একজন পুষ্প রানী by মো. আমির হোসেন
হানাদারদের হিংস্র থাবা ল-ভ- করে দেয় পুষ্প রানীর সংসার। ওই দিন বাড়ির অন্যদের বেঁধে আগুন দিয়ে ৯ জনকে জীবন্ত দগ্ধ করে হায়েনারা। এতেও শান্ত হয়নি তারা। নিয়ে যায় পুষ্প ও তার জা মালতিকে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আহমদাবাদ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গোছাপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী রাখাল চন্দ্র শুল্ক বৈদ্যের স্ত্রী পুষ্প রানী শুল্ক বৈদ্য ২ সন্তান নিয়ে ভালই দিন কাটাচ্ছিলেন। তাছাড়া রাখালের পরিবারের ছিল এলাকায় বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে ভারত ছুটছিল। তখন রাখাল চন্দ্রের মা সুখমীয় শুল্ক বৈদ্য বাদ সাধেন। তিনি বলেন, মরতে হলে নিজের ভূমিতেই প্রাণ দেবো। যে কারণে এ পরিবারের কারোর ভারতে যাওয়া হয়নি। জ্যৈষ্ঠ মাসের ১২ তারিখ। গভীর রাতে হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে হানা দেয়। রাখালের ভাই অক্ষয় চন্দ্র শুক্ল বৈদ্য ঘুম থেকে উঠেছিলেন গোয়ালঘরে গরু-বাছুরদের খাবার দিতে। বাড়ির আঙিনায় অবস্থান করা হানাদারদের হাতে আটক হন তিনি। এরপর ঘরের দরজা ভেঙে রাখাল চন্দ্রকে টেনেহিঁচড়ে বের করে পাক আর্মিরা। তাদেরকে বেঁধে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো দুটি জিপের পাশে নিয়ে যায়। জিপের রডের সঙ্গে বেঁধে গাড়ি চালিয়ে পার্শ্ববর্তী পাল বাড়ির সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে অক্ষয় চন্দ্র শুক্ল বৈদ্য ও যতীন্দ্র রাম শুক্ল বৈদ্যকে হত্যা করে। গুলির শব্দ শুনে বাড়ি থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় অক্ষয় চন্দ্রের বড় ছেলে টেনু শুক্ল বৈদ্য (১৬)। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদাররা। একই সময়ে পাক আর্মি হত্যা করে পালবাড়ির বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্র পাল ও একজন পুরোহিতকে। এরপর তাদেরকে খড়ের গাদার সঙ্গে বেঁধে আগুন দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই আগুনে পুড়িয়ে অঙ্গার করে তাদেরকে। এরপর পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী মীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া পরিবারের অন্য সদস্যদের আটক করে সুখদেবপুরে নিয়ে যায়। ওই গ্রামে পাকবাহিনীর অনুসারী রশিদ মিয়ার বাড়িতে সবাইকে জিম্মায় রাখে। শঙ্কা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং শোকে মুহ্যমান থাকলেও অন্যদের সঙ্গে রশীদ মিয়ার বাড়িতে তাদের দুর্বিষহ দুটি দিন কেটে যায়। তৃতীয় দিন দুপুরে একটি জিপে করে চার পাকসেনা আসে রশিদ মিয়ার বাড়িতে। তারা আটককৃতদের মধ্যে পুষ্প ও মালতি ছাড়া অন্য সবাইকে উঠানে এনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ সময় পুষ্প ও মালতিকে দুর্গাপুর এলাকার একটি বাড়িতে নিয়ে রাখে। ওই সময়ের পুষ্প রানীর বয়স ছিল বিশ বছর। সুন্দরী পুষ্প রানী ও মালতিকে দেখে পাক হানাদারদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এবং তাদের শরীর নিয়ে উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। প্রথম দিন চারজন পাকসেনা লালসা মেটায়। এদেশীয় দোসররাও নির্যাতনে শামিল হয়। দীর্ঘদিন দুর্গাপুরে নির্যাতিত হন তারা। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করলেও মুক্তি মেলেনি তাদের। দীর্ঘ ৬ মাস পাকসেনাদরে বন্দিশালায় আটকে রাখা হয় দু’জনকে। এ সময় প্রতিদিনই পাকসেনারা পর্যায়ক্রমে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতো। দীর্ঘ সময় বন্দি থাকার পর ডিসেম্বরে দেশ শত্রুমুক্ত হলে মুক্তি পান দুই জা। মুক্তি পেয়ে দু’জনই চলে যান বাপের বাড়িতে। সেখান থেকে ফিরে আসেন স্বামীর ভিটায়। এদিকে বাড়ির অন্য ৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেলেও রাখাল বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা জানা যায়নি আজও। পুষ্প রানী মুক্তিযুদ্ধের পর একযুগ স্বামীর জন্য সিথিতে সিঁদুর পরেছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কোন স্বামী যদি ১২ বছর নিরুদ্দেশ থাকেন তাহলে তাকে মৃত বলেই ধরে নেয়া হয়। রাখাল শুক্ল বৈদ্যকেও সনাতনী বিধান অনুযায়ী মৃত বলে ধরে নেয়া হলো। ১৯৮৫ সালে রাখাল শুক্ল বৈদ্যের ছেলেরা বড় হলে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বেদনা ভুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন পুষ্প রানী। তার দুই ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। দুই ছেলেকেই বিয়ে করিয়েছেন। বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং স্বামীর প্রাপ্ত সম্পত্তি সব মিলিয়ে বেশ ভালভাবেই দিন কাটছে তার। এ ব্যাপারে পুষ্প রানীর সঙ্গে কথা বললে তিনি সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। দিনের পর দিন তাদের আটতে রেখে হায়েনার দল কিভাবে পাশবিক অত্যাচার চালায় তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমরা কোনদিন স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্য দেখতে পারবো তা ভাবতে পারিনি। পুষ্প রানী বলেন, পাকসেনাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর গ্রামের মানুষ ও স্বজনরা আমাদেরকে ভাল চোখে দেখতো না। মনে হয়েছিল কেন ওই সময় আমাদের মৃত্যু হলো না। পুষ্প বলেন, বর্তমান সরকার আমাদেরকে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্মীকৃতি দেয়ায় আমরা গর্ববোধ করছি। আবারও আমাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছি। পুষ্প রানী বলেন, হবিগঞ্জের মহিলা সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর মাধ্যমে এই স্মীকৃতি পাওয়ায় আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
No comments