ভিন্নমত থাকলেও মাও সেতুং-এর নিশানা মোছেনি চীন by মাহবুবা চৌধুরী
চীনা
কমিউনিস্ট পার্টি সিপিসির আমন্ত্রণে সাত দিনের সফরে চীন গিয়েছিলাম। পনেরো
সদস্যের বেশ বড়সড় একটা দল। দলে ছিলেন সাংবাদিক, কূটনৈতিক, কলামনিস্ট এবং
শিল্প উদ্যোক্তা। ঢাকা থেকে কুনমিং দুই ঘণ্টা। কুনমিং-এ যাত্রাবিরতি প্রায়
দেড় ঘণ্টা। কুনমিং থেকে বেইজিং সাড়ে তিন ঘণ্টা। বেইজিং বিমানবন্দরে পৌঁছতেই
দেখলাম আমাদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছেন চীনা কর্মকর্তারা। ঝকঝকে তকতকে
সুপরিসর বাসে উঠে পড়লাম। বিমানবন্দর থেকে ওয়ান সু হোটেলে পৌঁছতে প্রায়
পৌনে এক ঘণ্টা। যখন হোটেলের রুমে ঢুকলাম তখন রাত সাড়ে তিনটা। বলা হলো ভোর
সাড়ে ছ’টায় ওয়েকআপ কল দেয়া হবে। হোটেলে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে নাস্তা সেরে
সকাল ন’টায় মিটিং! একটু অবাক হলাম। এত রাতে ঘুমিয়ে এত সকালে উঠবো কি করে?
হ্যাঁ, আমরা ঠিকই উঠেছি। সময়মতো মিটিংয়েও উপস্থিত হয়েছি। পরে বুঝেছি,
চীনারা এত কর্মঠ আর পরিশ্রমী বলেই এত উন্নতি করতে পেরেছে। সকাল ন’টায়
বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার করিডোর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। চায়না
ইনস্টিটিউট অব সাউথ অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড ওসেনিয়া স্টাডিজের
উপপরিচালক লি লি আশাবাদ ব্যক্ত করলেন, এই করিডোর চারটি দেশের অর্থনৈতিক
শক্তি বৃদ্ধি করবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই করিডোরটি কলকাতা হয়ে
ঢাকা-চট্টগ্রাম, মিয়ানমারের মান্দালয় দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত যাবে। এ
ব্যাপারে চীন খুবই আন্তরিক। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনকে নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে আগ্রহী। ভাবলাম,
সত্যি কি কোনদিন এই করিডোর হবে? নাকি শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে? বেলা
এগারোটায় মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার গুয়ো ইয়াঝু। খাবার টেবিলে চীনের অতীত,
বর্তমান, ভবিষ্যৎ, আন্তর্জাতিক- সব বিষয়েই আলোচনা হলো। দুপুর দেড়টায়
ইম্পেরিয়াল প্যালেস এবং তিয়ানআনমেন স্কয়ারে গেলাম। ইমপেরিয়াল প্যালেস দেখতে
প্রচুর লোকসমাগম হয়। প্রাসাদগুলো অনেকটাই মঠের আদলে তৈরী। বিরাট এলাকা
জুড়ে প্রাসাদ। চারদিকে গাছগাছালি, লেক, স্নিগ্ধ-শান্ত পরিবেশ। তিয়ানআনমেন
স্কয়ারে বহু মানুষের আনাগোনা। সবাই ঘুরেফিরে দেখছেন। কেউ ছবি তুলছেন। আবার
কেউবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে জটলা করে আড্ডা দিচ্ছেন। ভাবতে অবাক লাগে- এই
তিয়েনআনমেন স্কয়ারে একদিন গণতন্ত্রকামী ছাত্র দমনে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালানো
হয়েছিল। এর কাছেই মাও সেতুং-এর বিশাল রঙিন ছবি। দেখে অবাক হলাম, বর্তমান
চীন মাওয়ের অনেক নীতির সঙ্গেই একমত নয়। তার অনেক সিদ্ধান্তই ব্যাপক
সমালোচিত হয়েছে। বর্তমান চীন এগিয়ে চলেছে আধুনিক ধ্যানধারণা নিয়ে। তাই বলে
মাও সেতুং-এর নাম-নিশানা তারা মুছে ফেলেনি। বর্তমান শাসকরা তার যোগ্য
সম্মানটুকু দিতে কার্পণ্য করেনি। চীনের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার
আছে। বিকালে নিউচিয়ে মসজিদে গেলাম। চীনে প্রায় আড়াই কোটি মুসলমান রয়েছেন।
মসজিদের ইমাম সাহেব আমাদের স্বাগত জানালেন। মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা
নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। দেখলাম, বেশ কিছু মুসল্লি নামাজ পড়ছেন। মসজিদের এক
পাশের একটা কামরায় চোখ জুড়ানো তৈজসপত্র। তাতে সোনালি হরফে লেখা রয়েছে
আল্লাহর কালাম। রয়েছে নানা রঙের নানা আকারের নজরকাড়া তসবিহ। এ সব কিছুই
বিক্রির জন্য।
দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষক, নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাদের মূল কথা হচ্ছে- চীন থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে আরও মনোযোগী হতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য চীন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন অবৈতনিক শিক্ষা, খাদ্য ও অর্থ সাহায্য।
চীনের বিভিন্ন প্রদেশে আমরা অবস্থান করেছি এবং নানা ধরনের চীনা খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেছি। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের চাইনিজের সঙ্গে আসল চীনা খাবারের সামান্যতম মিলও খুঁজে পাইনি। খাবার টেবিলে প্রায়ই মজার ঘটনা ঘটতো। আমাদের অনেকেই না বুঝে অনেক কিছু খেয়ে ফেলতো। পরে এ নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছে। বেইজিং-এ পিকিং ডাক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি। বিরাট টেবিল। টেবিলের মাঝখানে বড়সড় গোল চাকতি। ওয়েটাররা একের পর এক খাবার এনে রাখছে। চাকতি ঘুরিয়ে নিজের কাছে খাবারের ডিশ এনে সবাই খাবার তুলে নিচ্ছেন। ওয়েটারগুলো এক শব্দও ইংরেজি বোঝে না। নানা পদের খাবার আসছে। এবার এলো ছোট ছোট টুকরার ভুনা মাংস। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করা হলো। সে ইংরেজি বোঝে না। কেউ বললো- এটা ছোট মুরগি, কেউ বললো পাখি। অনেকেই মনের আনন্দে খেতে শুরু করলেন। আমি সব সময়ই কোন না কোন চীনা কর্মকর্তার পাশে বসার চেষ্টা করতাম। উদ্দেশ্য তাদের কাছ থেকে খাবার সম্পর্কে জেনে নেয়া। আমার পাশে বসা চীনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দিস ইজ ফ্রগ, ভেরি টেস্টি। খাওয়ার পর সবাইকে বললাম, ওই পাখির মাংসটা কেমন? অনেকেই বললেন, বেশ ভাল। কেন আপনি খাননি? বললাম, না, ওটা পাখির মাংস নয়। ওটা ছিল ব্যাঙ। যারা খাননি তারা হো হো করে হেসে উঠলেন। আর যারা খেয়েছেন তারা তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আরেক দিন ডিনারে অনেকেই তৃপ্তি করে পিৎজা খাচ্ছেন। আমি গাইড মিস নিয়েকে বললাম, পিৎজায় কিসের মাংস একটু জেনে দেবে? মিস্ নিয়ে এসে বললো, ওটা পর্ক অর্থাৎ শুয়োর। আমি এসে বলতেই যারা খাওয়া শুরু করেছিলেন তারা ফেলে দিলেন। যারা খেয়ে ফেলেছেন তারা পানি খেতে শুরু করলেন।
শিল্প সংস্কৃতিতেও রয়েছে চীনের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য। লিউ আন থিয়েটারে পিকিং অপেরা দেখতে গেলাম। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নানা রঙের, নানা ঢঙের মুখোশ পরে কি সুন্দরভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলছে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম। অপেরা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন কোন সুদূর অতীতে হারিয়ে গেছি।
চীনে গিয়ে চীনের প্রাচীর দেখবো না তা তো হয় না। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই রওনা হয়ে গেলাম। সেদিন ছিল প্রচ- শীত। তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে। হাত মোজা, পা মোজা, জাম্পার কোট টুপি এক গাদা গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে গ্রেটওয়ালে পৌঁছলাম। পথে যেতে লক্ষ্য করলাম দোতলা-তিনতলা ফ্লাইওভার, যানজটের বালাই নেই। ছিমছাম দালানকোঠা। প্রচুর গাছগাছালি। কি বিরাট দেশ। ১৩৫ কোটি জনসংখ্যা, তবু যেন রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। আমাদের দেশের মতো লোকারণ্য নয়। গ্রেটওয়ালের আশেপাশে প্রচুর উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড় কেটে কেটেই তৈরি হয়েছে গ্রেটওয়াল। ক্যাবল কারে করে যেতে হয় গ্রেটওয়ালের বেদীতে। তার পর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা। গ্রেটওয়াল নির্মাণের পেছনে যে কারণটি রয়েছে তা হলো- মঙ্গোলিয়ান দস্যুরা চীনে ঢুকে ধন-সম্পদ লুট করে পালিয়ে যেতো। ওই দস্যুদের রুখে দেয়ার জন্যই গ্রেটওয়ালের পরিকল্পনা। ছোটবেলায় গ্রেটওয়ালের কথা বইতে পড়েছি। মনে মনে কল্পনা করেছি গ্রেটওয়াল দেখবো। গ্রেটওয়ালে দাঁড়িয়ে মনে হলো বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ।
বিকালে কুনমিং-এর উদ্দেশে যাত্রা করলাম। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর কুনমিং পৌঁছলাম। কুনমিং হোটেলে মালপত্র রেখে ডিনার সেরে নিলাম। পরদিন সকাল ন’টায় ইউননান প্রদেশের বৈদেশিক বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলেন মি. হাও কুন, ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ইউননান প্রদেশ।
বিকালে এথনিক ভিলেজ পরিদর্শনে গেলাম। বিরাট এলাকা জুড়ে এই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার গ্রাম গড়ে উঠেছে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পোশাক-আশাক, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, বাসস্থান- সব কিছুই সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে তুলে ধরছে। ইচ্ছে করলে ওদের পোশাক পরে ছবি তোলা যায়। তবে তার বিনিময়ে কিছু পয়সা গুনতে হয়। এথনিক ভিলেজে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী দোকান। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তৈরি পণ্যসামগ্রী ইচ্ছে করলে কেনা যেতে পারে। এথনিক ভিলেজে রয়েছে প্রচুর সবুজ গাছগাছালি। নানা রঙের ফুল, নানা জাতের পাখি আর থিরথিরে ঢেউ তোলা দিঘি।
রাতে পুয়ারের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। পুয়ারে জিং লান হোটেলে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল।
পরদিন সকালে সোজা নিনগার কাউন্টির মিনঝেং ভিলেজ। সেখান থেকে পিকান বাগান পরিদর্শন। পিকান হচ্ছে অনেকটা আখরোট জাতীয় ফল। খেতে খুবই সুস্বাদু। বছরে পঞ্চাশ হাজার টন পিকান উৎপন্ন হয়। সেগুলো মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগই রপ্তানি করা হয়।
সেখান থেকে নেকলি ভিলেজ। এখানে বলাবাহুল্য, বিভিন্ন ভিলেজে গিয়ে উপভোগ করেছি উষ্ণ আতিথেয়েতা। অনাবিল সৌন্দর্য আর নতুন অভিজ্ঞতা। পুয়ার আমার কাছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের গাঘেঁষে ঘন সবুজ চায়ের বাগান। পাহাড়ের পাদদেশে নাম না জানা ফুলের সমারোহ। ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে নানা জাতের পাখি। যেন এক রূপকথার রাজ্য।
পুয়ার মিউজিয়াম আমাকে মুগ্ধ করেছে। চীনারা চায়ের চাকতি করে সেটা সংরক্ষণ করে রাখে বহুদিন। এই মিউজিয়ামে ১২০ বছরের পুরনো চায়ের চাকতি রয়েছে। এটা নয়নাভিরাম কাচের বাক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। চীন হচ্ছে চায়ের সূতিকাগার। চীনে প্রথম যে ব্যক্তি চা আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম পায়লা। বহু বছর আগে ওই ভদ্রলোক একটা গুহায় আটকা পড়েছিলেন। তার সঙ্গে খাবার-দাবার কিছুই ছিল না। তখন সে পানিতে চায়ের পাতা ভিজিয়ে সেই পানি পান করে অনেকদিন সুস্থভাবে বেঁচে ছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর পায়লা সবাইকে সেই কাহিনী বলেন এবং গ্রামের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন- এই পাতা গরম পানিতে ভিজিয়ে খেলে সুস্থ থাকা যায়। তখন থেকেই গ্রামবাসী চা খেতে শুরু করে এবং চা চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে ক্রমে তা সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে উঠেই পুয়ার টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন দেখতে গেলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। ঘুরে ঘুরে দেখানো হলো সব কার্যক্রম।
পরের গন্তব্য পুয়ার ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক। প্রায় দুই কিলোমিটার উঁচু-নিচু সিঁড়ি বেয়ে এই পার্ক ঘুরে দেখতে হয়। ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে। আমরা হেঁটে চলেছি। দু’ধারে কত রঙবেরঙের পাখি। রোদ পোহাচ্ছে হিপোপটেমাস। দেখলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বানর। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম বানরপল্লীতে। হাতে ক্যামেরা দেখে বানরকুল ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে। সত্যিই অভূতপূর্ব দৃশ্য। এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে পড়ছে ওরাং ওটাং। বক, সরস আরও কত নাম না জানা পাখি রোদ পোহাচ্ছে দল বেঁধে। দেখলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম মাছ। আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের যে ঘটনাটি অপেক্ষা করছিল তা দেখে আমি অভিভূত। চোখের সামনে বসে আছে পান্ডা। একটি নয় দু’টি নয়, বেশ কয়েকটি। পান্ডা দেখার জন্য হংকং-এর ওশান পার্কে গা ঝলসানো রোদে দাঁড়িয়ে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পান্ডার দেখা পাইনি। কোন ঝোপের আড়ালে পান্ডা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। দেখলাম, পান্ডাকে আপেল খাওয়ানো হচ্ছে। গাইড বললো, পান্ডাকে আদর করতে পারো। সাবধান, ওর লেজ ধরবে না। লেজ ধরলে ওরা ভীষণ রেগে যায়। যদিও পান্ডা খুবই নিরীহ প্রাণী। রাতের ফ্লাইটে কুনমিং ফিরে এলাম। পরদিন দুপুরে ঢাকার পথে যাত্রা করলাম।
এই সফরে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মধুর। চীনারা খুবই বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ ও পরোপকারী। চীন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে চীন পৌঁছে যাবে উন্নতির উচ্চ শিখরে। বর্তমানে চীনে মাথাপিছু আয় প্রায় ছয় হাজার ডলার।
দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষক, নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাদের মূল কথা হচ্ছে- চীন থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে আরও মনোযোগী হতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য চীন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন অবৈতনিক শিক্ষা, খাদ্য ও অর্থ সাহায্য।
চীনের বিভিন্ন প্রদেশে আমরা অবস্থান করেছি এবং নানা ধরনের চীনা খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেছি। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের চাইনিজের সঙ্গে আসল চীনা খাবারের সামান্যতম মিলও খুঁজে পাইনি। খাবার টেবিলে প্রায়ই মজার ঘটনা ঘটতো। আমাদের অনেকেই না বুঝে অনেক কিছু খেয়ে ফেলতো। পরে এ নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছে। বেইজিং-এ পিকিং ডাক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি। বিরাট টেবিল। টেবিলের মাঝখানে বড়সড় গোল চাকতি। ওয়েটাররা একের পর এক খাবার এনে রাখছে। চাকতি ঘুরিয়ে নিজের কাছে খাবারের ডিশ এনে সবাই খাবার তুলে নিচ্ছেন। ওয়েটারগুলো এক শব্দও ইংরেজি বোঝে না। নানা পদের খাবার আসছে। এবার এলো ছোট ছোট টুকরার ভুনা মাংস। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করা হলো। সে ইংরেজি বোঝে না। কেউ বললো- এটা ছোট মুরগি, কেউ বললো পাখি। অনেকেই মনের আনন্দে খেতে শুরু করলেন। আমি সব সময়ই কোন না কোন চীনা কর্মকর্তার পাশে বসার চেষ্টা করতাম। উদ্দেশ্য তাদের কাছ থেকে খাবার সম্পর্কে জেনে নেয়া। আমার পাশে বসা চীনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দিস ইজ ফ্রগ, ভেরি টেস্টি। খাওয়ার পর সবাইকে বললাম, ওই পাখির মাংসটা কেমন? অনেকেই বললেন, বেশ ভাল। কেন আপনি খাননি? বললাম, না, ওটা পাখির মাংস নয়। ওটা ছিল ব্যাঙ। যারা খাননি তারা হো হো করে হেসে উঠলেন। আর যারা খেয়েছেন তারা তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আরেক দিন ডিনারে অনেকেই তৃপ্তি করে পিৎজা খাচ্ছেন। আমি গাইড মিস নিয়েকে বললাম, পিৎজায় কিসের মাংস একটু জেনে দেবে? মিস্ নিয়ে এসে বললো, ওটা পর্ক অর্থাৎ শুয়োর। আমি এসে বলতেই যারা খাওয়া শুরু করেছিলেন তারা ফেলে দিলেন। যারা খেয়ে ফেলেছেন তারা পানি খেতে শুরু করলেন।
শিল্প সংস্কৃতিতেও রয়েছে চীনের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য। লিউ আন থিয়েটারে পিকিং অপেরা দেখতে গেলাম। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নানা রঙের, নানা ঢঙের মুখোশ পরে কি সুন্দরভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলছে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম। অপেরা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন কোন সুদূর অতীতে হারিয়ে গেছি।
চীনে গিয়ে চীনের প্রাচীর দেখবো না তা তো হয় না। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই রওনা হয়ে গেলাম। সেদিন ছিল প্রচ- শীত। তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে। হাত মোজা, পা মোজা, জাম্পার কোট টুপি এক গাদা গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে গ্রেটওয়ালে পৌঁছলাম। পথে যেতে লক্ষ্য করলাম দোতলা-তিনতলা ফ্লাইওভার, যানজটের বালাই নেই। ছিমছাম দালানকোঠা। প্রচুর গাছগাছালি। কি বিরাট দেশ। ১৩৫ কোটি জনসংখ্যা, তবু যেন রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। আমাদের দেশের মতো লোকারণ্য নয়। গ্রেটওয়ালের আশেপাশে প্রচুর উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড় কেটে কেটেই তৈরি হয়েছে গ্রেটওয়াল। ক্যাবল কারে করে যেতে হয় গ্রেটওয়ালের বেদীতে। তার পর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা। গ্রেটওয়াল নির্মাণের পেছনে যে কারণটি রয়েছে তা হলো- মঙ্গোলিয়ান দস্যুরা চীনে ঢুকে ধন-সম্পদ লুট করে পালিয়ে যেতো। ওই দস্যুদের রুখে দেয়ার জন্যই গ্রেটওয়ালের পরিকল্পনা। ছোটবেলায় গ্রেটওয়ালের কথা বইতে পড়েছি। মনে মনে কল্পনা করেছি গ্রেটওয়াল দেখবো। গ্রেটওয়ালে দাঁড়িয়ে মনে হলো বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ।
বিকালে কুনমিং-এর উদ্দেশে যাত্রা করলাম। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর কুনমিং পৌঁছলাম। কুনমিং হোটেলে মালপত্র রেখে ডিনার সেরে নিলাম। পরদিন সকাল ন’টায় ইউননান প্রদেশের বৈদেশিক বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলেন মি. হাও কুন, ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ইউননান প্রদেশ।
বিকালে এথনিক ভিলেজ পরিদর্শনে গেলাম। বিরাট এলাকা জুড়ে এই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার গ্রাম গড়ে উঠেছে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পোশাক-আশাক, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, বাসস্থান- সব কিছুই সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে তুলে ধরছে। ইচ্ছে করলে ওদের পোশাক পরে ছবি তোলা যায়। তবে তার বিনিময়ে কিছু পয়সা গুনতে হয়। এথনিক ভিলেজে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী দোকান। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তৈরি পণ্যসামগ্রী ইচ্ছে করলে কেনা যেতে পারে। এথনিক ভিলেজে রয়েছে প্রচুর সবুজ গাছগাছালি। নানা রঙের ফুল, নানা জাতের পাখি আর থিরথিরে ঢেউ তোলা দিঘি।
রাতে পুয়ারের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। পুয়ারে জিং লান হোটেলে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল।
পরদিন সকালে সোজা নিনগার কাউন্টির মিনঝেং ভিলেজ। সেখান থেকে পিকান বাগান পরিদর্শন। পিকান হচ্ছে অনেকটা আখরোট জাতীয় ফল। খেতে খুবই সুস্বাদু। বছরে পঞ্চাশ হাজার টন পিকান উৎপন্ন হয়। সেগুলো মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগই রপ্তানি করা হয়।
সেখান থেকে নেকলি ভিলেজ। এখানে বলাবাহুল্য, বিভিন্ন ভিলেজে গিয়ে উপভোগ করেছি উষ্ণ আতিথেয়েতা। অনাবিল সৌন্দর্য আর নতুন অভিজ্ঞতা। পুয়ার আমার কাছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের গাঘেঁষে ঘন সবুজ চায়ের বাগান। পাহাড়ের পাদদেশে নাম না জানা ফুলের সমারোহ। ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে নানা জাতের পাখি। যেন এক রূপকথার রাজ্য।
পুয়ার মিউজিয়াম আমাকে মুগ্ধ করেছে। চীনারা চায়ের চাকতি করে সেটা সংরক্ষণ করে রাখে বহুদিন। এই মিউজিয়ামে ১২০ বছরের পুরনো চায়ের চাকতি রয়েছে। এটা নয়নাভিরাম কাচের বাক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। চীন হচ্ছে চায়ের সূতিকাগার। চীনে প্রথম যে ব্যক্তি চা আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম পায়লা। বহু বছর আগে ওই ভদ্রলোক একটা গুহায় আটকা পড়েছিলেন। তার সঙ্গে খাবার-দাবার কিছুই ছিল না। তখন সে পানিতে চায়ের পাতা ভিজিয়ে সেই পানি পান করে অনেকদিন সুস্থভাবে বেঁচে ছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর পায়লা সবাইকে সেই কাহিনী বলেন এবং গ্রামের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন- এই পাতা গরম পানিতে ভিজিয়ে খেলে সুস্থ থাকা যায়। তখন থেকেই গ্রামবাসী চা খেতে শুরু করে এবং চা চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে ক্রমে তা সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে উঠেই পুয়ার টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন দেখতে গেলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। ঘুরে ঘুরে দেখানো হলো সব কার্যক্রম।
পরের গন্তব্য পুয়ার ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক। প্রায় দুই কিলোমিটার উঁচু-নিচু সিঁড়ি বেয়ে এই পার্ক ঘুরে দেখতে হয়। ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে। আমরা হেঁটে চলেছি। দু’ধারে কত রঙবেরঙের পাখি। রোদ পোহাচ্ছে হিপোপটেমাস। দেখলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বানর। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম বানরপল্লীতে। হাতে ক্যামেরা দেখে বানরকুল ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে। সত্যিই অভূতপূর্ব দৃশ্য। এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে পড়ছে ওরাং ওটাং। বক, সরস আরও কত নাম না জানা পাখি রোদ পোহাচ্ছে দল বেঁধে। দেখলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম মাছ। আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের যে ঘটনাটি অপেক্ষা করছিল তা দেখে আমি অভিভূত। চোখের সামনে বসে আছে পান্ডা। একটি নয় দু’টি নয়, বেশ কয়েকটি। পান্ডা দেখার জন্য হংকং-এর ওশান পার্কে গা ঝলসানো রোদে দাঁড়িয়ে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পান্ডার দেখা পাইনি। কোন ঝোপের আড়ালে পান্ডা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। দেখলাম, পান্ডাকে আপেল খাওয়ানো হচ্ছে। গাইড বললো, পান্ডাকে আদর করতে পারো। সাবধান, ওর লেজ ধরবে না। লেজ ধরলে ওরা ভীষণ রেগে যায়। যদিও পান্ডা খুবই নিরীহ প্রাণী। রাতের ফ্লাইটে কুনমিং ফিরে এলাম। পরদিন দুপুরে ঢাকার পথে যাত্রা করলাম।
এই সফরে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মধুর। চীনারা খুবই বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ ও পরোপকারী। চীন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে চীন পৌঁছে যাবে উন্নতির উচ্চ শিখরে। বর্তমানে চীনে মাথাপিছু আয় প্রায় ছয় হাজার ডলার।
No comments