নিজেই এত দূরে চলে গেলেন কী করে? by রফি হক
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী প্রসঙ্গে লিখতে বসে
আমার আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই বিরাশি সালে
কুষ্টিয়া থেকে অনেকটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা
দিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল এমন যে, ঢাকার আর্ট কলেজটিতে গেলেই আমাকে ভর্তি
করে নেবে। কিন্তু পরীক্ষা দিতে হল নানারকমের। সেখানেই প্রথম দেখি কাইয়ুম
স্যারকে। সে এক বিস্ময় লাগা ঘোর, তিনি আমাদের ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব পালন
করছেন! আমি তাকে দেখি আর লিখি। তিনিও আমাকে খুব লক্ষ করছিলেন। এক সময় এগিয়ে
এসে বললেন, এই ছেলে খাতাটি দাও তো...। আমি তখনও সব প্রশ্নের উত্তর দিতে
পারিনি। তিনি খাতা নিয়ে গেলেন। আমার খুব মন খারাপ হল। চোখ থেকে মুছে গেল
আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন।
কিন্তু যেটুকু পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তাতেই টিকে গেলাম। আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হলেন আমার শিক্ষক। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। আমি ছিলাম প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টে। শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ এবং কিবরিয়ার ছাত্র। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসতেন আড্ডা দিতে কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে। মোহাম্মদ কিবরিয়া তারও শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তারা পরস্পরের অসামান্য বন্ধু ছিলেন। কিবরিয়া স্যার মৃত্যুশয্যায় তার বন্ধু-সহকর্মী কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিবরিয়া স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে প্রথম যে শিল্পী হাসপাতালে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন, তিনি কাইয়ুম চৌধুরী।
এ বছরের মার্চে যখন আমি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিটিং স্কলার হিসেবে গেছি, তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, যেখানেই যাবে বাংলাদেশের প্রকৃতিকে মনে রাখবে। বাংলাদেশের নদী, নৌকা, জল-হাওয়া, লোকজ মোটিফস বুকে ধারণ করবে। সেটাই হবে দেশকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায়। আর ওখানকার মিউজিয়ামগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখবে কিন্তু...
কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম যেমন সরল, নির্মল সুন্দর বাংলাদেশের কথা বলে; তিনি ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন তেমনই সরল, নির্মল আর সাদাসিধে। সমকালীন শিল্পকলার প্রবল দ্বিধার ভেতরেও তিনি তার ক্যানভাসে নিজস্ব ভাষা প্রকাশে ছিলেন অবিচল, দৃঢ়। সেখানে তার প্রকাশভঙ্গি ছিল পুরোপুরি লোকজ। নিজের শেকড়ের বাইরে তিনি কখনোই যাননি। দেশের প্রতি তার প্রবল মমতামাখানো ভালোবাসাকে আলিঙ্গন করে শিল্পী হিসেবে তিনি নিজে যেমন সমৃদ্ধ হয়েছেন, তেমনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের চিত্রকলাকে। সাম্প্রতিক সময়ে স্যারের সঙ্গে কোথাও দেখা হলেই বলতাম, আপনার জন্ম যদি ইউরোপ বা আমেরিকাতে হতো তাহলে আপনার নামে একাধিক আর্ট
মিউজিয়াম থাকত, কেবল আপনার নিজস্ব শিল্পশৈলীর কারণেই। তিনি শুনে লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসতেন।
সত্যিকার অর্থেই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পশৈলী এতটাই দেশজ ও মৌলিক যে, তার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তিনি অতুলনীয়।
সম্প্রতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউদার্ন এশিয়া অ্যাট শিকাগো আয়োজিত আমার শিল্প-বক্তৃতায় বিশেষভাবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলার মৌলিকতা ও নিজস্বতা নিয়ে আলোচনা করেছি। ওখানকার শিল্পালোচক ও অধ্যাপকেরা আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। কাইয়ুম স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ২০০২ সালে নরওয়েজিয়ান অ্যাম্বেসির সহযোগিতায় সোসাইটি ফর প্রমোশন অব বাংলাদেশ আর্ট (এসপিবিএ) BANGLADESH ART : a collection of contemporary art নামে বাংলাদেশের চিত্রকলার ওপর একটি শিল্পগ্রন্থ প্রকাশ করে। সেই প্রকাশনায় আমাকে নিয়ে তিনি দুই বছর রাতদিন কাজ করেছেন। তখন তাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল। তিনি দেশকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। এমন নিখাদ দেশপ্রেমিককে আজ স্মরণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠছে।
মনে পড়ে, ২০০৩ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছি শুনে কী যে খুশি হলেন তিনি! মনে হল পুরস্কারটি তিনি নিজেই পেয়েছেন। কতজনকে যে বললেন... প্যারিস যাওয়ার আগের রাতে নিজে হাতে লিখে দিলেন কী কী করতে হবে, কী কী নিতে হবে, কোন্ কোন্ মিউজিয়াম দেখতে হবে... যেন নিজের সন্তানকে বিদেশ পাঠাচ্ছেন। আর ওনার কাছে থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বললেন, রঁদ্যা মিউজিয়ামে যাবেই। মিউজিয়ামের বাগানে বসে বন্ধুর সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে ভুলো না.. ভোর রাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। তাড়াহুড়া করছি। আজিমপুরের তার শেখ সাহেব বাজারের বাসা থেকে বেরিয়ে নিউমার্কেট অবধি চলে এসেছি। স্যারের ফোন পেলাম, তুমি যাচ্ছ পুরস্কার আনতে... এটার কোনো নিউজ হবে না? তুমি এক কাজ কর, শুধু তোমার ছবিটি দিয়ে পাঠিয়ে দিও... আমি ব্যবস্থা করব। এই হলেন শিক্ষক, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
পরশু রাতে বাংলাদেশের মহৎপ্রাণ শিল্পের এই বিরাট মানুষটির মঞ্চে পড়ে যাওয়ার কথা আমার এক বন্ধু জানিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই। বললেন, ...মঞ্চে একটু আগে বক্তব্য শেষ করে বসেছিলেন তিনি। এরপর কথা বলতে দাঁড়ালেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কিন্তু কাইয়ুম স্যার আবার উঠে এসে বললেন, একটি কথা বলতে আমি ভুলে গেছি... আর, তারপরই পড়ে গেলেন..
সবারই প্রার্থনা ছিল, কথাটি বলার জন্য ফিরে আসুন তিনি।
আর ফিরলেন না, চলে গেলেন চির স্তব্ধতায়। তিনি সবার জন্যই অন্তপ্রাণ ছিলেন। কখনও কাউকে দূরে সরিয়ে দেননি। আজ তিনি নিজেই এত দূরে চলে গেলেন কী করে? বিদায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বিদায় বন্ধুসম প্রিয় শিক্ষক।
রফি হক : চিত্রশিল্পী; সম্পাদক, শিল্পপ্রভা
কিন্তু যেটুকু পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তাতেই টিকে গেলাম। আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হলেন আমার শিক্ষক। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। আমি ছিলাম প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টে। শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ এবং কিবরিয়ার ছাত্র। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসতেন আড্ডা দিতে কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে। মোহাম্মদ কিবরিয়া তারও শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তারা পরস্পরের অসামান্য বন্ধু ছিলেন। কিবরিয়া স্যার মৃত্যুশয্যায় তার বন্ধু-সহকর্মী কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিবরিয়া স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে প্রথম যে শিল্পী হাসপাতালে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন, তিনি কাইয়ুম চৌধুরী।
এ বছরের মার্চে যখন আমি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিটিং স্কলার হিসেবে গেছি, তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, যেখানেই যাবে বাংলাদেশের প্রকৃতিকে মনে রাখবে। বাংলাদেশের নদী, নৌকা, জল-হাওয়া, লোকজ মোটিফস বুকে ধারণ করবে। সেটাই হবে দেশকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায়। আর ওখানকার মিউজিয়ামগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখবে কিন্তু...
কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম যেমন সরল, নির্মল সুন্দর বাংলাদেশের কথা বলে; তিনি ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন তেমনই সরল, নির্মল আর সাদাসিধে। সমকালীন শিল্পকলার প্রবল দ্বিধার ভেতরেও তিনি তার ক্যানভাসে নিজস্ব ভাষা প্রকাশে ছিলেন অবিচল, দৃঢ়। সেখানে তার প্রকাশভঙ্গি ছিল পুরোপুরি লোকজ। নিজের শেকড়ের বাইরে তিনি কখনোই যাননি। দেশের প্রতি তার প্রবল মমতামাখানো ভালোবাসাকে আলিঙ্গন করে শিল্পী হিসেবে তিনি নিজে যেমন সমৃদ্ধ হয়েছেন, তেমনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের চিত্রকলাকে। সাম্প্রতিক সময়ে স্যারের সঙ্গে কোথাও দেখা হলেই বলতাম, আপনার জন্ম যদি ইউরোপ বা আমেরিকাতে হতো তাহলে আপনার নামে একাধিক আর্ট
মিউজিয়াম থাকত, কেবল আপনার নিজস্ব শিল্পশৈলীর কারণেই। তিনি শুনে লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসতেন।
সত্যিকার অর্থেই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পশৈলী এতটাই দেশজ ও মৌলিক যে, তার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। তিনি অতুলনীয়।
সম্প্রতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউদার্ন এশিয়া অ্যাট শিকাগো আয়োজিত আমার শিল্প-বক্তৃতায় বিশেষভাবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলার মৌলিকতা ও নিজস্বতা নিয়ে আলোচনা করেছি। ওখানকার শিল্পালোচক ও অধ্যাপকেরা আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। কাইয়ুম স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ২০০২ সালে নরওয়েজিয়ান অ্যাম্বেসির সহযোগিতায় সোসাইটি ফর প্রমোশন অব বাংলাদেশ আর্ট (এসপিবিএ) BANGLADESH ART : a collection of contemporary art নামে বাংলাদেশের চিত্রকলার ওপর একটি শিল্পগ্রন্থ প্রকাশ করে। সেই প্রকাশনায় আমাকে নিয়ে তিনি দুই বছর রাতদিন কাজ করেছেন। তখন তাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল। তিনি দেশকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। এমন নিখাদ দেশপ্রেমিককে আজ স্মরণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠছে।
মনে পড়ে, ২০০৩ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছি শুনে কী যে খুশি হলেন তিনি! মনে হল পুরস্কারটি তিনি নিজেই পেয়েছেন। কতজনকে যে বললেন... প্যারিস যাওয়ার আগের রাতে নিজে হাতে লিখে দিলেন কী কী করতে হবে, কী কী নিতে হবে, কোন্ কোন্ মিউজিয়াম দেখতে হবে... যেন নিজের সন্তানকে বিদেশ পাঠাচ্ছেন। আর ওনার কাছে থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বললেন, রঁদ্যা মিউজিয়ামে যাবেই। মিউজিয়ামের বাগানে বসে বন্ধুর সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে ভুলো না.. ভোর রাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। তাড়াহুড়া করছি। আজিমপুরের তার শেখ সাহেব বাজারের বাসা থেকে বেরিয়ে নিউমার্কেট অবধি চলে এসেছি। স্যারের ফোন পেলাম, তুমি যাচ্ছ পুরস্কার আনতে... এটার কোনো নিউজ হবে না? তুমি এক কাজ কর, শুধু তোমার ছবিটি দিয়ে পাঠিয়ে দিও... আমি ব্যবস্থা করব। এই হলেন শিক্ষক, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
পরশু রাতে বাংলাদেশের মহৎপ্রাণ শিল্পের এই বিরাট মানুষটির মঞ্চে পড়ে যাওয়ার কথা আমার এক বন্ধু জানিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই। বললেন, ...মঞ্চে একটু আগে বক্তব্য শেষ করে বসেছিলেন তিনি। এরপর কথা বলতে দাঁড়ালেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কিন্তু কাইয়ুম স্যার আবার উঠে এসে বললেন, একটি কথা বলতে আমি ভুলে গেছি... আর, তারপরই পড়ে গেলেন..
সবারই প্রার্থনা ছিল, কথাটি বলার জন্য ফিরে আসুন তিনি।
আর ফিরলেন না, চলে গেলেন চির স্তব্ধতায়। তিনি সবার জন্যই অন্তপ্রাণ ছিলেন। কখনও কাউকে দূরে সরিয়ে দেননি। আজ তিনি নিজেই এত দূরে চলে গেলেন কী করে? বিদায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বিদায় বন্ধুসম প্রিয় শিক্ষক।
রফি হক : চিত্রশিল্পী; সম্পাদক, শিল্পপ্রভা
No comments