কূটনৈতিক পল্লীতে বিস্ময়
গ্রামীণ
ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের অবনতি ঘটার পর
দীর্ঘদিন স্থিতাবস্থা বিরাজ করছিল। তবে দু’দেশের সম্পর্কের আগের
টানাপড়েনের চেয়ে এবারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের কটূক্তির
উদ্দেশ্য নিয়ে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গুলশান-বারিধারার কূটনৈতিক পল্লী
বিস্মিত। কারণ, দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলেও কাদা ছোড়াছুড়ি বা এতটা
নিম্নমানের কটূক্তির দরকার পড়ে না। ফিদেল কাস্ত্রো, হুগো শ্যাভেজ, গাদ্দাফি
কিংবা সাদ্দাম হোসেন কট্টর আমেরিকা বিরোধী হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত।
অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের অনেকে বলেছেন, কিন্তু তারা কখনও ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’
ধরনের উক্তি করেননি। এর কোন দরকার পড়েনি। কারণ, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা
বিশ্বের সব সমাজে অগ্রহণযোগ্য একটি বিষয়।
প্রফেসর ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকা না থাকা নিয়ে জাতি বিভক্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগও কিছুটা বিভক্ত ছিল। কিন্তু এবারে কি এমন ঘটলো, যে কারণে আওয়ামী লীগকে এ রকম কঠিন অবস্থান নিতে হলো- সেই প্রশ্ন সর্বত্রই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে এবারের বিষয়টি নিরঙ্কুশভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন। যে কোন রাষ্ট্র দরকার হলে যুক্তরাষ্ট্রে তার পোশাক রপ্তানি বন্ধ বা তাকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিংবা আরও কোন চরম পথ অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভিয়েনা কনভেনশনের বরখেলাপ করতে পারে না। একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত, যিনি তার দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং সার্বভৌমের মুখপাত্র তাকে এতটা নির্দয়তায় বিশেষ করে নিজের মর্যাদা খাটো করে অপমান করতে হবে কেন? বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও। এ অবস্থান কি সুচিন্তিত? তারা যুক্তি দিচ্ছেন, আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অসেনৌজন্যমূলক আচরণ করার বিষয়টি ঢাকায় অবস্থানরত কূটনৈতিক কোরকেও বিচলিত করতে পারে। এ কূটনৈতিক কোরের একজন ডিন রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, কাজের মেয়ে মর্জিনার বিষয়টি কূটনৈতিক কোরের নিয়মিত বৈঠকে উঠতে পারে।
উল্লেখ্য, সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে তাঁর বাসার ‘কাজের বুয়া মর্জিনা’র সঙ্গে তুলনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উপহাস করেন। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা না করার’ বিদেশনীতি অনুসরণ করতে বাধ্য। তাই কোন একটি দেশকে বৈরী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা বাংলাদেশ সংবিধান সমর্থন করে না। তবে বিশ্লেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, যে বিষয়টি অনেকেরই নজর এড়িয়ে যাচ্ছে সেটি হলো সৈয়দ আশরাফ নিজের অবচেতনে হলেও ‘কাজের বুয়াদের’ খাটো করেছেন। কাজের বুয়া একটি মানবিক সেবাধর্মী পেশা। বাংলাদেশ রেমিট্যান্স নিয়ে বড়াই করে। কাজের বুয়াদের অবদান সেখানে কম নয়। তাছাড়া একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি সমাজের কোন অনগ্রসর অংশকে আহত করতে একেবারেই পারেন না।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যায়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক এ দূরত্ব কমানোর কার্যকর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য এ দূরত্ব কমাতে মোটেও সহায়ক হবে না।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত যে, ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে কেবল দ্বিপক্ষীয় ফ্রেমে দেখার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশ বলছে- তারা এখন পূর্বমুখী কূটনীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু চীন ছাড়া পূর্বের প্রায় সব দেশের বিদেশনীতি মার্কিন নীতির সঙ্গে কোন না কোনভাবে বাধা। অনেকে পরিহাস করে বলছেন- চীন, জাপান ও ভারতের সঙ্গে দৃশ্যমান ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করার পর আওয়ামী লীগ যদি মনে করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রকে আর গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই তাহলে সেটা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। অনেকের মতে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে হালকা করে দেখা কিংবা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেই অবশ্য আওয়ামী লীগ দলগতভাবে প্রচ- ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এর আগে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে ঢাকায় ড্যান মজিনার উত্তরসূরি মার্কিন নারী রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের পর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একই ভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তা-ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারসম্মত কিনা সেটাও ছিল এক প্রশ্ন।
এটা লক্ষণীয়, ড্যান মজিনা কিছুদিন আগে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখলে ক্ষমতাসীন মহলকে সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। গত ২৭শে নভেম্বর তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। ২৮শে নভেম্বর তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গেও তিনি একই দিনে সাক্ষাৎ করেন। ওই দুই ‘রুটিন’ সাক্ষাৎকালে মার্কিন মন্ত্রী পরবর্তী নির্বাচন কবে হতে পারে সে বিষয়ে জানতে চান। ২৯শে নভেম্বর ঢাকা ছাড়ার আগে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চায় এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাবে।’
ওই একই দিন প্রায় একই সময়ে খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উপহাস করেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা মন্ত্রী, চার আনাও না, এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই।’ তিনি এসময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে কাজের মেয়ে মর্জিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করতে পারে।’ অনেকের মতে ‘ওই অবস্থার’ কথা ইঙ্গিত করে সৈয়দ আশরাফ ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তন নাকি এর পরের কোন পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তা স্পষ্ট নয়। উইকিলিকস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এক-এগারোতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। কথা বলেছেন।
অনেকের মতে নিশা দেশাইয়ের সফর সম্পর্কে সরকার হয়তো ভিন্ন কোন বার্তা পেয়ে থাকবেন। কারণ, সরকারি মহল মনে করে, বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিংয়ের অংশ হিসেবে তিনি ঢাকায় আসেন। তাই প্রধানমন্ত্রী তাকে সাক্ষাৎ দেননি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিশা দেশাইয়ের সাক্ষাৎকে সরকার ভালভাবে নেয়নি। কারণ, তিনি সরকারি মহলের বিবেচনায় এখন আর বিরোধীদলীয় নেতা নন। পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে নিশা দেশাইয়ের মন্তব্যেও সরকারে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শুভাকাঙক্ষীরা মনে করেন, বিএনপি আদৌ লবিং করে আনলে তাকে পাল্টা লবিং করে ঠেকাতে হবে। লবিংয়ের উত্তর লবিং। প্রকাশ্য বৈরিতা কোন উপযুক্ত উত্তর নয়। এর আগে সরকারের চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর মন্তব্যের উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের হতাশা বাংলাদেশকে জানিয়েছিল।
উল্লেখ্য, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশ। এশিয়ায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র’ বিবেচনা করে। সে কারণে শেখ হাসিনাই এর আগে একটি চুক্তি করেছেন। গত মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত দু’দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে অংশীদারত্বের সংলাপেও উভয় পক্ষই পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার সংকল্প ব্যক্ত করে।
২০১৫ সালের গোড়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর ওয়াশিংটন সফর প্রায় ঠিক ছিল। এখন এ সফর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে কিনা সেটাও প্রশ্ন। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে যে কোন মন্তব্যকেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনজরে দেখবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কোন পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। ফলে নির্বাচন বিষয়ক যে কোন ইঙ্গিত তাদের গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের আমেরিকাকে প্রয়োজন নেই। আমি আজই (গত মঙ্গলবার) পড়ছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি না করে আমেরিকার কোন উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমেরিকা তৈরী পোশাকের সঙ্কটে পড়বে। তার এ কথার অর্থ সম্ভবত এই যে আমেরিকাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকেই। বলাই বাহুল্য, এ রকম ধারণা হাস্যকর। দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এই নীতি অনুসরণের ফল ভয়াবহ হবে। তবে চলতি সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সম্ভবত একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশকে জানান দিতে চায় যে চীন তাদের হাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাস।’
উল্লেখ্য, এর আগে মাইলাম তার একাধিক নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশ ক্রমশ কার্যত একদলীয় সরকার ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে।’ ওবামা সরকার যে বাংলাদেশের চলতি ‘একতান্ত্রিক লক্ষণের’ বিরুদ্ধে কোন কঠোর অবস্থান নেয়নি, তাতে মাইলাম তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
প্রফেসর ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকা না থাকা নিয়ে জাতি বিভক্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগও কিছুটা বিভক্ত ছিল। কিন্তু এবারে কি এমন ঘটলো, যে কারণে আওয়ামী লীগকে এ রকম কঠিন অবস্থান নিতে হলো- সেই প্রশ্ন সর্বত্রই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে এবারের বিষয়টি নিরঙ্কুশভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন। যে কোন রাষ্ট্র দরকার হলে যুক্তরাষ্ট্রে তার পোশাক রপ্তানি বন্ধ বা তাকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিংবা আরও কোন চরম পথ অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভিয়েনা কনভেনশনের বরখেলাপ করতে পারে না। একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত, যিনি তার দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং সার্বভৌমের মুখপাত্র তাকে এতটা নির্দয়তায় বিশেষ করে নিজের মর্যাদা খাটো করে অপমান করতে হবে কেন? বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও। এ অবস্থান কি সুচিন্তিত? তারা যুক্তি দিচ্ছেন, আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অসেনৌজন্যমূলক আচরণ করার বিষয়টি ঢাকায় অবস্থানরত কূটনৈতিক কোরকেও বিচলিত করতে পারে। এ কূটনৈতিক কোরের একজন ডিন রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, কাজের মেয়ে মর্জিনার বিষয়টি কূটনৈতিক কোরের নিয়মিত বৈঠকে উঠতে পারে।
উল্লেখ্য, সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে তাঁর বাসার ‘কাজের বুয়া মর্জিনা’র সঙ্গে তুলনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উপহাস করেন। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা না করার’ বিদেশনীতি অনুসরণ করতে বাধ্য। তাই কোন একটি দেশকে বৈরী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা বাংলাদেশ সংবিধান সমর্থন করে না। তবে বিশ্লেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, যে বিষয়টি অনেকেরই নজর এড়িয়ে যাচ্ছে সেটি হলো সৈয়দ আশরাফ নিজের অবচেতনে হলেও ‘কাজের বুয়াদের’ খাটো করেছেন। কাজের বুয়া একটি মানবিক সেবাধর্মী পেশা। বাংলাদেশ রেমিট্যান্স নিয়ে বড়াই করে। কাজের বুয়াদের অবদান সেখানে কম নয়। তাছাড়া একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি সমাজের কোন অনগ্রসর অংশকে আহত করতে একেবারেই পারেন না।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যায়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক এ দূরত্ব কমানোর কার্যকর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য এ দূরত্ব কমাতে মোটেও সহায়ক হবে না।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত যে, ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে কেবল দ্বিপক্ষীয় ফ্রেমে দেখার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশ বলছে- তারা এখন পূর্বমুখী কূটনীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু চীন ছাড়া পূর্বের প্রায় সব দেশের বিদেশনীতি মার্কিন নীতির সঙ্গে কোন না কোনভাবে বাধা। অনেকে পরিহাস করে বলছেন- চীন, জাপান ও ভারতের সঙ্গে দৃশ্যমান ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করার পর আওয়ামী লীগ যদি মনে করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রকে আর গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই তাহলে সেটা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। অনেকের মতে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে হালকা করে দেখা কিংবা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেই অবশ্য আওয়ামী লীগ দলগতভাবে প্রচ- ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এর আগে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে ঢাকায় ড্যান মজিনার উত্তরসূরি মার্কিন নারী রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের পর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একই ভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তা-ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারসম্মত কিনা সেটাও ছিল এক প্রশ্ন।
এটা লক্ষণীয়, ড্যান মজিনা কিছুদিন আগে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখলে ক্ষমতাসীন মহলকে সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। গত ২৭শে নভেম্বর তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। ২৮শে নভেম্বর তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গেও তিনি একই দিনে সাক্ষাৎ করেন। ওই দুই ‘রুটিন’ সাক্ষাৎকালে মার্কিন মন্ত্রী পরবর্তী নির্বাচন কবে হতে পারে সে বিষয়ে জানতে চান। ২৯শে নভেম্বর ঢাকা ছাড়ার আগে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চায় এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাবে।’
ওই একই দিন প্রায় একই সময়ে খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উপহাস করেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা মন্ত্রী, চার আনাও না, এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই।’ তিনি এসময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নাই যে কাজের মেয়ে মর্জিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করতে পারে।’ অনেকের মতে ‘ওই অবস্থার’ কথা ইঙ্গিত করে সৈয়দ আশরাফ ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তন নাকি এর পরের কোন পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তা স্পষ্ট নয়। উইকিলিকস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এক-এগারোতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। কথা বলেছেন।
অনেকের মতে নিশা দেশাইয়ের সফর সম্পর্কে সরকার হয়তো ভিন্ন কোন বার্তা পেয়ে থাকবেন। কারণ, সরকারি মহল মনে করে, বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিংয়ের অংশ হিসেবে তিনি ঢাকায় আসেন। তাই প্রধানমন্ত্রী তাকে সাক্ষাৎ দেননি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিশা দেশাইয়ের সাক্ষাৎকে সরকার ভালভাবে নেয়নি। কারণ, তিনি সরকারি মহলের বিবেচনায় এখন আর বিরোধীদলীয় নেতা নন। পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে নিশা দেশাইয়ের মন্তব্যেও সরকারে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শুভাকাঙক্ষীরা মনে করেন, বিএনপি আদৌ লবিং করে আনলে তাকে পাল্টা লবিং করে ঠেকাতে হবে। লবিংয়ের উত্তর লবিং। প্রকাশ্য বৈরিতা কোন উপযুক্ত উত্তর নয়। এর আগে সরকারের চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর মন্তব্যের উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের হতাশা বাংলাদেশকে জানিয়েছিল।
উল্লেখ্য, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশ। এশিয়ায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র’ বিবেচনা করে। সে কারণে শেখ হাসিনাই এর আগে একটি চুক্তি করেছেন। গত মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত দু’দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে অংশীদারত্বের সংলাপেও উভয় পক্ষই পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার সংকল্প ব্যক্ত করে।
২০১৫ সালের গোড়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর ওয়াশিংটন সফর প্রায় ঠিক ছিল। এখন এ সফর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে কিনা সেটাও প্রশ্ন। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে যে কোন মন্তব্যকেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুনজরে দেখবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কোন পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। ফলে নির্বাচন বিষয়ক যে কোন ইঙ্গিত তাদের গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ মনে করে, তাদের আমেরিকাকে প্রয়োজন নেই। আমি আজই (গত মঙ্গলবার) পড়ছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি না করে আমেরিকার কোন উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে আমেরিকা তৈরী পোশাকের সঙ্কটে পড়বে। তার এ কথার অর্থ সম্ভবত এই যে আমেরিকাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার প্রয়োজন বাংলাদেশকেই। বলাই বাহুল্য, এ রকম ধারণা হাস্যকর। দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে এই নীতি অনুসরণের ফল ভয়াবহ হবে। তবে চলতি সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কথা ভাবছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সম্ভবত একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশকে জানান দিতে চায় যে চীন তাদের হাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাস।’
উল্লেখ্য, এর আগে মাইলাম তার একাধিক নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশ ক্রমশ কার্যত একদলীয় সরকার ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে।’ ওবামা সরকার যে বাংলাদেশের চলতি ‘একতান্ত্রিক লক্ষণের’ বিরুদ্ধে কোন কঠোর অবস্থান নেয়নি, তাতে মাইলাম তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
No comments