ব্যাঙের একটি বায়োলজিক্যাল নাম আছে ব্যাঙ সেটা জানে না by মাহবুব কামাল
১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিনের
অনুষ্ঠানে ছুটে যায়, এমন এক পাড় বিএনপি আমার জ্ঞানী যেখানে পা রাখতে ভয়
পায়, অর্বাচীন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিরোনামের লেখাটি পড়ার পর বলেছেন, বিএনপি
আন্দোলন জমাতে পারছে না বুঝলাম, ফ্রেশ নির্বাচনের প্রয়োজন আছে কিনা- হ্যাঁ
কিংবা না বলুন।
শুধু হ্যাঁ অথবা না বলে যে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না- এ কথাটি যে কতোবার বলেছি বা শুনেছি, মনে নেই। উদাহরণটাও অনেক পুরনো- আপনি কি বউ পেটানো ছেড়ে দিয়েছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ অথবা না যেটাই বলা হোক না কেন, প্রমাণ হবে যে উত্তরদাতা স্বামী হিসেবে ভালো নয়। আমিই বা কোন্ দুঃখে ভালো লেখক নন অপবাদ নেব? উপরের প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলা মানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমি মেনে নিইনি, আর না বললে মেনে নিয়েছি। উত্তরটা হচ্ছে, আমি মেনে নেয়া না-নেয়ার দোলাচলে আছি। শেক্সপিয়র আমার এই দোলাচল আগাম অনুভব করেই বুঝি চারশ বছর আগে লিখেছিলেন- to be or not to be, that is the question.
যুক্তিবিদ্যা ঘেঁটেছেন যারা, তারা জানেন যে, এই শাস্ত্রে অনেক ধরনের ফ্যালাসি বা চিন্তার প্রতারণার কথা বলা আছে। এই ফ্যালাসির কারণে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণ মনে হবে; কিন্তু সেই যুক্তি প্রতারণামূলক অর্থাৎ বিষয়টিকে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করা চলে না। সহজ পাঠকের জন্য একটি সহজ উদাহরণ দিয়েই ক্ষান্ত হবো। আমি এ যাবত যত মেয়ে দেখেছি, তাদের সবাই স্বার্থপর; সুতরাং পৃথিবীর সব মেয়েই স্বার্থপর- এমন সিদ্ধান্ত টানা যুক্তিসঙ্গত নয়। যুক্তিশাস্ত্রে এটাকে বলে অবৈধ সামান্যকরণ।
যুক্তিবিদ্যায় নানা ধরনের ইলিউশন বা ভ্রমের কথাও আছে। আলো-আঁধারিতে দড়িকে সাপ মনে করা যেমন একটি অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম, আবার দার্শনিক ইলিউশনও থাকে মানুষের। আমাকে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছে, তেমন একটি ইলিউশন দিয়েই তার মীমাংসা করার চেষ্টা করব। ইলিউশনটি হল, কখনও কখনও উপায়কে (means) লক্ষ্য (goal) বলে ভ্রম হয় আমাদের। যেমন- ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে লক্ষ্য হলো ভালো থাকা আর উপায় হচ্ছে উপার্জন। এই উপায় চার প্রকারের বৈধ উপার্জনের যে কোনো একটি হতে পারে- চাকরি, ব্যবসা, কৃষি, ভিক্ষাবৃত্তি।
একইভাবে যুক্তিবোধের অভাবে অথবা নিরন্তর প্রচার-প্রপাগান্ডার ফলে মগজ ধৌত হওয়ার কারণে গণতন্ত্রকে আমরা লক্ষ্য জ্ঞান করি। অথচ এটি উপায় মাত্র, লক্ষ্যটা- বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সমাজ- খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বাকযন্ত্রসহ সামগ্রিকভাবে জীবনের নিরাপত্তা। বলা নিষ্প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্রকে উপায় না ভেবে লক্ষ্য ভাবেন, তাদের কাছে নির্বাচন এক বড় ফ্যাক্টর। তাদের ভ্রম হয় যে, নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেই জীবন সার্থক হয়ে যায়।
আসলে এই দুনিয়াটা মগজ ধোলাইয়ের এক বড় কারখানা। যে যার সুবিধামতো অন্যের মগজ ধোলাই করে চলেছে। প্রেমিকার মগজ ধোলাই করে প্রেমিক এই বলে যে, লাভ ইজ ডিভাইন- প্রেম আসে স্বর্গ থেকে- উদ্দেশ্য, সে যেন ছেড়ে না যায় তাকে। সেনাবাহিনীর মগজ ধোলাই করা হয় দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে অকাতরে তারা দিতে পারে জীবন। আবার সেনাবাহিনী যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না নিতে পারে, সেজন্য জনগণের মগজ ধোলাই করে রাজনীতিক এই বলে যে, বন্দুক ছাড়া কিছুই জানে না তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীও মগজ ধোলাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বলে- ব্লাডি সিভিলিয়ান। এমনকি বাবা-মা যে সন্তানদের পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য শেখান, সূক্ষ্মভাবে দেখলে সেটাও এক ধরনের মগজ ধোলাই- যেন বয়সকালে তাদের দেখভাল করে তারা।
ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে রাজনীতিকরা জনগণের মাথায় সুশাসন ঢোকায় না, গেঁথে দেয় নির্বাচন। তারা নির্বাচনকেই মহিমান্বিত করে, সুশাসনকে নয়। পাঠক লক্ষ করুন, দেশের সব সাংবিধানিক সংস্থাই কার্যত পলিটিক্যাল কসমেটিক্স; কিন্তু এগুলোর একমাত্র নির্বাচন কমিশন নিয়েই যত ঝগড়া, যত বিবাদ। মানবাধিকার কমিশন কি নির্বাচন কমিশনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশন? কিন্তু বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনকেই ঢেলে সাজাতে চায়, অন্য কোনো সাংবিধানিক সংস্থাকে নয়। আবার সরকারি দল অবিকল রাখতে চায় কমিশন। উদ্দেশ্য একটাই- নির্বাচনে জেতা। তাতে বৈধভাবেই যা খুশি করা যায়, সেনাশাসকদের মতো গঞ্জনা সইতে হয় না। আর পাবলিক? নির্বাচনের মাহাত্ম্য এত বেশি তাদের কাছে যে, ওটা সুষ্ঠু না হলে মুখ বেজার করে আর নিরপেক্ষ হলে আত্মহারা হয়ে বগল দাবায়। তার দোষ কী? তাকে যে শেখানো হয়েছে- তার গন্তব্য নির্বাচন, নিরাপদ জীবন নয়!
পাঠক কি ভাবতে শুরু করেছেন আমি নির্বাচন তথা গণতন্ত্র কনসেপ্টের সতীত্ব নষ্ট করতেই এতক্ষণ সম্ভোগ-রসিকতা করলাম? ডেফিনিটলি নট। নিরাপত্তামূলক সমাজে পৌঁছানোর যত উপায় বা পথ আছে, গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে অন্যরকম একটা উপায় পরীক্ষা করা হয়েছিল। লাভ হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ যা, তাতে ৭০ বছর গণতন্ত্র চর্চা করা হলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে উঠে যেতে পারত। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হিসাবের জাবেদা খাতায় দেখা গেল, আয়-ব্যয় মিলে গিয়ে বিয়োগফল শূন্য, হাতে থেকেছে উড পেনসিল। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক নির্মাণগুলো যখন ধসে পড়ছিল, এক কলামে লিখেছিলাম- সোস্যালিজম ইজ দ্য লংগেস্ট ওয়ে টু ডেমোক্রেসি। শেষ পর্যন্ত তো গণতন্ত্রেই যেতে হবে, তবে কেন এত ঘোরাঘুরি করে পথটাকে দীর্ঘ করা হলো? এটা তো গেল কমিউনিজমের কথা। বিনেভোলেন্ট ডিক্টেটরশিপ বা জনহিতাকাক্সক্ষী একনায়কত্বের কথাও বলেন অনেকে। সে চেষ্টাও কি কম হয়েছে? আসলে ডিক্টেটর যত বিনেভোলেন্টই হোন, মানুষের স্বাধীন বিকাশ সহ্য করেন না। পাঠক মনে আছে তো, বিরুদ্ধাচরণ করায় সাদ্দাম কীভাবে প্লট করে তার দুই মেয়ে-জামাইকে হত্যা করেছিলেন? সাদ্দাম-গাদ্দাফিরা আলটিমেটলি জনহিতাকাক্সক্ষী নন অবশ্যই। বাকি থাকল মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহীতন্ত্র, আমীরতন্ত্র, শেখতন্ত্র ইত্যাদি। আদিবাসী বাদ দিলে চিন্তা-চেতনায় সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে অনগ্রসর এই অঞ্চলের মানুষ তেলের ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করে; গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য বোঝে না। এক পা-ওয়ালা মানুষের দেশ থেকে কেউ একজন দুই পা-ওয়ালার দেশে এসে বিস্মিত হল। আরে লোকটাকে ধরছে না কেন কেউ, পড়ে যাবে তো! মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদেরও হয়তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসে এমন উপলব্ধিই হয়। তবে এদের কোনো আক্ষেপ নেই; উইপোকা ঢিবিতে যে পরম শান্তিতে ঘুমায়, এদের ঘুমও তেমন নিশ্চিন্ত।
হ্যাঁ, প্রথমেই স্বীকার করে নিই, গণতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা; এরপর যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল যখন, তখন আমাদের অনেকেই চেঁচামেচি করেছি, কিন্তু সংশোধনীটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু ছিল না। তবে থিওরিটিক্যালি সেটা শুদ্ধ হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্র্যাকটিক্যালি তা ছিল সংশয়মূলক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখলাম, সংশোধনীটি আসলেই ছিল উদ্দেশ্যমূলক। এককথায় বললে, পঞ্চদশ সংশোধনী নিজে খারাপ না হলেও সঙ্গদোষে খারাপ প্রমাণিত হয়েছে। এই সঙ্গ হল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রমাণ করতে পারেনি যে, পঞ্চদশ সংশোধনী আনার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেনি। আমরা খুঁত ধরা ননদ নই, তাই বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যে-কোনো প্রকারেই হোক, ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল।
এখন তাহলে কী করা? ফ্রেশ নির্বাচনের দাবিটি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু প্রশ্ন, সেই নির্বাচন কি আত্মাহুতির? পরিচিত এক ঘোর-বিএনপি একদিন বললেন, শেখ মুজিব ও অনুপ চেটিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অথচ চেটিয়া জেলে আর মুজিব জাতির পিতা। জীবনে বড়জোর পাঁচবার মেজাজ খারাপ হয়েছিল এত। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে তাকে বলেছিলাম- আওয়ামী লীগকে আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় রাখব, পারলে ঠেকায়েন। আমাদের চোখের সামনে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধপরায়ণতার এক ছবি ঝুলে আছে, যে ছবি রূপ নিতে পারে গৃহযুদ্ধের ছবিতে; আমরা কি এত সহজেই বলে দিতে পারি- বর্তমান স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাক? বিএনপির শরীরে জমা হয়েছে বিপজ্জনক মেদ, ক্লেদও। হাঁটতে হবে তাকে প্রচুর, ঘাম ঝরিয়ে দূর করতে হবে সব মেদ ও ক্লেদ। সারাতে হবে উদরাময় রোগও। এরপর নামতে হবে মাঠে। আমাদের স্পষ্ট কথা, ফ্রেশ নির্বাচন আমাদের জন্য দার্শনিক চাপ সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এটা কোনো দায় নয়। আমরা প্রশ্ন করতেই পারি- বিএনপি নির্বাচন চাচ্ছে, নাকি চাচ্ছে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ?
আমরা আগেই প্রমাণ করেছি, নির্বাচন হল উপায়, লক্ষ্য নয়। সেই লক্ষ্যটা কী, বিএনপিকে তার একটা ছবি এঁকে দেখাতে হবে আমাদের। সেটা পিকাসো কিংবা দ্য ভিঞ্চির আঁকা ছবির মতো সুন্দর হতে হবে, এমন কথা নেই। ছবিটা এখনকার দৃশ্যপটের চেয়ে ভালো হলেই চলবে।
অতঃপর বিএনপি হাঁটতে থাকুক। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? বিএনপির হাঁটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে সুশাসন। এটা কঠিন কিছু নয়। বিএনপির মিছিলের দিকে না পাঠিয়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে পাঠালেই কিছু না কিছু সুশাসন হয়। দ্বিতীয় কথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত করছেন কেন, অপরাধের সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা নিতে পারেন না?
আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। এক মদ্যপ বলেছিল- আমি তো প্রতিদিন মদ খাই না; যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন খাই আর যেদিন বৃষ্টি হয় না সেদিন। এই উপমায়, আমরাও সব সময় খারাপ থাকি না; দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে তখন খারাপ থাকি আর যখন গণতন্ত্র থাকে না তখন। আমরা এটা বুঝে গেছি, কেউ আমাদের ভালো রাখতে পারবে না। একমাত্র জনগণের সম্মিলিত শক্তি যদি পারে কিছু করতে। মুশকিল হল, তারা জানে না যে, তারা কত শক্তি ধারণ করে; ব্যাঙ যেমন জানে না তার একটি বায়োলজিক্যাল নাম আছে (bufo melanostictus)। যেদিন তারা জেনে যাবে এই রহস্য, সেদিন নাটকের গ্রিন রুম থেকে উঠে আসবে হয়তো তারা মূল স্টেজে। প্রম্পটারেরও দরকার হবে না তখন তাদের। মুখস্থ বলে যাবে সংলাপ।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
শুধু হ্যাঁ অথবা না বলে যে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না- এ কথাটি যে কতোবার বলেছি বা শুনেছি, মনে নেই। উদাহরণটাও অনেক পুরনো- আপনি কি বউ পেটানো ছেড়ে দিয়েছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ অথবা না যেটাই বলা হোক না কেন, প্রমাণ হবে যে উত্তরদাতা স্বামী হিসেবে ভালো নয়। আমিই বা কোন্ দুঃখে ভালো লেখক নন অপবাদ নেব? উপরের প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলা মানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমি মেনে নিইনি, আর না বললে মেনে নিয়েছি। উত্তরটা হচ্ছে, আমি মেনে নেয়া না-নেয়ার দোলাচলে আছি। শেক্সপিয়র আমার এই দোলাচল আগাম অনুভব করেই বুঝি চারশ বছর আগে লিখেছিলেন- to be or not to be, that is the question.
যুক্তিবিদ্যা ঘেঁটেছেন যারা, তারা জানেন যে, এই শাস্ত্রে অনেক ধরনের ফ্যালাসি বা চিন্তার প্রতারণার কথা বলা আছে। এই ফ্যালাসির কারণে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণ মনে হবে; কিন্তু সেই যুক্তি প্রতারণামূলক অর্থাৎ বিষয়টিকে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করা চলে না। সহজ পাঠকের জন্য একটি সহজ উদাহরণ দিয়েই ক্ষান্ত হবো। আমি এ যাবত যত মেয়ে দেখেছি, তাদের সবাই স্বার্থপর; সুতরাং পৃথিবীর সব মেয়েই স্বার্থপর- এমন সিদ্ধান্ত টানা যুক্তিসঙ্গত নয়। যুক্তিশাস্ত্রে এটাকে বলে অবৈধ সামান্যকরণ।
যুক্তিবিদ্যায় নানা ধরনের ইলিউশন বা ভ্রমের কথাও আছে। আলো-আঁধারিতে দড়িকে সাপ মনে করা যেমন একটি অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম, আবার দার্শনিক ইলিউশনও থাকে মানুষের। আমাকে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছে, তেমন একটি ইলিউশন দিয়েই তার মীমাংসা করার চেষ্টা করব। ইলিউশনটি হল, কখনও কখনও উপায়কে (means) লক্ষ্য (goal) বলে ভ্রম হয় আমাদের। যেমন- ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে লক্ষ্য হলো ভালো থাকা আর উপায় হচ্ছে উপার্জন। এই উপায় চার প্রকারের বৈধ উপার্জনের যে কোনো একটি হতে পারে- চাকরি, ব্যবসা, কৃষি, ভিক্ষাবৃত্তি।
একইভাবে যুক্তিবোধের অভাবে অথবা নিরন্তর প্রচার-প্রপাগান্ডার ফলে মগজ ধৌত হওয়ার কারণে গণতন্ত্রকে আমরা লক্ষ্য জ্ঞান করি। অথচ এটি উপায় মাত্র, লক্ষ্যটা- বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সমাজ- খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বাকযন্ত্রসহ সামগ্রিকভাবে জীবনের নিরাপত্তা। বলা নিষ্প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্রকে উপায় না ভেবে লক্ষ্য ভাবেন, তাদের কাছে নির্বাচন এক বড় ফ্যাক্টর। তাদের ভ্রম হয় যে, নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেই জীবন সার্থক হয়ে যায়।
আসলে এই দুনিয়াটা মগজ ধোলাইয়ের এক বড় কারখানা। যে যার সুবিধামতো অন্যের মগজ ধোলাই করে চলেছে। প্রেমিকার মগজ ধোলাই করে প্রেমিক এই বলে যে, লাভ ইজ ডিভাইন- প্রেম আসে স্বর্গ থেকে- উদ্দেশ্য, সে যেন ছেড়ে না যায় তাকে। সেনাবাহিনীর মগজ ধোলাই করা হয় দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে অকাতরে তারা দিতে পারে জীবন। আবার সেনাবাহিনী যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না নিতে পারে, সেজন্য জনগণের মগজ ধোলাই করে রাজনীতিক এই বলে যে, বন্দুক ছাড়া কিছুই জানে না তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীও মগজ ধোলাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বলে- ব্লাডি সিভিলিয়ান। এমনকি বাবা-মা যে সন্তানদের পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য শেখান, সূক্ষ্মভাবে দেখলে সেটাও এক ধরনের মগজ ধোলাই- যেন বয়সকালে তাদের দেখভাল করে তারা।
ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে রাজনীতিকরা জনগণের মাথায় সুশাসন ঢোকায় না, গেঁথে দেয় নির্বাচন। তারা নির্বাচনকেই মহিমান্বিত করে, সুশাসনকে নয়। পাঠক লক্ষ করুন, দেশের সব সাংবিধানিক সংস্থাই কার্যত পলিটিক্যাল কসমেটিক্স; কিন্তু এগুলোর একমাত্র নির্বাচন কমিশন নিয়েই যত ঝগড়া, যত বিবাদ। মানবাধিকার কমিশন কি নির্বাচন কমিশনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশন? কিন্তু বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনকেই ঢেলে সাজাতে চায়, অন্য কোনো সাংবিধানিক সংস্থাকে নয়। আবার সরকারি দল অবিকল রাখতে চায় কমিশন। উদ্দেশ্য একটাই- নির্বাচনে জেতা। তাতে বৈধভাবেই যা খুশি করা যায়, সেনাশাসকদের মতো গঞ্জনা সইতে হয় না। আর পাবলিক? নির্বাচনের মাহাত্ম্য এত বেশি তাদের কাছে যে, ওটা সুষ্ঠু না হলে মুখ বেজার করে আর নিরপেক্ষ হলে আত্মহারা হয়ে বগল দাবায়। তার দোষ কী? তাকে যে শেখানো হয়েছে- তার গন্তব্য নির্বাচন, নিরাপদ জীবন নয়!
পাঠক কি ভাবতে শুরু করেছেন আমি নির্বাচন তথা গণতন্ত্র কনসেপ্টের সতীত্ব নষ্ট করতেই এতক্ষণ সম্ভোগ-রসিকতা করলাম? ডেফিনিটলি নট। নিরাপত্তামূলক সমাজে পৌঁছানোর যত উপায় বা পথ আছে, গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে অন্যরকম একটা উপায় পরীক্ষা করা হয়েছিল। লাভ হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ যা, তাতে ৭০ বছর গণতন্ত্র চর্চা করা হলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে উঠে যেতে পারত। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হিসাবের জাবেদা খাতায় দেখা গেল, আয়-ব্যয় মিলে গিয়ে বিয়োগফল শূন্য, হাতে থেকেছে উড পেনসিল। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক নির্মাণগুলো যখন ধসে পড়ছিল, এক কলামে লিখেছিলাম- সোস্যালিজম ইজ দ্য লংগেস্ট ওয়ে টু ডেমোক্রেসি। শেষ পর্যন্ত তো গণতন্ত্রেই যেতে হবে, তবে কেন এত ঘোরাঘুরি করে পথটাকে দীর্ঘ করা হলো? এটা তো গেল কমিউনিজমের কথা। বিনেভোলেন্ট ডিক্টেটরশিপ বা জনহিতাকাক্সক্ষী একনায়কত্বের কথাও বলেন অনেকে। সে চেষ্টাও কি কম হয়েছে? আসলে ডিক্টেটর যত বিনেভোলেন্টই হোন, মানুষের স্বাধীন বিকাশ সহ্য করেন না। পাঠক মনে আছে তো, বিরুদ্ধাচরণ করায় সাদ্দাম কীভাবে প্লট করে তার দুই মেয়ে-জামাইকে হত্যা করেছিলেন? সাদ্দাম-গাদ্দাফিরা আলটিমেটলি জনহিতাকাক্সক্ষী নন অবশ্যই। বাকি থাকল মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহীতন্ত্র, আমীরতন্ত্র, শেখতন্ত্র ইত্যাদি। আদিবাসী বাদ দিলে চিন্তা-চেতনায় সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে অনগ্রসর এই অঞ্চলের মানুষ তেলের ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করে; গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য বোঝে না। এক পা-ওয়ালা মানুষের দেশ থেকে কেউ একজন দুই পা-ওয়ালার দেশে এসে বিস্মিত হল। আরে লোকটাকে ধরছে না কেন কেউ, পড়ে যাবে তো! মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদেরও হয়তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসে এমন উপলব্ধিই হয়। তবে এদের কোনো আক্ষেপ নেই; উইপোকা ঢিবিতে যে পরম শান্তিতে ঘুমায়, এদের ঘুমও তেমন নিশ্চিন্ত।
হ্যাঁ, প্রথমেই স্বীকার করে নিই, গণতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা; এরপর যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল যখন, তখন আমাদের অনেকেই চেঁচামেচি করেছি, কিন্তু সংশোধনীটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু ছিল না। তবে থিওরিটিক্যালি সেটা শুদ্ধ হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্র্যাকটিক্যালি তা ছিল সংশয়মূলক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখলাম, সংশোধনীটি আসলেই ছিল উদ্দেশ্যমূলক। এককথায় বললে, পঞ্চদশ সংশোধনী নিজে খারাপ না হলেও সঙ্গদোষে খারাপ প্রমাণিত হয়েছে। এই সঙ্গ হল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রমাণ করতে পারেনি যে, পঞ্চদশ সংশোধনী আনার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেনি। আমরা খুঁত ধরা ননদ নই, তাই বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যে-কোনো প্রকারেই হোক, ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল।
এখন তাহলে কী করা? ফ্রেশ নির্বাচনের দাবিটি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু প্রশ্ন, সেই নির্বাচন কি আত্মাহুতির? পরিচিত এক ঘোর-বিএনপি একদিন বললেন, শেখ মুজিব ও অনুপ চেটিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অথচ চেটিয়া জেলে আর মুজিব জাতির পিতা। জীবনে বড়জোর পাঁচবার মেজাজ খারাপ হয়েছিল এত। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে তাকে বলেছিলাম- আওয়ামী লীগকে আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় রাখব, পারলে ঠেকায়েন। আমাদের চোখের সামনে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধপরায়ণতার এক ছবি ঝুলে আছে, যে ছবি রূপ নিতে পারে গৃহযুদ্ধের ছবিতে; আমরা কি এত সহজেই বলে দিতে পারি- বর্তমান স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাক? বিএনপির শরীরে জমা হয়েছে বিপজ্জনক মেদ, ক্লেদও। হাঁটতে হবে তাকে প্রচুর, ঘাম ঝরিয়ে দূর করতে হবে সব মেদ ও ক্লেদ। সারাতে হবে উদরাময় রোগও। এরপর নামতে হবে মাঠে। আমাদের স্পষ্ট কথা, ফ্রেশ নির্বাচন আমাদের জন্য দার্শনিক চাপ সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এটা কোনো দায় নয়। আমরা প্রশ্ন করতেই পারি- বিএনপি নির্বাচন চাচ্ছে, নাকি চাচ্ছে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ?
আমরা আগেই প্রমাণ করেছি, নির্বাচন হল উপায়, লক্ষ্য নয়। সেই লক্ষ্যটা কী, বিএনপিকে তার একটা ছবি এঁকে দেখাতে হবে আমাদের। সেটা পিকাসো কিংবা দ্য ভিঞ্চির আঁকা ছবির মতো সুন্দর হতে হবে, এমন কথা নেই। ছবিটা এখনকার দৃশ্যপটের চেয়ে ভালো হলেই চলবে।
অতঃপর বিএনপি হাঁটতে থাকুক। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? বিএনপির হাঁটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে সুশাসন। এটা কঠিন কিছু নয়। বিএনপির মিছিলের দিকে না পাঠিয়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে পাঠালেই কিছু না কিছু সুশাসন হয়। দ্বিতীয় কথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত করছেন কেন, অপরাধের সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা নিতে পারেন না?
আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। এক মদ্যপ বলেছিল- আমি তো প্রতিদিন মদ খাই না; যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন খাই আর যেদিন বৃষ্টি হয় না সেদিন। এই উপমায়, আমরাও সব সময় খারাপ থাকি না; দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে তখন খারাপ থাকি আর যখন গণতন্ত্র থাকে না তখন। আমরা এটা বুঝে গেছি, কেউ আমাদের ভালো রাখতে পারবে না। একমাত্র জনগণের সম্মিলিত শক্তি যদি পারে কিছু করতে। মুশকিল হল, তারা জানে না যে, তারা কত শক্তি ধারণ করে; ব্যাঙ যেমন জানে না তার একটি বায়োলজিক্যাল নাম আছে (bufo melanostictus)। যেদিন তারা জেনে যাবে এই রহস্য, সেদিন নাটকের গ্রিন রুম থেকে উঠে আসবে হয়তো তারা মূল স্টেজে। প্রম্পটারেরও দরকার হবে না তখন তাদের। মুখস্থ বলে যাবে সংলাপ।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
No comments