লোকশিল্প আমাকে শিল্পী করেছে... by ড. মুস্তফা মজিদ
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর যেদিন সত্তরে পা রেখেছিলেন সেদিন তার কবিতার মতো ধীর উচ্চারণ আমার মন ছুঁয়েছিল। তিনি বলেছিলেন :
“...দেশের ঘোর কৃষ্ণ সময়ে প্রত্যেক শিল্পীর কিছু না কিছু সামাজিক দায় আছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশকে ভালোবাসা যায়। সবুজ-শ্যামল প্রান্তর; দিগন্তে ফসলের মাঠ; বিস্তীর্ণ ভূমির ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদী; নদীর বুক ফুঁড়ে ভেসে যাওয়া গহনা নৌকা; নদী পাড় ঘেঁষে স্নানশেষে পল্লীবধূদের ঘরে ফেরা এসবকিছুই প্রকৃতির অনুষঙ্গ। প্রকৃতিকে গভীর মমতায় ভালোবাসলে দেশকে প্রকৃতই ভালোবাসা যায়...”
৯ মার্চ ২০০৪ সালে তিনি সত্তরে পা রেখেছিলেন। সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয় আয়োজন করেছিল তার একক চিত্রকলা প্রদর্শনী। আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি পাঁচশ বছর বাঁচুন স্যার...। সেই পরিভ্রমণে ৩০ নভেম্বর ২০১৪-তে এসে প্রায় ৮২ বছর বয়সে চির স্তব্ধতাকে আলিঙ্গন করলেন।
আমি কাইয়ুম স্যারের সরাসরি ছাত্র না হলেও তিনি আমার শিক্ষক, আমাদের অনেকের শিক্ষক। তিনি আমার প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন, ছেলেবেলাকার স্বপ্নের মানুষ ছিলেন এই কথাটির সূত্র ধরে উৎসের পেছনে ফিরে তাকাব। ধান ভানতে শিবের গীতের তে শোনাবে হয়তো।
আমার মনে হয়, জীবনের অনেক হারানো সূত্রেরই খেই মেলে কথার উৎসে। আমার তখন তের/চৌদ্দ বয়স। কিছুদিন আগে বাবা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আমি ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে থেমে আছি। থেমে গেছে আমার পৃথিবী। বিশ্বাস হতে চায় না বাবা নেই। রোজ ভোরে কবরস্থানে গিয়ে বাবার কবরের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। যদি তিনি দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে ওঠেন! এরপর নিজেই একদিন অনুভব করলাম আমার আচরণ স্বাভাবিক নয়। আমি বিষাদগ্রস্ত। এর থেকে মুক্তির উপায় আমার জানা নেই।
এ সময় আমার প্রতিদিনের ভাবনাগুলো ডায়েরিতে লিখতে শুরু করি। প্রতিদিন এক বা দুই পৃষ্ঠা লিখি আর ফাঁকা জায়গায় ছবি আঁকি। সেও এক নেশার মতো। অনেক শিল্পীরই বাল্যকাল থেকে ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক দেখা যায়। আমার ছিল না। তবে বই পড়তাম খুব। হাতের কাছে যা পেতাম পড়ে ফেলতাম। আমার ছবি আঁকার প্রতিভা ডায়েরির পৃষ্ঠাতেই আবদ্ধ ছিল। পরে সেটা উসকে দিয়েছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। কীভাবে, সে কথায় পরে আসছি।
রাজধানী ঢাকার অগাধ জলে এসে পৌঁছলাম একদিন। উদ্দেশ্য আর্ট কলেজে ভর্তি হব। সেটা ৮২ সালের মাঝামঝি সময়। আর্ট কলেজে যে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় এটা জানতাম না। প্রস্তুতি নেই। এখনকার মতো কোচিংয়ের ব্যবস্থাও ছিল না।
আমাদের পরিবারের তখন খুব দুরাবস্থা। এটা ৭৪ সালের কথা। আমার মা সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার নানা উপায় খুঁজতে লাগলেন। এর একটা উপায় হল বই খাতা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে ঠোঙা বানানো। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকার সঙ্গে পরিচয় তখনকার কোনো একদিন। আমি মুগ্ধ হয়ে ঠোঙা বানানোর ম্যাগাজিনে তাঁর আঁকা দেখতাম। আমার খুব ঘোর লাগত, অনুপ্রাণিত হতাম। তার আঁকা কপি করতে চেষ্টা করতাম কাঁচা হাতে। ওই অদৃশ্য ইন্সপিরিশন না পেলে আমি আজ ছবি আঁকতাম না, হয়তো অন্য কোনো পেশা হতো আমার। কিন্তু কাইয়ুম স্যারকে সামনা-সামনি প্রথম দেখেছি ৮২ সালে, আর্ট কলেজে ভর্তি হতে এসে।
মানুষের জীবন খুব আশ্চর্য, বহমান নদীর মতন। হিসাব করে কখনও কিছু হওয়া যায় না। কাইয়ুম স্যারও এমন কথা বলেছেন: একেকজনের একেক রকমের ইন্সপিরিশন থাকে। না হলে জগতে এত পেশা থাকতে কেনোই বা ছবি আঁকাকে পেশা হিসেবে বেছে নেব...? তবে ছবি আঁকার বিষয়টি মন থেকে একান্ত অনুভব প্রকাশের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। ছোটবেলায় পাঠ্য-পুস্তকের ভেতর আঁকিবুকি দেখে মনের ভেতর কেমন একটা ঘোর লাগত। ভাবতাম, আমিও যদি শিল্পী হতে পারতাম! সেখানে অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ভালো লাগত।
সন্দেশের সমর দে, পূর্নচন্দ্র চক্রবর্তীর আঁকাও টানত। আর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী...! কি অনন্য একজন মানুষ। ছেলেবেলায় পড়া ফাঁকি দিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আঁকা নকল করেছি...
দেশের প্রতি প্রগাঢ় মমতামাখানো নিখাদ ভালোবাসা ছিল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর। তিনি ছিলেন দেশ অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ।
তার পেন্টিংয়ের মোটিফস, উপাদান, অনুষঙ্গ এ সবের পুরোটাই যেন লোকশিল্পের আঁধার। এ দেশের লোকশিল্পের রং ও মোটিফসগুলো এমনভাবে সমকালীন আধুনিক একটা রূপ দিয়েছেন যা এক কথায় অপূর্ব ও তুলনাহীন। লোকজ মোটিফ নিয়ে আমাদের আরেক অগ্রগণ্য শিল্পী কামরুল হাসানও কাজ করেছেন। কিন্তু সেখানে পাশ্চাত্যের নানা ধারার সম্মিলন ঘটেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর বেলায় তা ঘটেনি। এসব বড় পরিসরে বড় ভাবনা ক্যানভাসের কথা। আমি বিশ্বাস করি এগুলো নিয়ে আলাদা করে লিখবেন, যারা গবেষণা করবেন তার কাজের ওপর।
লোকশিল্প নিয়ে তিনি বলেছেন : আমাদের লোকশিল্প রঙয়ের আঁধার। পৃথিবীতে যত রং আছে আমি মনে করি তারও চেয়ে বেশি রং আমাদের লোকশিল্পের উপাদানে রয়েছে। বাংলার লোকশিল্প আমাকে শিল্পী করেছে...
আমি গ্রামীণ শিল্পীদের ভাবটিকে, ঘরানাটিকে পর্যবেক্ষণ করি। এবং আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ওদের কাজে রং ব্যবহারের সরলতা, ফর্ম ব্যবহারের নিপুণতায় আমি অবাক হই। যেমন শখের হাঁড়ি, হাতে টেপা মাটির পুতুল... কী অপূর্ব সরল ব্যঞ্জনা! জয়নুল আবেদিন স্যার সবসময় গ্রামীণ শিল্পীদের পরিমিতিবোধ ও সেন্স অব প্রোপরশনের কথা বলতেন। আবেদিন স্যার আমার ভেতরে লোকশিল্পের পর্যবেক্ষণটি ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। যা আমার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতেন। অবজারভারে করা নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখ আঁকা একটি ইলাস্ট্রেশন আবেদিন স্যারকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি তার ছাত্র তরুণ কাইয়ুম চৌধুরীকে বলেছিলেন : তুমি এই রকম নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখের ছবি নিয়া কাজ করতে পার। দুইটা নৌকা, চারটা মাছের চোখ। তিনটা নৌকা ছয়টা মাছের চোখ। নৌকাগুলো যখন পানির স্রোতে আগাইয়া যাইব তখন পানির কাঁপনে মাছের চোখও দেখবা কেমন কাঁপব...
কাইয়ুম স্যার বিহ্বল হয়ে শিল্পাচার্যের সে কথা স্মরণ করতেন। তিনি বলেছেন, আবেদিন স্যার অমন কথা না বললে হয়তো আমার জীবনটা অন্য ধারায় চলে যেতে পারত! গুরুজনদের কারও একটি কথায় জীবনের মানে পাল্টে যেতে পারে, জীবনের রুটিন বদলে যেতে পারে। আবেদিন স্যারের ওই কথার পরে আমি কখনোই আর ক্যানভাস ও ইজেল ত্যাগ করিনি..
কাইয়ুম স্যারকে নিয়ে এত কথা বলার আছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সব সামাজিক আন্দোলনে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছেন। তিনি এত ক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। যেমন প্রকাশনা শিল্পের রুচিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদকে পেইন্টিংয়ের মর্যাদায় নিয়ে গেছেন। সাহিত্য সঙ্গীতে তার গভীর মনোযোগ ছিল। লোকগান এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভেতর থেকে জীবনের চিত্রকল্প একান্ত অনুভবে আনতেন। যা তার সৃষ্টিকাজে সহায় হয়েছে বারবার। সেই সঙ্গীতের ভেতরেই নিজেকে বিলীন করে দিলেন আমার শিক্ষক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। মৃত্যুর পর সেই কথাটিই মনে বাজছে।
“...দেশের ঘোর কৃষ্ণ সময়ে প্রত্যেক শিল্পীর কিছু না কিছু সামাজিক দায় আছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশকে ভালোবাসা যায়। সবুজ-শ্যামল প্রান্তর; দিগন্তে ফসলের মাঠ; বিস্তীর্ণ ভূমির ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদী; নদীর বুক ফুঁড়ে ভেসে যাওয়া গহনা নৌকা; নদী পাড় ঘেঁষে স্নানশেষে পল্লীবধূদের ঘরে ফেরা এসবকিছুই প্রকৃতির অনুষঙ্গ। প্রকৃতিকে গভীর মমতায় ভালোবাসলে দেশকে প্রকৃতই ভালোবাসা যায়...”
৯ মার্চ ২০০৪ সালে তিনি সত্তরে পা রেখেছিলেন। সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয় আয়োজন করেছিল তার একক চিত্রকলা প্রদর্শনী। আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি পাঁচশ বছর বাঁচুন স্যার...। সেই পরিভ্রমণে ৩০ নভেম্বর ২০১৪-তে এসে প্রায় ৮২ বছর বয়সে চির স্তব্ধতাকে আলিঙ্গন করলেন।
আমি কাইয়ুম স্যারের সরাসরি ছাত্র না হলেও তিনি আমার শিক্ষক, আমাদের অনেকের শিক্ষক। তিনি আমার প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন, ছেলেবেলাকার স্বপ্নের মানুষ ছিলেন এই কথাটির সূত্র ধরে উৎসের পেছনে ফিরে তাকাব। ধান ভানতে শিবের গীতের তে শোনাবে হয়তো।
আমার মনে হয়, জীবনের অনেক হারানো সূত্রেরই খেই মেলে কথার উৎসে। আমার তখন তের/চৌদ্দ বয়স। কিছুদিন আগে বাবা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আমি ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে থেমে আছি। থেমে গেছে আমার পৃথিবী। বিশ্বাস হতে চায় না বাবা নেই। রোজ ভোরে কবরস্থানে গিয়ে বাবার কবরের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। যদি তিনি দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে ওঠেন! এরপর নিজেই একদিন অনুভব করলাম আমার আচরণ স্বাভাবিক নয়। আমি বিষাদগ্রস্ত। এর থেকে মুক্তির উপায় আমার জানা নেই।
এ সময় আমার প্রতিদিনের ভাবনাগুলো ডায়েরিতে লিখতে শুরু করি। প্রতিদিন এক বা দুই পৃষ্ঠা লিখি আর ফাঁকা জায়গায় ছবি আঁকি। সেও এক নেশার মতো। অনেক শিল্পীরই বাল্যকাল থেকে ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক দেখা যায়। আমার ছিল না। তবে বই পড়তাম খুব। হাতের কাছে যা পেতাম পড়ে ফেলতাম। আমার ছবি আঁকার প্রতিভা ডায়েরির পৃষ্ঠাতেই আবদ্ধ ছিল। পরে সেটা উসকে দিয়েছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। কীভাবে, সে কথায় পরে আসছি।
রাজধানী ঢাকার অগাধ জলে এসে পৌঁছলাম একদিন। উদ্দেশ্য আর্ট কলেজে ভর্তি হব। সেটা ৮২ সালের মাঝামঝি সময়। আর্ট কলেজে যে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় এটা জানতাম না। প্রস্তুতি নেই। এখনকার মতো কোচিংয়ের ব্যবস্থাও ছিল না।
আমাদের পরিবারের তখন খুব দুরাবস্থা। এটা ৭৪ সালের কথা। আমার মা সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার নানা উপায় খুঁজতে লাগলেন। এর একটা উপায় হল বই খাতা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে ঠোঙা বানানো। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকার সঙ্গে পরিচয় তখনকার কোনো একদিন। আমি মুগ্ধ হয়ে ঠোঙা বানানোর ম্যাগাজিনে তাঁর আঁকা দেখতাম। আমার খুব ঘোর লাগত, অনুপ্রাণিত হতাম। তার আঁকা কপি করতে চেষ্টা করতাম কাঁচা হাতে। ওই অদৃশ্য ইন্সপিরিশন না পেলে আমি আজ ছবি আঁকতাম না, হয়তো অন্য কোনো পেশা হতো আমার। কিন্তু কাইয়ুম স্যারকে সামনা-সামনি প্রথম দেখেছি ৮২ সালে, আর্ট কলেজে ভর্তি হতে এসে।
মানুষের জীবন খুব আশ্চর্য, বহমান নদীর মতন। হিসাব করে কখনও কিছু হওয়া যায় না। কাইয়ুম স্যারও এমন কথা বলেছেন: একেকজনের একেক রকমের ইন্সপিরিশন থাকে। না হলে জগতে এত পেশা থাকতে কেনোই বা ছবি আঁকাকে পেশা হিসেবে বেছে নেব...? তবে ছবি আঁকার বিষয়টি মন থেকে একান্ত অনুভব প্রকাশের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। ছোটবেলায় পাঠ্য-পুস্তকের ভেতর আঁকিবুকি দেখে মনের ভেতর কেমন একটা ঘোর লাগত। ভাবতাম, আমিও যদি শিল্পী হতে পারতাম! সেখানে অতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ভালো লাগত।
সন্দেশের সমর দে, পূর্নচন্দ্র চক্রবর্তীর আঁকাও টানত। আর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী...! কি অনন্য একজন মানুষ। ছেলেবেলায় পড়া ফাঁকি দিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আঁকা নকল করেছি...
দেশের প্রতি প্রগাঢ় মমতামাখানো নিখাদ ভালোবাসা ছিল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর। তিনি ছিলেন দেশ অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ।
তার পেন্টিংয়ের মোটিফস, উপাদান, অনুষঙ্গ এ সবের পুরোটাই যেন লোকশিল্পের আঁধার। এ দেশের লোকশিল্পের রং ও মোটিফসগুলো এমনভাবে সমকালীন আধুনিক একটা রূপ দিয়েছেন যা এক কথায় অপূর্ব ও তুলনাহীন। লোকজ মোটিফ নিয়ে আমাদের আরেক অগ্রগণ্য শিল্পী কামরুল হাসানও কাজ করেছেন। কিন্তু সেখানে পাশ্চাত্যের নানা ধারার সম্মিলন ঘটেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর বেলায় তা ঘটেনি। এসব বড় পরিসরে বড় ভাবনা ক্যানভাসের কথা। আমি বিশ্বাস করি এগুলো নিয়ে আলাদা করে লিখবেন, যারা গবেষণা করবেন তার কাজের ওপর।
লোকশিল্প নিয়ে তিনি বলেছেন : আমাদের লোকশিল্প রঙয়ের আঁধার। পৃথিবীতে যত রং আছে আমি মনে করি তারও চেয়ে বেশি রং আমাদের লোকশিল্পের উপাদানে রয়েছে। বাংলার লোকশিল্প আমাকে শিল্পী করেছে...
আমি গ্রামীণ শিল্পীদের ভাবটিকে, ঘরানাটিকে পর্যবেক্ষণ করি। এবং আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ওদের কাজে রং ব্যবহারের সরলতা, ফর্ম ব্যবহারের নিপুণতায় আমি অবাক হই। যেমন শখের হাঁড়ি, হাতে টেপা মাটির পুতুল... কী অপূর্ব সরল ব্যঞ্জনা! জয়নুল আবেদিন স্যার সবসময় গ্রামীণ শিল্পীদের পরিমিতিবোধ ও সেন্স অব প্রোপরশনের কথা বলতেন। আবেদিন স্যার আমার ভেতরে লোকশিল্পের পর্যবেক্ষণটি ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। যা আমার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতেন। অবজারভারে করা নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখ আঁকা একটি ইলাস্ট্রেশন আবেদিন স্যারকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি তার ছাত্র তরুণ কাইয়ুম চৌধুরীকে বলেছিলেন : তুমি এই রকম নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখের ছবি নিয়া কাজ করতে পার। দুইটা নৌকা, চারটা মাছের চোখ। তিনটা নৌকা ছয়টা মাছের চোখ। নৌকাগুলো যখন পানির স্রোতে আগাইয়া যাইব তখন পানির কাঁপনে মাছের চোখও দেখবা কেমন কাঁপব...
কাইয়ুম স্যার বিহ্বল হয়ে শিল্পাচার্যের সে কথা স্মরণ করতেন। তিনি বলেছেন, আবেদিন স্যার অমন কথা না বললে হয়তো আমার জীবনটা অন্য ধারায় চলে যেতে পারত! গুরুজনদের কারও একটি কথায় জীবনের মানে পাল্টে যেতে পারে, জীবনের রুটিন বদলে যেতে পারে। আবেদিন স্যারের ওই কথার পরে আমি কখনোই আর ক্যানভাস ও ইজেল ত্যাগ করিনি..
কাইয়ুম স্যারকে নিয়ে এত কথা বলার আছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সব সামাজিক আন্দোলনে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছেন। তিনি এত ক্ষেত্রে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। যেমন প্রকাশনা শিল্পের রুচিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদকে পেইন্টিংয়ের মর্যাদায় নিয়ে গেছেন। সাহিত্য সঙ্গীতে তার গভীর মনোযোগ ছিল। লোকগান এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভেতর থেকে জীবনের চিত্রকল্প একান্ত অনুভবে আনতেন। যা তার সৃষ্টিকাজে সহায় হয়েছে বারবার। সেই সঙ্গীতের ভেতরেই নিজেকে বিলীন করে দিলেন আমার শিক্ষক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। মৃত্যুর পর সেই কথাটিই মনে বাজছে।
No comments