বাংলাদেশী শ্রমিক না নেয়ার চাপ মালয়েশিয়ায় by মিজানুর রহমান
বাধা
পদে পদে। বাংলাদেশ থেকে যাতে শ্রমিক নেয়া না হয়, সেজন্য মালয়েশিয়ার
নেতৃত্বের ওপর প্রচন্ড রকমের চাপ রয়েছে। দেশটির নির্বাচনী রাজনীতিতেও
‘বাংলাদেশ’-এর নাম যুক্ত হয়ে গেছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে! মালয়েশিয়ার বারিসান
ন্যাশনাল কোয়ালিশনের পক্ষে ভোট বাড়াতে বাংলাদেশ থেকে লোক আমদানি করা হয়-
এমন তকমা জুড়ে দেয়া হয়েছে বিগত নির্বাচন থেকে। নির্বাচন শেষ হয়েছে, কিন্তু
সেই বিরোধিতার রেশ এখনও কাটেনি। বরং দিনে দিনে এর নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।
অতি সমপ্রতি মালয়েশিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস অনেকটা ঘোষণা দিয়ে ‘বাংলাদেশী
শ্রমিক’ আমদানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সংগঠনটির তরফে কিছু মৌলিক বিষয়কে
যুক্তি হিসেবে সামনে এনে বিরোধিতার পক্ষে বৃহৎ জনমত গড়ার চেষ্টা চলছে।
চারদিকে যখন এত নেতিবাচক প্রচারণা, এত দুঃসংবাদ! ঠিক সেই সময়ে একটি সুখবরের
আশায় ছিলেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বিশেষ করে শ্রম সংশ্লিষ্টরা।
একটি হাইপ্রোফাইল সফরকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল সেই প্রত্যাশা। দীর্ঘ এক যুগ পর
পুরোপুরি দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুলালামপুর
যাচ্ছেন, তা-ও মালয়েশিয়ান সরকার প্রধানের ঢাকা সফরের ‘ফিরতি সফর’ হিসেবে।
দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ মিশন, হাইকমিশনের পদস্থ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশী
কমিউনিটির সরকার সমর্থক নেতৃবৃন্দের ব্যস্ততা ও কথাবার্তায় ব্যাপক হতাশার
মধ্যেও একটু আশার আলো খোঁজে পান বাংলাদেশীরা। যদিও প্রধানমন্ত্রীর
মালয়েশিয়া সফর শুরুর আগে থেকেই মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নিয়ে জটিলতাসহ
সম্ভাবনাময় ওই শ্রম বাজারের বিষয়ে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারের
অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির অনেক ঘাটতি ছিল। তারপরও বাংলাদেশের সরকার প্রধানের
ওই সফর থেকে একটি সুখবর পাওয়ার আশা করেছিলেন প্রবাসীরা। ২রা ডিসেম্বর
প্রধানমন্ত্রী কুয়ালালামপুর পৌঁছার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রবাসী
বাংলাদেশীদের তরফে তাকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা জানানো হয়। আয়োজক মালয়েশিয়া
আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠন। আমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কয়েক
শ’ শ্রমিকও যোগ দেন সেই অনুষ্ঠানে। স্থানীয় সময় সাড়ে ৬টায় এটি শুরুর কথা
আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ থাকলেও তারা আগেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছতে শুরু করেন।
যদিও নির্ধারিত সময়ের অনেক পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াত
সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে
শ্রম বাজারের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ তোলেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী
ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। পরিস্থিতির উত্তরণে শেখ হাসিনা সরকারের
সাফল্যের বিস্তারিত তুলে ধরে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন মন্ত্রী। পরে
প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তৃতায় বিএনপি-জামায়াত আমলের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি
তুলে ধরেন। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে শ্রমিকদের অধিকার সমুন্নত রাখার
অঙ্গীকারও করেন তিনি। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকারি পর্যায়ে (জি-টু-জি)
যে চুক্তি হয়েছে তা নিয়ে অনেকে নাখোশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তার
বক্তব্যে এ বিষয়ে সরকারের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট করেন। একই সঙ্গে তার সফরের
মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোসহ সার্বিক সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার
প্রত্যাশা করেন। ওই অনুষ্ঠানের পরদিন মালয়েশিয়া প্রধানমন্ত্রী নজিব রাজাকের
সঙ্গে শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হয়েছে।
চারটি বিষয়ে চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা হয়েছে। সম্পাদিত প্রটোকলের আওতায়
দেশটির সারাওয়াক প্রদেশে ১২ হাজার বাংলাদেশীর কাজের সুযোগ তৈরি হবে বলে
কর্মকর্তাদের তরফে জানানো হয়েছে। দেশটিতে এখনও প্রায় ২ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী
রয়েছেন। যারা বৈধভাবে গিয়ে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন, বা গেছেনই অবৈধ
পথে। তাদের বৈধতার বিষয়- মালয়েশিয়া সরকার প্রধানের কাছে তুলেছিলেন
প্রধানমন্ত্রী। নানা সূত্রের খবর নাজিব রাজাক নাকি এতে খানিকটা উদ্বেগ
প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বিষয়টি ‘দেখা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে সরকারের
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাকি চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে কূটনীতিক
ও অফিসিয়ালদের ভিসা প্রক্রিয়া শিথিল এবং পর্যটন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে
সহযোগিতার বাড়ানোর বিষয়টি। কুয়ালালামপুর বা গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতেই
বাংলাদেশীদের বসবাস। দেশটিতে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন সিলেটের
গোলাপগঞ্জের হেতিমগঞ্জের আবদুল কুদ্দুস। তিনি সেখানে বিয়ে করে পরিবার-পরিজন
নিয়ে বসবাস করেন। প্রধানমন্ত্রী যখন কুয়ালালামপুরে (৩রা ডিসেম্বর
সন্ধ্যায়) তখন শহরের পুডো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তার দোকানে বসে কথা হয় এই
প্রতিবেদকের। আগ্রহ নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা ফল জানতে চান। বিশেষ
করে শ্রমিক পাঠানোর নতুন কোন চুক্তি হয়েছে কিনা, অবৈধ বাংলাদেশীদের বৈধতার
কোন আশ্বাস মিলেছে কিনা এমন নানা বিষয়ে জানতে চান তিনি। সারাওয়াক প্রদেশের
শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি এবং অবৈধদের বৈধতা দেয়ার সুনির্দিষ্ট কোন আশ্বাস না
পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, সারাওয়াকে যেতে অনেকেই আগ্রহী হবে
না। জি-টু-জি পদ্ধতি নিয়ে ওই প্রবাসী বলেন, প্রত্যেকে তার আত্মীয়স্বজনকে
নিয়ে আসতে চায়। নিজেরা চেষ্টা করে ভিসা বের করে অর্থ যোগাড় করে। কেবল মাত্র
জি-টু-জি হলে ব্যক্তি উদ্যোগে আর কোন ভিসা বের হবে না। মালয়েশিয়া
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মালির কাজ করেন গোলাপগঞ্জ সদরের আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমরা এখানে অনেক বাংলাদেশী কাজ করি। আমি ৭ বছর থেকে আছি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। তারা মালয়েশিয়ান
কোম্পানিকে কন্ট্রাক্ট দেয়। তারা আমাদের নিয়োগ দেয়। ওই শ্রমিক বলেন, সুযোগ
পেলে যে কেউ তার পরিবারের সদস্যদের আনতে চায়। সেখানে সরকারিভাবে কাউকে আনা
অনেক কঠিন হয়ে গেছে। শ্রম বাজার সম্প্রসারণ বিষয়ে সেখানে কর্মরত সরকারের
এক কূটনীতিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত সরকারি পর্যায়ে লোক
পাঠানোর বিষয়টি কিভাবে দ্রুততর করা যায় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
No comments