অপরদিকে ক্ষমতায় আসার আগে তাদের আদিবাসী বলে মানলেও, ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরই তা অস্বীকার করে বসে। এমনকি সংবিধান সংশোধনেও সুকৌশলে সরকার আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক এড়িয়ে যায়। আদিবাসী বা উপজাতি’র বদলে, তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। সরকারের দাবি, বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী। এছাড়া শান্তিচুক্তিতে নিজেদের উপজাতি হিসেবে মেনে নিয়েই জেএসএস স্বাক্ষর করেছিল। তাই উপজাতির বদলে আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া হলে, তা হবে চুক্তির লঙ্ঘন। অপরদিকে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে পাহাড়ি নেতারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের দাবি, এখানে ক্ষুদ্রত্ব ও বৃহত্বের প্রসঙ্গ উঠানো হয়েছে। তবে আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে খোদ পাহাড়ি দুই সংগঠনের মধ্যেই বিরোধ রয়েছে। ইউপিডিএফ-এর দাবি, নিজেদের পৃথক জাতিসত্তার দাবির সঙ্গে মিলে না আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি। আদিবাসী কথাটি কেবল একটি নৃতাত্ত্বিক বিষয়, জাতিসত্তার বিষয় নয়। বরং এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথক জাতিসত্তার দাবি। এতসব ইস্যুর ভিড়ে পাহাড়ের সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি চান শান্তি। কিভাবে এই শান্তি আসবে তা হয়তো তাদের জানা নেই। নিজেদের ভাগ্য তারা সঁপে দিয়েছেন নীতি-নির্ধারকদের হাতে।
এখনও সেখানে অনির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন স্বয়ং সন্তু লারমা নিজে। মাঝে হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। যদিও সেই রায় আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। অপরদিকে বাঙালি সংগঠনগুলো বলছে, নতুন করে জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা সম্প্রসারণ করা হলেও, এখানেও ন্যায্যতার ভিত্তিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া বিরোধ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড নিয়েও। চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের প্রায় সবক্ষেত্রে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দেয়া হলেও, উহ্য ছিল উন্নয়ন বোর্ড প্রসঙ্গ। একমাত্র এখানেই প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একজন বাঙালিÑওয়াদুদ ভূঁইয়া। এখন এই পদেও পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দেয়ার অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধন করা হয়। তবুও পাহাড়ি নেতারা এই বোর্ডের প্রয়োজন নেই দাবি করে এর বিলুপ্তি চান। অপরদিকে বাঙালিরা চান এর প্রধান হিসেবে একজন বাঙালিকেই নিয়োগ দেয়া হোক। এছাড়া পার্বত্য এলাকার সবচেয়ে বিরোধ যে বিষয়টি নিয়ে, সেই ভূমি কমিশন দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর। পাহাড়ি নেতাদের দাবি অনুযায়ী নতুন করে আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। আর এই নতুন সংশোধিত আইন মানতে রাজি নন বাঙালিরা। তারা বলছেন, যেভাবে সংশোধনী আনা হচ্ছে তাতে দায়রা আদালতের কার্যপরিধি খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া কোন বিষয়ে ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান আপত্তি দিলেও কাজ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ৩ জন উপজাতীয় সদস্য যে মত দেবেন তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হবে। এছাড়া শিক্ষা ও চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি কোটা ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির বেলায় নিজেদের সমানাধিকার দাবি তাদের। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বিজিবি কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণ নিয়েও চলছে সমস্যা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবি ক্যা¤প স্থাপনে যে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। বিজিবি বলছে, এ ভূমি ১৯৯১ সালেই অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ভারত-ফেরত শরণার্থীরা এখানে অবস্থান করছিলেন। তাদের কাউকে উচ্ছেদ না করে এখানে ক্যা¤প স্থাপনের কাজ চলছে। এমনকি হাইকোর্টে ভূমির যে অংশ নিয়ে মামলা চলছে তা বাদ দিয়েই ক্যা¤প স্থাপনের কাজ চলছে বলে জানান বাবুছড়া ৫১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। সেখানে বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় ‘স্বাভাবিক চাল-চলনে বাধা সৃষ্টি হওয়ায়’ প্রায় একুশটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অপরদিকে বিজিবি বলছে, তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা। তারা অপকৌশলের শিকার। একই অবস্থা বান্দরবানেও। সেখানে স্থানীয় এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি বিজিবি’র। অপরদিকে স্থানীয় উচহ্লা ভান্তে দাবি করছেন, প্রায় ১০০ একর ভূমি তার মালিকানাধীন। অপরদিকে স্থানীয় পাহাড়িরা অনেকে নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের শ্মশানে যেতে পারছেন না বলে এখান থেকে বিজিবি ক্যা¤প স্থাপনের বিরোধিতা করছেন। আর বিজিবি’র দাবি ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অরক্ষিত সীমান্ত নিরাপত্তায় এখানে ক্যা¤প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখনও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে উত্তেজনা নিরসন হয়নি। আলোচনায় রয়েছে আদিবাসী-উপজাতি-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিতর্ক। আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিতে বহুদিন ধরে আন্দোলন করছে পাহাড়ি সংগঠনগুলো। অপরদিকে ক্ষমতায় আসার আগে তাদের আদিবাসী বলে মানলেও, ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরই তা অস্বীকার করে বসে। এমনকি সংবিধান সংশোধনেও সুকৌশলে সরকার আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক এড়িয়ে যায়। আদিবাসী বা উপজাতি’র বদলে, তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। সরকারের দাবি, বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী। এছাড়া শান্তিচুক্তিতে নিজেদের উপজাতি হিসেবে মেনে নিয়েই জেএসএস স্বাক্ষর করেছিল। তাই উপজাতির বদলে আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া হলে, তা হবে চুক্তির লঙ্ঘন। অপরদিকে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে পাহাড়ি নেতারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের দাবি, এখানে ক্ষুদ্রত্ব ও বৃহত্বের প্রসঙ্গ উঠানো হয়েছে। তবে আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে খোদ পাহাড়ি দুই সংগঠনের মধ্যেই বিরোধ রয়েছে। ইউপিডিএফ-এর দাবি, নিজেদের পৃথক জাতিসত্তার দাবির সঙ্গে মিলে না আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি। আদিবাসী কথাটি কেবল একটি নৃতাত্ত্বিক বিষয়, জাতিসত্তার বিষয় নয়। বরং এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথক জাতিসত্তার দাবি। এতসব ইস্যুর ভিড়ে পাহাড়ের সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি চান শান্তি। কিভাবে এই শান্তি আসবে তা হয়তো তাদের জানা নেই। নিজেদের ভাগ্য তারা সঁপে দিয়েছেন নীতি-নির্ধারকদের হাতে।
No comments