সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতার উপশম আছে বৈকি by মনজু আরা বেগম
আর কত তাজা প্রাণ ঝরে গেলে, আর কত মায়ের
বুক খালি হলে আমরা পাব নিরাপদ সড়ক? পাব রাস্তাঘাটে চলাচলের নিরাপত্তা, পাব
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে সড়ক দুর্ঘটনারোধে
যুগোপযোগী কঠোর আইন আর তার যথাযথ বাস্তবায়ন। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা
খুললেই আমরা দেখতে পাই মৃত্যুর মহোৎসব। দিনটা শুরু হয় অশুভ সব খবর দেখে, গা
শিউরে ওঠা কত বিচিত্র ধরনের মৃত্যুর খবর। এই তো কিছুদিন আগে ছিনতাইকারীরা
গৃহবধূ আয়েশা আক্তারের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাকে মাইক্রোবাসের
সঙ্গে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে মেরেই ফেলল। আমরা দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছি। জীবন্ত
মানুষকে পুড়িয়ে মারছি। মানুষকে টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তাবন্দি করে রাখতে
একটুও দ্বিধাবোধ করছি না।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবতাবোধসহ মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সন্তান বাবা-মাকে খুন করছে, মা সন্তানকে। সামান্য কারণে স্বামী-স্ত্রীকে, স্ত্রী-স্বামীকে হত্যা-খুন করতে একটুও দ্বিধাবোধ করছে না। কারও কষ্ট কিংবা কারও যন্ত্রণায় তেমনভাবে এখন আর কেউ সহমর্মিতা দেখায় না। সবাই নিজেকে নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। আমরা বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি। বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের আবেগ। এসব মৃত্যুর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাই বেশি। স্ত্রী-স্বামী কিংবা সন্তানসহ আপনজনরা ঘর থেকে বাইরে বেরোলে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়, তারা সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে তো? আমাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং পথচারীদের চাপা দেয়ার ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে সবচেয়ে বেশি। পত্রিকান্তরে জানা যায়, চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য দুর্ঘটনা ঘটে শতকরা ৯১ ভাগ। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৪টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় লাশের মিছিল। একই পরিবারের ৬ সহোদরের মৃত্যুর ঘটনা বিরল। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল অর্থাৎ ১৪ বছরে সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ৪২ হাজার ৫২৬ জনের। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। কারণ সব দুর্ঘটনাই সরকারি হিসাবে আসে না।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে গাড়ির অতিরিক্ত গতি ৫৩.২৮ ভাগ। মোটরযান আইনে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও অধিকাংশ চালকই এ নিয়ম মানেন না। মহাসড়ক, শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিক আপের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। ভারি ট্রাক, লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারি যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণ দেখানো হয়েছে ৩৭.৩৮ শতাংশ। পথচারীদের ভুলের কারণে মৃত্যু হয় ৩.৫৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ৫.৭৮ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত এবং দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হকের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পুলিশের রেকর্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতের আসল চিত্র আসে না। তিনি জানান, ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার; কিন্তু পুলিশের হিসাবে আসে ১ হাজার ৯০০। বিশ্বব্যাংকের জরিপে নিহতের সংখ্যা বছরে প্রায় ১২ হাজার; কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এ সংখ্যা ১৮ হাজার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ। দেড় শতাংশ ধরলেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। পরিবার তথা দেশের অর্থনীতিতে এই যে বিরাট ক্ষতি, তা থেকে রক্ষাকল্পে আমাদের তেমন কোনো উদ্যোগ কর্মপরিকল্পনা, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা এর বাস্তবায়ন লক্ষণীয় নয়। একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর গতানুগতিক রীতিতে তাৎক্ষণিকভাবে একটা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়, তারপর এটা কোনো আঁস্তাকুড়ে বা হিমঘরে গিয়ে পড়ে থাকে, তা আর আমরা জানতে পারি না। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা কিছুদিন এটা নিয়ে হইচই দেখতে পাই, তারপর আর খবর থাকে না।
প্রতিদিন যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে তার কারণ আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এসব কারণের মধ্যে প্রধানত ত্র“টিপূর্ণ যানবাহন, ত্র“টিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা, ওভারলোডিং, ওভারটেকিং, ওভার স্পিড, গাড়িচালকদের অদক্ষতা, ভুয়া লাইসেন্স, বেপরোয়া ও নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি না চালানো, গাড়ির গতিসীমা অনুসরণ না করা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, মানববন্ধন, আন্দোলন, মিছিল-মিটিং কম হয়নি বা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাড়ির লাইসেন্স এবং চালকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ যথাযথ হয় না বা হচ্ছে না। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী একজন চালককে লাইসেন্স দেয়ার আগে মহাসড়কে তার ৩৫ মিনিটের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা কতটুকু পালিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের পুরো দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, গাড়ি আছে ২১ লাখ কিন্তু চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। আন্তঃজেলায় যেসব বড় বড় বাস চলে সে সব বাসের চালককে দেখা গেছে সারা রাত জেগে গাড়ি চালিয়ে এসে পরের ট্রিপ ধরতে। এটার কারণ হচ্ছে, একদিকে চালকের স্বল্পতা অন্যদিকে বাণিজ্যিক মনোভাব অর্থাৎ অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় মানুষের জীবনকে বাজি রেখে মালিকপক্ষ এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় দুর্ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে অনেক আইন আছে; কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগই যুগোপযোগী নয়। এসিড অপরাধ দমন আইন, এসিড সরবরাহ আইন, শিশু ও নারী নির্যাতন ইত্যাদি আইন প্রণয়ন করার ফলে এবং এসব আইনে ভয়াবহ শাস্তির বিধান রেখে এর ভয়াবহ দিকটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এসিড নিক্ষেপ সংক্রান্ত অপরাধ অনেক কমে এসেছে। আইন শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না যদি না তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় নিয়ে এক সেমিনারে জানা যায়, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ দেশ পর্যায়ক্রমে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। বাকি ৫০ শতাংশ দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার দুটিই বেড়ে চলেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক বলেন, জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্য দেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা হাতে নিলে কারিগরি সহায়তা পাওয়া যাবে। সড়ক দুর্ঘটনারোধে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য এ খাতে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণযান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিগত ১০-১১-১৪ তারিখ থেকে বিআরটিএ অভিযান শুরু করেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, সারা দেশে ৩ লাখ ১৩ হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতেই ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪। শতকরা হিসাবে ৩৩ ভাগ যানবাহনের ফিটনেস নেই। এক দিনেই সারা দেশে মোট ২৪৯টি মামলা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ২১ জন চালককে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা/প্রশিক্ষণের সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চালক হিসেবে নিয়োগদান, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি আমদানি বন্ধকরণ, ভুয়া লাইসেন্স প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি/কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা, হাইওয়েতে ত্রুটিপূর্ণ যান পরীক্ষা করতে হাইওয়ে পুলিশ পেট্রোল জোরদার করাসহ বিদ্যমান আইনের সময়োপযোগী সংশোধন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং এ বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে ।
মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক
সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবতাবোধসহ মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সন্তান বাবা-মাকে খুন করছে, মা সন্তানকে। সামান্য কারণে স্বামী-স্ত্রীকে, স্ত্রী-স্বামীকে হত্যা-খুন করতে একটুও দ্বিধাবোধ করছে না। কারও কষ্ট কিংবা কারও যন্ত্রণায় তেমনভাবে এখন আর কেউ সহমর্মিতা দেখায় না। সবাই নিজেকে নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। আমরা বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি। বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের আবেগ। এসব মৃত্যুর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাই বেশি। স্ত্রী-স্বামী কিংবা সন্তানসহ আপনজনরা ঘর থেকে বাইরে বেরোলে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়, তারা সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে তো? আমাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং পথচারীদের চাপা দেয়ার ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে সবচেয়ে বেশি। পত্রিকান্তরে জানা যায়, চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য দুর্ঘটনা ঘটে শতকরা ৯১ ভাগ। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৪টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় লাশের মিছিল। একই পরিবারের ৬ সহোদরের মৃত্যুর ঘটনা বিরল। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল অর্থাৎ ১৪ বছরে সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ৪২ হাজার ৫২৬ জনের। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। কারণ সব দুর্ঘটনাই সরকারি হিসাবে আসে না।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে গাড়ির অতিরিক্ত গতি ৫৩.২৮ ভাগ। মোটরযান আইনে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও অধিকাংশ চালকই এ নিয়ম মানেন না। মহাসড়ক, শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিক আপের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। ভারি ট্রাক, লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারি যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণ দেখানো হয়েছে ৩৭.৩৮ শতাংশ। পথচারীদের ভুলের কারণে মৃত্যু হয় ৩.৫৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ৫.৭৮ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত এবং দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হকের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পুলিশের রেকর্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতের আসল চিত্র আসে না। তিনি জানান, ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার; কিন্তু পুলিশের হিসাবে আসে ১ হাজার ৯০০। বিশ্বব্যাংকের জরিপে নিহতের সংখ্যা বছরে প্রায় ১২ হাজার; কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এ সংখ্যা ১৮ হাজার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ। দেড় শতাংশ ধরলেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। পরিবার তথা দেশের অর্থনীতিতে এই যে বিরাট ক্ষতি, তা থেকে রক্ষাকল্পে আমাদের তেমন কোনো উদ্যোগ কর্মপরিকল্পনা, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা এর বাস্তবায়ন লক্ষণীয় নয়। একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর গতানুগতিক রীতিতে তাৎক্ষণিকভাবে একটা কমিটি গঠন করে দেয়া হয়, তারপর এটা কোনো আঁস্তাকুড়ে বা হিমঘরে গিয়ে পড়ে থাকে, তা আর আমরা জানতে পারি না। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা কিছুদিন এটা নিয়ে হইচই দেখতে পাই, তারপর আর খবর থাকে না।
প্রতিদিন যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে তার কারণ আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এসব কারণের মধ্যে প্রধানত ত্র“টিপূর্ণ যানবাহন, ত্র“টিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা, ওভারলোডিং, ওভারটেকিং, ওভার স্পিড, গাড়িচালকদের অদক্ষতা, ভুয়া লাইসেন্স, বেপরোয়া ও নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি না চালানো, গাড়ির গতিসীমা অনুসরণ না করা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, মানববন্ধন, আন্দোলন, মিছিল-মিটিং কম হয়নি বা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাড়ির লাইসেন্স এবং চালকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ যথাযথ হয় না বা হচ্ছে না। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী একজন চালককে লাইসেন্স দেয়ার আগে মহাসড়কে তার ৩৫ মিনিটের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা কতটুকু পালিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের পুরো দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, গাড়ি আছে ২১ লাখ কিন্তু চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। আন্তঃজেলায় যেসব বড় বড় বাস চলে সে সব বাসের চালককে দেখা গেছে সারা রাত জেগে গাড়ি চালিয়ে এসে পরের ট্রিপ ধরতে। এটার কারণ হচ্ছে, একদিকে চালকের স্বল্পতা অন্যদিকে বাণিজ্যিক মনোভাব অর্থাৎ অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় মানুষের জীবনকে বাজি রেখে মালিকপক্ষ এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় দুর্ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে অনেক আইন আছে; কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগই যুগোপযোগী নয়। এসিড অপরাধ দমন আইন, এসিড সরবরাহ আইন, শিশু ও নারী নির্যাতন ইত্যাদি আইন প্রণয়ন করার ফলে এবং এসব আইনে ভয়াবহ শাস্তির বিধান রেখে এর ভয়াবহ দিকটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এসিড নিক্ষেপ সংক্রান্ত অপরাধ অনেক কমে এসেছে। আইন শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না যদি না তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় নিয়ে এক সেমিনারে জানা যায়, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ দেশ পর্যায়ক্রমে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। বাকি ৫০ শতাংশ দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার দুটিই বেড়ে চলেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক বলেন, জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্য দেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা হাতে নিলে কারিগরি সহায়তা পাওয়া যাবে। সড়ক দুর্ঘটনারোধে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য এ খাতে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণযান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিগত ১০-১১-১৪ তারিখ থেকে বিআরটিএ অভিযান শুরু করেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, সারা দেশে ৩ লাখ ১৩ হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতেই ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪। শতকরা হিসাবে ৩৩ ভাগ যানবাহনের ফিটনেস নেই। এক দিনেই সারা দেশে মোট ২৪৯টি মামলা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ২১ জন চালককে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা/প্রশিক্ষণের সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চালক হিসেবে নিয়োগদান, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি আমদানি বন্ধকরণ, ভুয়া লাইসেন্স প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি/কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা, হাইওয়েতে ত্রুটিপূর্ণ যান পরীক্ষা করতে হাইওয়ে পুলিশ পেট্রোল জোরদার করাসহ বিদ্যমান আইনের সময়োপযোগী সংশোধন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং এ বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে ।
মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক
No comments